#প্রাণ_ভোমরা
#রোকসানা_রাহমান
পর্ব (১৬)
“ভালোবাসার শীর্ষ উপাধি হলো ‘বেহায়া’। সেটা যতদিন না অর্জন করতে পারবে ততদিন ভাববে তুমি ভালোবাসতে শিখনি।”
এর বিপরীতে ছেলের মুখ থেকে কিছু শুনতে প্রস্তুত নন লোকমান সাহেব। তাই দ্রুত বললেন,
“কী হলো কলটা দে। আজ রাতের মধ্যেই বউমাকে এই বাড়িতে দেখতে চাই।”
শ্রাবণ ফোন হাতে নেয়। ডায়াল লিস্টে ঢুকে আচমকা বলল,
“না,বাবা৷ আমি বেহায়া হতে চাই না। হয়ে কী লাভ? রিধি এসবের দাম দিবে না। ও আমাকে পাত্তা দেই না,গর্জে নেয় না। আমার দিকে তাকায় না,আগ বাড়িয়ে দুটো কথা বলে না পর্যন্ত। তাহলে ভালোবাসার বুঝবে কী? বুঝার চেষ্টাটাও কখনো করবে না। তার থেকে ভালো..”
শ্রাবণের কথা শেষ হওয়ার পূর্বেই লোকমান সাহেব তার উরুতে আলতো করে ছুঁলেন। আশ্বস্ততার ছোঁয়া! তারপর ধীরে বললেন,
“ভালোবাসা কোনো সম্পত্তি নয় যে তুমি হিসেব-নিকেষ করে মূল্য-অমূল্য বের করবে। আর রিধি শুধু তোমার ভালোবাসা নয়, স্ত্রী। তোমরা একটি দীর্ঘায়ত সম্পর্কের ডোরে বাধা পড়েছো। যেটাকে তোমরা নিছকই ভুল সিদ্ধান্তে গড়িয়ে নিতে চাচ্ছো। যা একদমই উচিৎ নয়। বিয়ে কোনো ছেলেখেলা নয়। স্বয়ং আল্লাহর তরফ থেকে রহমত,অমূল্য বন্ধন”
শ্রাবণ বিপরীতে কিছু বলে না। চুপ করে থাকে। নীরব দৃষ্টিপাত বাবার মুখের দিকে। লোকমান সাহেব হাতের ছোঁয়া আরেকটু গাঢ় করলেন। চোখের পাতা ফেলে আশ্বাস দিয়ে,ফোনের দিকে ইশারা করলেন।
শ্রাবণ সাথে সাথে কল দিল না। সেকেন্ড কয়েক রিধির নাম্বারটার দিকে চেয়ে থাকল। না,তার কাছে রিধির নাম্বার ছিল না। সেই তিন বছর আগের বার্তা পাঠানোর ফলেই নাম্বারটা পেয়েছে। সেভ করেনি। মুছেও দেয়নি। যেভাবে এসেছিল সেভাবেই পড়ে আছে। শ্রাবণ আরেকবার বাবার দিকে তাকিয়ে কলটা দিয়েই ফেলল। ফোন কানে ধরে রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষার প্রহর গুণতে শুরু করে। সেকেন্ড দুয়েক পার হতেই শ্রাবণ ফোন বিছানায় ছুড়ে মারে। আরক্ত চোখে বাবার দিকে তাকিয়ে বলল,
“বলেছিলাম না? এই মেয়ে আমাকে বুঝবে না। আমার ভালোবাসার মূল্য দিবে না? এবার প্রমাণ হলো তো,বাবা?”
ছেলের কথায় লোকমান সাহেব বাকরুদ্ধ। চোখদুটো বড় করে শ্রাবণের দিকে তাকিয়ে থাকেন কিছুক্ষণ। অতঃপর অস্থির হয়ে বললেন,
“কী হয়েছে? রিধি কল ধরেনি?”
শ্রাবণ বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেল। দরজার দিকে পা ফেলে কঠিনস্বরে বলল,
“ধরবে কী? ফোন বন্ধ করে রেখেছে। ঠিক বুঝে গেছে,আমি এখন কল দিব। জ্বালাব,কানের কাছে ঘ্যান ঘ্যান করব। হাত পাতব,পা ধরব,ভিক্ষে চেয়ে চলব,’রিধি এসো আমরা সংসার করি।”
শেষ কথাটা বড়ই বিদ্রুপ শোনায়। লোকমান সাহেব ছেলের পিছু ছুটে বললেন,
“এত রেগে যাচ্ছিস কেন? অন্য কারণেও বন্ধ থাকতে পারে। হয় তো চার্জ নেই,আবার কারেন্টও নেই।”
শ্রাবণ দরজা ছেড়ে বেরিয়ে চেঁচিয়ে বলল,
“সব আছে,বাবা। তুমি ওকে চিনো না। ছলনাময়ী একটা। স্বার্থপর!”
শ্রাবণ বাবার চোখের আড়ালে চলে আসে। হঠাৎ রাগটা তাকে ভীষণভাবে গ্রাস করে ফেলেছে। কিছুতেই নিজেকে নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছে না। অথচ এমন বেতাল রাগ আগে কখনও চোখে পড়েনি। শ্রাবণ রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে গেটের ধারে চলে আসে। কোণায় স্থির থাকা বড় ড্রামটিতে সজোরে লাথি মারে। আবর্জনা ছড়িয়ে পড়ে এদিকসেদিক! শ্রাবণ শূন্যে তাকিয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ে,
“কী প্রয়োজন ছিল,বাবার কাছে বিয়ের কথাটা বলার? সয়ে নেওয়া ব্যথাটা অসহণীয় না করলেই নয়? আপনি মানুষটা খুব খারাপ রিধি।”
_______________________________________
মাগরিবের নামাজ শেষ করেই হৃদ্যের রুমে হাজির হলেন শায়লা হক। কাল শেষ রাতে দেখা হয়েছিল দুজনের। সারাদিন আর হয়নি। হৃদ্য রুম থেকে বের হয়নি। শায়লা হকও ডাকতে আসেননি। ঘুমানোর সুযোগ দিয়েছিলেন। রাতের ঘুমটা দিনেই পূর্ণ হোক। হৃদ্যও বেশ আরাম করেই ঘুমাল সারাবেলা। আড়মোড়া ভেঙে,ক্লান্ত হয়ে উঠেছে বিকেল পাঁচটায়। ঘুম থেকে উঠেই সে ভাবনায় হারিয়ে গেল। চিন্তাশক্তির ব্যবহার চলছে প্রবলভাবে। ভাবতে ভাবতে তার জীবন থেকে আরো এক ঘন্টা চলে গেল। সেই সময় শায়লা হক বললেন,
“এত মন দিয়ে কী ভাবছিস?”
হৃদ্য খানিকটা চমকাল। মায়ের দিকে এক পলক তাকিয়ে আবারও ভাবনায় ডুব দিল। শায়লা হক ছেলের পাশে বসলেন। মুখের দিকে তাকিয়ে আফসোস করে বললেন,
“ভেবেছিলাম নার্সারি দিয়ে তোর একটা গতি হবে। এখন দেখছি সেটাও বাতিল। লেখাপড়া ছেড়ে দিনরাত যে নার্সারিতে পড়ে থাকতি,এখন সেটাও করছিস না। ব্যাপার কী? বন্ধ করে দেওয়ার কথা ভাবছিস?”
হৃদ্য মায়ের কথা শুনল কী শুনল না বুঝা যাচ্ছে না। সে এখনও ভাবুকমনে আছে। শায়লা হক বিরতি নিয়ে আবার বললেন,
“ঐটুকু জমি কিনতে তোর বাবার কম খাটুনি করতে হয়নি। কত জায়গায় দৌড়াল। তুই তো জমি দেখিয়ে কিনে দাও বলেই সাড়া। কী করে কিনল একটাবার জানার চেষ্টাও করলি না৷ মানুষটাকে আর কত খাটাবি? আর কত উদাসীন থাকবি? একটু সজাগ হ বাপ।”
হৃদ্য তৎক্ষনাৎ সজাগ হলো। মায়ের দিকে মুখ এগিয়ে নিয়ে এসে বলল,
“আজ আবার স্বপ্ন দেখলাম,আম্মু। আগের মতো না,একদম অন্যরকম। বাস্তব-অবাস্তবের মিশেল। আমি তো এখনও সেই ঘোর কাটিয়ে উঠতে পারছি না। ভাবলাম একজনকে হয়ে গেল আরেকজন। কী আশ্চর্য!”
ছেলের এমন অদ্ভুত বচনপ্রপঞ্চে খানিকটা বিরক্তের আভাস ফুটল শায়লা হকের বদনে। সচরাচর ছেলেমেয়ের উপর বিরক্ত হন না তিনি। হৃদ্যকে যেন একটু বেশিই আগলে রাখেন। একটু বেশিই মিশতে পছন্দ করেন। এতকাল তো তাই করে এসেছেন। কিন্তু আজ পারছেন না। স্বামীর অপ্রকাশিত কষ্টটা তিনি উপলব্ধি করতে পারেন৷ সেইসাথে সূদূর ভবিষ্যৎ নিয়েও ভীষণ চিন্তায় পড়েন। কী হবে তার ছেলের ভবিষ্যৎ? কেমন হবে মেয়েটার সংসার জীবন? মাঝেই মাঝেই অস্পষ্টভাবে কানে কথা আসে রিধিকে নিয়ে। অনেকেই সন্দেহের জোরে খারাপ কথাও জুড়ে দেন।
হৃদ্য উৎসাহ নিয়ে আবার বলল,
“এমন স্বপ্ন আমি আজ অবধি দেখিনি,আম্মু। পুষ্পরানির জায়গায় ফুলপরী হাজির। যার মুখটা আমি চিনি। খুব ভালো করেই চিনি। তারমধ্যে…”
হৃদ্যের কথা শেষ হওয়ার আগেই শায়লা হক উঠে পড়লেন। বেরোতে বেরোতে বললেন,
“পেট,পিঠের সাথে লেগে গেছে। ফ্রেশ হয়ে আয়। আমি খাবার বাড়ছি।”
হৃদ্য থামল না। কথাটা শেষ করেই ছাড়ল। কিন্তু শায়লা হকের কান অবধি পৌঁছায়নি। সে ভেবেই কুল পাচ্ছে না,খাবে কখন? হৃদ্য আশ্চর্য সুরে উচ্চারণ করল,’ভ্রমর ফুলপরী?’ প্রশ্নটা করে আরো আশ্চর্য বোধ করল। মুখে ফুটে উঠল নানা রকম ভঙ্গি। ভ্রমর বাসায় এসেছিল? তার রুমে? তার বাগানেও? অসম্ভব! হৃদ্য কিছুতেই বিশ্বাস করতে চায় না। তার ঠিক মনে আছে,বাসায় ফিরতে তিনটা পার হয়েছিল। মানে রাতের একদম শেষ প্রহর। সেই সময় ভ্রমর তার বাড়িতে কী করে আসবে? মাকেই বা কী বলে আসবে? যে মেয়ে দিনের একটু সময় বাইরে থাকলে ছটফট করে,বাক্যের ইতি টানে আম্মা বলে। সেই মেয়ে অত রাতে তার ঘরে ফুলপরী সেজেছে? অকল্পনীয়! হৃদ্য বসা থেকে আবার শুয়ে পড়ে। নিজেই নিজেকে স্বান্তনা দিয়ে বলে,’আমি স্বপ্ন দেখেছি। হ্যাঁ,আমি স্বপ্ন দেখেছি। ভ্রমর আমার এত কাছে আসতে পারে না। সাহস নেই।’ হৃদ্য চুপ থাকে। তারপর আবার নিজেকে প্রশ্ন করে,’ কার সাহস নেই? ভ্রমরের নাকি হৃদ্যের?’
হৃদ্য শোয়া থেকে উঠে পড়ে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে খুটে খুটে দেখে অনেক্ষণ। চোখের অস্থিরতাকে শান্ত করতে চোখ বন্ধ করে। কিন্তু শান্ত হয় না। আরো চঞ্চল হয়ে পড়ে,অস্থিরে মরে! এ সে কাকে দেখছে? হৃদ্য চোখ বন্ধ করেই আপনমনে উচ্চারণ করে,’ভ্রমর বড় হয়ে গিয়েছে,অনেক বড়। পুচকি,তুই ভুল বলেছিস। ছোটপরী নয়,তুই অনেক বড় পরী। যতটা বড় হলে কারো হৃদয়ে ঝড় তোলা যায়। লণ্ডভণ্ড করা যায় জাগতিক সব ইচ্ছের!’
______________________________________
হৃদ্য খাবার টেবিলে হাজির হলো রাত নয়টায়। গোসল করেছে। মাথার চুল থেকে পানি পড়ছে এখনও। গায়ের পাতলা গেঞ্জিটার অনেকাংশই ভেজা। শায়লা হকের নজরে আসতে তিনি ধমকে উঠলেন,
“রাতেরবেলা গোসল করেছিস অথচ মাথাটা মুছলি না। ঠান্ডা লাগলে?”
প্রতিত্তোরে হৃদ্য হালকা হাসল। শায়লা হক নিজের আঁচল দিয়ে মাথা মুছে দিলেন। তারপর খালি প্লেটে ভাত বেড়ে দিলেন। হৃদ্য ভাত মেখে মুখে তুলবে,অমনি নাকে অন্যকিছুর ঘ্রাণ বাড়ি দিয়ে গেল। অমন অবস্থায় সোজা তাকাল রান্নাঘরে। সাথে সাথে চোখ ছানাবড়। বিস্মিত স্বরে উচ্চারণ করল,ভ্রমর!
পাশ থেকে বাবা তাগিদ দিয়ে বললেন,
“খাবার রেখে অন্যদিকে কী দেখছিস? ভাত খা।”
হৃদ্য বাবার কথা কানে মাখাল না। সে চেয়ে আছে রান্নাঘরে ভ্রমরের মতো দেখতে মেয়েটির দিকে। মাথায় সাদা ঘোমটা টানা। বাম দিকে হালকা বাঁকা হয়ে ছাকনি দিয়ে চা ছাকছে। সেই সুবাধে মুখের অর্ধেক ভাগ দেখা যাচ্ছে। হৃদ্যের মনে সন্দেহ জাগল। ভ্রমর তো এমন মাথায় ঘোমটা টানে না। তাহলে এই মেয়েটিকে কে? ভ্রমরের মতো দেখতে অন্য কেউ? হৃদ্য দ্বিধায় পড়ে। দ্বিধা কাটাতে সন্দিগ্ধ কণ্ঠে রিধিকে জিজ্ঞেস করল,
“আপু,রান্নাঘরে কি কিছু দেখতে পাচ্ছিস?”
রিধি লবণ নিচ্ছিল। লবণ হাতে নিয়েই রান্নাঘরে তাকাল। বলল,
“কিছু বলতে কী?”
“একটা মেয়ে,মাথায় সাদা ওড়না,হাতে চা-ছাকনি।”
রিধি ভ্রূ কুঁচকে ভাইয়ের দিকে তাকাল। হঠাৎ কী ভেবে মিটিমিটি হাসল। ঠাট্টা করে বলল,
“না। আমি কাউকে দেখতে পাচ্ছি না। রান্নাঘর তো শূন্য!”
#প্রাণ_ভোমরা
#রোকসানা_রাহমান
পর্ব (১৭)
“আপু,রান্নাঘরে কি কিছু দেখতে পাচ্ছিস?”
রিধি লবণ নিচ্ছিল। লবণ হাতে নিয়েই রান্নাঘরে তাকাল। বলল,
“কিছু বলতে কী?”
“একটা মেয়ে,মাথায় সাদা ওড়না,হাতে চা-ছাকনি।”
রিধি ভ্রূ কুঁচকে ভাইয়ের দিকে তাকাল। হঠাৎ কী ভেবে মিটিমিটি হাসল। ঠাট্টা করে বলল,
“না। আমি কাউকে দেখতে পাচ্ছি না। রান্নাঘর তো শূন্য!”
হৃদ্য ফ্যালফ্যাল নয়নে রিধির দিকে তাকিয়ে থাকে অল্পক্ষণ। তারপর ক্ষীণ আশা নিয়ে বলল,
“ভালো করে দেখ।”
রিধি ভাইয়ের করুণ অনুরোধে বেশ মজা পাচ্ছে। ভেতরে ভেতরে হেসে ফেটে পড়লেও সামনাসামনি কপট রাগ নিয়ে বলল,
“তোর কি আমাকে অন্ধ মনে হয়? আস্ত একটা মেয়ে মানুষকে চোখে পড়বে না? নাকি তোর দেখা মেয়েটা পিঁপড়ে সাইজ? সেক্ষেত্রে চোখে অণুবীক্ষণ যন্ত্র লাগানো যেতে পারে।”
হৃদ্য আর কিছু বলল না। মাথা ঘুরিয়ে আরেকবার রান্নাঘরের দিকে তাকাল। আপু দেখতে পারছে না তাহলে সে কেন দেখবে? চোখের ভুল হয় তো! ভুল শুধরাতে দৃষ্টি পুনরায় রান্নাঘরে ঠেকাল। সাথে সাথে হৃদ্য থমকে গেল। নিশ্বাস আটকে সাদা ওড়নায় মুড়িত মেয়েটির দিকে তাকিয়ে থাকে। মেয়েটি চা হাতে এদিকেই আসছে। হাঁটার গতি মন্থর। কিঞ্চিত হেলেদুলে হাঁটছে। হঠাৎ পথিমধ্যেই দাঁড়িয়ে পড়ে। হৃদ্যের মা শায়লা হকের সাথে বাম হাত নাড়িয়ে কিছু বলছে। হৃদ্যের চোখ ধীরে ধীরে বড় হতে থাকে। মনে মনে বলে,’আম্মুও কি মেয়েটাকে দেখতে পাচ্ছে?’ মেয়েটি কথা বলা শেষ করে হৃদ্যের পাশে এসে দাঁড়াল। ঠোঁটে হালকা হাসি। চোখে দারুন মায়া! সেই মায়ায় হৃদ্যের ডুবি ডুবি অবস্থা। প্রায় ডুবেই যাচ্ছিল। বাবা বাঁচিয়ে দিলেন। ধমকে উঠে বললেন,
“কখন থেকে ভাত মেখে বসে আছিস। খাচ্ছিস না কেন?”
হৃদ্য চমকে ওঠে। ভীতস্বরে বলল,
“খাচ্ছি,আব্বু।”
হৃদ্য সব ভুলে চটপট ভাত মুখে দেয়। মাখা ভাত,আমাখা ভাত বিরতিহীন মুখে ঢুকাতে থাকে। ফলে ভাতের দানা গলায় ঠেকে। হিঁচকি ওঠে। পানির জন্য হাত বাড়াতে গিয়ে আবার চমকে যায়। পানির গ্লাসের পাশেই চায়ের কাপ। ভালোবাসায় বানানো সুঘ্রাণ,সুস্বাদের আলু-চা। হৃদ্যের হিঁচকি থেমে যায়। ভাতের দানা গলাতে বসে থাকে। চা থেকে উড়ে চলা ধোঁয়ার দিকে তাকিয়ে হৃদ্য ক্ষীণস্বরে বলল,
“আপু,তুই কি এখানে চা,চায়ের কাঁপ,গরম ধোঁয়া দেখতে পাচ্ছিস?”
রিধি ভাত চিবুচ্ছিল। সেভাবেই চায়ের দিকে তাকাল। তারপর নির্বিকারে বলল,
“না।”
হৃদ্য সঙ্গে সঙ্গে রিধির দিকে তাকায়। চোখদুটো বড় বড় করে জিজ্ঞেস করল,
“ভালো করে দেখ তো আমার চোখে ছানি পড়েছে নাকি, বা অন্য কিছু!”
রিধি মুখের ভাত গিলে নেয়। তারপর অভিজ্ঞ ডাক্তারের চরিত্রে ঢুকে পড়ে। এঁটো হাতে হৃদ্যের চোখ পরখ করে বলল,
“ঠিক বুঝতে পারছি না। যন্ত্র চালাতে হবে মনে হয়।”
হৃদ্য রিধির হাত সরিয়ে দেয়। ভ্রূ উঁচিয়ে কড়া চাহনি ফেলে আপুর উপর। তারপর হাত ধুয়ে খাবার টেবিল ছাড়ে। রুমে যাওয়ার পূর্বে আম্মুর কাছে এসে ফিসফিসিয়ে বলল,
“আম্মু,তুমি ঐ মেয়েটির সাথে কী কথা বলছিলে?”
শায়লা হক ছেলের প্রশ্নের জবাব দিতে গেলে চোখ পড়ে সামনে। রিধি হৃদ্যের পেছনে দাঁড়িয়ে হাতের ইশারায় না না বুঝাচ্ছে। শায়লা হক খানিক ভেবে বললেন,
“কোন মেয়ে?”
হৃদ্য ভ্রমরকে খুঁজল। কোথাও নেই। টেবিলের উপর চায়ের কাঁপটা পর্যন্ত নেই। সে ধপ করে নিশ্বাস ফেলে বলল,
“কিছু না,আম্মু।”
নিজেই নিজেকে ধমকাতে ধমকাতে রুমে চলে যায় হৃদ্য। সোজা বিছানায় বসে পড়ে। মনে মনে ভ্রমরকে কয়েকশো বোকা দেয়। এই মেয়ের জন্যই সব! ধমকাধমকির পর্ব শেষ করে বালিশে মাথা ঠেকায়। ডান দিকে কাত হয়ে শোয়। সাথে সাথে চোখদুটো বিস্ফোরক! ভ্রমরের মতো দেখতে মেয়েটি তার খাটের কিনারে বসে আছে। পা দুলাচ্ছে আর চুল নিয়ে খেলছে। গুনগুনিয়ে গানও গাচ্ছে। হৃদ্য হুড়মুড়িয়ে উঠে বসল। দেয়ালে সাথে ঘেষে ভীত নিশ্বাস ফেলছে। ভ্রমর না দেখেও বুঝি সব দেখতে পারছে। গুনগুন থামিয়ে বলল,
“চা ঠান্ডা হয়ে গিয়েছে। মানুষছেলে জলদি খাও। আমার তাড়া আছে। আকাশে উড়ব। আমার সখীরা এখনই ডাকতে আসবে।”
হৃদ্য মাথা দেয়ালের সাথে ঠেকায়। স্থির অবস্থায় শুধু মনিটা নাড়িয়ে পাশে তাকাল। খাটের কাছের টেবিলেই চায়ের কাঁপ রাখা। সেই আগের মতো গরম ধোঁয়া উড়ছে। হৃদ্য শুকনো ঢোক গিলল। নিভুস্বরে বলল,
“হুম।”
ভ্রমর ঠোঁট টিপে হাসল খানিক্ষণ। হাসতে হাসতে হৃদ্যের রুম থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে। হৃদ্য চায়ে চুমুক দিল। দ্বিতীয় চুমুক দেওয়ার পূর্বে ধীরে ডাকল,
“ভ্রমর?”
ভ্রমর থামল না। পিছুও ফিরল না। আগের ন্যায় চলছে যেন কিছু শুনতেই পায়নি। হৃদ্য এবার গলায় জোর এনে ডাকল,
“ভ্রমর?”
এবারও ভ্রমরের দিক থেকে কোনো সাড়া পাওয়া গেল না। হৃদ্য কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল। ভ্রমর ততক্ষণে দরজার কাছে চলে গিয়েছে। ঠিক সেসময় হৃদ্য সন্দিগ্ধে ডাকল,
“ফুলপরি?”
ভ্রমর থমকাল। ঘাড় বাকিয়ে মিষ্টি করে সুধাল,
“কিছু বলবে মানুষছেলে?”
হৃদ্য সাথে সাথে ডান হাতটা বুকের বা পাশে সজোরে চেপে ধরল যেন এখনি হার্টফ্যাল করবে! সেই অবস্থায় কোনোমতে মাথাটা দুদিকে নাড়ল। ভ্রমরও নীরবে দরজার আড়ালে চলে গেল। তারপরই দুটো নারীর খিলখিল হাসির শব্দ ভেসে এলো। হৃদ্য স্বাভাবিক অবস্থায় থাকলে ঠিক বুঝতে পারতো কারা হাসছে।
_____________________________________________
কিছু প্রয়োজনীয় সনদপত্র নিয়ে ইউনিভার্সিটিতে গিয়েছিল রিধি। বিভাগীয় প্রধানের সাইন নিতে। সেখান থেকে ফিরতে ফিরতে প্রায় সন্ধ্যা। বিকেলের নরম আলো আঁধারে মিশে গিয়েছে। প্রকৃতি ঢাকা পড়েছে ঝাপসা অন্ধকারে। সেই অন্ধকারের ফাঁকে রিধির চোখ আটকাল একটি ছেলের উপর। অল্প বয়স। গাঢ় নীল রঙের পোলো-শার্ট গায়ে ছেলেটির চলনে সাহেবি ভাব। চোখদুটি ব্যস্ত কারো অনুসন্ধানে। সেই ফাঁকে ঘন ঘন হাত দিয়ে চুল পেছনে ঠেলে দিচ্ছে। রিধি রিকশা থামাল। বিস্মিতস্বরে ডাকল,
“শরৎ?”
শরৎ চমকে তাকায় পেছনে। রিকশার দিকে চোখ পড়তে দৌড়ে আসে। সোজা রিকশায় চড়ে বসে। একপাশ থেকে রিধিকে জড়িয়ে ধরে কেঁদেই দিল। ভেজা গলায় শুধু কয়েকবার বলল,
“ভাবি, আমার ভাবি!”
শরৎের পরম আদুরী ছোঁয়া ও ভালোবাসার ডাকটি রিধিকে কাঁপিয়ে দিল। শিরদাঁড়া বেয়ে বিদ্যুৎ বয়ে গেল। বেশ সময় পর নিজেকে স্বাভাবিক করে বলল,
“কী হয়েছে,শরৎ? এভাবে বাচ্চাদের মতো কাঁদছো কেন?”
শরৎ উত্তর দিতে চেয়েও পারে না। আবার কেঁদে ওঠে। চোখ ফেটে উষ্ণ জল গড়িয়ে পড়ে। রিধির কাঁধ ভিজে যায়। ইস্ত্রী করা জামাটি কুঁচকে যায়। রিধি আর কিছু জিজ্ঞেস করে না। শরৎের পিঠে হাত বুলিয়ে দেয়। মমতাভরে বলল,
“হয়েছে। আমার লক্ষীভাই,আর কাঁদে না।”
এভাবে কেটে যায় অনেকটা সময়৷ শরৎ কান্না থামায়। চোখ মুছে আহ্লাদী সুরে বলল,
“বাসায় চলো,ভাবি।”
রিধি চকিত কণ্ঠে বলল,
“কোন বাসায়?”
“আমাদের বাসায়। এখন তো তোমার রাগ পড়ে গেছে।”
“রাগ?”
“হুম। বড় ভাইয়া বলেছে,’তুমি নাকি আমার উপর রাগ করেছো,তাই না বলে চলে গেছো।”
রিধি সন্দিগ্ধ স্বরে বলল,
“তোমার ভাইয়া এটা বলেছে?”
“হুম। সেজন্যই তো আমি নিজে রাগ ভাঙাতে আসলাম।”
রিধি সামান্য হাসল। শরৎের গাল ছুঁয়ে আদর করে বলল,
“সাথে কে এসেছে?”
“কেউ না।”
রিধি আঁতকে উঠে বলল,
“তুমি একা এসেছো?”
শরৎ খানিকটা ভাব নিয়ে বলল,
“হুম। বড় হয়েছি না? একা একা চলতে শিখছি। ভাইয়াকে অবশ্য বলেছিলাম আসতে। আসল না। শুধু ঠিকানা ধরিয়ে দিল।”
রিধির মনে রাগ উদয় হল। মনে মনে শ্রাবণকে কিছু খারাপ বকা দিতে ব্যস্ত হয়ে যায়। সেই সময় শরৎ আবার বলল,
“এখন তাড়াতাড়ি চলো। ভাইয়াকে চমকে দিব। ভাইয়া বলেছে,আমি নাকি তোমার রাগ ভাঙাতে পারব না। এখন দেখবে,কেমন রাগ ভাঙিয়েছি।”
শরৎের তাড়া দেওয়াতে রিধির মন খারাপ হলো। সে কি ঐ বাড়িতে যেতে পারে? কেন যাবে? কোন টানে? কিন্তু শরৎ? কত আশা নিয়ে এসেছে! এতদূর থেকে একা একা চলে এসেছে,তাকে নিয়ে যাবে বলে। একদিনেই ছেলেটা তাকে এত ভালোবেসে ফেলল? এমন ভয়ানক ভালোবাসাটাকে কি এড়িয়ে যাওয়া যায়? রিধি ঘড়ি দেখে, ছয়টা বেজে পঞ্চাশ। রাত তো হয়েই এলো। শরৎকে একা ছাড়বে? ভাবতেই রিধির মনে ভয় জাগে। তাহলে কি নিজের বাসায় নিয়ে যাবে? ভাবতে ভাবতে সময় পেরিয়ে যায়। এদিকে শরৎ চঞ্চল হয়ে উঠেছে। বার বার তাড়া দিচ্ছে। রিধি বলল,
“চলো,আগে আমার বাসায় যায়।”
শরৎ রাজি হলো। রিধি রিকশার ভাড়া মিটিয়ে দেয়। গেইটের ভেতর পা রাখতে গিয়ে হঠাৎ বাবার কথা মনে পড়ে। সাথে এটাও মনে পড়ে,শ্রাবণ আর রিধির বিয়ের কথা এ বাড়ির কেউ জানে না। এদিকে শরৎ তো ভাবি ডাকতে ডাকতে মুখে ফ্যানা তুলে ফেলছে। বাসার কেউ যদি সন্দেহ করে? রিধি থমকে যায়,দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে। আচমকা বলল,
“শরৎ,চলো আগে তোমার ভাইকে দেখিয়ে আসি,তুমি কেমন রাগ ভাঙাতে পারো?”
“তোমার বাসায় যাব না?”
“যাবে,পরে। আগে তোমার বাসায় যাই?”
শরৎ সময় নিয়ে বলল,
“আচ্ছা।”
__________________________________________
আকাশ মেঘলা। যেকোনো সময় মেঘ গলে বৃষ্টি ঝরে পড়বে। সেদিকে কোনো হুঁশ নেই ভ্রমর আর হৃদ্যের। দুজনেই গভীর ভাবনায় মশগুল। তবে ভাবনাগুলো আলাদা। কেউ কারো দিকে তাকাচ্ছে না। নিজ নিজ বারান্দায় মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থাকা সত্ত্বেও দৃষ্টি জমাট বাঁধা অন্ধকারে। রাত নেমেছে অনেক্ষণ আগে। একটু পরেই খাবারের ডাক পড়বে।
দমকা হাওয়ায় ঝরা পাতা এসে পড়ে হৃদ্যের গালে। সঙ্গে সঙ্গে ভাবনার সুতো কাটা পড়ে। চোখ পড়ে ভ্রমরের দিকে। হৃদ্য ডাকতে গিয়েও থমকে গেল। দ্বিধায় পড়েছে। এটা কে? ভ্রমর নাকি ফুলপরি? দেখতে তো দুজনই এক। হৃদ্য দ্বিধা কাটাতে ডাকল,
“ফুলপরি?”
ভ্রমর চোখ তুলে তাকাল। কপাল দলা করে বলল,
“কে ফুলপরি?”
হৃদ্য থতমত খায়। ফুলপরির ভাবনা লুকিয়ে বলল,
“কেউ না। মুখ কালা করে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? কী সমস্যা?”
ভ্রমরের পাঁক তোলা চোখ নিভে যায়। আকাশের কালো মেঘ এবার তার মুখে জমেছে। একটু পরেই চোখ থেকে বৃষ্টি ঝরবে এমন ভাব। সেভাবেই বলল,
“আম্মু বলেছে,আমাকে নাকি কোনো কলেজেই ভর্তি নিবে না।”
হৃদ্য অবাক হয়ে বলল,
“কলেজ? তুই কলেজে ভর্তি হবি?”
“হবো না? স্কুল শেষ করেছি তো কলেজে ভর্তি হওয়ার জন্যই। কত কষ্ট করে শেষ করেছি বলো তো? তিন তিন বারে এসএসসি টপকালাম। এখন বলে কলেজে ভর্তি হতে পারব না। তাহলে আমার এত কষ্টের মূল্য কোথায় রইল?”
হৃদ্যের হঠাৎ মনে পড়ল,আজ ভ্রমরের পরীক্ষার ফলাফল দেওয়ার কথা ছিল। অথচ সে এটা ভুলে বসে আছে। সব ঐ ফুলপরির জন্য! হৃদ্য মনে মনে কয়েকশো বকা দিল ফুলপরিকে। তারপর বলল,
“পাশ করেছিস অথচ কলেজে ভর্তি হতে পারবি না? কেন?”
ভ্রমর মুখ কালো করে বলল,
“নাম্বার কম পেয়েছি।”
“কত?”
“মনে নেই। এত নাম্বার মনে থাকে নাকি? বিষয় কয়টা সেটাই ভুলে গেছি।”
হৃদ্য কপট রাগ নিয়ে বলল,
“আরে পয়েন্ট কত?”
“২.২৫।”
হৃদ্যের মুখ হা হয়ে গেল। অনেক্ষণ সেভাবে থেকে তারপর হতাশ গলায় বলল,
“গণিতে এ+ আসেনি? আমি যে প্রশ্ন এনে দিয়েছিলাম হুবহু এসেছিল। আমি উত্তরও লিখে দিয়েছিলাম ভ্রমর!”
ভ্রমর সাথে সাথে কিছু বলল না। কিছুক্ষণ নীরব থেকে হঠাৎ কেঁদে ফেলল। কাঁদতে কাঁদতে বলল,
“আমি আর পড়তে পারব না। আমার পড়া শেষ।”
হৃদ্য স্বান্তনা দিবে নাকি কটু কথা শোনাবে বুঝতে পারছে না। এই মেয়ে নিজে তো ডুবছে,সাথে ও কে ও ডুবাচ্ছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে সহসা বলল,
“কাঁদতে হবে না। আন্টির কথা হয় তো ভালো করে শুনিসনি। সরকারি কলেজে ভর্তি হতে পারবি না। বেসরকারিতে পারবি।”
ভ্রমর কান্না থামাল। আশা নিয়ে বলল,
“সত্যি?”
হৃদ্য গম্ভীরস্বরে বলল,
“হুম।”
ভ্রমর উৎসাহ নিয়ে বলল,
“কোন কলেজে?”
হৃদ্য নীরবে দ্রুত ভেবে নিল। ভালো প্রাইভেট কলেজগুলোতে ভর্তি হতে গেলেও ভালো গ্রেড লাগে। ভ্রমরের সেটা নেই। ভ্রমরের মতো এই সমস্যাটাতে হৃদ্যও পড়েছিল। কিন্তু ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার সময়। এইচএসসিতে ফেল করেনি,তবে ভালো রেজাল্টও আনতে পারেনি! ভাবা শেষে বলল,
“আমার ভার্সিটিতে।”
ভ্রমর বোকার মতো প্রশ্ন করল,
“কলেজ রেখে সোজা ভার্সিটিতে ভর্তি হবো?”
হৃদ্য হেসে ফেলল। সহাস্যে বলল,
“দরকার হলে তাই করবি।”
ভ্রমর কাঁদো কাঁদো গলায় বলল,
“তুমি আমার সাথে মজা করছো?”
হৃদ্য হাসি থামিয়ে বলল,
“না,মজা করছি না। ওখানে ইন্টার লেভেল থেকেই শুরু।”
ভ্রমর খুশি হয়ে বলল,
“আমি এখনি গিয়ে আম্মুকে বলছি।”
ভ্রমর আর এক মুহূর্তও দাঁড়াল না। ছুটে ভেতরে চলে গেল। হৃদ্য খালি বারান্দার দিকে তাকিয়ে থাকল। মনে মন বলল,’ভ্রমর এখনও ছোট কিন্তু ফুলপরি অনেকটা বড়। ভ্রমর বড় হলে ফুলপরির মতোই হবে। হেলেদুলে হাঁটবে আর পুরুষদের মনে ঝড় তুলবে। গায়ের রঙটা একটু কালো,তাতে কি? কালো আকাশ তো ঝড়ের বিশেষ লক্ষণ!
________________________________________
শরৎকে নিয়ে মোড়ে দাঁড়িয়ে আছে রিধি। মোড় ঘুরলেই শ্রাবণদের বাড়ি। সে ভেতরে যাবে না। কিছু একটা বলে শরৎকে পাঠাতে হবে। কিন্তু কী বলবে? যেভাবে হাত ধরে হাঁটছে,মনে তো হয় না তাকে ছাড়া যাবে। রিধি উপায় খুঁজতে খুঁজতে বলল,
“তুমি কিন্তু কাজটা ঠিক করোনি।”
শরৎ অবাক হয়ে বলল,
“কোন কাজ?”
“এই যে একা একা আমার বাড়ি চলে গিয়েছিলে। যদি কোনো দুর্ঘটনা ঘটত? আর কখনও এমন করবে না।”
শরৎ কথা নাড়াল। বাধ্য ছেলের মতো বলল,
“আচ্ছা,ভাবি। আর যাব না।”
রিধি এই সুযোগটা কাজে লাগাতে বলল,
“আমাকে ছুঁয়ে প্রমিস করো।”
“কী প্রমিস?”
“আর কখনও আমার বাড়ি আসবে না।”
শরৎ রিধির মুখের দিকে তাকাল। তারপর বলল,
“কেন যাব না? ভাইয়ার সাথে যাব,আব্বুর সাথে যাব।”
” না যাবে না।”
“কেন?”
শরৎের প্রশ্নে রিধি অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,
“আমি চাই,তুমি শুধু আমার সাথে যাবে।”
“তুমি নিয়ে যাবে সবসময়?”
“হুম।”
শরৎ খুশিমনেই প্রতিজ্ঞা করে বসে। রিধিকে ছুঁয়ে কথা দেয়,তাকে ছাড়া কখনও ঐ বাড়ি যাবে না। রিধি হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। তারপর মোড়ের দোকানটার সামনে দাঁড়িয়ে পড়ে। কৌশলে বলল,
“তুমি বাসায় যাও,আমি কিছু জিনিস কিনব।”
শরৎ গেল না। বলল,
“সমস্যা নেই,ভাবি। আমি অপেক্ষা করছি।”
রিধি অগত্যা বিস্কুট,চিপস কিনল। তারপর শরৎের সাথে হাঁটতে হাঁটতে গেইটের সামনে চলে আসে। ভেতরে ঢুকার আগে বলল,
“তোমার ভাইয়াকে সারপ্রাইজ দিলে কেমন হয়?”
“সারপ্রাইজ?”
“হুম। তুমি আগে ভেতরে যাবে,তোমার ভাইয়া ভাববে তুমি রাগ ভাঙাতে পারো নি। সে খুশি হবে। হাসবে,তোমাকে ভেঙাবে। তখন হঠাৎ করে আমি সামনে আসব,তেমার ভাই….”
শরৎ রিধির দিকে এক হাত উঁচিয়ে থামিয়ে দিল। বলল,
“বুঝে গিয়েছি ভাবি,ফিল্মি ব্যাপার তাই তো? আমি নিজে ফিল্ম বানাচ্ছি আর আমি এসব বুঝব না। তুমি শুধু দেখ,আমি কী সুন্দর অভিনয় করি। তুমি এখানটাই চুপটি করে দাঁড়িয়ে থাকো। আমি শিস বাজালেই এন্ট্রি নিবে কেমন? আশ্বিন ভাইয়াকে শিখিয়ে দিব পাশ থেকে যেন একটু মিউজিক ছেড়ে দেয়।”
শরৎের কথায় রিধি মাথা নাড়ল। শরৎের কথামতো বাইরে দাঁড়িয়ে থেকে শরৎকে ভেতরে পাঠিয়ে দিল। সাথে সাথে তীক্ষ্ণ ব্যথা অনুভব হয় বুকে। ব্যথাটা সহ্য করতে পারে না। চোখ ছেড়ে জল গড়িয়ে পড়ে। বেশিক্ষণ পড়তে দেয় না। রিধি চোখের পানি মুছে চলে যাওয়ার জন্য পেছন ঘুরে। কারো বুকের সাথে ধাক্কা খায়। রিধি চোখ তুলে তাকায়। বুকটি আর অন্য কারো নয়,শ্রাবণের!
চলবে
চলবে
[আমার শুক্রবার মানেই ব্যস্ততা। আজও ব্যস্ত ছিলাম। ভেবেছিলাম দিব না। পর মুহূর্তেই মনে হলো,এক দিন পর পর দেই। আবার মিস দিলে খুব খারাপ দেখাবে। তাই ছোট করে হলেও দিলাম।]