#প্রিয়দর্শিনী
#সামান্তা_সিমি
#পর্ব_৪
🍁
পরদিন সকাল হতে হতে আরো দুজন ছেলে এসে উপস্থিত হলো যূথীদের বাড়িতে।
যূথী সকালে ঘুম থেকে উঠে বারান্দায় দাঁড়িয়ে পায়রা দুটোকে খাবার দিচ্ছিল।তখনই দেখতে পেল চিরপরিচিত পুলিশের একটি জীপগাড়ি মাঝ উঠোনে এসে থামল।একজন পুলিশ এবং দুটো ছেলে নামল গাড়ি থেকে।ছেলে দুটোর পোশাক বেশ ফিটফাট।একদম ওই নিশান নামক লোকটার মত।দেখলেই বুঝা যায় ওরা শহরের মানুষ।যূথী গেইটের আড়ালে দাঁড়িয়ে সবটা পর্যবেক্ষণ করছিল।
কয়েক সেকেন্ডের মাথায় নিশানও বেরিয়ে আসল।ওঁরা নিচু স্বরে কিছু একটা নিয়ে কথা বলছে।
যূথী নিজের মনে বিড়বিড় করছে,
‘ বুদ্ধিমান লোকটা তো এখন তাঁর দলবল নিয়ে হাজির হয়েছে।কতদিন থাকবে কে জানে।’
.
সকালের নাস্তা বানানোয় যূথী চাচীকে টুকটাক সাহায্য করল।তারপর চলে গেল কলেজের জন্য তৈরি হতে।শেফালী তাঁর জন্য রাস্তার মোড়ে অপেক্ষা করবে।দেরি হয়ে গেলে আবার ওর ঘ্যানঘ্যান শুরু হয়ে যাবে।
নাস্তা শেষে ব্যাগ কাঁধে ঝুলিয়ে বেরিয়ে পড়ল যূথী।উঠোনে নেমে একবার নিশানদের ঘরের দিকে তাকাল।এখান থেকে দেখা যাচ্ছে দরজা খোলা।কিন্তু মানুষজন কই?সব চিন্তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলে যূথী রাস্তার দিকে পা বাড়াল।কিছুটা যেতেই পেছন থেকে কেউ ডেকে উঠল,
‘ যূথী! ‘
দাঁড়িয়ে পড়ল সে।এটা তো বুদ্ধিমান লোকটার গলা।এতক্ষণ তো এখানে ছিল না হঠাৎ কোন গুহা থেকে উদয় হলো?
যূথী পেছন ফেরে ভ্রু নাচিয়ে জিজ্ঞেস করল,
‘ কি?’
নিশান গেইট পার করে বেরিয়ে আসলো।সেদিকে তাকাতেই যূথীর হার্ট জোরে বিট করে উঠল।লোকটার চোখগুলো হালকা ফোলা।মাথার চুল কিছুটা এলোমেলো। বোধ হয় ঘুম থেকে উঠে আসার কারণে এমন দেখাচ্ছে। কিন্তু এই রূপ দেখে যূথীর মাথা ভনভন করছে।এত হ্যান্ডসাম একটা ছেলে তাঁর বাড়িতে আছে এটা ভাবলেই গর্ববোধ হয়।বান্ধবীদের সাথে এই লোকটার কথা আলোচনা করে উচ্চ পর্যায়ের ভাব দেখানো যাবে।
নিশান এগিয়ে এসে বলল,
‘ কলেজে একা যাচ্ছো?’
‘ আমার বান্ধবী শেফালী যাবে।কেনো?’
‘ তোমাকে বলেছিলাম কিছুদিন সাবধানে…. ‘
‘ আপনি কি বলতে চাইছেন খুনির ভয়ে আমি এখন সৈন্য সামন্ত নিয়ে বাড়ি থেকে বের হব?’
‘ সামন্ত নিয়ে যেতে তো বলছি না।তুমি ওয়েট করো। আমিই কলেজে দিয়ে আসব তোমায়।’
‘ কোনো প্রয়োজন নেই।আমরা একাই যেতে পারব।’
নিশানকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে যূথী চুলের বেনী দুলাতে দুলাতে চলে গেল।নিশান চোয়াল শক্ত করে সেদিকে তাকিয়ে আছে।মাথার ভেতর রাগ চিড়বিড় করে উঠছে।মেয়েটাকে কষিয়ে দুটো থাপ্পড় দিতে পারলে রাগটা আপনাতেই কমে যেত।আর যাই হোক তাঁর কথা কেউ অমান্য করলে সেটা একদমই সহ্য হয় না।এইটুকুন একটা মেয়ে তাঁর কথা কেনো অমান্য করবে?
দেখতে দেখতে যূথী চোখের আড়াল হয়ে গেল।ভুলেও যদি সে একবার পেছন ফিরে তাকাত নিশানের লাল চোখগুলো সরাসরি দর্শন করতে পারত।
খোকনদের বাড়ির পুকুরের সামনে শেফালীকে পাওয়া গেল।যূথীকে দেখতে পেয়ে চিৎকার দিয়ে দৌড়ে আসল।ওর চেহারায় খুশি উপচে পড়ছে।
যূথী বিরক্ত হয়ে বলল,
‘ ছাগলের মত চিৎকার করছিস কেনো?এত খুশি হওয়ার কারণ কি?বিয়ে ঠিক হয়েছে নাকি?’
শেফালী এবার দুই পাটির দাঁত বের করে হাসল।
‘ ওই মাসল ম্যান তোদের বাড়িতেই উঠেছে তাই না?’
যূথী নিমিষেই বুঝে গেল শেফালী কার কথা বলছে।সবাই তাহলে জেনে গেছে লোকটার কথা।যূথী এবার ঘাড় উঁচু করে ভাব নিল।
‘ হ্যাঁ।শুধু তাই নয়।নীলুফা চাচীকে চিনিস তো?ওই যে গতবছর এসেছিল এখানে।ওই মাসল ম্যান নীলুফা চাচীর বড় ছেলে।এই প্রথমবার আমাদের বাড়ি এসেছে।’
‘ সত্যি!! তোর এত হ্যান্ডসাম এক ভাই আছে এটা তুই নিজেও জানিস না?শোন না আমি কালকে উনাকে দেখেছি রাস্তায়।বোধ হয় তোদের বাড়িতেই যাচ্ছিল তখন।উনাকে দেখলাম গাড়ি ড্রাইভ করছে।আমি একেবারে মুগ্ধ হয়ে গেলাম।’
যূথী শেফালীর মাথায় বড়সড় একটা চাটি মেরে বলল,
‘ তোকে কে বলেছে উনি আমার ভাই?আমি এখনো উনাকে ভাইয়া বলে ডাকিনি আর তুই ভাই বানিয়ে দিচ্ছিস? ‘
‘ কি আশ্চর্য! আমি ভাই বানাতে যাব কেনো?উনি তো ইতিমধ্যে তোর ভাইয়ের আসনে বসে আছে।সজীবের আপন খালাতো ভাই উনি।সেই হিসেবে তোরও তো ভাই নাকি।কথায় কথায় মাথায় চাটি মারিস কেনো।ভালো লাগে না কিন্তু। ‘
শেফালী মুখ ফুলিয়ে হাঁটা দিল।যূথী ভাবছে সত্যিই তো ওই লোকটা তাঁর ভাই হয়।তাহলে এখনো পর্যন্ত ভাই বলে ডাকেনি কেনো?
_________________________________
বিকেলের সোনালি রোদ ছুঁয়ে দিচ্ছে সদ্য গজে উঠা ধানের চারাগুলোকে।সমস্ত আকাশ জুড়ে এক অন্যরকম সৌন্দর্য বিরাজমান।হালকা ঝিরিঝিরি বাতাসে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা খেজুর গাছের পাতাগুলো দুলে উঠছে।খোলা মাঠে চড়ে বেড়াচ্ছে কারো বাড়ির পোষা গরু।ঝোপঝাড়ের আনাচেকানাচে লাল ঝুটিওয়ালা মোরগও নজরে আসছে।
অপরূপ সুন্দর এই দৃশ্য যেন শিল্পীর হাতে তুলিতে আঁকা।
উঁচুনিচু মাটির রাস্তার পথ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে উনিশ কি বিশ বছরের দুজন প্রানবন্ত কন্যা।বাতাসে তাঁদের লম্বা বেনী দুলছে।দুজনই কথা বলছে উচ্ছ্বসিত কন্ঠে।
‘ যূথী তুই শহরে চলে যাস না কেনো?ওখানে ভালো কোনো ভার্সিটিতে ভর্তি হয়ে গেলেই তো পারিস।গ্রাম থেকে শহর কত উন্নত।তোর চাচী তো অনেকবার বলেছিল।’
শেফালীর কথায় মুচকি হাসল যূথী।হাতে থাকা লম্বা শুকনো গাছের ডাল টা দুলাতে দুলাতে বলল,
‘ শহরে গেলে দম বন্ধ হয়ে মারা যাব আমি।আমার জন্ম হয়েছে এখানে।এই গ্রাম ছেড়ে, তোদের ছেড়ে শহরে যাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়।’
‘ কিন্তু তোর তো পড়ালেখা করার খুব শখ।অত খারাপ ছাত্রীও না তুই।শহরে গিয়ে পড়ালেখা করলে আরো অনেক কিছু জানতে পারবি।অনেক অভিজ্ঞতা হবে।’
‘ আরে রাখ্ তোর অভিজ্ঞতা। ধুলোবালি মাখা শহরে আমি যেতে চাই না।এই দেখ এখানে মাটির গন্ধ শরীর মন দুটোকেই চাঙ্গা করে দেয়।এসব আমি শহরে পাব কোথায়?’
এই বলে যূথী চোখ বুজে লম্বা একটা শ্বাস নিল।হঠাৎই শেফালী যূথীর হাত টেনে বলে উঠল,
‘ দেখ দেখ কারা আসছে!’
শেফালীর দৃষ্টি লক্ষ্য করে যূথী সেদিকে তাকাল।নিশান এবং তাঁর সাথের ছেলে দুজন হেঁটে এদিকেই আসছে।নিশানকে দেখে যূথী ঠোঁট কামড়ে হাসল।ওই লোকটার রূপের ছটায় সে বারবার অভিভূত হয়ে যাচ্ছে। গায়ে ক্রিম কালার শার্টে কি উজ্জ্বল দেখাচ্ছে। পরনে কালো প্যান্ট।আবার হাতে ঘড়িও পড়েছে।পাশের ছেলে দুজনকে হাত নাড়িয়ে কপাল কুঁচকে কি যেন বুঝাচ্ছে।
শেফালী যূথীকে ধাক্কা মেরে বলল,
‘ তোর কি হলো?আর মাসল ম্যানের সাথে দুজন ছেলে দেখা যাচ্ছে ওঁরা কারা?ওদের কথা তো তুই বলিস নি!’
‘ মারব এক চড়।যেভাবে বলছিস মনে হয় যেন উনাদের সকল আপডেট খবর তোর কাছে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব নিয়েছি আমি!ছেলে দুটো বোধ হয় উনার মতই ইনভেস্টিগেট করতে এসেছে এখানে।আজ সকালেই ওদের দেখলাম।’
‘ যূথী রে.. বাকি দুজন ছেলেও তো কি ঝাকানাকা। শহরের ছেলেদের গেট আপ থাকে অন্যরকম।দেখলেই বুঝা যায় ওঁরা শহর থেকে নেমে এসেছে।আমাদের গ্রামে এমন রাজকুমারের মত ছেলে বিগত কয়েক বছরেও বোধ হয় পা রাখেনি।’
‘ ঠিক বলেছিস।আমাদের এখানের ছেলেদের দিকে একবার তাকালে দ্বিতীয়বার তাকাতে ইচ্ছে করে না।সারাদিন লুঙ্গি পরে গলায় গামছা ঝুলিয়ে ঘুরে বেড়ায়।রাস্তায় দেখা হলে উঁচু দাঁত বের করে হাসে।কি যে বিরক্ত লাগে।আর ওদের দেখ্!কি সুন্দর ঝকঝকে পোশাক।’
.
নিশান হিমেশ এবং অনিকের সাথে কথা বলতে বলতে এগিয়ে আসছে।ওঁরা আজ সারাদিন প্রচুর ব্যস্ত ছিল।নানান জায়গায় ইনভেস্টিগেশনের জন্য যেতে হয়েছে।দুপুরের খাবারটাও ঠিকমতো খেতে পারেনি।খুনের বিষয়টা নিয়ে কিছুটা হিন্টস পেয়েছে।তবে আরো কয়েকদিন সময় লাগবে।
যূথীকে মাঝ রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে থমকে গেল নিশান।মেয়েটা এই সময় নিরিবিলি রাস্তায় কি করছে?বারবার না করা সত্বেও সারাদিন এখানে সেখানে ঘুরে বেড়াচ্ছে কেনো?
যূথী নিশানকে না দেখার ভান করে শেফালীর সাথে হেসে হেসে গল্প করছে।তখনই নিশান সরাসরি বলে উঠল,
‘ বাড়ি যাও যূথী।’
যূথী ভ্রু কুঁচকে তাকালো।নিশানের এমন কড়া নির্দেশ শুনে বেশ অবাক হচ্ছে। পেছনের লম্বা বেনীটাকে সামনে এনে বলল,
‘ কেনো?আমরা তো প্রতিদিন এমন সময়ে হাঁটতে বের হই।দেখুন কি সুন্দর শান্ত পরিবেশ।’
‘ যূথী কিছুক্ষণ পর সন্ধ্যা নামবে।তুমি বাড়ি যাও।’
‘ আরেহ্! সন্ধ্যা নামবে আমিও তো জানি।তাতে কি হয়েছে?’
নিশানের মাথার ভেতরের সুপ্ত রাগ নাড়াচাড়া দিয়ে জেগে উঠতে চাইছে।ঘাড়ত্যাড়া মেয়েটা থাপ্পড় না খেলে ঠিক হবে না।
কোনোরকমে নিজেকে সামলে শক্ত গলায় বলল,
‘ তোমাকে বাড়ি যেতে বলেছি তুমি বাড়ি যাবে।রাইট নাউ!আর একটা কথাও নয়।’
নিশানের ধমক শুনে যূথী ভয় পেল কিছুটা।চোখের দিকে তাকিয়ে থাকতে না পেরে দৃষ্টি অন্যদিকে ফিরিয়ে নিল।
যূথীকে অবাক করে দিয়ে নিশান আবারো গলা কাঁপিয়ে বলে উঠল,
‘ আই টোল্ড ইউ টু গো হোম যূথী!’
যূথী আর এক সেকেন্ডও দেরি না করে শেফালীর হাত ধরে বাড়ির রাস্তায় পা চালাল।
নিশান বড় বড় করে নিঃশ্বাস ফেলে নিজেকে শান্ত রাখার চেষ্টা করছে।পাশ থেকে অনিক বলল,
‘ স্যার এই মেয়ে তো ভীষণ ঘাড়ত্যাড়া। ‘
নিশান কোনো উত্তর না দিয়ে সামনের দিকে হাঁটা দিল।
চলবে…
#প্রিয়দর্শিনী
#সামান্তা_সিমি
#পর্ব_৫
🍁
ভোরবেলায় কিছু একটা শব্দ শুনে জেগে উঠল যূথী।চোখ মেলে উঠে বসতেই বুঝতে পারল বাইরে তুমুল বেগে বর্ষণ হচ্ছে।টিনের চালে বৃষ্টির ঝমঝম শব্দে অদ্ভুত এক সুর বাজছে।আলস্যে ভরা হাই তুলল যূথী।বৃষ্টি হলে ঘুমটা আরো জম্পেশ হবে।বৃষ্টির যে নমুনা তাতে নিশ্চিত রাস্তায় হাঁটু পরিমাণ কাদা হবে।আজ আর কলেজ যাওয়া হবে না।তাই এখন আরামসে একটা সুখের ঘুম দেওয়াই যায়।
বালিশে মাথা রাখতেই আবার লাফ দিয়ে উঠে বসল।এক ছুটে চলে এল বারান্দায়। যা ভেবেছিল তাই।পায়রার খাঁচাটা একদম গ্রিলের সাথে লেগে আছে যেকারণে বৃষ্টির ছাঁট এসে ওদের গায়ে লাগছে।ওদের অর্ধেক শরীর প্রায় ভেজা।যূথী অতি সন্তর্পণে খাঁচাটা ফ্লোরে নামিয়ে রাখল।তখনি পায়রা দুটো চাপা স্বরে ডেকে উঠল
যূথী কল্পনায় ভাবছে ওরা নিজেদের ভাষায় যূথীকে বকাবকি করছে।কেনো সে এমন দায়িত্ব জ্ঞানহীনের মত কাজ করল?ওর ভুলের কারণে এই সাতসকালে বৃষ্টির পানিতে গোসল করতে হলো ওদের।
মুচকি হেসে উঠে দাঁড়াল যূথী।উঠোনে ভালোই পানি জমেছে।আকাশে মাঝেমধ্যে বিদুৎ চমকাচ্ছে। সাথে দমকা শীতল বাতাস।চারিদকে এখনো ভালোকরে আলো ফুটেনি।কেনো জানি যূথীর ঘুমের রেশ কেটে গেল।এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে খুব ভালো লাগছে।ভোরবেলায় বৃষ্টি দেখায় এত আনন্দ তা তো জানা ছিল না।বারান্দার গ্রিল ঘেঁষে দাঁড়িয়ে পড়ল সে।গুনগুন করে গেয়ে উঠল,
‘ আকাশ এত মেঘলা যেও নাকো একলা…’
.
কিছুক্ষণের মধ্যেই বৃষ্টির বেগ কিছুটা কমে আসলো।তবে আকাশে এখনো কালো মেঘ।যূথী গেইট খুলে বাইরে বেরিয়ে আসল।মাটিতে পা রাখতেই অর্ধেক ডুবে গেল।ঠান্ডা পানিতে তাঁর পা হালকা শিরশির করে উঠছে।এক পা এক পা করে মাঝ উঠোনে চলে আসলো সে।রাস্তায় আজ কোনো মানুষজন দেখা যাচ্ছে না।অন্যদিন এই ভোরবেলাতেও দুয়েকজনের আনাগোনা থাকত।কেউ সবজি নিয়ে বাজারের পথে যেত আবার কারো মাথায় পানের বোঝা।আজ বোধ হয় ওরা বৃষ্টির কারণে আটকা পড়েছে।
রাস্তার দিকে তাকিয়ে যখন সে আকাশকুসুম ভাবছে ঠিক তখনই কেউ পেছন থেকে ওর মুখ চেপে ধরল।ঘটনা এত দ্রুত ঘটল যে যূথী চিৎকার দেওয়ার সুযোগটাও পেল না।ভয়ের চোটে সে লাফালাফি শুরু করে দিল।কিন্তু এতে করে পেছনের অজানা ব্যক্তি আরো চেপে ধরল তাঁকে।ব্যথার কারণে ওর চোখে পানি এসে গেছে।কে বা কারা তাঁর সাথে এমন করছে এটা সে এই মুহুর্তে ভাবতে পারছে না।মাথায় শুধু নিশানের বলা একটা লাইন ঘুরছে-‘তোমাকে কয়েকদিন সাবধানে থাকতে হবে।’
অজানা ব্যক্তিটি তাঁকে টানতে টানতে রাস্তার দিকে নিয়ে যাচ্ছে। চিৎকার দেওয়ার চেষ্টা করেও পারছে না সে।টলমলে চোখে বারবার নিশানের ঘরের দিকে তাকানোর চেষ্টা করছে।কোথায় তিনি?উনি কি তাঁকে বাঁচাতে আসবে না?
যূথী বোধ শক্তি না হারিয়ে গায়ের সবটুকু জোর প্রয়োগ করে লোকটার হাতে জোরে কামড় বসাল।আর এতে হাত কিছুটা আলগা হওয়ার সাথে সাথেই সে চিৎকার করে উঠল।কিন্তু লোকটি পুনরায় তাঁর মুখ চেপে ধরে হিড়হিড় করে টেনে নিতে শুরু করল।
যূথী সব আশা ছেড়ে দিয়েছে।নিশ্চয়ই আজ খারাপ কিছু হবে তাঁর সাথে।হয়তোবা ওরা তাঁকে মেরেও ফেলতে পারে।যূথীর বুক ভেঙে কান্না নেমে আসছে।কিন্তু মুখে টু শব্দও করতে পারছে না।
হঠাৎ তাঁর চোখের পলকে আশ্চর্যজনক এক ঘটনা ঘটল।এবারও এটা এত তাড়াতাড়ি হলো যে সে কিছুই বুঝতে পারল না।শুধু দেখলো যে লোকটা এতক্ষণ তাঁর মুখ চেপে ধরেছিল সে হুমড়ি খেয়ে লুটিয়ে পড়ল কাদাজলে।যূথীর গাল দুটো ব্যথায় টনটন করছে।তবুও সে তাকিয়ে রইল যন্ত্রণায় কুঁকড়ে উঠা লোকটার দিকে।সমস্ত মুখে গামছা পেঁচানো,হাতে চকচকে ছুড়ি নিয়ে কুচকুচে কালো শরীরের লোকটা উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে।
তখনই কেউ একজন যূথীর কবজি টেনে পেছনের দিকে নিয়ে গেল।যূথী গিয়ে পড়ল সেই লোকটার বুকের উপর।মাথা তুলে তাকাতে দেখতে পেল সেই প্রতীক্ষিত মুখ।
সেটা নিশান ছাড়া আর কেউ নয়।যূথী অপলক তাকিয়ে রইল নিশানের দিকে।বৃষ্টির পবিত্র ফোঁটা ছুয়ে দিচ্ছে লোকটার চোখ নাক মুখ।গালের চাপদাঁড়ি বৃষ্টির ফোঁটায় সিক্ত হয়ে উঠছে।কপালে পড়ে থাকা চুলগুলো বাতাসের সাথে উড়তে চাইছে।চোখগুলো ভীষণ ফুলে আছে।চোখের রগ গুলো লালে লাল। যূথীর দুনিয়ার আর কোনোদিকে খেয়াল নেই।সে যেন নিশানের চেহারায় ডুবে গেছে।এই মুহূর্তে সে লেপ্টে আছে নিশানের বুকে।কিন্তু নিশানের নজর যূথীর দিকে নয়।সে তাকিয়ে আছে সামনের কুৎসিত ধরনের ব্যক্তিটির দিকে যে এতক্ষণ যূথীকে টানতে টানতে নিয়ে যাচ্ছিল।লোকটার দিকে রিভলবার তাক করে নিশান বলল,
‘ হাতের ছুড়িটা ফেল্। ‘
লোকটি ছুড়ি ফেলল না।বরং তা উঁচিয়ে ধরে আরেকটু সামনে এগিয়ে আসলো।
নিশান যূথীকে একহাত দিয়ে আরেকটু আগলে নিল।
চোখ রাঙিয়ে বলল,
‘ এই বাড়িতে এসে মেয়েটার গায়ে হাত দিয়ে তুই এমনিতেই অনেক সাহস দেখিয়ে ফেলেছিস।আর সাহস দেখাবি তো জানে মারা যাবি।ওখানেই থেমে যা নাহলে….’
নিশান কথা শেষ করার আগেই আরো দুজন লোক চলে আসলো।ওদের মুখেও গামছা বাঁধা।দুজনের হাতে তীক্ষ্ণ ছুড়ির ফলা চিকচিক করছে।নিশান একটুও দমে না গিয়ে বলল,
‘ গুড জব।এই মেয়েটাকেই মারতে এসেছিস তাই না?ওকে কাম!সাহস থাকলে ছুয়ে দেখা।’
তখনি হিমেশ এবং অনিক ছুটে আসল।ওদের হাতে রিভলবার।ওরা দুজন পেছন থেকে এসে রিভলবার তাক করল।যদিও ওদের রিভলবারে গুলি নেই।কিন্তু ক্রিমিনাল গুলোকে ভয় দেখানো এখন মুখ্য বিষয়।কেউ কিছু বুঝে উঠার আগে আরো একটা ঘটনা ঘটে গেল।হিমেশ এবং অনিকের পেটে প্রচন্ড দুটো ঘুষি বসিয়ে দুজন ক্রিমিনাল দৌড় দিল রাস্তার দিকে।বাকি আরেকজনও ওদের অনুসরণ করল।অনিক ব্যথায় চোখমুখ কুঁচকে ফেলছে।হিমেশ কোনমতে ওকে সাহায্য করে রাস্তার দিকে যেতে নিলে নিশান বলে উঠল,
‘ ওদের পেছনে গিয়েও লাভ হবে না।ধরতে পারবে না।’
হিমেশ এবং অনিক সায় দিল।এবার নিশান দৃষ্টি নিক্ষেপ করল তাঁর বুকে সেঁটে থাকা যূথীর দিকে।মেয়েটা চোখ খিঁচে বন্ধ করে ওর শার্ট খামচে ধরে আছে।কোনোকিছু না ভেবে নিশান জোরে এক ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিল যূথীকে।যূথী পড়তে পড়তে সামলে নিল নিজেকে।অবাক হয়ে দেখছে নিশানকে।এমন আচরণ করার কারণটা সে বুঝতে পারছে না।
নিশান দাঁত কটমট করে ধমকিয়ে উঠল,
‘ থাপড়িয়ে গাল ফাটিয়ে দেব বেয়াদপ মেয়ে কোথাকার! কথা কানে যায় না তোমার?এই মেয়ে চুপ করে আছো কেনো?আমি যে বলেছিলাম কয়েকটা দিন কেয়ারফুলি থাকতে সেটা গায়ে লাগে নি তাই না?ভোরবেলায় তুমি উঠোনে কি করছো?কে আসতে বলেছে তোমায় এখানে?’
যূথী একরাশ বিস্ময়তা নিয়ে এই প্রথম বলে উঠল,
‘ নিশান ভাইয়া…!’
‘ সাট আপ! তুমি এক্ষুনি আমার সামনে থেকে যাও।তুমি যতক্ষণ আমার সামনে থাকবে আমার রাগ বেড়েই চলবে।আমার হাতও উঠে যেতে পারে তোমার উপর।যাও এখান থেকে। ‘
যূথীর মাথা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে।সুদর্শন এই লোকটির এমন ভয়ানক রূপও আছে এটা সে কল্পনাও করেনি।এই মুহূর্তে নিশান ভাইয়ার চেহারায় সেই অনিন্দ্য সুন্দর রূপ কোথায় যেন গায়েব হয়ে গেছে।সেই চেহারায় এখন বিরাজ করছে ভয়াবহ রাগ।
না চাইতেও যূথীর চোখের কোণে পানি এসে ভিড় করছে।ভাগ্যিস বৃষ্টির কারণে সেই পানি কেউ দেখতে পাচ্ছে না।সে জানে মারাত্মক একটা ভুল করে ফেলেছে।নিশান ভাইয়ার কথা মানা উচিত ছিল তাঁর।সেই হিসেবে নিশান ভাইয়ার ধমক দেওয়া স্বাভাবিক।কিন্তু তাঁর এত কষ্ট হচ্ছে কেনো?কেউ তাঁকে কখনো এভাবে বেয়াদপ বলে ধমক দেয়নি এই কারণে নাকি অন্যকোনো কারণ?
যূথী যন্ত্রের মত পা ফেলে ঘরের দিকে এগিয়ে গেল।
নিশানও আর এক মুহুর্ত দেরি না করে বড় বড় কদম ফেলে চলে গেল ঘরে।হিমেশ এবং অনিক নিশানের পানে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল।
চারদিকে ফর্সা হতে শুরু করেছে।খোয়ারে থাকা মুরগি গুলো বেরিয়ে আসার জন্য ডাকাডাকি করছে।নেড়ি কুকুরটা এতক্ষণ নারকেল গাছের গোড়ায় আশ্রয় নিয়েছিল।বৃষ্টি কমে আসাতে নেমে এল উঠোনে।
_____________________________
সকালে লতিফা বেগম পরোটা বানাচ্ছে। যূথী টুকটাক সাহায্য করছে চাচীকে।যূথীর চেহারা মনমরা।চোখগুলো মলিন।তাঁর ইচ্ছে করছে সব ফেলে দিয়ে নিজের রুমে দরজা বন্ধ করে বসে থাকে।তাঁর সহজে মন খারাপ হয় না।সবসময়ই সে প্রানবন্ত,উচ্ছ্বল।কিন্তু যখন মন খারাপ হয় তখন মরে যেতে ইচ্ছে করে।সেই মন ভালো হতে বেশ কয়েকদিন কেটে যায়।আজ যূথীর তেমন একটি দিন।
লতিফা বেগম যূথীকে এটা সেটা বলে যাচ্ছেন কিন্তু কোনো উত্তর পাচ্ছেন না।প্রথমে খেয়াল না করলেও এবার পরোটা বানানো বন্ধ করে বললেন,
‘ কিরে চুপ করে আছিস কেনো?’
যূথী চাচীর দিকে না তাকিয়ে নিজের মনে পেঁয়াজ কাঁটতে লাগল।লতিফা বেগম যূথীর হাত টেনে উনার দিকে ফিরিয়ে নিলেন।যূথীর চোখে পানি টলমল করছে।নাকের ডগা লাল হয়ে আছে।
‘ একি অবস্থা চেহারার!পেঁয়াজ কাটতে কষ্ট হচ্ছে আমাকে বললেই পারতি।আর কাটতে হবে না যা।বাকিটা আমি করে নিব।’
চাচীর থেকে হাত ছুটিয়ে যূথী পুনরায় পেঁয়াজ কাটতে শুরু করল।লতিফা বেগম যূথীর চিবুকে হাত দিয়ে বললেন,
‘ কি হয়েছে তোর?মন খারাপ কেনো?কেউ কিছু বলেছে?’
লতিফা বেগমকে অবাক করে দিয়ে যূথী এবার ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।কান্নার কারণে চোখের সামনে সবকিছু ঝাপসা হয়ে আসছে।তাই পেঁয়াজ কাটা থামিয়ে কাঁদতে থাকল।
লতিফা চাচী অস্থির কন্ঠে বলতে বলতে লাগলেন,
‘ তুই এতক্ষণ তাহলে কাঁদছিলি?আমি ভাবলাম পেঁয়াজ কাটার কারণে চোখে পানি এসেছে।কি হয়েছে বল আমায়?কাঁদছিস কেনো?’
যূথী হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখের পানি মুছে ভোরবেলার সমস্ত ঘটনা বলে দিল।লতিফা বেগম হতভম্ব।তাঁর বাড়ির উঠোনে এমন এক ভয়াবহ ঘটনা ঘটে গেছে অথচ তিনি টেরও পেলেন না।নিশান এবং তাঁর সাথের ছেলে দুটো না থাকলে আজ কি হত!ভাবলেই গায়ে কাটা দেয়।
যূথীকে জড়িয়ে ধরে বললেন,
‘ কেনো তুই ভোরবেলা বাইরে গেলি বলতো!নিশান তো সেদিনই বলেছিল সাবধানে থাকতে।কেনো কথা শুনিস নি?তোর কিছু হলে আমার কি অবস্থা হতো ভাবতে পারছিস?’
যূথী এখনো ফুঁপিয়ে চলেছে।নিশানের সেই ক্রুদ্ধ চেহারা যতবারই তাঁর চোখে ভাসছে ততবারই কষ্ট হচ্ছে খুব।কারো সুন্দর চেহারার আড়ালে এত রাগ থাকতে পারে এটা তাঁর জানা ছিল না।
চলবে…