প্রিয় প্রেমাসক্তা পর্ব -০৬

#প্রিয়_প্রেমাসক্তা
পর্ব:০৬
লেখিকা: #রুবাইদা_হৃদি
পড়ন্ত গোধূলি বেলায় হুট করেই এক অদ্ভুত ঘটনা হসপিটাল ঘটলো সায়াহ্নের থমকে যাওয়া জীবনে। সায়াহ্ন স্তব্ধ,নির্বাক। হালকা পেষ্ট রঙের চাদর টা হাতের মুঠোয় মুচড়ে ধরতে মৃদু কাঁপুনির আবির্ভাব হলো তার সর্বাঙ্গে। তার চক্ষুদ্বয়ের সামনে বিশাল আয়োজন। চারদিকে জন্মদিনের আমেজের রেশ। সায়াহ্ন খুব জোর দিয়ে মনে করার চেষ্টা করলো আজকে মাসের কতো তারিখ। মে মাসের চব্বিশ তারিখ মনে হতেই সমস্ত উৎকন্ঠা বিসর্জন দিয়ে চুপিসারে বসে রইলো।
জামিল সাহেব বিরস মুখে বললেন,

‘শুভ জন্মদিন আম্মা।’

সায়াহ্নের কর্ণকুহরের শ্রবণ হলেও সে দাঁতে দাঁত চেপেই বলল,

‘এইসব আয়োজন কে করেছে।’

‘তোর শুভাকাঙ্ক্ষী ।’ বললেন সামিউল। তার কথা শুনে সায়াহ্ন চারদিকে চোখ বুলালো। তার পছন্দের বেলী আর কামিনী দিয়ে বড় করে জন্মদিনের শুভেচ্ছা বার্তা সামনের দেয়ালে টাঙানো। হসপিটালের প্রাণহীন রুম টা সজীবতায় ঘেরা। সায়াহ্ন রাগ জমানোর চেষ্টায় বিভোর হবার প্রাণপণ চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলো।
একে একে রুমে নোভা,রাইসা ঢুকে সায়াহ্নকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানালো। সায়াহ্ন নিস্তব্ধ। তার সামনেই রেড ভেলভেট কেক রাখা। সায়াহ্ন সামিউলের মুখপানে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই সামিউল বোনের দৃষ্টির অর্থ বুঝতে পেরে বলল,

‘আমরা কেউ কিছু করি নি। দুপুরে সবাই বাসা থেকে আসার পর এইগুলা দেখে আমরা নিজেরাও তোর মতোই অবাক। যেই করুক,তার এই অনাকাঙ্ক্ষিত সারপ্রাইজ এর জন্য তোর জন্মদিনটা তো পালন হচ্ছে।’

বলেই সামিউল খ্যাঁক করে হেসে উঠলো। ভাইয়ের উক্ত হাসি সায়াহ্নের কুঞ্চিত কপাল যেন আরো কুঁচকে এলো। অদ্ভুত!
হুট করে এমন কার আবির্ভাব হলো কে জানে। সায়াহ্ন সেই কবেই তার জন্মদিন ভুলে বসে আছে সে নিজেই জানে না। বাসা বা ফ্রেন্ড সার্কেল তার তোপের মুখে পড়বে বলেই জন্মদিনের শুভ্রচ্ছা টুকু জানায় না।
আজকে বিশাল আয়োজনে সায়াহ্ন বাকরুদ্ধ। সে সটান হয়ে বসে গলায় জোর এনে নোভার উদ্দেশ্য করে বলল,

‘রিসেপশনে গিয়ে জিগ্যেস করে আয় এই তামাশা গুলো কে করেছে।’

‘শান্ত থাক প্লিজ। উত্তেজিত হলে তোর সমস্যা হবে।’ নোভা কিছুটা ভয়ার্ত স্বরেই সায়াহ্নের উদ্দেশ্যে বলল। সায়াহ্ন উত্তেজিত হয়েও মিইয়ে গেলো। বেডের এককোণে বসে রইলো চুপিসারে। সামিউল বেশ শোরগোল করছে । পূর্বে হলে বোনের জন্মদিন নিয়ে উত্তেজনার শেষ ছিলো না তাদের। কী থেকে কী জীবনের অধ্যায়ে ঘনীভূত হলো কে জানে!
এরপর থেকেই সায়াহ্ন হারিয়ে গিয়েছে সেই সাথে হারিয়েছে তার চাঞ্চল্য। সামিউল বোনের সামনে গিয়ে পূর্বের ন্যায় দাঁত বের করে হেসে বলল,

‘কিরে বুড়িয়ে যাচ্ছিস তো।’

সায়াহ্নের অশ্রু যেন বাধ ভাঙলো। হুঁ হুঁ করে কেঁদে উঠলো। কান্নার দমকে তাদের মা ছুটে এসে রাগান্বিত স্বরে বলল,

‘বারবার বলেছিলাম মেয়েটাকে আর কষ্ট দিয়ো না। তবুও এইসব করার অনুমতি কেন দিলে উনাকে।’

সাবিনা বেগম এক প্রকার ছুটে এসেই বললেন। সায়াহ্ন মায়ের দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে ক্ষুদ্ধ হলেও প্রকাশ করলো না। আজ যেন সব বাধন ছাড়া শূন্য লাগছে। সাবিনা বেগমের থেকে দৃষ্টি জানালার বাইরে স্থির করে বিড়বিড় করে বলল,

‘মা এখন তুমি কতোটা ভাবো। যদি ওইদিন টা একটু ভাবতে আজ হয়তো আমিও উল্লাসে মেতে থাকতে পারতাম।’

সায়াহ্নের নীরব অভিব্যক্তি নিভৃতেই রয়ে যায়। সব কিছু বিষাক্ত। বিষাক্ত তার অতীত। বিষাক্ত তার আপনজনেরা।

______________________

স্নিগ্ধ রজনী পুষ্পময় পথ। কৃষ্ণচূড়ার রক্তিমতায় লালাভ সজীবতা ছড়াচ্ছে। হিমেল হাওয়ায় দুলতে থাকা রক্তবর্ণের ফুল গুলোকে হ্ঠাৎ করেই জীবিত মনে হলো সায়াহ্নের নিকট। তারা যেন দু হাত মেলে নিজেদের নিয়ে বড়াই করছে সৌন্দর্যের। সায়াহ্ন বাইরে থেকে দৃষ্টি সরিয়ে আয়নার দিকে স্থাপন করলো। নিজের প্রতিবিম্ব দেখে নিজ মনেই হেসে উঠলো। মাথায় সাদা দবদবে ব্যান্ডেজ,চোখের নীচে গাঢ় কালো দাগ যেন বলে দিচ্ছে তার ভেতরকার কষ্টের কথা। চুল গুলো থেকে রুক্ষতা প্রকাশ পাচ্ছে। তারা যেন অভিমান করে আছে। মৃদু বাতাসের তালে সায়াহ্ন দীর্ঘশ্বাস টেনে ঘড়ির পানে চোখ বুলালো। তার জন্মদিন শেষ হতে আরো চার ঘন্টা বাকি।
সবাই তার উদাসীনতার জন্যই চলে গিয়েছে হয়তো! সে অবশ্য চায় না কেউ থাকুক। তার সাথে থাকার অধিকার কারো নেই। যত্রতত্র ভেবে সায়াহ্ন কপাল কুঞ্চিত করে ভাবনার অন্তরায় গিয়ে ভাবলো,’এতোশত আয়োজন করা কে সেই শুভাকাঙ্ক্ষী!’
সায়াহ্ন বেড থেকে উঠে দাঁড়িয়ে ওড়না ভালো করে পেচিয়ে নিজেকেই শাসিয়ে বলল,’চলে যাওয়া কিছু নিয়ে ঘাটাঘাটি করতে নেই সায়াহ্ন। হয়তো তোর পুরোনো ক্ষত জাগ্রত করার প্রয়াসেই কেউ এই আয়োজন করেছে।’

সায়াহ্ন মৃদু হাসলো। এইসব ভাবনায় ডুবে থাকার সময় তার নিকট নেই। বর্তমান তার খোলা হাওয়া বুক ভরে নিতে ইচ্ছে হচ্ছে। নিজের কিছুটা জমে থাকা কষ্ট বাতাসের বুকে ভাসিয়ে দিতে ইচ্ছা হচ্ছে। ওড়নাটা আরো ভালো ভাবে টেনে সায়াহ্ন পা বাড়ালো নাম না জানা গন্তব্যে । সে গন্তব্যের পথিক শুধু সে একা…আশেপাশে কেউ নেই…কেউ নেই।

‘ছাদ থেকে পড়ে যাবার পেশা বাদ দিয়ে এখন ডাকাতির পেশায় ঢুকেছেন বুঝি!’

গাম্ভীর্যপূর্ণ হেয়ালির কথাটা সায়াহ্নের কর্ণকুঠরে পৌছুতেই সে পেছন না ফিরেই চোখ মুখ কুঁচকে বলল,

‘আপনি আবার !’

‘এতো সহজেই চিনে ফেললেন । কি ব্যাপার! আমার কথা ইদানীং ভাবেন না’কি?’ রাওনাফ সায়াহ্নের পাশের দোলনায় বসে ভ্রু নাচিয়ে বলল। সায়াহ্ন বিরক্তিতে মুখ দিয়ে ‘দ’ উচ্চারণ করেও থেমে গেলো।
হসপিটাল থেকে বেরিয়ে ভার্সিটির পাশের একটা পার্কে এসে বসেছিলো সে। সাঝের টিমটিম স্নিগ্ধ আলোয় আর ফুরফুরে বাতাসে এই জায়গায় বসলেই বিষাক্ত বেদনা নিগড়ে বেরোয় সায়াহ্নের। নিজেকে সে হারিয়ে বারবার খুজে বেড়ায় এখানে এসেই।
সায়াহ্নকে চুপ দেখে রাওনাফ দোলনা থেকে বসেই পা বাড়িয়ে সায়াহ্নের দোলানায় হালকা লাথি দিতেই সায়াহ্নের দোলনা দোলে উঠে।
আকস্মাৎ দোলনার দোলে উঠার জন্য ভড়কে যায় সায়াহ্ন। কপটা রাগ দেখিয়ে পাশ ফিরে তাকিয়ে বলল,

‘করছেন কি!’

‘কানা আপনি?’ রাওনাফ আবারো ধাক্কা দিয়ে নিজেও দোল খেতে খেতে পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ে দিলো। সায়াহ্ন তার এহেন আচরণের জন্য বেশ বিরক্ত বোধ করছে। সেই রাত থেকে এই লোক তার পিছু ছাড়ার নাম গন্ধ নেই। হুট করে সেই রাত্রির কথা মনে হতেই সায়াহ্ন পা মাটিতে নামিয়ে দোলনা থামিয়ে রাওনাফের মুখপানে নয়ন স্থির করে বলল,

‘আপনার বন্ধুকে বলবেন আমি তাকে বিয়ে করতে রাজি।’

রাওনাফ সামনের আবছা আঁধারচিত্রের দিকে মুখ করে আছে। সায়াহ্ন প্রশ্নসূচক দৃষ্টি রাওনাফের আড়চোখের নজর এড়াচ্ছে না। সে আবছা আলোয় মুচকি হাসলো। সায়াহ্ন আবারো উক্ত প্রশ্ন করতেই রাওনাফ দোলানা থামিয়ে সায়াহ্নের মুখ পানে তাকিয়ে বলল,

‘আপনার বিয়ে ছাদের সাথে করা উচিৎ।’

‘মানে!’ সায়াহ্ন বিস্ময় নিয়ে বলতেই রাওনাফ হেয়ালি করে বলল,

‘আমার ধারণা আপনি ছাদের সাথে মান অভিমান করে লাফিয়ে পড়েন অভিমান প্রকাশ করতে। যেমন একজন প্রেমিকা তার প্রেমিক পুরুষের সাথে অভিমান করে বারবার চলে যাবার জন্য উদ্যত হয়। আপনি এইযে বারবার লাফ দেন তবুও যেমন মারা যান না। তেমনি প্রেমিকা গুলোও প্রেমিকদের ছেড়ে যায় না।’

এতোটুকু বলেই রাওনাফ সশব্দে হেসে উঠলো। হার হাসির কম্পন সর্বদিক বিরাজ করছে। চাদের নম্র আলোয় রাওনাফের গা দুলিয়ে হাসার দৃশ্যটি সায়াহ্ন প্রগাঢ়ভাবে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে অনুধাবন করছে।
লোকটার বলা কথায় তার প্রচন্ড রাগ হলেও সব রাগ নিমিষেই ধূলিসাৎ হলো। সায়াহ্নের ভাবমূর্তি রাওনাফের দৃষ্টিগোচর হতেই,

‘এভাবে দেখলে তো প্রেমে পরে যাবেন ওই সময়ের মতো।’

সায়াহ্ন দৃষ্টি সরিয়ে অবাক হয়ে বলল,’কোন সময়ের মতো!’

রাওনাফ অদ্ভুত ভাবে হাসলো। দোলনায় বসেই সায়াহ্নের একদম নিকটে গিয়ে বলল,

‘আপনার ষোড়শী বয়সের প্রথম প্রেমের মতো।’

‘কে আপনি?’ সায়াহ্ন অবাক হয়ে বলতেই রাওনাফ দূরে সরে গিয়ে বলল,

‘অতীতের কালো অধ্যায় বাদ দিয়ে আমাকে খুজে বেড়ান। দেখেন খুজে পান কিনা!’

চলবে……..

[

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here