প্রিয় প্রেমাসক্তা পর্ব -০৩

#প্রিয়_প্রেমাসক্তা
পর্ব:০৩
লেখিকা: #রুবাইদা_হৃদি
‘মেয়েটির শরীরের অবস্থা ভালো নয়।’ বললেন হলের ডাক্তার মিসেস রেজা। তার কথায় মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার মতো অবস্থা হলো রুমে উপস্থিত প্রত্যেকটা মানুষের।
বিছানায় শুয়ে থাকা মলিন মুখের মেয়েটির দিকে কয়েকজোড়া চোখ দৃষ্টি স্থির করে বিরস মুখে দাঁড়িয়ে রইলো। এরপূর্বে সায়াহ্ন যখন এমন অসুস্থ ছিলো তখন ডাক্তার বার বার বলেছিলেন,’ওর দিকে বিশেষ যত্ন নিতে। কোনোক্রমে আবারো কোনোকিছু নিয়ে প্যানিক করলে অসুখ সারানো দায় হয়ে যাবে।’
উক্ত কথা নোভার মন পিঞ্জরে উঁকি দিতেই সে হল সুপারকে অনুনয় করে বলল,

‘ম্যাম সায়াহ্নকে নিয়ে আমি আমার বাসায় যেতে চাই।’

হল সুপার চশমার ফাঁক দিয়ে নোভাকে পর্যবেক্ষণ করে গম্ভীর কন্ঠে বলল,

‘ওর খেয়াল রাখতে পারবে তুমি?’

‘জ্বী ম্যাম পারবো।’ নোভা শুকনো ঢোক গিলে বলেই মোহনা আর রাইসার মুখপানে তাকালো। ওরা চোখের ইশারায় নোভাকে ধাতস্থ করলো,পাশে আছি।নোভা সায়াহ্নের মাথার কোণে বসতেই মিসেস রেজা এবং হল সুপার সব বুঝিয়ে দিয়ে চলে যান। নোভা সায়াহ্নের মাথায় হাত বুলিয়ে চুপ করে বসে রইলো। সে দোটানায় ভুগছে। সায়াহ্ন জ্ঞান হুট করে এমন প্যানিক কি জন্য করলো ভেবে পাচ্ছে না। এর উপর এই অসুস্থতার কথা সায়াহ্নের বাবাকে জানানো জরুরী হলেও সায়াহ্নের তোপের মুখে পড়তে হবে ভেবে চুপসে রইলো নোভা। এই মেয়েটাকে একা কোনোক্রমেই সে ছেড়ে যেতে পারে না।নোভা তপ্ত শ্বাস ফেলে আনমনেই বলল,

‘কবে মেয়েটা সব ভয় থেকে মুক্তি পাবে কে জানে।বড্ড ভয় হয়। যন্ত্রণা দিয়ে মুড়িয়ে থাকা হৃদয়টাকে বন্ধী করে সুন্দর হাসিটা কবে সত্যিকারের হবে রে আফরা? তুই কি আদেও কোনোদিন সত্যিকারের হাসি নিয়ে বাঁচতে পারবি?’

নোভা নিজ মনেই আওড়াচ্ছে আর সায়াহ্নের শুষ্ক মুখপানে তাকিয়ে রয়েছে। একটা শুভ দিনের সূচনা সায়াহ্নের জীবনটাকে অন্ধকারে ডুবিয়ে একা করে দিয়েছে। আর কেউ না জানুক নোভা সায়াহ্নের সবটা জেনে বোনের মতো আগলে রাখার প্রচেষ্টাতেও বারবার ব্যর্থ। হুট করে কি এমন হলো নোভা কিছুতেই ভেবে পাচ্ছে না। তবে কি পুরনো অতীত আবারো সায়াহ্নের জীবন দুয়ারে কড়া নাড়ছে?
উক্ত কথা ভেবেই নোভা সায়াহ্নের হাতজোড়া আঁকড়ে ধরলো । যেন ছেড়ে দিলেই সে হারিয়ে যাবে।

__________________

সন্ধ্যা ঘনিয়েছে। লালাভ সিঁদুর রাঙা বারিবাহ কালো আঁধারে লুকানোর প্রচেষ্টায় নিমজ্জিত। ধূলিকণা উড়ো শহরে বৃষ্টি যেন শাসন চালিয়ে তাদের বাধ্য বাচ্চার ন্যায় দমিয়ে স্নিগ্ধ করে রেখেছে পরিবেশ। ধোঁয়া উঠা কফিতে চুমুক দিয়েই রাওনাফ বলল,

‘বিয়ের ডেট কবে?’

রাওনাফের প্রশ্ন শুনে আতিকের মুখ হতে সদ্য পান করা কফিটুকু বেরিয়ে ছিটকে দেয়ালে গিয়ে আঁকিবুঁকি করলো। রাওনাফ সেদিলে ভ্রুক্ষেপ না করে আতিকের উত্তরের জন্য অপেক্ষায় রইলো। কারণ সে জানে আতিককে পাল্টা প্রশ্ন না করলেও সে এ টু জেড সব উগ্রে দিবে।
আতিক রাওনাফের গম্ভীর ভাবমূর্তির দিকে তাকিয়ে কাঁদোকাঁদো হয়েই বলল,

‘মেয়েটা আমাকে ব্লক করে রেখেছে।’

‘তারপর।’ রাওনাফের পাল্টা প্রশ্ন শুনে আতিকের কাঁদোকাঁদো ভাবটা যেন আংশিক বাড়লো। সে কফির মগ পাশে রেখে রাওনাফের দিকে ঝুকে এগিয়ে হাত ধরে বলল,

‘মেয়েটা কি করে পারলো আশা দিয়ে আমাকে দেবদাস বানাতে।দোস্ত মেয়েটা আমাকে ছ্যাকা দিয়েছে।’

রাওনাফ আতিকের হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে আয়েসি ভঙ্গিতে আবারো কফিতে চুমুক বসালো। আতিকে এমন স্বভাব কলেজ লাইফ থেকে। কোনো মেয়ে ওর দিকে তাকিয়ে হাসলেই মনে হতো মেয়েটা ওর প্রেমে মারাত্মক ভাবে ডুবে মরেছে। এরপর মেয়েটাকে কোনো ছেলের সাথে দেখলেই এমন কান্না শুরু হতো। রাওনাফ আতিকের কথা থেকে মনোযোগ সরিয়ে গভীর ভাবে কিছু একটা ভাবতে ব্যস্ত হয়ে উঠলো। রাওনাফের দিকে তাকিয়ে আতিক আবারো হাত ঝাঁকিয়ে বলল,

‘দোস্ত মেয়েটাকে আমি প্রথম দেখাতেই ভালোবেসে ফেলেছি।’

‘তোর তো সব মেয়েকেই ভালো লাগে।’

আতিক রাওনাফের কথা শুনে মাথা চুলকিয়ে মেকি হাসলো। তবে চেহারায় প্রেমিক প্রেমিক রেশ ফুঁটিয়ে বলল,

‘সব মেয়ে আর এই মেয়ে কি এক? এই মেয়েটা আলাদা। একদম আলাদা।’

আতিকের কথা শুনে রাওনাফ ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে আতিকের চোখ বরাবর তাকালো। ভণিতা না করে আতিকের চোখে চোখ রেখেই বলল,

‘কখনো যদি জানিস কোনো মেয়ের পূর্বের অতীতে ভয়ানক কিছু অভিজ্ঞতা রয়েছে এরপর মেয়েটাকে তুই কিভাবে গ্রহণ করবি?’

‘স্বাভাবিক ভাবে।’ আতিকের প্রত্যুত্তর শুনে রাওনাফ মৃদু হাসলো। যতোটা স্বাভাবিক আতিক বলছে ততোটা স্বাভাবিক তো কিছু নয়।
রাওনাফ আতিকের হাতে মৃদু চাপড় দিয়ে বলল,

‘বাসায় যা। আন্টি তোর জন্য মেয়ে ঠিক করেছে। বিয়ে নিয়ে এতো ডেস্পারেট না হয়ে কাজে মন দে।’

রাওনাফের কথা শুনে মুখে লম্বা হাসি টেনে পুরো কফিটুকু এক চুমুকে খেয়ে আতিক বলল,

‘এমন সারপ্রাইজ আগে দিবি তো ব্যাটা।হুদ্দাই ওই মেয়ের শোকে আমি দেবদাস হচ্ছিলাম।’

‘সায়াহ্ন আফরা।’ রাওনাফ মৃদু স্বরে বলল। আতিক শুনতে না পেয়ে ‘কিছু বললো কি’না’ জিগ্যেস করতেই রাওনাফ উঠে দাঁড়িয়ে বলল,

‘বাসায় যা। চেম্বারে কাজ আছে আমার।’

‘রাত এগারোটায় তোর চেম্বারে প্রেশেন্টের ছায়া তো দূর মশাও পাবি না। এখন গিয়ে লাভ নেই। এরথেকে চল কোথাও গিয়ে ঘুরে আসি।’

‘তুই যা। আমার গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে।’ রাওনাফ গাড়ির চাবি নিয়ে বের হয়ে গেলো ক্যাফে থেকে। আতিক বিমূর্ত হয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে বিয়ের খুশিতে টগবগ করে উঠলো। ব্যাচেলার দের সাথে থেকে থেকে সেও যে পার্ফেক্ট ব্যাচেলারের খাতায় নাম লেখাচ্ছিলো তা ভেবেই আঁৎকে উঠে আবার নিজেকে নিজেই বলল,

‘কংগ্রেস আতিক। এইবার তুই ও বিবাহিত হয়ে ঘুরে বেড়াবি আহা।’

‘তোর ফোনটা কোথায় আফরা?’ সায়াহ্ন সবেই ওয়াশরুম থেকে বের হয়েছে। নোভার প্রশ্ন শুনেই ভয়ে কেঁপে উঠলো। স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো দরজার হাতল ধরে। সায়াহ্নের অস্বাভাবিক কাঁপুনি নোভা দূর হতেই উপলব্ধি করতে পারলো। নোভা সায়াহ্নের দিকে পাঁ বাড়াতেই সায়াহ্ন কম্পিয় কন্ঠে বলল,

‘ওরা আমার পিছু কোনোদিন ছাড়বে না নোভা। দেখিস ওরা আমাকে বাঁচতে দিবে না।’

নোভা সায়াহ্নের দিকে এগিয়ে গিয়ে শক্ত হাতে জড়িয়ে নিলো । সায়াহ্ন নোভার বুকে মাথা রেখে চুপ করে নিজেকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা চালাচ্ছে। খানিক বাদে নিজেই মাথা উঠিয়ে চুল গুলো এলোমেলো করে দিয়ে বলল,

‘আজ বিকেলে হলে ফিরবো।’

‘আর দু’টো দিন থেকে এরপর যাও।’ নোভার মা দরজা ঠেলে রুমে ঢুকে বললেন। হাতে থাকা ফলের বাটিটা নোভার হাতে দিয়ে ইশারায় সায়াহ্নকে দিতে বললেন। সায়াহ্ন নোভার মায়ের দিকে তাকিয়ে মুখে হাসি টেনে বলল,

‘আজ দিয়ে দুদিন হয়ে গেলো এসেছি। আর দুদিন থেকে গেলে আমাদের দুজনেই বের করে দিবে।’

সায়াহ্নের কথা শুনে নোভাও সম্মতি জানালো। যেদিন সায়াহ্ন অসুস্থ হলো ওইদিন ই তারা তাদের বাসায় এসে উঠেছে। যদিও নোভা তার মাকে বলেছে,সায়াহ্নের জ্বরের জন্য ক্লান্ত হয়ে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলো এইজন্য যত্নের জন্য তার বাসায় নিয়ে আসা। এর প্রত্যুত্তরে নোভার মা পাল্টা কোনো প্রশ্ন করেন নি। তবে সায়াহ্নকে সে মোটেও পছন্দ করেন না। নোভাকে বারবার মানা করেন ওর সাথে মিশতে। তবুও তার মেয়েটা সব কথা উপেক্ষা করে এই মেয়েটার সাথেই মিশবে।
তিনি হাজার বার বলেও বুঝাতে পারেন না। ‘এইসব নষ্ট মেয়েদের সাথে মেশা পাপ। সমাজে মানুষ ভালো চোখে নেয় না।’
নোভার মা সুফিয়া বেগম মেয়ের হাত ধরে টান দিতেই নোভা মায়ের দিকে তাকায়। সুফিয়া বেগম মেয়ের চোখের দিকে ইশারা দিয়ে বাইরে আসতে বলেই নিজে বেরিয়ে যায়। নোভা মায়ের ডাক শুনে বিরক্তির সহিত বের হয়ে যায় মায়ের পেছনে পেছনে। সায়াহ্ন সেদিকে তাকিয়ে মৃদু হাসলো। নোভাকে বাহিরে ডেকে নিয়ে এখনি নিশ্চয় আন্টি হুমকি সরূপ বলবে,

‘এই নষ্ট মেয়ের সাথে যোগাযোগ কমাবি নয়তো তুই আমাকে আর মা বলে ডাকবি না।’

নোভা হয়তো এই কথা শুনে খুব রেগে যাবে। মা’কে শাসিয়ে চলে আসবে। যুক্তি দিয়ে হাজারো কথা সাজাবে। সায়াহ্ন জানে যুক্তিতর্কে সবাই তাকেই দোষারোপ করবে। তার দিকেই আঙুল তুলে বলবে,’তোমার বাঁচার অধিকার নেই।’

চলবে……..

[রি-চেক করা হয় নি]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here