প্রীতিকাহন পর্ব ৩৪

#প্রীতিকাহন❤
#লেখনীতে_কথা_চৌধুরী❤
#পর্ব_৩৪

❌কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ❌

হাঁটুর ওপর দুই হাত রেখে মুখ গুঁজে মিষ্টি ফুঁপিয়ে কাঁদছে। সেই দুপুরের আগে থেকে সে এই কান্না জমিয়ে রেখেছিল। এখন নবাবের কথা শুনে সেই কান্নার মেঘ বৃষ্টিতে রূপ নিলো। ক্রন্দনরত মিষ্টিকে দেখে নবাব যেন পাথর হয়ে গেল। কী করবে আর বলবে কিছুই বোধগম্য হচ্ছে না তার। কিন্তু এই মেয়েটাকে আর কাঁদাতে চায় না সে।

কত-শত সংকোচের বেড়াজালে বন্দি হওয়া হাতকে সচল করে যখন নবাব মিষ্টির মাথা স্পর্শ করলো, তখন সময় ব্যয় না করে মিষ্টি নবাবের হাত সরিয়ে দিলো। নবাব বুঝতে পারলো অভিমানে মিষ্টি এমন আচরণ করছে। তবে মিষ্টির এই অভিমানই যেন এখন নবাবের মাঝে সাহসের সঞ্চার করলো। সে পুনরায় মিষ্টির মাথার ওপর হাত রাখলো আর মিষ্টিও হাত সরিয়ে দিলো। কিন্তু এবার মিষ্টি মাথা উঁচিয়ে মুখেও প্রতিবাদ করলো, “রেখো না আমার মাথার ওপর তোমার হাত। আমি কখনও চাইনি তোমার জীবন ধ্বংস করে তোমার হাত আমার মাথায় পেতে; যেই হাত কিনা আমাকে ভরসা, সান্ত্বনা আর আশ্রয় দিবে।”

নবাবের চোখের কোলে একটু একটু করে পানি জমছে। তার হাড় ভাসা গলা দিয়ে সামান্য কথা আসতেও খুব কষ্ট হচ্ছে, “এই মিষ্টি, কতবার বলবো আমি, তুমি না এলেই আমার জীবন ধ্বংস হতো? কতবার বলবো বলো, তুমি না এলে আমার জীবন অপূর্ণ রয়ে যেত? কেন তুমি ঐ সোহেলের কথায় আমাকে এক নিমিষেই পর করে দিলে? আজ অবধি তোমার বিয়ে নিয়ে আমি কি কিছু বলেছি? কখনও তোমার সাথে এমন আচরণ করেছি যাতে তোমার মনে হয় আমি তোমার বিয়ের বিষয়গুলো মানতে পারিনি?”

“না, না, না। নবাব আমাকে…” মিষ্টির কান্না এবার বাঁধ ভাঙলো নবাবের প্রশ্নে। দ্বিতীয়বারের মতো মিষ্টি নিজের হৃদয়ের ব্যথা আর চোখের পানি নিয়ে নবাবের বুকে ঠাঁই নিলো। নবাবের শার্ট ডান হাতে খামচে ধরে মিষ্টি ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো, “আমাকে মেরে ফেলো না নবাব, আমাকে মেরে ফেলো। তোমার কষ্ট, তোমার অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ আমি আর নিতে পারছি না। আমি মরে গেলে আমার পরিবারেরও আমার প্রতি আক্রোশ থাকবে না।”

আচমকা এসে যখন মিষ্টি নবাবের বুকে মাথা রাখলো, তখন নবাব বিস্মিত হয়েছিল। কিন্তু নিজের সকল কষ্টের ভিড়ে ব্যাকুল মিষ্টি তার কাছে আশ্রয় নিয়েছে– এমনটা ভাবতেই নবাব নিজ মনে শান্তি অনুভব করলো। একটা সংকোচ নবাবকে ঘিরে ধরলেও নবাব পরম যত্নে মিষ্টিকে আলিঙ্গন করে বললো, “চুপ করো। আমি তোমাকে মরতে দিবো না। তোমাকে মরতে দিলে কি এতসব করতাম? সবার থেকে আড়াল করে নিজের সবটা দিয়ে আগলে রাখবো তোমায়। তুমি শুধু আমার ওপর একটু বিশ্বাস রেখো।” মিষ্টি জবাব দিলো না। কান্নার শব্দে ঘরের বাতাস ভারী করলো আর চোখের জলে নবাবের শার্টে অদৃশ্য দাগের সূচনায় ভেজাতে লাগলো।

.

আজকে দিনের শুরুটা নবাবের কাছে ছিল অতি চমৎকার। গতকাল বিকালে মিষ্টি যেই কান্নাকাটি করেছিল তা আজ সকালে নবাব দেখতে পায়নি বরং সকালে যখন মিষ্টির রুমে গেল নবাব, তখন সে দেখলো মিষ্টি প্রসন্ন মুখে রুমের ছোট্ট জানালা দিয়ে প্রকৃতি উপভোগ করছে।

“এই মিষ্টি, কখন ওঠেছো?” নবাব প্রশ্ন করতে মিষ্টি পূর্ণ দৃষ্টিতে দেখেছিল নবাবকে আর মৃদু হেসে জবাব দিয়েছিল, “অনেক আগে।” কক্সবাজারে এসে আলাদা রুমেই রাত্রিযাপন করছে মিষ্টি আর নবাব। তাই নবাব টের পায়নি মিষ্টির জেগে ওঠার বিষয়ে।

নবাব বিছানায় বসতে মিষ্টি জানালা থেকে সরে এলো। নবাবের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো, “কালকে কখন ফিরবো আমরা?”

“আরে যাবে তো৷ এসব বাদ দিয়ে চটপট তৈরি হয়ে নাও।”

“কেন?” অবাক হলো মিষ্টি।

“নাস্তা সেরে আমরা মাথিনের কূপ দেখতে যাবো।”

“সেটা আবার কোথায়?”

নবাব ওঠে দাঁড়িয়ে মিষ্টির কাছাকাছি হলো আর নিচু গলায় বললো, “যেখানে বিরহী প্রেমের ঐতিহাসিক স্মৃতিচিহ্ন গাঁথা আছে।”

পরোটা, সবজি আর চা দিয়ে সকালের নাস্তা শেষ করলো নবাব। মিষ্টিও তাই খেলো শুধু চায়ের স্বাদ নিতে আপত্তি করলো, “দেখো, আমি চা খাই না সেটা তোমার অজানা নয়। বারংবার চা খাওয়ার কথা জিজ্ঞেস করো না তো।” মিষ্টি বিরক্ত হয়েছিল সেটা টের পেয়ে নবাব কেবল ঠোঁট টিপে হেসেছিল।

বাস ধরে ঘন্টা দুয়েকের মধ্যে নবাব আর মিষ্টি পৌঁছে গেল সবুজ পাহাড়ে ঘেরা টেকনাফে। নাফ নদীর পাশে টেকনাফ পুলিশ ফাঁড়ির চত্বরে যত এগিয়ে যাচ্ছে মিষ্টি, ততই তার কৌতূহল আকাশ ছুঁই ছুঁই করছে।

“নবাব, তুমি এত জায়গা সম্পর্কে জানো কীভাবে? আমি কখনও এই জায়গার নামই শুনিনি। তুমি কীভাবে জানলে?” মিষ্টি নিজের কৌতূহল দমিয়ে রাখতে ব্যর্থ হলো আর তাই নবাবকে জিজ্ঞেস করে ফেললো।

কক্সবাজারে নিজেদের কিঞ্চিৎ নিরাপদ মনে করায় নবাব মাস্ক ব্যবহার করছে না। তবে চুল সামলাতে গিয়ে ক্যাপ পড়তে হচ্ছে। মুখের দাড়ি এখন বেশ গজিয়ে গেছে আর সেই মুখভর্তি দাড়িতে মৃদু হেসে পথে চলেছে নবাব।

“এই হাসছো কেন? জানি না বলে হাসছো আমার ওপর?” মিষ্টির কন্ঠে অভিমানের সুর নবাবের হাসির মাত্রা দ্বিগুণ করলো। হাসিতে মত্ত নবাব মিষ্টিকে বললো, “কারণ বলতে গেলে তুমি হয় আমাকে ইতিহাসবিদ নয় ভালোবাসাবিদ বানিয়ে দিতে পারো।”

“ভালোবাসাবিদ? এ আবার কেমন কথা?” বুঝতে পারলো না মিষ্টি।

মিষ্টির পাশাপাশি হাঁটতে গিয়ে নবাব বললো, “বিদেশে যাওয়ার পর তো আর দেশে আসিনি কিন্তু যখন দেশে এলাম, তখন ফিরে গিয়ে হঠাৎ আমার বই পড়ার খুব নেশা হলো। বলতো পারো তোমাকে অনুভব করতাম বইয়ের পাতায়।” নবাবের কথায় হালকা লজ্জা এসে মিষ্টির দৃষ্টি চঞ্চল করলো, “তুমি কিন্তু বাজে বকছো নবাব। আমি কিন্তু তোমায়…” মিষ্টির কথার মাঝে নবাব বললো, “তুমি এসব বলবে আমি জানতাম। তাই তো বলতে চাইছিলাম না।”

মিষ্টির লজ্জা কাটেনি তবুও সে বললো, “বইয়ের পাতায় মানুষ কাহিনি, লেখক আর লেখকের তৈরি চরিত্রকে অনুভব করে। আর তুমি কিনা বলছো…” আবারও মিষ্টিকে থামিয়ে নবাব বললো, “এই মিষ্টি, আমার কাছে তো তুমিই দুর্বোধ্য এক কাহিনি, আমার কাছে তো তুমিই লেখক যে আমাকে নিয়ে কাহন সৃষ্টি করলে আমি ধন্য হবো। আর সেই কাহনে তুমিই হবে আমার সুপ্রিম চরিত্র যাকে ঘিরে আমি আজন্ম প্রীতিকাহন রচনা করবো।”

“আমি তোমাকে মাথিনের কূপ সম্পর্কে বলতে বলেছি নবাব, এসব কাব্যিক কথা শোনাতে বলিনি।” লজ্জা তিরতির করে বাড়তেই মিষ্টির কন্ঠ কাঁপতে শুরু করলো। হাঁটা বন্ধ করে যখন মিষ্টি স্থির হলো, তখন নবাব উচ্চৈঃস্বরে হেসে বললো, “হিজাবের আড়ালে তোমার চেহারায় হয়ত কিছু একটা ভাসছে যা আমার দেখা হলো না।… যাক গে, আগে ভেতরে চলো তারপর বলছি।” মিষ্টি কিছু বললো না তবে নবাব সামনে এগিয়ে যেতে একটা তপ্ত নিশ্বাস ফেলে পূর্ণ দৃষ্টিতে দেখলো নবাবকে। এরপর নবাবের পথে মিষ্টিও হাঁটতে শুরু করলো।

সজ্জিত প্রাঙ্গনের মধ্যে ছাউনিতে ঢাকা একটা কূপ দেখিয়ে নবাব মিষ্টিকে বললো, “এই মিষ্টি, এটাই মাথিনের কূপ।”

মিষ্টি কয়েক কদম এগিয়ে নিথর জলের দিকে তাকাতেই ওর মনে খেলে গেল হিম শীতল অনুভূতি। এই অনুভূতির সাথে যেন মিষ্টি বহুদিন থেকে পরিচিত। কূপের জল দেখে এবার সে নবাবকে জিজ্ঞেস করলো, “মাথিন কি কোনও বিখ্যাত পুরুষ?”

“না, না, মাথিন তো একটা মেয়ের নাম।”

“মেয়ে?” অবিশ্বাসে কপাল কুঁচকে এলো মিষ্টির।

“হ্যাঁ। বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে আদিবাসী সম্প্রদায়ের এক রাজার কন্যা ছিল, যার নাম মাথিন।”

“ও আচ্ছা, রাজার মেয়ে ছিল বলে কূপের নাম উনার নামে হয়েছে, তাই তো?”

মৃদু হেসে মাথা নাড়ালো নবাব, “নাহ, সেজন্য রাখা হয়নি।”

“তাহলে?”

“১৯২৩–১৯২৪ সালের দিকে পুলিশ কর্মকর্তা হিসেবে কক্সবাজারের টেকনাফে কর্মরত ছিলেন ধীরাজ ভট্টাচার্য। তখন মাথিন এই পাত কুয়া থেকে জল নিতে আসতেন। থানার নবাগত সুদর্শন তরুণ কর্মকর্তা ধীরাজ থানায় বসে বসে মাথিনের পানি আনা-নেয়া দেখতেন। এভাবে ধীরাজের সঙ্গে মাথিনের দৃষ্টি বিনিময় এবং পরে প্রণয়ের সূচনা হয়। এরপর হঠাৎ একদিন বাবার অসুস্থতার কথা জানতে পেরে ছুটি নিয়ে সন্ধ্যার অন্ধকারে কাউকে কিছু না বলে কলকতায় ফিরে যান তিনি। গোত্র আভিজাত্যের প্রতিবন্ধকতায় ধীরাজ-মাথিনের বিয়ে হয়নি। তাছাড়া ধীরাজ আর ফিরে আসেননি। এদিকে মাথিনও তাকে ছাড়া জল-খাবার মুখে তুলবেন না বলে পণ করেন। সমধুর প্রেমের করুণ বিচ্ছেদে মাথিন তিলে তিলে মৃত্যুবরণ করেন। এতে শাশ্বত অকৃত্রিম প্রেমের এক ইতিহাস বিরচিত হয়। মাথিনের অতৃপ্ত প্রেমের অমোঘ সাক্ষী হলো এই মাথিনের কূপ।” একটু থামলো নবাব। দুই হাত তফাতে দাঁড়ানো মিষ্টির দিকে নবাব এগিয়ে এলেও মিষ্টি কুয়ার জলেই নিমগ্ন রইলো। নবাব তার স্থির দৃষ্টিতে মিষ্টিকে দেখলো আর নরম কন্ঠে বললো, “আমার আর তোমার ব্যাপারও ধীরাজ মাথিনের মতো। ওদের মিলন হয়নি গোত্র আভিজাত্যের প্রতিবন্ধকতায় আর বয়সের অমিলহেতু আমাদেরও মিলন হতে দিতো না।”

মিষ্টি নিরবে শুনছে আর নবাব বলছে, “যদি আমাদের পরিনতি ধীরাজ আর মাথিনের মতো হতো তবে আমিও এমন স্মৃতিচিহ্ন তৈরি করে আমাদের ভালোবাসাকে অমর করে দিতাম।”

“ওঁরা পরস্পরকে ভালোবাসতো কিন্তু সেসব তো আমাদের…” মিষ্টি মাঝ বাক্যে থামতেই নবাব জানতে চাইলো, “থামলে কেন? মিথ্যা কথাটা বুঝি মুখ দিয়ে আসছে না?”

“মিথ্যা কেন হবে?” প্রশ্ন করতে গিয়ে মিষ্টির গলা কাঁপলো আর সেটা স্পষ্ট বুঝতে পেরে নবাব বললো, “এই মিষ্টি, তোমার নবাব না তোমাকে অনেক চেনে গো। তার কাছে মিথ্যা বলো না কারণ এতে ফায়দা হবে না।… সে বুঝে তোমার মনের অবস্থা, সে জানে তুমি কতটা উদ্বিগ্ন নবাবের চিন্তায়, সে অনুভব করে কতটা স্পন্দনে তোমার চেহারা আরক্ত হতে পারে। তার কাছে এসবের নামই ভালোবাসা; মিষ্টির মিষ্টি ভালোবাসা।”

…চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here