প্রিয়দর্শিনী,পর্ব:২+৩

#প্রিয়দর্শিনী
#সামান্তা_সিমি
#পর্ব_২
🍁
যূথীদের বাড়িতে ঢুকলে সর্বপ্রথম নজর পড়ে রাস্তা বরাবর দাঁড়িয়ে থাকা টিনশেড বিল্ডিং টার দিকে।তার ডান পাশে কিছুটা দূরে আরো একটা টিনশেড বিল্ডিং। তবে এটা তেমন বড় নয়।মূলত এটা অতিথিদের জন্যই তৈরি।তাই দুটো ঘর প্রায়ই খালি পড়ে থাকে।

কিন্তু আজ বাড়িতে অতিথি আসার দরুণ বিল্ডিংয়ের গেইট খোলে দেওয়া হয়েছে।গেইটের সাথে লম্বা বারান্দা। সেই বারান্দা পরিয়ে ঘর।যূথী এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে আছে সেই ঘরের বন্ধ দরজার সামনে।মনে হাজারো বিরক্তি।নিশান নামক লোকটির ব্যাপারে সে এখনো কিছুই জানতে পারেনি।ভাত খাওয়ার সময় চাচীকে জিজ্ঞেস করতে গেছিল আর তখনই পাশের বাড়ির খোকনের মা হাজির।খোকনের মা হলো লতিফা চাচীর অন্তরঙ্গ বান্ধবী। দুজন গল্প জুড়ে দিলে দিনদুনিয়ার খবর থাকে না।তাই যূথী আর কিছু জিজ্ঞেস করতে পারেনি।

দরজায় কান পেতে যূথী কিছু একটা শোনার চেষ্টা করল।কিন্তু ভেতর থেকে কোনো শব্দই তো আসছে না।অবশেষে দরজায় হালকা করে টোকা দিল সে।
কয়েক সেকেন্ডের ভেতর উত্তর আসল,

‘ বাইরে অপেক্ষা করুন।’

এমন ভারী গলার আওয়াজ শুনে ভড়কে গেল যূথী।কোনো এক অজানা কারণে তাঁর বুকের ধুকপুকানি বেড়ে যাচ্ছে। কে এই লোক! যার গলার কন্ঠে এত দম?কিন্তু মুহূর্তেই যূথীর মুখটা রাগে ছেঁয়ে গেল।এত সাহস এই ব্যক্তির!ওদের বাড়িতে এসে ওকেই আদেশ করছে বাইরে অপেক্ষা করুন।অপমানসূচক কথা!উনি কি ঘরদোর সব নিজের মনে করছে নাকি?লোকটা এখনো তাঁকে চেনে না।যূথী এই গ্রামে একপিস ই আছে।একবার বের হোক তখন মজা দেখাবে।

খুট করে আওয়াজ তুলে দরজা খুলে গেল।সামনের ব্যক্তিটিকে দেখে যূথীর চোখের মনি স্থির হয়ে এল।এ কাকে দেখছে সে?বলিউডের ভারুণ ধাওয়ান এখানে এল কি করে?সে কি স্বপ্ন দেখছে?ভারুণ শ্যুটিং বাদ দিয়ে এই গ্রামে কি করছে?নাকি সুদূর ইন্ডিয়া থেকে এই গ্রামে শ্যুটিং করতে এসেছে!
যূথীর মগজে যখন এসব নানা আজগুবি প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে তখন নিশান যূথীর স্থির হওয়া চোখের সামনে আঙুল দিয়ে চুটকি বাজিয়ে বলল,

‘ দরজা থেকে সরে দাঁড়ান মিস আ…অথবা মিসেস।’

চুটকির আওয়াজে হুঁশ ফিরল যূথীর।তৎক্ষনাৎ বুঝতে পারল এই লোকটি ভারুণ ধাওয়ান নয়।হুবহু ভারুণের মত দেখতে নিশান নামের ব্যক্তিটি।
দরজা থেকে সরে দাঁড়াল যূথী।নাক ফুলিয়ে বলল,

‘ এক্সকিউজ মি! আমি মিসেস নই।এসব মিস মিসেস বলে ডাকবেন না।আমার ভাল নাম আছে।’

যূথীর ভালো নামের প্রতি কোনো আগ্রহ দেখালো না নিশান।যূথীকে বাইরে রেখে রুমে ঢুকে গেল।আরেক দফা অপমান অনুভব করল যূথী।বিরক্তিতে তাঁর কপাল কুঁচকে আসছে।এই লোকের সামনে আর এক মুহুর্তও থাকবে না সে।কোত্থেকে উঠে এসে এই বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে কে জানে?লতিফা চাচীর আত্মীয় হবে বোধ হয়।কিন্তু আগে তো কখনো দেখে নি।

নিশান এবার বেরিয়ে এল দুটো প্লাস্টিকের চেয়ার নিয়ে।যূথীর সামনে একটা রেখে অন্যটা কিছুটা দূরে নিয়ে নিজে বসে পরল।যূথীকে চোখের ইশারায় বলল,

‘ টেইক ইউর সিট।’

যূথী এবার দাঁত কিড়মিড় করে খেঁকিয়ে উঠল।

‘ আচ্ছা লোক তো আপনি!অর্ডার করছেন আমায়?আপনি জানেন আমি কে?এই বাড়ির মেয়ে আমি।তাই আমার সাথে সেভাবেই কথা বলুন।’

নিশান কোনো প্রতিত্তোর করল না।ঠোঁট কামড়ে যূথীর পা থেকে মাথা পর্যন্ত নজর বুলাতে লাগল।হালকা পাতলা গড়নের ফর্সা মেয়েটির মন চঞ্চলতায় ভরপুর। চেহারার দিকে তাকালেই বুঝা যায় এ মেয়ের কথায় কথায় মুখে খৈ ফুটে।গাঢ় কালো ভ্রু যুগলের নিচে দুটো মায়াবী চোখ বিরক্তি নিয়ে দেখছে তাঁকে।নিশান তো এই মেয়েটির জন্য সম্পূর্ণ অজানা অচেনা।তবুও তাঁর সামনে মেয়েটার কোনো অস্বস্তি নেই?এটা ভালোই বুঝেছে যে মেয়েটি ভীষণ ত্যাদড় স্বভাবের।নিশান আবার বলল,

‘ বসুন এখানে।’

যূথীর এবার খেয়াল হলো যে এই লোকটি তাঁকে আপনি করে বলছে।অথচ লোকটিকে দেখে মনে হচ্ছে তাঁর থেকে বয়সে অনেক বড় হবে।তাহলে আপনি করে বলার উদ্দেশ্যটা কি?
যূথী অন্যদিকে তাকিয়ে চেয়ার টেনে বসে পড়ল।

‘ গ্রামে যে একজনের খুন হয়েছে সেটা তো জানেন তাই না?’

যূথী আরো একবার সেই ভয়ানক দৃশ্যটির কথা মনে করে কেঁপে উঠল।যতই সে দৃশ্যটা মন থেকে মুছে ফেলার চেষ্টা করছে ততই যেন তা জেঁকে বসছে।নিশ্চয়ই ইতিমধ্যে পুরো গ্রাম রটে গেছে যে যূথী দেখেছে খুন হতে।এখন তো রাস্তায় বের হলেই সকলে হাজারটা প্রশ্ন করবে।
যূথী তাকিয়ে দেখে নিশান গভীর দৃষ্টিতে দেখছে তাঁকে।লোকটির বাদামী চোখ গুলোতে তীক্ষ্ণ বুদ্ধির ছাপ।চেহারার কোথাও যেন খানিকটা কাঠিন্য রয়েছে।তবে তা সহজে ধরা যায় না।

‘ সকালে আমি কলেজে যাচ্ছিলাম।প্রতিদিন আমি আর শেফালী একসাথেই যাই।কিন্তু আজ সে বলল কলেজ যাবে না।তাই একাই রওনা দিলাম।কাঁচা রাস্তা পেরিয়ে মেইন রোডের মাথায় রিকশা নিব ভেবেছি।কিন্তু গাঙের পাশে জাম গাছটার কাছে আসতেই দেখি চেয়্যারম্যান আঙ্কেল কালো মতন একটা লোকের সাথে তর্ক বিতর্ক করছে।’

‘ গাঙ থেকে জাম গাছের দূরত্ব অনেকখানি।দূর থেকে বুঝলেন কিভাবে যে ওঁরা তর্ক করছে।’

‘ না আসলে ওঁদের মুখের ভাবভঙ্গি দেখে আন্দাজ করেছি যে কোনোকিছু নিয়ে দুজনেই বেশ রেগে আছে।দূর থেকে তো ওদের কোনো কথা শুনতে পাই নি।’

‘ আই সি।তারপর কি হলো?’

‘ কথা কাটাকাটির একপর্যায়ে সেই লোকটি পকেট থেকে চাপাতি বের করে চেয়্যারম্যানের মুখ চেপে ধরে পেটের এক সাইডে লাগিয়ে দিল।এসব খুনোখুনি আমি কখনো দেখিনি।তাই ভয়ের চোটে সেখানেই চিৎকার দিয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছিলাম।’

যূথী থামল এবার।একটা জলজ্যান্ত মানুষ তাঁর চোখের সামনে খুন হয়ে গেল এটা ভাবলেই গায়ে কাটা দেয়।কিছুক্ষণ নীরবতার পর নিশান আচমকা প্রশ্ন ছুড়ল,

‘ চাপাতি চেনো তুমি?’

যূথী খেয়াল করল লোকটি এবার আপনি থেকে তুমিতে নেমে এসেছে।লোকটি বোধ হয় এখন বুঝতে পেরেছে মেয়েটি বয়সে তাঁর থেকে ছোট।যূথী বলল,

‘ চিনব না কেনো?টিভিতে সিআইডি দেখি।ওখানে কত রকমের ক্রাইম দেখা যায়।সাথে বিভিন্ন রকম অস্ত্র। ‘

‘ তাহলে ক্রাইম সম্পর্কেও ভালই ধারণা আছে তোমার।’

যূথী চোখ ছোট ছোট করে তাকাল নিশানের দিকে।লোকটা কোন কথা থেকে কোথায় চলে যাচ্ছে বুঝতে পারছে না সে।

‘ ঠিক আছে।এবার ওই লোকটি সম্পর্কে বলো।দেখতে কেমন ছিল।চেহারা দেখে চিনেছো?’

‘ জ্বি না।কখনো এই গ্রামে দেখিনি আমি।’

‘ আচ্ছা এখন যাও তুমি।’

যূথীর মুখ কালো হয়ে গেল।উনি আবারো তাঁকে অর্ডার দিল।কি আশ্চর্য! এতক্ষণ তো তাঁকে আসামীর মত জেরা করল।এগুলো জিজ্ঞেস করার পিছনে উদ্দেশ্য কি?নিজেকে কি হিরো ভাবে?অবশ্য দেখতে হিরোদের থেকে কম নয়।
কৌতূহল দমাতে না পেরে যূথী জিজ্ঞেস করে বসল,

‘ আপনি আমার থেকে এতকিছু জানতে চাইলেন কেনো?এগুলো দিয়ে আপনার কি দরকার?’

‘ কোনো দরকার নেই।এই যে তোমার কৌতূহল হচ্ছে কেনো আমি এতকিছু জিজ্ঞেস করছি তেমন ভাবে আমারও কৌতূহল হচ্ছিল পুরো ঘটনা শোনার জন্য। ‘

যূথী চোখ উল্টাল।এই মানুষটাকে তো সুবিধার লাগছে না।কেমন ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে কথা বলে।
চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল সে।গেইটের কাছে যেতেই সাদা গাড়িটার উপর নজর পড়ল।তৎক্ষনাৎ পেছন ফিরে জিজ্ঞেস করল,

‘ খরগোশের মত দেখতে ওই গাড়িটা কি আপনার?’

হালকা হাসল নিশান।তবে যূথী সেই হাসি দেখতে পেল না।

‘ গাড়িটা তো আমার।কিন্তু এটাকে খরগোশের সাথে তুলনা করলে কেনো?’

‘ খরগোশ দেখতে সাদা। গাড়িটাও সাদা।খরগোশ উবু হয়ে বসে থাকলে যেমন দেখায় গাড়িটাকেও তেমন দেখাচ্ছে। ‘

‘ সুন্দর বিশ্লেষণ দিলে তো!চমৎকার! ‘

‘ চালাতে পারেন গাড়িটা?’

নিশান উঠে দাঁড়াল।চেয়ার দুটোকে রুমে নিয়ে যেতে যেতে বলল,

‘ সময় করে একদিন গাড়িতে করে ঘুরিয়ে আনব তোমায়।তখন না হয় দেখো চালাতে পারি কিনা।’

যূথী ভীষণ লজ্জা পেয়ে গেল।বুদ্ধিমান মানুষটা কিভাবে বুঝে গেল যে তাঁর গাড়িটাতে উঠতে ইচ্ছে করছিল! মানুষটাকে যতটা খারাপ ভেবেছিল ততটা খারাপ তাহলে নয়।

চলবে…
#প্রিয়দর্শিনী
#সামান্তা_সিমি
#পর্ব_৩
🍁
ফুটন্ত ডুবো তেলে আলুর চপ ভাজা হচ্ছে। টগবগে তেলের কারণে চপগুলো এমনভাবে ধাক্কাধাক্কি করছে মনে হয় যেন কড়াই ঠেলে বেরিয়ে আসবে।
যূথী চুলার আঁচ কিছুটা কমিয়ে চপগুলো উল্টিয়ে দিল।তাঁর মুখ থমথমে। বিকেলে ওই লোকটার সাথে কথোপকথন গুলো মনে করে তাঁর চেহারা কাঁদোকাঁদো হয়ে যাচ্ছে। বারবার প্রতিজ্ঞা করছে জীবনে কখনো কারো পরিচয় না জেনে তাঁর সাথে কথা বলবে না।
একটু আগেই লতিফা চাচী থেকে নিশানের পরিচয় জানতে পেরেছে যূথী।চাচীর বড়বোন নীলুফা চৌধুরীর বড় ছেলে নিশান।নীলুফা চৌধুরীকে তো সে চিনে।কিন্তু উনার ছেলেকে তো চিনতো না।কখনো এই বাড়িতে দেখেনি।তবে শুনেছে নীলুফা চৌধুরীর দুটো ছেলে।উনারা ঢাকায় থাকে।দুটো ছেলের একজনকেও সে চিনত না।
লতিফা চাচী থেকে নিশানের প্রফেশনের কথা এবং কোন উদ্দেশ্যে এই গ্রামে হাজির হয়েছে সব জানতে পেরেছে।এরপর থেকেই যূথীর মুখ ভার।এত বড় লেভেলের একজন মানুষের সাথে সে কিভাবে পারল ওইরকম ব্যবহার করতে?না জেনে না বুঝে কত কি বলে ফেলেছে।ভাবলেই লজ্জায় মাথাকাটা যাওয়ার অবস্থা।

‘ আলুর চপ তো পুড়ে যাচ্ছে যূথী।তোর ধ্যান কোনদিকে।তাড়াতাড়ি নামা।’

চাচীর কথা শুনে যূথী লাফ দিয়ে উঠল।দক্ষ হাতে চপগুলো বাটিতে তুলে ফেলল।তখনই কোথা সজীব এসে একটা গরম চপ হাতে নিল।কিন্তু সাথে সাথেই আবার রেখে দিতে হল।চপগুলো আগুন গরম হয়ে আছে।
যূথী সজীবের কান মলে বলল,

‘ ভাগ বাদর! এগুলো তোর জন্য বানানো হয় নি।ওই যে দেখছিস সোফায় লোকটা বসে আছে মানে তোর নিশান ভাইয়া। এগুলো উনার জন্য তৈরি।’

পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ুয়া সজীব চোখ বড় বড় করে বলল,

‘ উনি বুঝি এতগুলো খাবে?মানুষ না রাক্ষস উনি?’

লতিফা বেগম পাশে দাঁড়িয়ে ট্রেতে নাশতা সাজাচ্ছিলেন।নিজের ছেলের কথা শুনে ধমকে উঠে বললেন,

‘ এক চড় লাগাব বেকুব ছেলে কোথাকার।ওটা তোর ভাই হয়।নিশান ভাইয়া বলে ডাকবে ওকে।যাও গিয়ে ভাইয়ার সাথে গল্প করো।তোমাকে ওখানেই নাস্তা দিব।’

সজীব শুকনো মুখে চলে গেল।
লতিফা বেগম গ্লাসে পানি ঢালতে ঢালতে বললেন,

‘ নিশান সোফায় বসে আছে।ওকে নাশতা দিয়ে আয়।’

বিপাকে পড়ে গেল যূথী।তাঁর তো ওই লোকটার সামনে যেতেই ইচ্ছে করছে না।বিকেলে যেসব কান্ড করেছে এরপর উনার সামনে গেলে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকতে হবে।

‘ আগুনের তাপে আমার খুব গরম লাগছে চাচী।আমি রুমে গিয়ে ফ্যান চালিয়ে বসি একটু।প্লিজ তুমি দিয়ে আসো।’

লতিফা বেগম আর কিছু না বলে ট্রে নিয়ে চলে গেলেন।উনাকে অনুসরণ করে যূথীও পা টিপে টিপে রওনা হলো।ড্রয়িংরুমের পাশের রুমে দাঁড়িয়ে কান পেতে রইল।লোকটা কেমন যেন অদ্ভুত। তাই সে আড়ি পেতে লোকটার কথাবার্তা শুনতে চায়।

নিশান জিজ্ঞেস করল,
‘ যূথী কোন ক্লাসে পড়ছে খালামণি?’

নিজের নাম শুনতে পেয়ে পর্দার কাছে আরেকটু চেপে আসলো যূথী।তাঁকে নিয়ে কথা হচ্ছে তাহলে। অদ্ভুত লোকটা তো তাঁর নামও জেনে ফেলেছে।বাড়িতে ঢুকতে না ঢুকতেই গোয়েন্দাগিরি শুরু করে দিয়েছে নাকি।
এবার লতিফা চাচীর গলা শুনা গেল,

‘ যূথী এবার অনার্সে উঠল।পড়ালেখা করার বড্ড শখ মেয়েটার।ভেবেছিলাম শহরে রেখে পড়াব।কিন্তু সে আমার থেকে দূরে যেতে চায়নি।’

‘ যূথীর বাবা মা….’

‘ নেই।ছোটবেলায় মা মারা গেছে।তারপর বাবা যে কোথায় গেল আর ফিরে আসেনি।সেই থেকে মেয়েটা আমাদের কাছেই থাকে।’

বাবা মা’য়ের কথা মনে পড়ায় একটু মন খারাপ হলো যূথীর।তবে এটা সাময়িক।মা’য়ের চেহারা ওর মনে পরে না।এখন তাঁর কাছে এই পরিবারটিই একমাত্র আপন।নিজের মেয়ের মত তাঁকে বড় করেছে।কখনো বুঝতেই দেয়নি যে যূথী বাইরের কেউ।

‘ যূথীকে কয়েকদিন একটু সাবধানে থাকতে হবে খালামণি।ও কিন্তু খুন হতে দেখেছে।যূথী বলেছে জ্ঞান হারানোর সময় সে চিৎকার দিয়েছিল।তাহলে এটা স্পষ্ট যে খুনি যূথীকে চিনে নিয়েছে।’

‘ কি বলছিস নিশান!এখন কি হবে?’

‘ চিন্তা করো না।খুনী খুব তাড়াতাড়ি ধরা পড়বে।আমাকে পানি দাও তো খালামণি।’

‘ ওহ্ দেখলি পানি আনতে মনে নেই।যূথী নিশানের জন্য পানি নিয়ে আয়।রান্নাঘরে গ্লাসে পানি রাখা আছে।’

চাচীর চিৎকার শুনে দরজার পাশ থেকে সরে এল যূথী।নিশানের কথা শুনে মনের ভেতর ভয় জন্ম নিল।আবার নিজের উপর রাগ হচ্ছে প্রচুর।গ্রামে এত মানুষ থাকতে একমাত্র সে-ই খুন হতে দেখল!

যূথী পানির গ্লাস নিয়ে ড্রয়িংরুমে ঢুকল।আড়চোখে দেখল নিশান সোফায় বসে চপ খাচ্ছে।
পাশের রুম থেকে ফোনের আওয়াজ পেতেই লতিফা বেগম উঠে চলে গেলেন।যূথী সোফার কিনারায় দাঁড়িয়ে অনামিকা আঙুলে উড়না পেঁচিয়ে চলেছে।কিছু একটা বলতে গিয়েও বলতে পারছে না।নিশান ব্যাপারটা খেয়াল করে জিজ্ঞেস করল,

‘ কিছু বলবে কি?’

যূথী উপর নিচে মাথা নাড়ল।

‘ তাহলে বলো!হেসিটেট করছো কেনো?’

‘ হেসিটেট করার মত ব্যাপার তাই হেসিটেট করছি।হুহ্!’

‘ আরে কুল কুল রেগে যাচ্ছো কেনো?যা বলবে ধীরেসুস্থে বলো।’

যূথী ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে সামনের চেয়ারে বসে পড়ল।প্লেট থেকে একটা চপ তুলে নিয়ে মুখে পুরে দিল।চোখের কোনা দিয়ে নিশানকে একবার দেখে নিয়ে বলল,

‘ এখান থেকে চপ খেয়েছি বলে কিছু মনে করবেন না আবার।আমি কষ্ট করে বানিয়েছি তাই অন্তত একটা তো খেতেই পারি তাই না?’

নিশান শান্ত ভঙ্গিতে যূথীর কর্মকান্ড দেখে যাচ্ছে।মৃদু হেসে বলল,

‘ তুমি চাইলে আরো একটা খেতে পারো।’

‘ কোনো প্রয়োজন নেই।পরে ভাববেন মেয়েটা একটা খাদক।যাই হোক যেটা বলতে এসেছি সেটা হলো তখন আমি আপনাকে আমি চিনতে পারি নি।তাই কি না কি বলে ফেলেছি।যতই আপনি আপনার দরকারে এই গ্রামে আসুুন আপনি তো এই বাড়ির অতিথি।ওরকম চিল্লিয়ে কথা বলা উচিত হয় নি।এরজন্য দুঃখ প্রকাশ করছি আমি।’

‘ তুমি আমার পরিচয় জানতে পেরেছো বলে দুঃখ প্রকাশ করছো।পরিচয় জানতে না পারলে কি করতে?’

‘ জানতে না পারলে আপনার উপর আরো রাগ ঝাড়তাম। কারণ আপনি অপমান করেছেন আমায়।কেউ আমাকে অপমান করলে আমি তা সহজে ভুলি না।’

‘ আচ্ছা। ধরলাম আমি তোমায় অপমান করেছি।সেকারণে তুমি আমার সাথে চিল্লিয়ে কথা বলেছো।তাহলে তো সমান সমান হলো ব্যাপারটা তাই না?তাহলে শুধু শুধু কেনো দুঃখ প্রকাশ করছো?’

যূথীর মুখ ঝুলে পড়ল।এটা তো ভেবেই দেখেনি।আগ বাড়িয়ে নিজেকে বুদ্ধু প্রমাণ করে ফেলল সে।এখন তো লোকটা ভাববে মেয়েটা কতটা বোকা,কতটা গাধী।নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,

‘ তাতে কি! দুঃখ প্রকাশ করলে কেউ ছোট হয়ে যায় না।এই যে তখনের ব্যাপারটা সমান সমান হওয়ার পরেও আমি নিজে থেকে এসে দুঃখ প্রকাশ করেছি এতে কিন্তু আমি আপনার থেকে অনেক উপরে উঠে গেছি।’

নিশান শরীর দুলিয়ে হেসে উঠল।যূথী মুখ বাঁকা করে বসে আছে।লোকটার সামনে সে কিছুতেই নিজেকে বোকা প্রমাণ করবে না।লোকটাকে বুঝাতে এবং জানাতে হবে যে যূথী কি পরিমাণ সাহসী এবং চালাক।গলা পরিষ্কার করে আবার বলল,

‘ শুনুন আমি খুন হতে দেখেছি আর এতে কিছুটা ভয় পেয়েছি বলে অজ্ঞান হয়ে গেছিলাম।আমার জায়গায় যদি অন্য কেউ থাকত তাহলে ভয়ের চোটে এতক্ষণে পগারপার হয়ে যেত।আরো একটা কথা। খুনি আমাকে দেখেছে তো কি হয়েছে?সে কি করবে আমার?আমাকে কেনো সাবধানে থাকতে হবে?দেখুন গিয়ে পুলিশের ভয়ে সে হয়তোবা গা ঢাকা দিয়ে দেশ ছেড়ে চলে গেছে।’

নিশান এবার সামনের দিকে কিছুটা ঝুঁকে এসে জিজ্ঞেস করল,

‘ আমি যে সাবধানে থাকার কথা বলেছিলাম এটা তুমি কিভাবে জানলে?দরজার পাশে দাঁড়িয়ে কথা শুনছিলে নাকি?’

যূথী মুখের ভেতর দাঁত কিড়মিড় করে উঠল।নিজের কথার জালে নিজেই ফেঁসে যাচ্ছে। আজ এমন হচ্ছে কেনো?

‘ আপনি আমাকে কি ভাবেন হুম?আমার আর খেয়েদেয়ে কাজ নেই যে আমি আপনার কথা শোনার জন্য আঁড়ি পেতে থাকব?’

‘ কিন্তু আমি যে পর্দার ফাঁকে তোমার উড়না দেখেছিলাম!’

যূথী শক্ত মুখ করে উঠে দাঁড়াল।নিশানের জন্য আনা পানির গ্লাসটা একচুমুকে নিঃশেষ করে দিল।নাশতার খালি প্লেট নিয়ে পাশের রুমে যাওয়ার সময় আবার পেছন ফিরে বলল,

‘ বেশ করেছি কথা শুনেছি।আমার বাড়ি আমার ঘর আমি যা ইচ্ছা করব।আর হ্যাঁ পানির গ্লাস তো আমি খালি করে দিলাম।কষ্ট করে পানি এনেছি তার জন্য একটু পানি তো খেতেই পারি তাই না?আপনি ডাইনিং টেবিল থেকে পানি খেয়ে আসুন।’

ধুপধাপ পা ফেলে যূথী পর্দা ঠেলে ভেতরের রুমে ঢুকে গেল।নিশান নিঃশব্দে হাসছে।
হাত উঁচিয়ে ঘড়িতে টাইম দেখে নিয়ে উঠে দাঁড়াল।একটা জরুরি কাজে তাঁকে পুলিশের সাথে দেখা করতে লোকাল থানায় যেতে হবে।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here