প্রিয় প্রেমাসক্তা পর্ব -০২

#প্রিয়_প্রেমাসক্তা
পর্ব:০২
লেখিকা: #রুবাইদা_হৃদি
‘আমাকে ছেড়ে দিন।’

‘আপনি এতো ভীতু কেন মিস.।’ মোবাইলের ফ্ল্যাশ সায়াহ্নের মুখমণ্ডলে ফেলে গম্ভীর স্বরে বলল লোকটি। সায়হ্ন বন্ধ রাখা চোখগুলো খুলে নিরস দৃষ্টিতে সামনে থাকা ব্যক্তিটির চেহারা দেখে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বলল,

‘ আপনি তো চলে গিয়েছিলেন।’

‘ আপনার মতো ভিতুকে একা রেখে কিভাবে যাই বলেন?’ লোকটির কপাল উঁচিয়ে বলল। সায়াহ্ন নিজেকে ছাড়িয়ে কপট রাগ দেখিয়ে বলল,

‘ মুখ চেপে ধরে রেখেছিলেন কেন কিডন্যাপারের মতো। আপনার মতলব সুবিধাজনক লাগছে না মিস্টার।’

লোকটি সটান হয়ে দাঁড়িয়ে বিনাবাক্যেই দূরে দাঁড়িয়ে থাকা সিএনজি টাকে ইশারায় ডাকলো। সায়াহ্ন অবাক হয়ে পাল্টা প্রশ্ন করার পূর্বেই লোকটি পকেটে হাত গুজে দায়িত্বশীলতার সহিত ড্রাইভার কে বলল,

‘ম্যাডাম যেখানে বলবে সেখানে সেফলি নামিয়ে দিবেন।’

ড্রাইভার দাঁত বের করে সম্মতি দিতেই লোকটি সায়াহ্নের দিকে তাকিয়ে বলল,

‘সাবধানে যাবেন।’

‘আপনি মানে…’ সায়াহ্ন প্রশ্ন করার জন্য উদ্যত হতেই লোকটি ছাউনি থেকে বেরিয়ে ঝুম বৃষ্টির মাঝেই ল্যাম্পপোস্টের হলদে আলোয় বৃষ্টির ন্যায় মিলিয়ে যাচ্ছে। সায়াহ্ন পিছু থেকে ডাকলো কয়েকবার। তবে সেই ডাক আদেও লোকটার কর্ণকুহরে পৌছালো কি’না কে জানে!
বৃষ্টির ঝমঝম নৃত্যের তালে লোকটির সঙ্গে এক অদ্ভুত রাত্রির সূচনালগ্ন নিমিত্তেই সমাপ্তির কাতারে পৌছুতেই সায়াহ্ন সিএনজি তে উঠে বসে ঠোঁট আওড়ালো,

‘ অদ্ভুত লোক তো।’

________________

প্রভাতের শুভারম্ভ । সুপ্ত কিরণের একঝাঁক আদুরে ঝলকানি বৃষ্টিভেজা রাস্তায় চকচক করছে। ব্যস্ত রাস্তায় যানের আনাগোনা হাতে গোনা গুটিকয়েক। ঝড়ের অংশবিশেষ প্রকৃতিকে মোহনীয় করে তুলেছে। শীতল প্রবাহিত উত্তুরে হাওয়া শরীর ছুঁতেই কেঁপে উঠে রাওনাফ। দরজার বাইরে মাথানিচু করে মৃদু কাঁপছে সে। ক্লান্ত শরীরটাকে টেনে দাঁড় করিয়ে আবারো কলিংবেল চাপতেই ওপাশ থেকে সাড়াশব্দ না পেয়ে আবারো ভেজা সিড়িতে বসে পড়লো সে।
প্রায় দশ বিশেক কিংবা ত্রিশ মিনিট বাদে দরজা খোলার শব্দে নড়েচড়ে বসলো সে। নিজেকে যথাসম্ভব স্থির রাখার আপ্রাণ চেষ্টায় নিমজ্জিত হতেই ওপাশ থেকে মধ্যবয়সী নারী দুশ্চিন্তাগ্রস্ত কন্ঠে বলে উঠলো,

‘কাল কোথায় ছিলি সারারাত? মায়ের যে চিন্তা হয় সেটা কি কোনোদিন বুঝবে না তুমি?’

রেহেনা বেগমের কথায় মাথা উঁচিয়ে রাওনাফ তাকাতেই উনি উচ্চস্বরে চিৎকার করে বলল,

‘মাথায় ব্যান্ডেজ কেন। এই তোর মাথায় কি হয়েছে? রায়হান দেখে যা তোর ভাই কি কান্ড ঘটিয়ে এসেছে।’

রেহেনা বেগম একনাগাড়ে বিলাপ করেই চলেছে। রাওনাফ যথাসম্ভব নিজেকে শক্তসমর্থ দেখানোর চেষ্টা করে উঠে দাঁড়িয়ে মায়ের হাত ধরে আশ্বাস দিয়ে বলল,

‘সামান্য একটু লেগেছে মা।অস্থির না হলে আমাকে দয়া করে রুমে যেতে দাও। শরীরটা বড্ড মেজমেজ করছে।’

রেহেনা বেগম ছেলের শার্ট মুচড়ে ধরে কান্না করছে অনবরত । দুই ছেলের মাঝে ছোটো ছেলেকে সে বেশিই চোখেচোখে রাখেন। তার ধারণা তার এই ছেলেটা শান্ত তবে বেপরোয়া। যার পেছনে অহেতুক ঝামেলা যেন আষ্টেপৃষ্ঠে লেগে থাকেই। রেহেনা বেগম কান্নারত অবস্থাতেই বড় ছেলে রায়হান কে আবারো ডেকে রাওনাফের দিকে রক্তচক্ষু নিয়ে তাকিয়ে বলল,

‘তোর এই অবস্থা কিভাবে হয়েছে খুলে বল আমাকে। নয়তো তোর বাসায় ঢোকা বন্ধ আজ ।’

মায়ের এমন শাসনে হাসি পেলো রাওনাফের। মনে মনে খানিকক্ষণ হেসে মায়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,

‘আর বলো না। গাড়িটাকে হুট করেই পেছন থেকে বড় একটা গাড়ি ধাক্কা দেয়। ব্যালেন্স করতে গিয়ে কপালে লেগেছে।’

‘গিয়েছিলি আতিকের জন্য পাত্রী দেখতে। চোরের মতো মার খেয়ে ফেরত আসলি কেনো।’

রায়হান অফিস যাবার জন্য গেইট দিয়ে বের হবার সময় রাওনাফেকে উদ্দেশ্যে কতে বলে উঠে। রাওনাফ ভাইয়ের কথা শুনে মৃদু হাসে। রেহেনা বেগম কিছু বলার জন্য মুখ খুলতেই রায়হান তাকে থামিয়ে দিয়ে ব্যস্ততা দেখিয়ে বলল,

‘অফিস থেকে এসে সব শুনবো আম্মা। তোমার নবাবজাদাকে রুমে পাঠিয়ে লম্বা একটা ঘুমের ব্যবস্থা করে দাও। এরপরেই দেখবে সব ঠিক।’

রায়হান উক্ত কথা বলেই গেইট পেরিয়ে বেরিয়ে যেতেই রাওনাফ মায়ের কাঁধে হাত রেখে ভেতরে নিয়ে যেতে যেতে বলল,

‘খুদা লেগেছে মা। তোমার হাতে খাবো।’

রাওনাফের শ্লেষাত্মক কন্ঠে বলা কথায় রেহেনা বেগম রাগ ধরে রাখতে পারলেন না। কাজের মেয়েটাকে ডাকতে ডাকতে ছুটলেন রান্নাঘরের উদ্দেশ্যে। রাওনাফ মায়ের যাওয়ার পানে চেয়ে দ্রুতপায়ে নিজের রুমের দিকে পা বাড়ায়।
রুমে প্রবেশ করেই মোবাইল চার্জে বসিয়ে ফ্রেশ হয়ে এসে আবারো মোবাইল হাতে তুলে নেয়। বেডের এক কোণে বসে মোবাইল হাতে ঘুরাতে ঘুরাতে আতিকের নাম্বারে ডায়াল করে কিয়ৎক্ষণ অপেক্ষা করতেই অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে ফোনের ওপাশ থেকে কাঙ্ক্ষিত ব্যক্তির গলার আওয়াজ পেতেই রাওনাফ বলল,

‘মেয়েটাকে তুই সিউর বিয়ে করবি?’

‘হ্যাঁ। মেয়েটাকে আমার বড্ড পছন্দ হয়েছে দোস্ত।’

‘তাই বলে এই বাচ্চা মেয়েকে?’ রাওনাফ কিছুটা বিরক্তির সুরেই বলল। ওপাশ থেকে আতিক লাজুক স্বরে বলল,

‘বাচ্চা কোথায় দেখলি। বড়ই তো। এইবার অনার্সে পড়ছে। সেকেন্ড ইয়ার।’

রাওনাফ নিশ্চুপ খানিকক্ষণ বসে রইলো। ওপাশ থেকে আতিক কয়েক বার ‘হ্যালো’ বলতেই রাওনাফ কপালে আঙুল ঠেকিয়ে গম্ভীর ভাবে বলল,

‘মেয়েটা কি বলেছে?’

‘মেয়েটাও রাজি দোস্ত। আজ রাত চারটার দিকে টেক্সট পাঠিয়ে উত্তর দিয়েছে।’

রাওনাফ প্রত্যুত্তর না করে ফোন কেটে দু হাত কপালে ঠেকিয়ে বসে রইলো। নিজ মনেই সে বলে উঠলো,

‘আপনার জন্য গোটা একটা রাত উৎসর্গ করলাম মিস.শাড়িওয়ালী। এতো সহজেই ছাড় পাবেন বুঝি?’

মধ্যাহ্নের তপ্ত রোদ চোখে পড়তেই ঘুম ছুটলো সায়াহ্নের। উঠে বসতে যেতেই বুঝতে পারলো শরীরের সর্বাংশ ব্যথায় মুড়িয়ে আছে। মাথা ঝিমঝিম করতেই সে আবারো শুয়ে পড়লো। এইদিয়ে আজ দু’দিন ভার্সিটির গুরুত্বপূর্ণ ক্লাস মিস দিয়েছে সে। গতদিন শপিং করতে গিয়ে পুরো দিন আর আজ কালকের রাতের ধকলের জন্য। আড়মোড়া ভেঙ্গে উঠে বসতেই দরজার দিকে নজর যেতেই দেখলো নোভা রুমে ঢুকছে। হলের এই রুমটা তাদের চারজনের জন্য বরাদ্দ। হলে থাকার দরুন দিন দিন আরো জেদ যেন সায়াহ্নকে আঁকড়ে ধরছে। বাবার থেকে দূরে থেকেই যেন তার স্বস্তি। টন খানেক ব্যথা নিয়েই সটান বসে রইলো সে দরজার দিকে মুখ করে। নোভা সায়াহ্নকে জাগ্রত দেখে ব্যাগ পাশের টেবিলে রেখে বলল,

‘আঙ্কেলের ফোন ধরিস না কেন।’

সায়াহ্ন জবাব দিলো না। নোভা সবটা জেনেও বারবার একই প্রশ্ন করবে। ওর বক্তব্য,’তোর আলিশান বাসা ছেড়ে বাবা-মাকে ছেড়ে কেনো কষ্ট করে হোস্টেলে থাকতে হবে।’
সায়াহ্ন এই প্রশ্নের ও জবাব দেয় না। সে দীর্ঘশ্বাস নিগড়ে চুল গুলো হাত খোঁপা করে উঠে দাঁড়িয়ে ক্লান্তিকর কন্ঠে বলল,

‘ডিপার্টমেন্টের খবর কি?’

নোভা আড়চোখে সায়াহ্নের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল,

‘কাল সেজে কোথায় গিয়েছিলি তুই? আর ওই রাত্রি বেলা একা ফিরলি কি করে? হল সুপার তোকে দেখা করতে বলেছে।’

সায়াহ্ন এবারেও জবাব দেওয়ার ইচ্ছা পোষণ করলো না। সে নির্বিঘ্নে নোভার প্রশ্ন এড়িয়ে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো। নোভা মেয়েটা বড্ড অভিভাবক টাইপ। তাকে সাশনে বেঁধে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়েও গত নয় মাসে ব্যর্থ হয়েছে। সায়াহ্ন পেছনে ঘুরে দেখলো নোভা তার পানে অসহায় দৃষ্টি নিক্ষেপ করে তাকিয়ে আছে। সায়াহ্ন পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য বলল,

‘কাল ডেটিং করতে গিয়েছিলাম।’

সায়াহ্নের উত্তর শুনে নোভা সশব্দে হেসে উঠলো। সেই সাথে সায়াহ্ন ও। নোভা ওর হাসি থামিয়ে সায়াহ্নের হাসিমুখের পানে তাকিয়ে বলল,

‘তুই আর প্রেম। ইম্পসিবল বস্তু।’

‘ডিরেক্ট বিয়ে করে দেখাবো অপেক্ষা কর।’ সায়াহ্ন রেলিঙের উপর ঝুঁকে বলল। নোভা ফাজলামো ভেবে নিজ কাজে ব্যস্ত হয়ে উঠলেই সায়াহ্ন রুমে ঢুকে মোবাইল নিয়ে আবারো বারান্দায় দাঁড়ালো সে।
বৈশাখের প্রবাহিত হাওয়া পশ্চিমের এই বারান্দায় যেনো আদুরে ভাব প্রকাশ করছে। সায়াহ্নের শরীরের প্রত্যেকটা অংশ যেন সতেজতায় প্রাণ ফিরে পেলো। লাল বর্ণের কৃষ্ণচূড়াটার শাখার মতো। বৃষ্টির ছোয়ায় যেন রুপ লাবণ্য তার উঁপচে পড়ছে। সায়াহ্ন বুক ভরে শ্বাস টেনে নিতেই অক্ষিকোটর হতে দু ফোঁটা অশ্রুর কণা গড়িয়ে পরতেই সে আনমনে বলল,

‘আমি কি আদেও এমন টা হতে চেয়েছিলাম? কেন বানালে আমাকে এমন!’

মোবাইলে তীব্র স্বরে টুংটাং করে খুদেবার্তা হোয়াটসএপে আসতেই সায়াহ্নের ঘোর কাটে। চট জলদি অশ্রুকণা লুকিয়ে মোবাইলের স্ক্রিনের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করতেই দেখে দু’টো ভিডিও এর ক্লিপ এসেছে আননোন নাম্বার থেকে। সায়াহ্ন কিছুটা কৌতুহল আর ভয় মিশ্রিত অনুভূতিত বশীভূত হয়ে ক্লিক করতেই ত্রিশ সেকেন্ডের একটি ভিডিও ক্লিপ ওপেন হবার সাথে সাথেই সে আতংকে কেঁপে উঠে। শরীরের কম্পণের মাত্রায় মোবাইলটি হাত থেকে একদম নীচতলায় গিয়ে দুমড়ে মুচড়ে পড়ে। নোভা উক্ত সময় তাকে ডাকার জন্যই আসছিলো। তবে সায়াহ্নকে নীচে পড়ে থাকা অবস্থায় কাঁপতে দেখে সে ভয় পেয়ে যায়। নোভা সায়াহ্নের পাশে বসতেই সায়াহ্ন কাঁপা গলায় বার বার উচ্চারিত করলো,

‘আমি বাঁচতে চাই…আমি নিজের মতো বাঁচতে চাই।’

[

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here