#প্রিয়_প্রেমাসক্তা
পর্ব:০৪
লেখিকা: #রুবাইদা_হৃদি
‘একটা মেয়েকে কোনো ছেলে জোরপূর্বক বাজে ভাবে স্পর্শ করে তখন মেয়েটার কতোটুকু বেঁচে থাকার ইচ্ছা মনেপ্রাণে থাকে বলতে পারিস রাইসা?’
সায়াহ্ন আকাশকুসুম ভাবান্তর হয়ে বলল। রাইসা সবেই বই খুলে নোটস গুলো দাগানোর জন্য উদ্যত হয়েও হলো না। সায়াহ্নের আকাশকুসুম ভাবান্তর মুখপানে তাকিয়ে বলল,
‘আমার তো ঠাটিয়ে দু’টো চড় দিতে ইচ্ছা হয় এমন ছেলেদের। যারা মেয়ে দেখলেই অমানুষ হয়।’
রাইসার কথা শুনে সায়াহ্ন নিস্তব্ধ বসে রইলো। রাইসা এরপরেও অনেক কথা একা একাই বলল। যুক্তিবাদী সব চিন্তা চেতনা রাইসার।বারবার বলল,’মেয়েটা আরো মাথা উঁচু করে বাঁচবে। যে মেয়েরা মরে যায়,পিছিয়ে যায় ওদের মরে যাওয়াই উচিৎ।’
রাইসার এহেন সব কথা শুনে সায়াহ্ন পা গুটিয়ে জানালার গ্রিল ধরে উদাস দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো ছুটে চলা কৃষ্ণাভ মেঘমল্লারের দিকে।
নোভার বাড়ি থেকে খানেক বাদেই সে এসে পড়েছিলো। নোভা তার দিকে অসহায় কাতর চোখে তাকিয়ে বারবার ক্ষমা চেয়েছে । সায়াহ্ন মুচকি হেসে নোভাকে আশ্বাস দিয়ে বলেছে,
‘এইগুলা ব্যাপার না নোভা। আমি ঠিক আছি।’
নোভা সায়াহ্নের কথায় মাথানত করে পায়ের আঙুল দিয়ে মেঝে ঘষেছে। সে সায়াহ্নের লুকিয়ে রাখা কষ্ট উপলব্ধি করে সৃষ্টিকর্তার নিকট বারবার প্রার্থনা করেছে,
‘মেয়েটা যেন পূর্বের ন্যায় ভুল কিছু করে না বসে। সে যেন ভালো থাকে।’
তবে মোটেও সায়াহ্ন ভালো নেই। তার ইচ্ছা হচ্ছে জানালার গ্রিল গুলো খুলে ঝাপিয়ে পরতে। শূন্যে ভেসে বেড়াতে। হুট করে যখন শূন্য শেষ হবে সে মুখ থুবড়ে মাটিতে পরে খিলখিল করে হাসবে। তার শরীর কাঁপিয়ে যখন লাল রক্তরা মাটি ভেজাবে তখন মাটি হয়তো রাগ দেখিয়ে তাকে শাসিয়ে বলবে,
‘এই মেয়ে তোর মতো তোর রক্ত ও নোংরা। তুই আমায় নোংরা করলি কেনো!’
সায়াহ্ন তখন আধোআধো চোখ বুজে ঠোঁট নাড়িয়ে বাকা হেসে বলবে,
‘বৃষ্টি তোমায় ধুয়ে স্নিগ্ধ করবে মাটি। তবে আমার এই নোংরা হওয়া আমিটা বিদায় নিচ্ছি দেখো মাটি। আর তোমায় নোংরা করবো না। আর কেউ আমায় আজ থেকে বলবে না,সায়াহ্ন তুই নোংরা হয়ে গিয়েছিস। তাই না বলো মাটি?’
সায়াহ্ন ভেবে আনমনে হেসে উঠলো। মাটির দিকে স্থির হয়ে তাকিয়ে রইলো। একফোঁটা অশ্রুবিন্দু বিসর্জন দিয়ে মাটির দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলো,
‘আমাকে বরণ করে নেবে না মাটি? আমি যে আসছি।’
___________________
মেঘবরণ বর্ষণমুখর প্রভাতের আরম্ভ। দূর আকাশে কালো মেঘ জমাট বেঁধে সভা বসিয়েছে বোধহয়। ঝাঁক বেধে ছুটোছুটি করছে মেঘের বাচ্চারা। ঝপঝপ শব্দে তারা মেঠো পথ থেকে শুরু করে শহুরে রাস্তা ভিজিয়ে আনন্দ উত্তাপে মেতে উঠেছে। অন্ধকারছন্ন প্রকৃতি যেন কারো শোকে মাতোয়ারা।
হসপিটালের করিডোরে মধ্যবয়স্ক পিতার বেদনার্ত মুখ যেন ওই দূর আকাশের ন্যায়। জামিল আলমের পরণে থাকা শুভ্র পাঞ্জাবিটার ভাজ খসে গিয়েছে। জীর্ণ মুখ যেন বিষাদের ছায়া। কেঁপে কেঁপে দুলছে সে। বুঝা দায়,হয়তো তিনি কাঁদছেন।
পাশে থাকা সামিউল বাবার কাঁধে হাত রেখে বলল,
‘তোমাকে বারবার বলেছি আব্বু সায়াহ্ন কে জোর করে হলেও তোমার কাছে রাখো।’
সামিউলের কথা শুনে প্রত্যুত্তর করলেন না তিনি। একজন নার্স এসে সামিউলের দিকে তাকিয়ে বলল,
‘৩০৪ নাম্বার কেবিনের ভদ্রমহিলাকে ঘুমের ইঞ্জেকশন দেওয়া হয়েছে। উনি আপনার কি হয়?’
‘আমার মা। সাবিনা বেগম। কেমন আছে এখন?’ সামিউল বাবার পাশে থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বলল। নার্স ব্যস্ততা দেখিয়ে বলল,
‘মেন্টাল স্ট্রেসের জন্য মেন্টালি ভেঙে পড়েছেন। উনার যত্ন নিবেন।’
‘সায়াহ্ন আফরা ?’ সামিউল নার্সের দিকে প্রশ্নোত্তর চোখে তাকাতেই উনি হাত ঘড়ি দেখে বললেন,
‘এখনো কিছু বলা মুশকিল। তিন তলার উপর থেকে পড়েছেন। এখনো যে সার্ভাইভ করছেন উনি এইটা উনার লাক। প্রে করেন সৃষ্টিকর্তা যেন সহায় হয়।’
সামিউল পেছনে থাকা চেয়ারে বসে পড়লো। শার্টের বোতাম গুলা খুলে দিয়ে বোনের জন্য আক্ষেপের সুর তুললো।
তার সায়ূ কেন তাদের থেকে দূরে পালায়! প্রত্যেকটা সকালের মতোই আজকের সকাল শুরু হলেও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আসা একটি ফোন যেন আবারো অন্ধকারময় করে তুলে তাদের। সায়াহ্ন নাকি উপর থেকে পরে গিয়েছে।
গুরুতর আহত। এই কথা শোনা মাত্রই সামিউল ছুটে এসেছে। বাবা-মাকে খবর না দিলেও কোনো সূত্র হতে খবর পেয়ে তারাও ছুটে এসেছেন হসপিটালে। মা সহ্য করতে না পেরে জ্ঞান হারিয়েছে বহু আগেই । বাবার দিকে সামিউল তাকাতে পারছে না। এই বয়সে কতো যন্ত্রণা সহ্য করছে ভেবেই সে আৎকে উঠলো। বাবার কাঁধে হাত রাখতেই জামিল সাহেব কেঁদে ফেললেন। বাবার কান্না দুমড়ে মুচড়ে দিলো সামিউলকে। বোনটাকে যে কোনোকালেই রক্ষা করতে পারে নি। আজ থেকে চার বছর পূর্বেও পারে নি আবার আজকেও পারে নি।
সায়াহ্নের ব্যর্থ বড় ভাই সে। যে বোনের মান বাঁচাতে পারে নি,বোনকে সেই সব মানসিক যন্ত্রণা থেকেও মুক্তি দিতে পারে নি সে। বোনটা সব সহ্য করে দূরে লুকিয়ে একা একাই চলে যেতে চেয়েছিলো।
সামিউল নিঃশব্দে কাঁদছে। মেয়েটা যন্ত্রণা পুষে সব ছেড়ে চলে যাবার জন্য উদ্যত হয়েছিলো। দোষ এই সমাজের? হয়তো হ্যাঁ হয়তো না!
প্রত্যেকটা মানুষ একটা মানুষকেই পিষে মারে যাদের সামান্য খুঁত পায়। তার বোনটার খুঁত তো তার বোনের দোষে হয় নি! তবুও তাকে আজ পিষে মরতে হচ্ছে। এর বিচার কার কাছে চাইবে সে? ভেবে পায় না। সব কিছুর প্রতি তীব্র বিতৃষ্ণা ঘিরে ধরে সামিউল কে। দু’হাত তুলে সৃষ্টিকর্তার নিকট বলে,
‘বোনটাকে ফিরিয়ে দাও। আমি আগলে রাখবো। নয়তো নিজ হাতেই দাফন করে আসবো।’
‘আপনার কাছে জীবনের মানে কি মিস.শাড়িওয়ালি?’ ভারী কন্ঠের প্রশ্নে সায়াহ্ন বেশ বিরক্ত হলো। বেড থেকে মাথা খানেক উঁচিয়ে প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। সায়াহ্নের শুষ্ক মুখ দেখে রাওনাফ পাশে রাখা চেয়ার টেনে বসে শিষ তুলে বলল,
‘কি হলো জবাব দিন।’
‘আপনি এখানে!’ সায়াহ্ন ভাঙ্গা কন্ঠে আশ্চর্য হয়ে বলল। রাওনাফ মাথার পেছনে হাত দিয়ে দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে বলল,
‘শুনলাম আপনি না’কি হোচট খেয়ে ভার্সিটির উপর থেকে নীচে পড়েছেন। তাই দেখতে এলাম কি করে পড়লেন।’
রাওনাফের এহেন জবান শুনে সায়াহ্ন মুখ ঘুরিয়ে শুয়ে পড়লো। তার কথা বলার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা জাগ্রত হচ্ছে না। গত পরশু তার জ্ঞান ফিরেছে। তবে সে এতে বেশ আশাহত হয়েছে। এতোকষ্ট করে দারোয়ান চাচাকে ম্যানেজ করে বৃষ্টির মধ্যে ছাদে উঠেও কোনো লাভ করতে পারে নি। উল্টা মারা যাবার বদৌলতে ডান পা,বা হাত,আর মাথা ফাটিয়ে,মেরুদন্ডে চিড় ধরিয়ে বসে আছে। নিজের প্রতি বিরক্ত হচ্ছে সে। মরতে গিয়েও শান্তি নেই। এইদিকে মা আর বাবার জন্য তার অনুশোচনা হলেও মোটেও প্রকাশ করে নি সে। জ্ঞান ফেরার পর বড় ভাই আঁকড়ে ধরে কিছুক্ষণ ছিঁচকাঁদুনের মতো কান্না করে গিয়েছে। এইসব কিছু তার অসহ্য লাগছে। আর সব থেকে বেশি অসহ্য লাগছে নোভাকে। ও পিছুপিছু এসে সাথে সাথেই তাকে সিকিউরড করেছে। সামনে পেলে অবশ্যই দুই দুইটা কষে থাপ্পড় মারবে নোভাকে। এই মেয়েটা তাকে মরতে যাবার পরেও জ্বালিয়ে মারছে।
নানা ভাবনায় মশগুল হয়ে রাওনাফের কথা বেমালুম ভুলেই গিয়েছে সায়াহ্ন । অপরদিকে রাওনাফ একই ভাবে বসে সায়াহ্নের শুকনো মুখের দিকে পর্যবেক্ষণ করছে।
মেয়েটা এতো দ্রুত হাল ছেড়ে দিবে ভাবে নি রাওনাফ। সায়াহ্নের আত্মহত্যার চেষ্টা করার খবর টা পেয়েই দ্রুত ওইদিন ছুটে এসেছিলো সেও। এই ধরণের প্রেশেন্টদের চোখেচোখে রাখা উচিৎ হলেও রাওনাফ ভেবেছিলো সায়াহ্ন কিছুটা হলেও মেন্টালি স্ট্রোং। তবে তার ধারণা ভুল করে দিয়ে এইমেয়ে এইদিয়ে তিনবার আত্মহত্যার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছে। রাওনাফ সব ভাবনা বাদ দিয়ে সটান হয়ে বসে গলা খাকারি দিয়ে বলল,
‘তা মিস.শাড়িওয়ালী বৃষ্টির মধ্যে ছাদ থেকে পড়তে রোম্যান্টিক একটা ফীল পেয়েছেন নিশ্চয়ই?’
রাওনাফের বলা কথায় কেঁপে উঠলো সায়াহ্ন। কিছুটা ভয় পেয়েছে সে। বেখেয়ালি হয়ে ছিলো এইজন্যই হয়তো! তবে রাওনাফের বলা কথায় ভ্রু কুঁচকে এলেও কুঁচকানোর চেষ্টায় ব্যর্থ হলো সে। মাথায় বেশ আঘাত লেগেছে যার দরুণ সম্পূর্ণ মাথা ব্যান্ডেজ করা। সায়াহ্ন স্বাভাবিক ভাবেই বলল,
‘আপনি কিভাবে জানলেন?’
‘আমি সবকিছুই জানি।’ রাওনাফের সহজ জবাব সায়াহ্নের পছন্দ হলো না। সে তীব্র বিরক্তি নিয়েই বলল,
‘হেয়ালি করছেন কেনো। মিস্টার আপনার মতলব আমার ওইদিন থেকেই ভালো ঠেকছে না।কি চান বলেন তো।’
‘আপনাকে।’
রাওনাফ সহজ ভঙ্গিতে জবাব দিয়ে সায়াহ্নের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো। সায়াহ্ন অবাক হয়ে পাল্টা প্রশ্ন করতে যাবার পূর্বেই রাওনাফ সায়াহ্নের হাত ধরে হাতের মুঠোয় কিছু একটা গুজে দিয়ে উঠে দাঁড়ালো। সায়াহ্ন জিগ্যেস করতেই রাওনাফ পূর্বের ন্যায় আবারো দ্রুত পায়ে বাইরে বেরিয়ে হাওয়ার তালে মিলিয়ে যেতে লাগলো। সায়াহ্ন বুঝতে পারে না এই লোকের এতো কিসের তাড়া!
হাতের ভাজ খুলে সায়াহ্ন আরেকদফা অবাক হয়ে বলল,
‘আশ্চর্য লোক তো।’
চলবে……….
[