প্রাণ_ভোমরা পর্ব ৩

#প্রাণ_ভোমরা
#রোকসানা_রাহমান

পর্ব (৩)

ভ্রমর কাঁদছে। দুই হাঁটুর মধ্যস্থানে কপাল ঠেকিয়ে ফুঁপিয়ে উঠছে ক্ষণে ক্ষণে। ঘরের দক্ষিণ কোণে পড়ার টেবিলে পিঠ ঠেকিয়ে মেঝেতে বসে আছে সে। বিকেল প্রায় শেষ হতে চলল। সাঁঝের মায়া আচ্ছন্ন করে নিচ্ছে চৈত্রের তপ্ত প্রকৃতির সজ্জায় ভূমন্ডলকে। দূরের বড় রাস্তাটা এবার বুঝি একটু স্বস্থি পাবে। যানজটের ঝামেলা কমতে শুরু করেছে। সূর্য মহোদয় রাতের আকাশে হারিয়ে যাওয়ার পূর্বে বিদায়ী হাসি হাসছেন। সেই হাসির রং গাঢ় কমলা। যার সবটা সৌন্দর্য পৃথিবীর বুকে ক্ষনিকের জন্য ঢেলে দিয়ে অস্ত নিলেন। সঙ্গে সঙ্গে রাতের আঁধার কাটাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে জনমানব। সাদা,লাল,নীল,সবুজসহ আরো হরেক রঙের আলো জ্বলে উঠে ক্ষেত্রবিশেষ জায়গাগুলোতে। কিন্তু ভ্রমরের চারপাশে বাড়তে থাকে ঘোর অন্ধকার! একটু কি কান্না বন্ধ করে বাতিটা জ্বেলে নিবে? তাতে যে শান্তি নেই। সে রকম ইচ্ছেও দেখা যাচ্ছে না তার মাঝে। সে ব্যস্ত! চোখের পানি ঝরাতে ব্যস্ত। নাকের পানি মুছতে ব্যস্ত। ফুঁপিয়ে উঠতে ব্যস্ত। এবং চাপা অভিমানের পাহাড় গড়তে ব্যস্ত। কিন্তু এই এত সব ব্যস্ততা কখন চেপে বসল তার ঘাড়ে?

হৃদ্যকে বাবার কথা জানিয়ে ভ্রমর খুব সুন্দর করে নিজেকে সুসজ্জিত করে। তার রেশম, কালো চুলে সযত্নে চিরুনির প্রলেপ বুলিয়ে উঠতে পপি রুমে আসে। জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ। মায়া দৃষ্টিতে ভ্রমরের দিকে তাকিয়ে থাকে। ভ্রমর সাজসজ্জায় ব্যস্ত থাকায় পপিকে খেয়াল করেনি। খেয়াল করতে উচ্ছসিত কণ্ঠে জানতে চাইল,

“বাজান এসে পড়েছে?”

পপি হালকা করে মাথা দুলায়। ছোট্ট নিঃশ্বাস ছেড়ে ভাতের প্লেট আর পানির গ্লাস টেবিলের উপর রেখে বলল,

“ম্যাডাম আপনারে খাইয়া নিতে কইছে।”

ভ্রমর শেষ বারের মতো আয়নায় নিজেকে নীরিক্ষণ করে নিল। বিছানায় পড়ে থাকা সাদা ওড়নাটা তুলে নিল। গলায় প্যাঁচিয়ে পপির দিকে তাকাল। সরল গলায় জিজ্ঞেস করল,

“কিসের খাবার?”
“দুফুরের খাওন।”

ভ্রমরের চোখদুটো নিষ্প্রভ হয়ে পড়ে। ছুটে আসে টেবিলের কাছে। ঢাকনা সরিয়ে নিতে চোখে পড়ে,ভাত আর কবুতরের মাংস। সে শুকনো ঢোক গিলে পপির দিকে করুণ দৃষ্টিতে তাকায়। ধীরে ধীরে জিজ্ঞেস করল,

“আমি বাজানের সাথে খাব না?”

পপি সেই চোখের দিকে তাকাতে পারল না। চোখ সরিয়ে নেয়। মাথাটা কিঞ্চিৎ ঝুকিয়ে নিল। ছোট্ট করে বলল,

“না।”

ভ্রমরের চোখ জ্বলে ওঠে। নাকের আগায় ফুটে উঠে কঠিন রাগ। কণ্ঠে তেজ ঢেলে বলল,

“খাব। আমি বাজানের পাশে বসে খাব। বাজানের প্লেট থেকে খাব। আমার বাজান আমাকে খায়িয়ে দিবে।”

ভ্রমরের তেজালো ও দৃঢ় স্বরে সামান্য সিঁটিয়ে যায় পপি। তার কণ্ঠ কাঁপছে। কম্পিত স্বরে ভয়ে ভয়ে বলল,

“ম্যাডাম আপনারে বাইরে যাইতে মানা করছে।”

ততক্ষণে ভ্রমর দরজার কাছে চলে এসেছিল। তাৎক্ষনিক থমকে দাঁড়ায়। টলমল চোখে পেছন ফিরে। আদ্র কণ্ঠে জিজ্ঞেস করল,

“আম্মু,মানা করেছে?”

পপি সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিতে পারল না। ভ্রমরের প্রশ্নে সে এলোমেলো হয়ে পড়েছে। তার কণ্ঠ ছেড়ে ‘হ্যাঁ’ শব্দটি বের হওয়ার সাথে সাথে যে ভ্রমর কান্নায় ফেটে পড়বে তা খুব ভালো করেই জানে। গত তিন বছর ধরে সে এমন করুণ মুহূর্তের সাক্ষী হচ্ছে। এই বাবা,মা ও মেয়ের ভেতরের সমস্যাটি এখনও ধরতে পারেনি সে। কিন্তু ভীষণ রকমের ঝামেলা তো আছেই,নাহলে বাবা কেন চাইবে না মেয়ের সাথে দেখা করতে? আর মা’ই বা কেমন? মেয়েটাকে এক নজরের জন্য তার বাবাকে দেখতে পর্যন্ত দেয় না। তার ম্যাডাম তো এত নিষ্ঠুর মনের মানুষ না। তাহলে? কেন করছেন এমন? বাবা আর মেয়ের মধ্যে এমন দেয়াল তৈরী করে রেখেছেন কেন?

পপি ধীরে ধীরে ভ্রমরের দিকে এগিয়ে আসে। এই মেয়েটির কান্না দেখলে তার কষ্ট হয়। হৃদয়ের কোথাও একটা যন্ত্রণা হয়। ভীষণ রকমের মায়া কাজ করে। মাঝে মাঝে মনে হয়,ভ্রমরকে তার বাজানের ছবি দেখাতে। শেষ যে বার ভ্রমরের বাবা এসেছিল লুকিয়ে ছবি তুলেছিল পপি। কিন্তু দেখানোর সাহস হয়ে উঠেনি। আর ভ্রমরও তো নাছোড়বান্দা। ভাঙবে কিন্তু মচকাবে না। সে এক কথায় অটল,’আমি স্বচক্ষে আমার বাজানকে দেখব। মন ভরে দেখব আর কল্পনায় ছবি অঙ্কন করব!’

“নুন আনতে ভুইলা গেছি। আপনি খাওয়া শুরু করেন,আমি যামু আর আমু।”

পপি যেভাবে খাবার রেখে গিয়েছিল এখনও সেভাবেই পড়ে আছে। শুধু ঠান্ডা আর পানসে হয়ে গেছে। পপি লবণ আনার কথা বলে বেরিয়ে গেলেও ফিরে আসেনি। হয় তো তার মনে হয়েছে,কারো নোনা পানি ঝরা দেখার থেকে লবণ ছাড়া খেতে দেওয়া শ্রেয়। কিংবা ধরেই নিয়েছে অন্য সব বারের মতো এবারও ভাতগুলো অবহেলায় পড়ে থাকবে। তার ধরে নেওয়া ভাবনার সত্যতা প্রকাশ পেল ঘন্টা দুয়েক পরেই। শরীফা খন্দকারের হুকুম পালন করতে ভ্রমরের রুমে আসে পপি। দরজা খোলাই ছিল। খাটের কাছে উদাসীন নয়নে বসে ছিল ভ্রমর। পপি শুধু নীরবে দেখল। চলে যাওয়ার পূর্বে বলেছিল,

“এহনো খান নাই? ম্যাডাম জানলে রাগ করব।”

পপির কথায় ভ্রমরের কোন হেলদোল হলো না। সামান্য পরিমান নড়ল না। এমন কী চোখ তুলে তাকালও না। ভাব দেখে মনে হচ্ছে,সে এই জগতে নেই। পপির ইচ্ছে হলো ভ্রমরের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে। জিজ্ঞেস করতে,’কোন দুনিয়াই হারিয়েছে।’ কিন্তু সাহাস পায় না। ভয় করে। সে যে কাজের বেটি! অনেক্ষণ নিশ্চুপে থাকে। ভ্রমরের দিক থেকে উত্তরের অপেক্ষা করে। পরিশেষে নিঃশব্দে বেরিয়ে যায়। ম্যাডামকে জানাতে হবে।

______________________________
মাগরিবের আযান পড়তে শরীফা খন্দকার সোফা ছেড়ে দাঁড়ালেন। স্বামী মীর খন্দকারের হাতে আচারের বোয়ামটা দিয়ে বললেন,

“নামাজটা পড়ে আসি।”

মীর খন্দকার বাটি ধরার বদলে শরীফা খন্দকারের হাত চেপে ধরলেন। শরীফা খন্দকার বেশ অবাক হয়। জিজ্ঞাসু দৃষ্টি রাখলে মীর খন্দকার বললেন,

“দুজন একসাথে নামাজ পড়ি না,অনেক বছর হয়েছে। চলো,আমিও পড়ব।”

শরীফা খন্দকার মৃদু হাসলেন। স্মৃতিপট থেকে চট করে ঘুরে এলেন। বিয়ের পর তাদের প্রথম ভোরের কথোপকথনটা ঠিক এমনই ছিল। শুধু ‘দুজন এক সাথে নামাজ পড়ি না,অনেক বছর হয়েছে’ ব্যথাতুর লাইনটি ছিল না। স্বামীকে সঙ্গে নিয়ে রুমের ভেতরে ঢুকার পথে পপি সামনে পড়ল। পপির সাথে চোখাচোখি হতে কিছু একটা ইশারা করলেন তিনি। বিপরীতে পপি মাথা নাড়ল। বড় বড় পা ফেলে পাশের রুমে চলে যায়। ভিড়ানো দরজা খুলতেই খানিকটা ভয় পেল। ভেতর থেকে যেন কালো ধোয়ার কুন্ডলি বেরিয়ে আসছে। ভীতস্বরে জিজ্ঞেস করল,

“ভ্রমর আপা? আপনি ভিতরে আছেন? ম্যাডাম নামাজ পইড়া নিতে কইছে।”

ভেতর থেকে কোনো শব্দ আসে না। পপি কান খাড়া করে কিছু শোনার চেষ্টা করছে। পারছে না। তাহলে কি ভ্রমর ঘুমিয়ে পড়েছে? এমন নিস্তব্ধ,নিকষ কালো রুমে ঢুকার স্পর্ধা করে উঠতে পারে না পপি। অন্ধকারকে সে খুব ভয় পায়। কোমরে সবসময় বাটন ফোনটা রেখে দেয়। বলা তো যায় না কখন বিদ্যুৎ চলে যায়! সে কোমর থেকে মুঠোফোন বের করে টর্চ জ্বালায়। আবছা আলো ভেতরে ফেলে আবার সন্দেহি গলায় বলল,

“আপা কি ঘুমাইতাছেন?”

এবারও কোনো উত্তর আসে না। তবে মিহি ও তীক্ষ্ণ কান্নার সুর ভেসে আসে।

______________________________

পাত্রপক্ষ বিকেলে আসার কথা থাকলেও এসে পৌঁছিয়েছে সন্ধ্যার পর। রিধি চুপচাপ,মাথা নত করে বসে আছে। তার ধারণা ছিল ব্যক্তিক ও অব্যক্তিক ধারার অসংখ্য প্রশ্নের সম্মুখীন হবে। কিন্তু এখন পর্যন্ত সে রকম প্রশ্ন করা হয়নি। তবে কি তাকে নিয়ে তাদের কোনো মাথা ব্যথা নেই? রিধি অতি সাবধানতায় চোরা চোখে সামনে তাকাল। তার মুখোমুখি দুটো পুরুষ মানুষ বসে আছে। একজন বয়স্ক ধাঁচের অন্যজন ছিমছাম,সুঠামদেহি। শিরদাঁড়া যথেষ্ট টান টান ও বুক ফুলিয়ে বসে থাকায় মুখটা বেশ উপরে অবস্থান করছে। রিধির চোখ অত দূর এগুলো না। লজ্জায় নাকি অস্বস্থি ঠেকছে বুঝতে পারছে না। মনে মনে অনাগ্রহ পোষণ করে চোখ সরিয়ে নিল। মুহূর্তেই হৃদয়টা হু হু করে ওঠে। মনে পড়ে এই সময় তার নীরব পাখি অফিস থেকে ফিরে। তারপর ফেসবুকে নিজ আইডির টাইমলাইনে দুই কী তিন লাইনের কবিতা পোস্ট করে। কখনও নিজের লেখা কখনও অন্য কারোর। তবে করবেই করবে। আর সেই কবিতার একমাত্র ও বিশেষ পাঠক হলো রিধি। তাহলে কি আজ তার কবিতা পড়া হবে না? রিধির মনে কালো মেঘ জমে। জিহ্বা ভার হয়ে আসে। যেন কিছু অনৈতিক কথাবার্তা বের করতে চাচ্ছে,সামনের মানুষগুলোর উদ্দেশ্যে। কিন্তু দোষটা কি তাদের? বিয়ের জন্য নাচানাচিটা তো সেই করেছে!

“আমি কি আপনার সাথে একটু আলাদাভাবে কথা বলতে পারি?”

রিধি খানিকটা চমকে ওঠে। চোখ তুলে তাকায় সামনের লোকটির দিকে। লজ্জায় তার মাথা কাটা যাওয়ার উপক্রম। সামনে দুজনের অভিভাবক বসা থাকা সত্ত্বেও অনুরোধ তার কাছে কেন? অনুমতি তো রিধির মা কিংবা বাবার কাছ থেকে নেওয়া উচিত ছিল। বরাবর তো এমনই ঘটে। তাহলে কি এই ছেলেটি অসভ্য,অশিষ্ট ধরনের? মান্য বলতে কিছু নেই?

রিধি ঘাড় বাকিয়ে বাবার দিকে তাকাল। তাঁর চোখ,মুখ স্বাভাবিক। তবে অপেক্ষায় আছেন রিধির উত্তরের। সেই সময় রিধি কাঁধে সামান্য চাপ খেল। রিধি বাবার থেকে চোখ সরিয়ে মায়ের দিকে তাকায়। শায়লা হক মেয়ের কাছ ঘেষেই দাঁড়িয়ে ছিলেন। পরস্পর দৃষ্টি বিনিময় হতে তিনি চোখের পাতা ফেললেন। যার মানে এই-‘ চুপ করে আছিস কেন? কিছু তো বল।’

রিধি হ্যাঁ,না কিছুই বলল না। বসা থেকে দাঁড়িয়ে বলল,

“আসুন।”

দুই কদম ফেলে রিধি থমকে গেল। আলাদা বলতে কোথায় গিয়ে কথা বলতে চাচ্ছেন তিনি? রিধি কি জিজ্ঞাসা করবে? রিধি পেছন ঘুরতে গিয়েও ঘুরল না। আচমকা চোখ পড়ে ঘড়ির কাঁটায়। সাতটা বেজে পঁচিশ। বিড়বিড় করে উচ্চারণ করছে,’ দেরি হয়ে গিয়েছে। অনেক দেরি! নীরব নিশ্চয় আমার অপেক্ষা করছে।’ রিধি অস্থির হয়ে পড়ে। পেছনের মানুষটির কথা বেমালুম ভুলে যায়। ব্যস্ত পা ফেলে নিজের রুমের দিকে ছুটছে। মোবাইল কোথায় রেখেছে মনে পড়ছে না। বিছানার সব কিছু এলোমেলো করে ফেলে। উপর ছেড়ে নিচেও খোঁজ চালায়। পাচ্ছে না। ড্রেসিং টেবিলের সামনে যায়। এটা সেটা সব নিচে ছুঁড়ে মারে। তবুও যদি পেত! সে হতাশ মনে বিছানায় বসে পড়ে। পাগলের ন্যায় মাথার দুধার চেপে ধরে। চুল খামচে ধরতে মনে পড়ে স্নাগারের কথা। রিধি হাওয়া বেগে গোসলখানায় ছুটে যায়। কয়েক সেকেন্ডের পরেই ফিরে আসে। অনলাইনে ঢুকতে ঢুকতে বিছানায় পা তুলে বসেছে। নোটিফিকেশন চেক করতে তার কাঙ্ক্ষিত জিনিসটি পেয়ে যায়। প্রথমেই চোখ পড়ে সময়ে। আটাশ মিনিট আগে আপলোড দিয়েছে। রিধি ঠোঁট না নাড়িয়ে পড়ে দুই লাইনের ছন্দ-কবিতাটি,

“তাহার স্মরণে কাহার হৃদয় ছটফটায়
কেউ তো বুঝে না হাসির পেছনে কী লুকায়!”

রিধির চোখ অশ্রুসজল। অনুভবের অতলে পৌঁছানোর পূর্বেই পুরুষকণ্ঠ বাজে,

“আমি কি একটু পানি পেতে পারি?”

রিধি কেঁপে ওঠে। হাত থেকে ফোনটা প্রায় পড়েই যাচ্ছিল।সামনের পুরুষ মানুষটিকে দেখে বিস্ময়ের অতিকে ওঠে। অজান্তেই লজ্জার স্নান চলে সর্বাঙ্গে। মনে পড়ে কিছুক্ষণ আগের ঘটনা। প্রচন্ড বিব্রত হয়। সে অন্য কারোর জন্য এতটাই ব্যাকুল ছিল সশরীরের এই মানুষটিকে চোখেই পড়েনি? রিধি আড়ষ্টভঙ্গিতে মোবাইলটা পাশে রাখে। বিছানার পাশে রাখা ছোট্ট টেবিলটা থেকে পানি এনে সামনের মানুষটির দিকে এগিয়ে দেয়। সে সহজভাবেই গ্লাস নিল। রিধির পাশে বসল। এক ঢোক,দুই ঢোক শেষ করে তিন ঢোকের জন্য পানি মুখে টেনে নিতে রিধি হুট করে বলল,

“আমরা বিয়ে করব কবে?”

ছেলেটির মুখের পানি গলায় পৌঁছুল না। ভীষম খেল তীব্রভাবে। নাকের তলায় জ্বলছে খুব। বসা থেকে উঠে পড়েছে সাথে সাথে। নিজেকে সামলাতে অনেকটা সময় নিল। চোখের শূভ্র অংশ লাল টকটকে পরিণত হয়েছে। বুকের ভেতর যেন যন্ত্রণার চিকন চিঁড় ধরেছে। গ্লাসটা পূর্বের জায়গায় রাখে। গাঢ় দৃষ্টি রিধির ওপর। রিধি তখনও উৎসুক নয়নে চেয়ে আছে। কোথায় হারাল তার লজ্জা? কয়েক সেকেন্ড নীরব থেকে রিধির কপালে হাত দিল ছেলেটি। কালো রঙের টিপটা তুলে নিয়ে,পুনরায় কপালের মধ্যিতে লাগিয়ে বলল,

“আপনি অশান্ত ও অস্থিরতায় ভুগছেন। মনের ভেতর কঠিন তোলপাড় চলছে। দিগভ্রান্ত! আপনার সময়ের প্রয়োজন। আগে নিজেকে…”

রিধি পুরো কথা শুনার ধৈর্য্য ধরতে পারল না। অধৈর্য্য হয়ে দ্রুত বলল,

“আপনাকে আমার মন পড়তে ডাকা হয়েছে? পছন্দ হলে বলুন নাহলেও বলুন। আমি অন্য ছেলে খুঁজে নিব।”

______________________________

হৃদ্য সারা বিকাল কাটাল বারান্দায় ঘুমিয়ে। সন্ধ্যার আযানে ঘুম ভেঙেছে। পেটের ভেতর গুড়ুম গুড়ুম শুরু হয়েছে। দুপুরে কিছু খেয়েছিল নাকি মনে পড়ছে না। এখন বারান্দা ছাড়তেও ইচ্ছে করছে না। সে বেতের চেয়ার ছেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়াল। হাতদুটো উপরে,নিচে,বামে,ডানে ঘুরাতে ঘুরাতে কয়েক দফা হামি ছাড়ল। মুখের ভেতর তিতো ভাব লেগে আছে। কিছু একটা খাওয়া দরকার। হৃদ্য আরেক বার ভ্রমরদের বারান্দায় চোখ রাখল। হতাশ ও দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে উচ্চারণ করল,’বাপ রে,দরজার সাথে জানালাও লাগিয়ে রেখেছে। এমন ভাব যেন আমি চুরি করে তার রুমে ঢুকে পড়ব!’

সে ঠোঁট একপাশে টেনে মুখ ঝামটা দিল। পুনরায় বিড়বিড় করল,’ বয়েই গেছে তোর অপেক্ষা করতে!’

সে বারান্দা ছেড়ে রুমে চলে গেল। খেতে যাওয়ার বদলে হাতে গিটার তুলে নেয়। ফিরে আসে বারান্দায়। বেতের চেয়ারটায় আরাম করে বসে সুর তোলার সাথে সাথে ঠোঁটদুটো গোল করে বাঁশির মতো চিকন,তীক্ষ্ণ ও মোহময় সুর তুলছে। সেকেন্ড কয়েক পেরোতে সামনের বারান্দায় নারী ছায়ামূর্তি উপস্থিত হলো। হৃদ্য মিষ্টি হাসল। সুরের টান সম্পন্ন করে রেলিং ঘেষে দাঁড়ায়। ভ্রূ উঁচিয়ে রুক্ষস্বরে জিজ্ঞেস করল,

“আমার আলু চা কোথায়?”

ভ্রমর অন্যদিকে মুখ করে দাঁড়িয়ে ছিল। হৃদ্যের কণ্ঠ পেয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ে বলল,

“কিভাবে দিব? আমার তো রুম থেকেই বের হওয়া বারণ!”

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here