#প্রিয়_প্রেমাসক্তা
পর্ব:১০
লেখিকা: #রুবাইদা_হৃদি
অতি কোমল মখমলে হাওয়ার আবেশ বইছে নিস্তব্ধ কুঁড়েঘরের আনাচেকানাচে। সামনে বসা রমণীটির ভাবাবেগ শূন্য । চোখে আজ ভয়ের রেশ নেই তবে অনেকের বিরুদ্ধে হাজারো অভিযোগের সুর তুলছে ওই চোখ দুটো । রাওনাফ একদম অবাক হলো না। সে নির্লিপ্ত ভঙ্গিমায় বসে রইলো।
সায়াহ্নকেও মোটেও বিচলিত দেখাচ্ছে না। সে হিজাবের একটা খুলে যাওয়া অংশ ঠিক করার মনোযোগ দিয়ে বলল,
‘বুঝলেন মিস্টার.সমাজে যেমন রাস্তার কু*কু*রের দাম নেই ঠিক আমাদেরও দাম নেই।’
সায়াহ্নের কথাটি কেমন অদ্ভুত কঠিন। রাওনাফ হেলে থাকা শরীরটাকে সোজা করে সামনের টেবিলে সাজানো খাবার গুলোতে মনোযোগ দিলো। খিচুড়ির একটা প্লেটে সায়াহ্নের জন্য ডিমভাজি এবং সালাদ সাজিয়ে রাখলো। নিজের জন্য প্লেট সাজাতে মনোনিবেশ করতেই সায়াহ্ন বলল,
‘আজকে খাবারের বিল টা আমি দিবো।’
‘কারণ!’ রাওনাফ নিজের প্লেট সাজাতে সাজাতেই বলল। তাকে একদম স্বাভাবিক লাগছে। যেন সায়াহ্নের বলা কোনো কথা সে শুনেই নি। সায়াহ্ন তার আচরণে খানেক বিচলিত হলেও প্রকাশ করছে না। খিচুড়ির প্লেট টা রাওনাফ সযত্নে সায়াহ্নের সামনে পরিবেশন করতেই সায়াহ্ন ধীর গলায় বলল,
‘শেষ বিদায়ের কিছু স্মৃতি উপহার সরুপ দিচ্ছি এইটা ভেবে নিতে পারেন।’
রাওনাফ এবার হাসলো । তার হাসির শব্দ ছড়ালো। সায়াহ্ন অবাক নয়নে তাকিয়ে বলল,
‘আমার পূর্বের বলা কথা গুলো শুনেন নি মিস্টার.?’
‘শুনেছি।’ রাওনাফের নির্লিপ্ত জবাব। সায়াহ্ন প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকাতেই বলল,
‘এইগুলা কোনো ব্যাপার না।’
‘এইগুলা কোনো ব্যাপার আপনার কাছে না হতে পারে তবে একটা মেয়ের কাছে অনেক বড় ব্যাপার।’ সায়াহ্ন কিছুটা ক্ষিপ্ততা প্রকাশ করে বলল। রাওনাফ চুপচাপ খিচুড়ির এক লোকমা মুখে উঠিয়ে হাত উঁচু করে সামনে ওই মাঝ বয়সী লোকটার উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো,
‘মামা খিচুড়িতে ঝাল কমায় দিতে পারো নাই। সেই কলেজ লাইফ থেকে এক রকমের ঝাল রয়ে গেলো তোমার খিচুড়ি তে।’
অদ্ভুত ভাবে লোকটা আবারো হাসি দিয়ে মাথা ঝাকালো। সায়াহ্নের এইসব দেখে প্রচন্ড রাগ লাগছে। মেজাজ সপ্তম আকাশে উঠছে। তবুও নিজেকে দমিয়ে বসে রইলো সে।
যেখানে মা-বাবা,ভাই তাকে বুঝে নি সেখানে বাইরের লোক থেকে আশা করটা বোকামো ভাবলো। রাওনাফ খিচুড়ি খেতে খেতে বলল,
‘নিন মিস.খান খান। মারাত্মক ভালো হয় বুঝলেন মামার হাতের খিচুড়ি টা।’
সায়াহ্ন প্রত্যুত্তর করলো না। তার হঠাৎ করেই প্রচন্ড কান্না পাচ্ছে। কান্নার তোড়ে চিৎকার করে বলতে ইচ্ছা হচ্ছে,
‘আপনিও বাকিদের মতো মিস্টার.রাওনাফ।’
তবে সে কান্নাটুকু গিলে ফেলে নিভৃতে বসে রইলো।
‘কান্না পেলে জমিয়ে রাখতে নেই পরে ঝড় হয়ে যায়।’
রাওনাফের কথা শুনে সায়াহ্ন এক নজর তাকালো। লোকটা মাথানিচু করে খাচ্ছে তবুও সে জেনে গেলো তার কান্না এসেছে।
সায়াহ্ন কান্নাটুকু পানি দিয়ে গিলে ফেললো। গলা ঝেড়ে বলল,
‘আমার সব কথা বলা শেষ। সেই সাথে সময় ও। আশাকরি আপনার সাথে আমার আর দেখা হবে না।’
‘ওমা! বিয়ে পর রুমে কি দেয়াল উঠিয়ে থাকবো!যে দেখা হবে না।’
রাওনাফ মশকরা করছে যেন। সায়াহ্নের সেটা মোটেও ভালো লাগছে না । সে হেয়ালি না করে সরাসরি বলল,
‘মজা করার মানসিকতা আমি হারিয়েছি। অহেতুক মজা করবেন না।’
‘আমি চাই সেই মানসিকতা আপনার আবার ফিরে আসুক।’
‘কখনো সম্ভন না।’ সায়াহ্ন ভারী গলায় বলল। রাওনাফ প্রত্যুত্তর করলো না। সে তৃপ্তি নিয়ে খাচ্ছে। কখনো শসার টুকরো তে কামড় বসাচ্ছে তো কখনো ঝালে পানি খাচ্ছে।
সায়াহ্নের কাছে দৃশ্যটুকু ভারী সুন্দর লাগছে। লোকটা খাবার ও যত্ন করে খায়।
নিজের প্লেটের দিকে তাকিয়ে খাওয়ার ইচ্ছা জাগলো না তবে নিষিদ্ধ এক ইচ্ছা জাগলো আর সেটা হচ্ছে,রাওনাফকে দেখার ইচ্ছা। সে জানে বড্ড অন্যায় করছে তবুও আজ দেখতে তো ক্ষতি নেই। কাল থেকে ভিন্ন পথ ভিন্ন জীবন।
সায়াহ্ন যে তার দিকে তাকিয়ে আছে বুঝতে পেরে মনে মনে হাসলো সে। খাবারের শেষ অংশ টুকু শেষ করতেই সায়াহ্ন চোখ সরিয়ে নিলো। তার মুখ ফুঁটে বলার ইচ্ছা জাগছে,
‘আপনি আরেকটু খান না প্লিজ,আমি বসে বসে দেখি।’
নিজের এহেন নির্লজ্জ আবদার মনে উদয় হতে নিজ মনেই বিব্রত পরিবেশে পড়লো সে। রাওনাফ খাবারের উচ্ছিষ্ট অংশ টুকুর দিকে তাকিয়ে বলল,
‘বুঝলেন মিস.আফরা,খাবার রান্নার পূর্বে তেজপাতা,এলাচ কিংবা লবঙ্গ যত্ন করে দেওয়া হয় তবে খাবার খাওয়া শেষ হতেই এদের দূরে ছুড়ে মারে সবাই। কারণ টা হলো খাবারের স্বাদ বৃদ্ধির পর এদের খোলস অকেজো। তেমনি কিছু মানুষ আপনার জীবনে স্বাদ আনবে বিস্বাদ আনবে তাই বলে ওই কিছু সংখ্যক মানুষের জন্য অন্য মানুষের গুন গুলো ভুলে যাবেন?’
সায়াহ্ন কথার মানে বুঝলো কি’না কে জানে! তবে সে চুপ করেই রইলো। রাওনাফ শার্টের উপরের দু’টো বোতাম খুলে দিতে দিতে বলল,
‘সহজ ভাষায় বলতে দুনিয়াতে উচ্ছিষ্ট কিছু মানুষকে ভেবে বাকি যারা ভালো মানুষ আছে তাদের অগ্রাহ্য করা বোকামি।’
‘আপনি বলতে চান আমি যেন সব ভুলে যাই?’
‘ভুল! আমি চাই আপনি সব মনে রাখুন।’
‘আমার মনে হয় আমাদের উঠা উচিৎ ।’ সায়াহ্ন দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল। তার বাহ্যিক জ্ঞান মোটেও ভালো লাগছে না।
রাওনাফ গলার স্বরে এবার কাঠিন্য ভাব আনলো। চোখেমুখে খানেক রাগের আভাষ ফুঁটে উঠতেই সায়াহ্ন চুপসে গেলো। তবে অন্তত শান্ত ভঙ্গিমায় সে বলল,
‘আপনার সাথে ঘটা ঘটনার জন্য আপনি দায়ী?’
‘আমি কেন দায়ী হতে যাবো?’ সায়াহ্নে জবাব দিতেই রাওনাফ বলল,
‘তবে কেন নিজেকে দোষারোপ করে পালিয়ে বেড়ান।’
‘কারণ আমার পরিবার,আপনাদের এই সমাজ আমাকে পালাতে সাহায্য করে।’
সায়াহ্নের জবাব শুনে স্তব্ধ হয়ে গেলো রাওনাফ। সে তার পেশার যে কয়েক বছর কাটিয়েছে সব প্রেশেন্ট কে সহজ ভাবে বুঝতে এবং বুঝাতে পেরেছে। তবে আজ এই মুহূর্তে সায়াহ্নের জবাবে তার ধারণা ভুল প্রমাণিত হচ্ছে। সায়াহ্নকে এই জবাবের পৃষ্ঠে কি জবাব দিবে তার জানা নেই!
সত্যি’ই তো সায়াহ্নেদের মতো যারা ভুক্তভোগী তাদের পালাতে সাহায্য তো আমরাই করি ।তাদের মুখের উপর দেয়াল টেনে তাদের সুন্দর নাম সরিয়ে আমরাই তাদের ধ’র্ষি’তা’র তকমা দেই।
সায়াহ্নের জ্বল জ্বল করা দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে রাওনাফ কোনো উত্তর খুজে পেলো না। তবে সে মনে মনে দৃঢ় এক সিদ্ধান্ত নিয়ে উঠে দাঁড়ালো। সেই সাথে সায়াহ্নের হাতজোড়াকে শক্ত করে ধরে তাকেও দাঁড় করালো। সায়াহ্ন কোনো প্রশ্ন করার পূর্বেই রাওনাফ বলল,
‘আমাকে আরেকটু বিশ্বাস করুন মিস.আমি আপনার বিশ্বাসে আঘাত দিবো না।’
চলবে…
[