প্রাণ_ভোমরা পর্ব ১৮+১৯

#প্রাণ_ভোমরা
#রোকসানা_রাহমান

পর্ব (১৮)

কিছু মানুষের উপস্থিতি ভালো ও মন্দ দুইয়ের মিশেল অনুভূতি সৃষ্টি করে। ফলে অস্বস্থির দানা বিঁধে তীব্রভাবে। শ্রাবণের উপস্থিতিটাও রিধির কাছে তেমনি। ছেড়ে যেতে মন খারাপ হয়,থেকে যেতে অশান্তি! বুঝে উঠতে পারে না কোন পথে তার সুখ। শ্রাবণের হঠাৎ আগমনে রিধি খানিকটা ভয় পেয়ে গিয়েছে। চমকেছে খুব! তাই শ্রাবণের মুখের দিকে বিস্ময় দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। বিস্ময়ে ফাটল ধরাল মেঘের গর্জন। রিধি বাস্তবে ফিরে। দৃষ্টি স্বাভাবিক হয়ে আসতে হঠাৎ রেগে যায়। খানিকটা চঁড়া গলায় বলল,

“শরৎকে আপনি পাঠিয়েছিলেন? এমন নির্বোধের মতো কাজটা আপনি কিভাবে করলেন? যদি ওর সাথে কোনো অঘটন ঘটত?”

শ্রাবণ নিশ্চুপ। চোখের চাহনি ও মুখের ভঙ্গি যথেষ্ট শান্ত। রিধির কথার কোনো পাত্তা দিল না। আকাশের দিকে তাকাল। গগণ ফাটছে ক্ষণে ক্ষণে। সেই ফাটলের মধ্যে আবার আগুন জ্বলে ওঠে বিভৎস চিৎকার তুলে সাবধান বাণী শুনাচ্ছে প্রাণকূলকে। সেই দিকে চোখ রেখেই শ্রাবণ সহজ স্বরে বলল,

“মনে হয় বৃষ্টি নামবে। প্রকৃতির স্নান করার সময় হয়েছে। আচ্ছা,প্রকৃতি এমন অনিয়ম করে গোসল করে কেন?”

শ্রাবণের এমন উদ্ভট কথা শুনে রিধি বোকা বনে গেল। বোকা চাহনি ফেলে শ্রাবণের দিকে। কিন্তু স্বল্পক্ষণের জন্যই। নিজের রূপে ফিরে আসে চোখের পলকে। আগের রাগটা দ্বিগুন বাড়িয়ে বলল,

“উল্টাপাল্টা কথা বলে আমাকে ভুলাতে আসবেন না। আমার প্রশ্নের জবাব দিন। কোন সাহসে শরৎকে একা পাঠালেন? আপনার কলিজা কেঁপে উঠেনি?”

শ্রাবণ আকাশ থেকে চোখ সরায়। রিধির দিকে তাকিয়ে সহজ গলায় বলল,

“আমার ভাই। কী করব না করব সেটা একান্তই আমাদের দুজনের ব্যাপার।”

রিধি আগুন চোখে চলল,

“আপনার ভাই দেখে যা খুশি করবেন? ভালোমন্দ দেখবেন না?”

শ্রাবণ বুকটা খানিক উঁচু করে সোজা হয়ে দাঁড়াল। প্যান্টের দু’পকেটে হাত পুরে বলল,

“না।”
“কেন? ওর ক্ষতি হলে আপনার কষ্ট হবে না?”
“না।”

এ পর্যায়ে রিধি দমে গেল। এমন অপ্রত্যাশিত উত্তরে রাগ অনেকটাই নিভে গেছে। ভীষণ রকম আশ্চর্য হয়ে বলল,

“এমন স্বর্থপরের মতো উত্তর দিচ্ছেন কেন? কী হয়েছে আপনার?”

শ্রাবণ পকেট থেকে হাত বের করে। বুকে বেঁধে নির্বিকারে বলল,

“আমি যার তার সাথে ব্যক্তিগত কথা বলতে উৎসাহি নই।

মুহূর্তেই রিধির চোখে খচখচ অনুভূতি হয়। টের পায় চোখদুটো টলমল পুকুরে রূপান্তর হচ্ছে। সেই টলটলে চোখে শ্রাবণের দিকে তাকিয়ে থাকতে পারে না। অপমানে বিষিয়ে উঠছে সারা শরীর। রিধি অন্য দিকে চোখ সরিয়ে নিতে,শ্রাবণ বলল,

” আমার ভাইকে নিয়ে আপনার দুশ্চিন্তা না করলেও চলবে। তার ভালোটা আমি দেখব,খারাপটাও। শুধু শুধু দূরের মানুষটাকে নিয়ে ভেবে আপনার দামি সময় কেন নষ্ট করবেন?”

রিধি না চাইতেও চোখজোড়া শ্রাবণের দিকেই এসে আটকাল। শ্রাবণ অত্যধিক ঠান্ডা গলায় বলল,

“আসতে পারেন।”

রিধি তখনও শ্রাবণের দিকেই চেয়ে আছে। পা দুটো যেন মাটি থেকে আলগা হতে চাচ্ছে না। চোখ দুটোও এই মানুষটার মুখ থেকে সরতে চাইছে না৷ মাঝে মাঝে এই মানুষটার মধ্যে কারো ছায়া দেখতে পায়। এই তো এখনও পাচ্ছে। অদৃশ্য ছায়া! যার সবটা ধূসর কালো রঙে গড়া। যে শুধু রিধির অন্তর জ্বালিয়ে দিতে জানে। রিধি চোখ বন্ধ করে নেয়। অন্তর্মনকে সুধায়,’ নির্লজ্জ,এখনও তার কথাই ভাবিস? সবার মধ্যে তাকেই খুঁজিস!’ সামনাসামনি বলল,

“আপনি কি আমার উপর রেগে আছেন?”

শ্রাবণ শুকনো হাসে। তাচ্ছিল্য সুরে বলল,

“আপনার তাই মনে হয়?”

রিধি মুখে কিছু বলে না। মাথাটা হালকা নাড়ায়। শ্রাবণ গাল টেনে একপাশে হেসে বলল,

“আপনার মনে হলে তাই।”

রিধি করুণ চোখে তাকায়। শ্রাবণ কিছু বলতে চেয়েও থমকে গেল। বৃষ্টির ফোঁটা পড়তে শুরু করেছে। দ্রুত বলল,

“ভেতরে চলুন। বৃষ্টি পড়ছে।”

রিধি শ্রাবণের আহ্বানকে অগ্রাহ্য করে। চলে যাওয়ার জন্য রাস্তায় এক পা ফেলে বলল,

“আমি আর মায়া বাড়াতে চাই না।”

কথাটা শেষ করে আরেকপা সামনে বাড়াতেই শ্রাবণ ওর পথরোধ করে। সামনে এসে বলল,

“ভিজে যাবেন। সাথে ছাতাও নেই। এই সময় রিকশা পাওয়া বড্ড মুশকিল!”

রিধি শ্রাবণের বাধা শুনল না। নিজের সিদ্ধান্তে অটল। শ্রাবণকে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে চায়। দুই কদম এগুতে হাতে টান খায়। শ্রাবণ ওর হাতের কব্জী বরাবর ধরে আছে। রিধি শক্ত গলায় বলল,

“হাত ছাড়ুন। আমি বাসায় যাব।”

শ্রাবণ হাত ছাড়ল না। নরম স্বরে বলল,

“বাসায় চলুন। সবাইকে আমি সামলে নিব।”
” না, যাব না।”
“কেন?”
“ভয় লাগে।”

শ্রাবণ ঘাড় বাকিয়ে রিধির দিকে তাকায়। দুজনের মধ্যে দূরত্ব দুই হাত। রিধি চোখ নামিয়ে ধীরে বলল,

“ছাড়ুন।”

শ্রাবণ ছাড়ার বদলে আরো শক্ত করে চেপে ধরে। রিধি চেষ্টা করেও হাত ছাড়াতে পারছে না। এ দিকে বৃষ্টির ফোঁটা ঘন হয়ে আসছে। মাথা,গাল,কাঁধ,বাহু,পিঠ বিভিন্ন অংশে ঠান্ডা স্পর্শে ছুঁয়ে দিচ্ছে। রিধি তাগাদা দিয়ে পুনরায় বলল,

“এমন করছেন কেন? ছাড়ুন। আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে।”

শ্রাবণ যেন কথাটা শুনলই না। সহসা বলল,

“আমি কি আপনার খুব অযোগ্য?”

শ্রাবণের আকস্মিক প্রশ্নে রিধি মোচড়ানো বন্ধ করে। শ্রাবণের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে,

“মানে?”
“আপনার ইচ্ছে হয়েছে বিয়ে করেছেন,ইচ্ছে হয়েছে হারিয়ে গিয়েছিলেন,ইচ্ছে হয়েছে ফিরেছেন, আমার পরিবারকে জানিয়েছেন,আমার বাসায় থেকেছেন আবার ইচ্ছে হয়েছে চলে গিয়েছেন। সবই তো আপনার ইচ্ছেতে হয়েছে রিধি। আমি মেনেও নিয়েছি। কিন্তু এবার আর পারছি না। আমার যে কিছু ইচ্ছে জেগেছে। সেটা কি আপনি মেনে নিতে পারেন না?”

রিধি ভয়ে ভয়ে বলল,

“কী ইচ্ছে?”
“সংসার সাজানো। আপনাকে নিয়ে নতুন উদ্যমে বাঁচা। পুরোনো জীবন বদলে নতুনত্বের সূচনা ঘটানো। সম্ভব নয় কি?”

রিধি আর শান্ত থাকতে পারল না। মুহুূ্র্তেই শ্রাবণের হাত থেকে ছাড়া পাওয়ার জন্য অস্থির হয়ে পড়ে। কাঁপাস্বরে অনুরোধ করল,

“আমার হাত ছাড়ুন।”

মেঘ গর্জে উঠল। সাথে শ্রাবণও। হঠাৎ করেই সে রিধিকে হেঁচকা টানে সামনে নিয়ে আসে। মুখের সামনে দাঁড় করিয়ে কঠিন স্বরে বলল,

“সমস্যা কী? তখন থেকে হাত ছাড়ুন,হাত ছাড়ুন করছেন কেন? একটা গুরুত্বপূর্ণ কথা বলছি কানে যাচ্ছে না?”

রিধি ভয় পায়। মিঁইয়ে যায়। কিছু বলার জন্য ঠোঁট নড়ে উঠতে শ্রাবণ ধমকে উঠে,

“ফের যদি হাত ছাড়ার কথা বলেছেন তাহলে কিন্তু..”
“তাহলে কী? বকবেন? মারবেন? অন্ধকারে একা পেয়ে অসভ্যতামি করছেন। অসভ্য ছেলে!”
“আমি অসভ্য?”
“তা নয়তো কী? কথায় কথায় মেয়েদের ছোঁয়া যাদের স্বভাব তাদের অসভ্যই বলে।”
“আমি মেয়েদের ছুঁয়ে বেড়াই?”
“এখনও তো ছুঁয়েই আছেন।”

শ্রাবণ রাগ চোখেই রিধির হাতের দিকে তাকাল। দমে গেল না। রাগ ধরেই দৃঢ় গলায় বলল,

“আপনি কোনো মেয়ে নন,আমার বিবাহিত স্ত্রী।”
“বিয়ে হলেই জোর করবেন?”
“দরকার হলে করব। বিয়েটা জোর করে হয়নি। দুজনের সম্মতিতেই হয়েছে। আর আপনি কোনো বাচ্চা মেয়েও নন যে দয়া দেখাব,মায়া দেখাব,’বাচ্চা মেয়ে আরেকটু বড় হোক’ এই বলে নিজেকে বুঝ দেব!”

শ্রাবণের কাট কাট কথায় রিধি বড় বড় চোখে তাকায়। মুখটাতে অধিকারত্বের দৃঢ় ছায়া স্পষ্ট! রিধির ভয় হতে থাকে। অজানা আসঙ্কা টের পায় মস্তিষ্ক। সে শ্রাবণকে ঠান্ডা করতে বলল,

“আপনি অযথা রেগে যাচ্ছেন। অভদ্র আচরণ করছেন। হাত ছাড়ুন,ব্যথা পাচ্ছি।”

শ্রাবণের রাগ কমার বদলে বেড়ে গেল। চেঁচিয়ে বলল,

“আমি অভদ্র?”

রিধি জিভ কাটে। কী বলতে গিয়ে কী বলছে? এখন উপায়? সে ভাবতে ভাবতে বাম হাত দিয়ে শ্রাবণের গাল ছুঁলো।কোমলস্বরে বলল,

“শান্ত হোন। আপনার কথা রাখলাম। বৃষ্টি থামলে যাব। দেখুন,আমি এখন কোথাও যাচ্ছি না।”

রিধির কথায় কাজ হলো। শ্রাবণ শান্ত হলো। রিধির চোখের দিকে শান্ত চোখে তাকাতে,রিধি হালকা হাসল। চোখের পাতা ফেলে বুঝাল,’আমি আছি।’ শ্রাবণ সেই চোখের ভাষায় কী বুঝল কে জানে! আচমকা রিধিকে জড়িয়ে ধরল। শক্ত বাঁধনে বেঁধে বলল,

“যাবেন না, কোথাও যাবেন না। এখানে থাকবেন। আমার বাসায়,আমার কাছে,আমার বুকের মধ্যে!”

অপ্রত্যাশিত পুরুষ ছোঁয়ায় রিধি কেঁপে ওঠে। শিরশির অনুভূতি বয়ে যায় মেরুদন্ডে। সে সহ্য করতে পারে না। ভেতরে তুমুল ছটফট শুরু হয়। শ্রাবণের হাতের বাঁধন ধীরে ধীরে ঘন হতে ঘনতর হচ্ছে। রিধি শঙ্কিত গলায় দ্রুত বলল,

“শ্রাবণ? কী করছেন? আমরা রাস্তায় আছি। কেউ দেখবে!”

শ্রাবণ সে কথা কানে নিল না। ঝমঝম করে নামা বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে প্রথম চুমুটা খেয়েই ফেলল!
#প্রাণ_ভোমরা
#রোকসানা_রাহমান

পর্ব (১৯)

রিধি গভীর মনোযোগে পড়ছে। তন্মধ্যেই হৃদ্যের আবির্ভাব ঘটে। তার দিকে ফোন বাড়িয়ে দিয়ে বলল,

“নে ধর।”

রিধি বই ছেড়ে তাকাল। একবার হৃদ্যের মুখের দিকে,আরেকবার ফোনের দিকে। তারপর প্রচণ্ড বিরক্ত নিয়ে ঝাঁরি দিল,

“ফোন ধরানোর জন্য এসেছিস? এই সাতসকালে আমাকে দিয়ে ফোন ধরানোর জন্য এসেছিস? থাপড়িয়ে গাল লাল করে দিব। আমার রুম থেকে বের হ।”

বোনের আকস্মিক রাগে হৃদ্য হতভম্ব! ক্ষণকাল রিধির মুখের দিকে তাকিয়ে থাকল। কী জন্য এসেছিল তা বেমালুম ভুলে বাইরে চলে গেল। আপুর রুম ছেড়ে নিজের রুমে আসতে মনে পড়ল শ্রাবণ ভাইয়া কল দিয়েছিল। রিধির সাথে কথা বলবে বলে। সে আবার ছুটে যায় বোনের রুমে। ভীরুস্বরে বলল,

“শ্রাবণ ভাইয়া লাইনে আছে। তোর সাথে কথা বলবে।”

রিধি অগ্নি চোখে তাকাল হৃদ্যের দিকে। হৃদ্য ভয় পেল। ভীত ঢোক গিলতে রিধি ওর হাত থেকে ফোনটা নিল। নিঃশব্দে লাইন কেটে দিল। শক্ত গলায় বলল,

“ফের যদি আমার রুমে আসিস,কম্পাস দিয়ে পায়ের তলা ফুটো করে দিব। বের হ,এক্ষুনি!”

হৃদ্য ধপধপ শব্দ তুলে বাইরে আসে। বুক ফুলিয়ে নিশ্বাস নিয়ে বিড়বিড় করে প্রশ্ন রাখে,’আপু,হঠাৎ আগুনরূপ ধারণ করেছে কেন?’

ফোনের অপরপাশে শ্রাবণ সবকিছুই শুনছিল। ভয়টা হৃদ্যের থেকে তাকেই যেন বেশি গ্রাস করেছে। রিধি কেটে দেওয়ার সাথে সাথে হাত থেকে ফোন পড়ে গিয়েছে। পাশ থেকে দু গ্লাস পানি খেয়ে বিড়বিড় করছে,’ রাগ,এত রাগ? থাপ্পড় দিয়েও তার রাগ পড়েনি? কী এমন করেছিলাম? সামান্য একটা চুমুই তো খেয়েছিলাম। তাও ঘাড়ের কাছটায়,অন্য কোথাও তো খাইনি। তার জন্য সারাক্ষণ চণ্ডী রূপ ধারণ করার কী আছে? সবকিছুতে বেশি বেশি।’ শ্রাবণ মুখ বাকিয়ে তৃতীয় বারের মতো পানির গ্লাস ভরে। তাৎক্ষনিক কিছু মনে পড়তে মিঁইয়ে যায়। ঢকঢক করে পানি পেটে চালান করে নিজের গালে দুটো চড় মারে আর ভাবে,’ রাগ তো করবেই। কেন করবে না? সেও তো একটা চড়ই মেরেছিল। তার জন্য আমি কেন দুটো মারতে গেলাম? পুরুষালি শক্তি আমাকে তখনি দেখাতে হলো? আবার জোর করে বাসে তুলে দিয়ে কী বলেছিলাম? এই পাড়ায় যেন তার পা না পড়ে। পড়লে,পা ভেঙে খোঁড়া করে দিব!
________________________________________
ভ্রমর ভর্তি ফরম জমা দিতে গিয়ে হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠে জানায়, সে এই কলেজে ভর্তি হবে না। এদিকে অনলাইনে আবেদন থেকে শুরু করে সিউরক্যাশ এ পেমেন্ট ও অন্যান্য কাগজপত্র সবটাই এক হাতে সামলিয়েছে হৃদ্য। তার সারা শরীর ঘামে চিপচিপে। রোদ্দুরে মাথার তালু ফেটে যাওয়া অবস্থা। সেই সময় ভ্রমরের এই ঘোষনা হৃদ্যের গায়ে ফোসকার মতো ঠেকল। মুখ কালো করে,ভ্রূ কুঁচকিয়ে বলল,

“কেন? কী সমস্যা?”

ভ্রমর সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিল না। হাতে থাকা কাগজপত্র মাঠে ছুঁড়ে বলল,

“ছি! এই কলেজে আমি পড়ব? যেদিকে তাকাই সেদিকেই তোমার প্রেমিকারা।”
“আমার প্রেমিকারা?”
“তা নয় তো কী? এই যে তোমার চারপাশে হেঁটে বেড়াচ্ছে,বসে আড্ডা দিচ্ছে,দুলে দুলে হাসছে এরা তোমার প্রেমিকা নয়?”

হৃদ্য এক পলকে চারপাশটা দেখে নিল। তারপর চোখ রাখল ভ্রমরের মুখে। তার মুখজুড়ে তাচ্ছিল্য! হৃদ্য বলল,

“এই সব মেয়ে আমার প্রেমিকা?”
“হুম।”
কী করে জানলি?”

ভ্রমর চোখ পাকিয়ে বলল,

“আমাকে দিয়ে গন্ডাগন্ডা প্রেমপত্র লিখিয়েছো আর আমি জানব না?”
“তোকে দিয়ে লিখিয়েছি বলে,তুই সব জানিস?”
“হুম।”
“কী কী জানিস,বল।”

হৃদ্য এক হাত কোমরে দিয়ে দুই পা আগপিছ করে দাঁড়াল। ভ্রমর হৃদ্যের কথার পাত্তা দিল না। সে হনহন করে কলেজ থেকে বেড়িয়ে যাচ্ছে। হৃদ্য পিছন ডাকল,ভ্রমর শুনছে না। থামছেও না। হৃদ্য পড়ে থাকা কাগজগুলো তুলে এনে ভ্রমরের হাত ধরে আটকাল। আকুতি করে বলল,

“চল ফরম জমা দিবি।”

ভ্রমর নাক,মুখ শক্ত করে বলল,

“না। আমি ভর্তি হব না। এখানে পড়ব না তোমার প্রেমিকাদের দেখব?”
“পড়বি।”
“কীভাবে?”

হৃদ্য হালকা হাসল। মশকরা করে বলল,

“চোখে পট্টি বেঁধে ক্লাসে ঢুকবি। ক্লাস শেষে আবার পট্টি বেঁধে বাড়ি চলে যাবি। ব্যস!”

ভ্রমর চোখ সরু করে তাকাল। হৃদ্যের বাঁকা হাসিতে তার গা জ্বলে যাচ্ছে। কোমরে হাত বেঁধে বলল,

“আমার যদি বমি আসে?”
“বমি আসবে কেন?”
“তোমার প্রেমিকাদের গন্ধে। এখন তো আমাকে নাকেও পট্টি বাঁধতে হবে? তাহলে নিশ্বাস নিব কী করে?”
“মুখ দিয়ে। এই যে এভাবে।”

হৃদ্য বড় হা করে বাতাস টানছে আর ছাড়ছে। ভ্রমর চোখগুলো পূর্বের চেয়েও অধিক ছোট করে বলল,

“পারব না। ভর্তি হব না মানে হব না। আমার বুঝি মানসম্মান নেই?”

হৃদ্য ভ্রূ উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল,

“এখানে মানসম্মান আসল কোথা থেকে?”

ভ্রমর অন্য দিকে মুখ করে বলল,

“এই ভার্সিটির প্রত্যেকটা মেয়ের কাছে তোমার প্রেমপত্র আছে। সবাইকে তুমি প্রপোস করেছো। একমাত্র আমি ছাড়া। সবার মাঝখানে আমাকে গরীব লাগবে। আমি গরীব হয়ে পড়তে পারব না।”

হৃদ্য সন্ধানি চোখে তাকাল। ভ্রমরের মুখে কিসের আভাস? হিংসা নাকি অন্য কিছু? তাহলে কি ভ্রমরও চাইছে হৃদ্যের কাছ থেকে প্রেমপত্র নিতে? হৃদ্য ভেতরে ভেতরে ভীষণ খুশি হয়। অত্যন্ত কৌতুহল দেখায়। সুধায়,

“তোরও কি প্রেমপত্র চায়?”

ভ্রমর বিস্মিত চোখে তাকায়। জিজ্ঞেস করে,

“তুমি আমাকে প্রেমপত্র দিবে?”

হৃদ্য হকচকিত! অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। কিছুক্ষণ এদিকওদিক চোখ ঘুরিয়ে আনে। নিজেকে ধাতস্ত করে চৌকসে বলল,

“তোর বমি আটকানোর জন্য নাহয় একটা প্রেমপত্র দিলাম!”

ভ্রমর সন্দিহান কণ্ঠে বলল,

“কে লিখে দিবে?”

হৃদ্য জবাব দিল না। পাশ দিয়ে চলে যাওয়া একটা মেয়েকে আটকাল। তার থেকে কলম আর কাগজ চেয়ে নিয়ে গটগট করে কিছু লিখল। তারপর ভ্রমরের দিকে ধরে বলল,

“নে, ধর তোর প্রেমপত্র।”

ভ্রমর ধীরে কাগজটা নিল। ‘প্রিয় ভোমরা’ আর ‘ইতি প্রাণ’ ছাড়া কিছু লেখা নেই। সবটাই ফাঁকা। ভ্রমর কাগজ দলা পাকিয়ে হৃদ্যের দিকে ছুঁড়ে বলল,

“আমি অন্য ভার্সিটিতে ভর্তি হব। নীলা আন্টিকে এখনি ফোন দেও। আমি বাসায় যাব।”

_______________________________________
আজিজুল হক অফিস থেকে ফিরেই বাড়ি মাথায় তুললেন। চেঁচিয়ে গলা ফাটিয়ে ফেলছেন বোধ হয়। শায়লা হক রান্না ফেলে বসার রুমে ছুটে এলেন। স্বামীকে কিছু জিজ্ঞেস করার সময় পেলেন না। তার আগেই তিনি ধমকে উঠলেন,

“এ বাড়িতে কি আমি একাই মোবাইল ব্যবহার করি যে সারা বাংলাদেশে আমার নাম্বার ছড়ানো হচ্ছে? পেয়েছেটা কী? অন্যের মেসেজ আমার ফোনে আসবে কেন? এত বড় সাহস! ”

শায়লা হক বুঝতে চেয়েও বুঝলেন না। কার মেসেজ,কেমন মেসেজ? তিনি প্রশ্ন তুলতে গিয়ে আবার বাঁধা পেলেন। আজিজুল হক ফোনটা সোফায় ঢিল মারলেন। চিৎকার করে বললেন,

“তোমার মেয়েকে বলো মেসেজ পড়ে আমাকে উদ্ধার করতে!”

আজিজুল হক চলে যেতে নিলে,সেখানে রিধির আগমন ঘটে। বাবার উদ্দেশ্যে বলল,

“আম্মু,তোমার স্বামীকে বলে দেও,আমার কাছে মোবাইল নেই,তাই তাঁর নাম্বারটা ব্যবহার করেছি। সামান্য মেসেজ নিয়ে এমন হুলস্থুল বাঁধানোর কিছু নেই। নিশ্চয় কোনো নোংরা মেসেজ আসেনি। এডমিট কার্ড ডাউনলোডের জন্য পিনকোড এসেছে।”

আজিজুল হক মানিব্যাগটা সায়লা হকের হাতে দিয়ে চলে গেলেন। স্বামীর না বলা কথাটা তিনি বুঝে ফেললেন। মেয়ের কাছে এগিয়ে বললেন,

“মোবাইল নেই বলবি না? কত টাকা লাগবে নিয়ে নে। আজই একটা ভালো মোবাইল কিনে নিবি।”

রিধি টাকা নিল না। মানিব্যাগটা স্পর্শও করল না। বাবার মোবাইলের মেসেজটা পড়ে রুমে চলে গেল। শব্দ করে দরজা আটকে মনে মনে বলল,’ বাকি জীবনটা আমি মোবাইলহীন কাটাতে চাই,আম্মু। এর জন্য বাবার বকা খেতেও রাজি!’

রিধি বন্ধ দরজা খুলল ভ্রমরের ডাকে। খানিকটা অবাক হয়ে বলল,

“কখন এলি,ভ্রমর?”

ভ্রমর মিষ্টি হাসল। রিধির বিছানায় বসে বলল,

“তোমরা যখন ঝগড়া করছিলে তখন।”

রিধি চট করে দেয়ালঘড়িতে তাকাল। দশটা বেজে পঁচিশ। বলল,

“সে তো অনেক্ষণ আগের ঘটনা। এতক্ষণ কী করছিলি?”
“আন্টির সাথে গল্প করছিলাম। একটু তরকারি নেড়ে দিলাম। বললেন, রাতের খাবার খেয়ে যেতে।”

রিধি ভ্রমরের পাশে বসে বলল,

“তোর আম্মু?”
“আম্মু একটা দরকারে বাইরে যাচ্ছিল। পপি আপুও সাথে যাবে। আমার যাওয়া নিষেধ! কিন্তু বাসায় তো আর কেউ নেই। আমি একা! তাই এখানে দিয়ে গেল। বলেছে,ফেরার সময় নিয়ে যাবে। আমি কি তোমার কাছে ততক্ষণ থাকতে পারব?”

রিধি ভ্রমরের গালে হাত রাখল। মেয়েটিকে তার ভীষণ ভালো লাগে। মুখটা মায়ায় ভরপুর! এই মায়ায় বুঝি তার ছোট ভাই বন্দী হয়েছে। কবে প্রকাশ পাবে এদের ভালোবাসা? রিধির খুব ইচ্ছে হয় এদের প্রেম দেখতে। যদিও সে বড় আপু তাতে কী? লুকিয়ে লুকিয়ে ঠিক দেখবে!

“বাবারা বুঝি এভাবেই কথা বলে?”

রিধি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায়। ভ্রমর বলল,

“আংকেল তোমার সাথে যেভাবে কথা বলে সেভাবে।”
“কীভাবে বলে?”
“এই যে অন্য দিকে তাকিয়ে। কখনও গম্ভীর কণ্ঠে,কখনও রাগি কণ্ঠে।”

রিধি মৃদু হাসল। টেবিলের কাছে গিয়ে বই গুছাতে গুছাতে বলল,

“না। উনার আমার উপর অভিমান হয়েছে তাই ওভাবে বলেন।”

ভ্রমর রিধির পাশে দাঁড়িয়ে বলল,

“অভিমান? কী নিয়ে?”

রিধি ভ্রমরের দিকে তাকাল। কিছুক্ষণ নীরব থেকে সহসা বলল,

“তুই বুঝবি না।”

ভ্রমরের মন খারাপ হয়। মনে মনে ভাবে,তার উপর কেউ অভিমান করে না। এমন অভিমান কি তার বাবাও করতে পারে?

“আব্বুর সাথে তোর আলাপ হয়েছে?”
“হুম। একটু আগেই হলো। আন্টি আলাপ করিয়ে দিয়েছেন।”

রিধি একটা ফরম ওর হাতে দিয়ে বলল,

“এখানে বাবার একটা সাইন লাগবে। নিয়ে আয়।”

ভ্রমর কাগজ নিল। বলল,

“আমি যদি ভুল করে ফেলি? তুমিও চলো,আপু।”

রিধি বইগুলো সাজিয়ে রাখতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ব্যস্ত গলায় বলল,

“আমি গেলে উনি রাগ করবেন।”
“কেন?”
“অভিমান ভাঙেনি যে তাই।”
“কেন ভাঙেনি?”
“জানি না।”
“কেন জানবে না? তোমার বাবা হয় না?”

রিধি ঘাড় বাকিয়ে তাকায়। ভ্রমর নিভে যায়। চোখ নামিয়ে বলল,

“আচ্ছা,নিয়ে আসছি।”

ভ্রমর চলে যেতে চাইলে রিধি পেছন ডাকে। ওর হাত থেকে কাগজটা নিয়ে কিছু একটা ভাবল। আচমকা ভ্রমরকে জড়িয়ে ধরে বলল,

“জানি। বাবার রাগ না ভাঙার কারণ জানি। চল আজ বাবার রাগ ভাঙাব।”
“কী করে?”

রিধি উত্তর দিল না। শুধু হাসল আর মনে মনে নিজেকে প্রস্তুত করে নিল। যত্ন করে লুকিয়ে রাখা কথাগুলো আজ সে বাবাকে বলবে,অবশ্যই বলবে।

চলবে
[কাল থেকে রোযা। রোযার মাসে ইবাদত,আনন্দ,উল্লাস,ব্যস্ততা সকলেরই। আমারও। সেই উপলক্ষে গল্প স্থগিত রাখব নাকি এখনও ভাবিনি। তবে দিলে পর্ব ছোট হবে এবং রাত দশটার পর। সবাই ভালো ও সুস্থতার মধ্যে পবিত্র রমজান মাস পার করুন এই শুভকামনা ও দোয়া। সবাইকে রমাদ্বান মোবারক❤️]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here