#প্রীতিকাহন❤
#লেখনীতে_কথা_চৌধুরী❤
#পর্ব_৩৫
❌কপি করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ❌
“এ কেমন অনুভূতি হায়! ইচ্ছে করছে কোথাও লুকিয়ে ফেলি নিজেকে। এত লজ্জায় কেন ফেলছে ও আমায়? কেন এসব বলে আমার হৃদয়ের স্পন্দন বৃদ্ধি করছে?” লজ্জায় পাথর হওয়া মিষ্টি নিজ মনে এসব ভাবলেও প্রসঙ্গ বদলে দিতে নবাবকে জিজ্ঞেস করলো, “তুমি এদের ইতিহাস জানলে কী করে?” মাথা নত রেখে মিষ্টি প্রশ্ন করতেই নবাবের ভ্রুকুঞ্চন হলো। কিন্তু হালকা হেসে জবাব দিলো, “বললাম তো বইয়ের নেশায় আমাকে ধরেছিল। তখন বইয়ের অনেক খোঁজ করতাম আর ধীরাজ ভট্টাচার্য একজন অভিনেতা ছিলেন। টেকনাফ ছাড়ার পর তিনি আর পুলিশের চাকরিতে যোগ দেননি। এরপর বই লিখেছেন নিজের জীবনের ওপর। তেমনই একটা আত্মজীবনীগ্রন্থ হলো ‘যখন পুলিশ ছিলাম’ আর এতেই উনি মাথিনের সম্পর্কে তুলে ধরেছিলেন। বইতে পড়ে আমার অনেক আগ্রহ হয়েছিল এই জায়গা একবার নিজের চোখে দেখে যাবার। বিদেশে বসেই সব পরিকল্পনা করে রেখেছিলাম কিন্তু পরিকল্পনা অনুযায়ী এখানে হানিমুনে আসার কথা ছিল না।” বলেই মুচকি হাসলো নবাব।
ছন্দহীন চোখের পলকের আড়ালে নিজের অস্বস্তি লুকিয়ে মিষ্টি জানতে চাইলো, “মানে?”
“আমি তো তখন জানতাম না তোমার সাথে আমার বিয়ে হবে। আমাদের বন্ধুত্বের কথা সবাই জানলেও আমাদের পরিবার কখনও দুইজনকে একা এখানে আসতে দিতো না। তাই ভেবেছিলাম দেশে ফিরে সবাইকে নিয়ে এখানে আসবো। কিন্তু দেখো, আল্লাহ কেবল তোমার সাথেই আমাকে এখানে আনলেন। আমার ভাগ্য দেখলে? এমন ভাগ্য লোকে সাত জন্মেও পায় না।” বলেই বেশ ভাব নিয়ে নবাব শার্টের কলার ঝেড়ে কোমড়ে হাত দিয়ে দাঁড়ালো। এদিকে নবাবের ভাবসাব দেখে তাচ্ছিল্যের সুরে মিষ্টি বললো, “ইশ, কী ভাব!”
“আলবাত ভাব। নবাবের ভাব থাকবে না তো কার থাকবে?” নবাবের মাঝে কিঞ্চিৎ ছেলেমানুষী দেখে মিষ্টি শব্দ করে হেসে উঠলো আর তাকে মুগ্ধ নয়নে দেখে নবাব বললো, “এই হাসিতে আমার মরণ হোক।”
.
কক্সবাজারের আকাশে আজ ঝলমল করছে পূর্ণিমার মস্ত বড়ো চাঁদ। চাঁদের আলো উপচে পড়ছে বিশাল সাগরের বুকে। দিনের সাগর যেমন মনকে বিমোহিত করে, তেমনি রাতের সাগরও হৃদয়কে পুলকিত করে। একরাশ মুগ্ধতা যেন জমছে মিষ্টির চিত্তে। সে বিভোর হয়ে আছে রাতের আকাশে, বাতাসে আর সাগরে। অন্যদিকে নবাব ডুবে আছে তার মিষ্টিতে। অনেকক্ষণ যাবত সে মিষ্টিকে দেখছে আর মিটমিট করে হাসছে।
জ্যোৎস্নার আলো ব্যতীত অন্য কোনও আলোর হদিস নেই বালুচরে। তাই নবাব মিষ্টির চেহারা স্পষ্ট দেখতে না পেলেও বুঝতে পারছে তার প্রতিক্রিয়া। চারপাশে মানুষের কোলাহল আর ক্লান্ত সাগরের মৃদু শব্দ ছাপিয়ে নবাব নিজের কন্ঠে ধ্বনি তুললো, “মিষ্টি?”
মিষ্টি নবাবের দিকে মুখ ফেরাতে নবাব জানতে চাইলো, “কিছু খাবে?”
“উঁহু।”
“এই মিষ্টি, কী দেখছো এত?”
“আকাশ, সাগর আর স্বাতী নক্ষত্র।”
“স্বাতী নক্ষত্র?” অবাক হলো নবাব এরপর জানতে চাইলো, “তুমি এসব এখনও মনে রেখেছো?”
“হ্যাঁ।”
“কিন্তু আমি তো কেবল একদিনই বলেছি এসব নিয়ে।”
মিষ্টি মাথা নুইয়ে নিলো। মলিন কন্ঠে সে জবাব দিলো, “সেদিনের পর আমি আর ভালো থাকিনি নবাব। সেদিনের পর এই স্বাতী নক্ষত্রই আমার একমাত্র সঙ্গী ছিল।”
মিষ্টির পাশেই বসা নবাব খানিকটা এগিয়ে এসে ওর হাত ধরে বললো, “আমি এমনটা করতে চাইনি মিষ্টি। আজকে বলতে কোনও বাঁধা নেই। তাই আমি তোমাকে আজকে কিছু বলতে চাই মিষ্টি।”
“আমারও কিছু জানবার আছে নবাব। কবে থেকে তুমি আমাকে…” স্বভাবতই মিষ্টি বাক্য অসম্পূর্ণ রেখে দিলো কিন্তু নবাবের সম্পূর্ণই বোধগম্য হলো।
“হুম, বলবো তোমায় মিষ্টি। আজ মন খুলে বলবো তোমায়।” ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেলে নবাব বলতে শুরু করলো, “আমার দিনক্ষণ মনে নেই মিষ্টি। আমি জানি না আমি কবে থেকে তোমাকে ভালোবাসতে শুরু করেছি। কিন্তু তুমি যখন ভার্সিটির স্টুডেন্ট আর আমি এবং মা তোমাদের বাসায় নিমন্ত্রণে গেলাম। সেদিন তোমাকে দেখে আমার হৃদয়ের স্পন্দন শুনতে পেয়েছিলাম। আমার আজও মনে আছে, হলুদ থ্রি-পিস পরা তুমি দরজা খুলে মিষ্টি করে হেসে বলে উঠেছিলে, ‘কেমন আছো ফুপি?’ ডান পাশে সিঁথি করে খোঁপা করা চুল, অতি সামান্য থ্রি-পিসে নিজেকে সজ্জিত করা তোমার মাঝে আমি হুট করেই হারিয়ে ছিলাম। সত্যি বুঝতেও পারিনি, আমি কেন হারালাম তোমাতে?… তোমাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম তোমার বয়ফ্রেন্ড আছে কি না, তখন কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে বলে উঠেছিলাম, ‘ছোট ছোট আর বাচ্চা বাচ্চা করো না তো। তাছাড়া আমি তোমাকে বন্ধু হতে বলেছি। বউ হতে বলেছি কি?’ বিশ্বাস করো এত লজ্জায় পড়েছিলাম যে সারারাত ঘুমাতে পারিনি।”
মিষ্টি নিচু গলায় বললো, “সেদিনের কথা আমারও মনে আছে। তোমার বয়স তখন বেশি নয়, সতেরো। তুমি বলেছিলে আমার সাথে কথা বলতে না-কি তোমার সংকোচ হতো আর সেটা নিয়েই আমাদের একটু…”
“হ্যাঁ, তবে তোমাকে সেদিন বউ সম্বোধন করার পর ঘুনাক্ষরেও বুঝতে পারিনি আমি তোমাকে ভালোবাসবো আর বউ হিসেবে পাবো।” মিষ্টি চুপ করে রইলো নিজের হাত নবাবের কাছে বন্দি রেখে। হাত ছাড়ানোর কোনও চেষ্টা ওর মাঝে নেই বিধায় নবাবও আঁকড়ে ধরে বলে গেল, “মিষ্টি, আমি কিছু অন্যায়ও করেছি যা আমাকে এখনও আঘাত করে। সেসব শুনলে কি তুমি রাগ করবে?”
যদিও জ্যোৎস্নার আলোয় নবাবের মুখাবয়ব স্পষ্ট নয় তবুও মিষ্টি তাকালো নবাবের দিকে, “নবাব, অতীতে আমাদের জীবনে অনেক কিছুই ঘটে। আমাদের উচিত অতীত মনে রেখে সেখান থেকে শিক্ষা নিয়ে এগিয়ে যাওয়া। অতীত পুষে কষ্ট পেয়ে বর্তমান আর ভবিষ্যৎ নষ্ট করার কোনও মানে হয় না। তোমার আজকে যা মনে আসে বলো। আমি চুপটি করে শুনবো। একটা কথা মনে রেখো, আমি মুখে যা-ই বলি না কেন? মনের ঘরে তোমার জন্য কখনও রাগ আর ঘৃণার ঠাঁই হবে না।”
“আমি জানি মিষ্টি। তাই তো আজ তোমায় সেসব কথা বলতে চাই, যা আমার মা-বাবাও জানেন না।”
“তাই তো আজকে সারারাত তোমার জন্য বরাদ্দ করলাম। তুমি বলবে, আমি শুনবো।”
নবাব হাসলো কিন্তু জ্যোৎস্নার আলোয় সেটা মিষ্টির নজরে পড়লো কিনা তা ওর অজানা। নবাব বললো, “সেই বৃষ্টির রাতে আমি তোমার কাছে জানতে চেয়েছিলাম, ‘তাহলে সেই বিশ্বাসকে পুঁজি করে আমি যদি বলি আমি তোমায় ভালোবাসি। তবে কি অবিশ্বাস করবে মিষ্টি?’ এটা মন থেকে বলেছিলাম মিষ্টি, রসিকতা ছিল না।”
“কী বলছো তুমি?” মিষ্টির প্রশ্নে নবাব হাত আলগা করে দিতে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিলো মিষ্টি।
মাথা নুইয়ে নবাব এবার বললো, “হ্যাঁ মিষ্টি, এটা সত্যি ছিল। অর্ষাকে আমি কখনওই হৃদয়ে ঠাঁই দিতে পারিনি। ওর সাথে হয়ত রাত জেগে কথা বলতাম কিন্তু প্রতিটা মূহুর্তে তোমার শূন্যতা অনুভব করতাম। অর্ষার সাথে যেদিন শেষ কথা হয়, তার আগের রাতেই আমি বুঝেছিলাম৷ আমি বুঝেছিলাম মিষ্টি তোমার কাছেই আমার হৃদয় বন্দি। বয়স কম ছিল তাই তুমি আমাকে বুঝাতে ভাবলাম বয়সের দোষ। কিন্তু বিশ্বাস করো বড় হয়েও তোমার কাছেই মনস্থির ছিল আর এখনও আছে। তুমি আমার চেয়ে বয়সে বড় হলেও আমি ভালোবেসেছি, পরিবার এবং সমাজ আমাদের সম্পর্ক অন্য চোখে দেখতে পারে জেনেও ভালোবেসেছি। কী করবো বলো? আমি তো তোমার মন দেখেছি, বয়স নয়।”
বিস্মিত কন্ঠে মিষ্টি বললো, “কিন্তু এসব তো তুমি আমাকে বুঝতে দাওনি নবাব৷ ঐ প্রশ্নের জবাবে রসিকতা বলার পর সেসব নিয়েও কখনও কথা বলোনি আর না কখনও বুঝিয়েছো।”
“আমি তোমাকে অসম্মান করতে চাইনি মিষ্টি তাই সেসব বিষয় নিয়ে কখনও আলোচনায় আসিনি। তাছাড়া আমাদের সম্পর্ক গাঢ় হলেও আমার কাছে যে তোমাকে দেওয়ার মতো কোনও ভবিষ্যৎ ছিল না। আমি যে তখন তোমায় পারতাম না আমার করে নিতে।… জানো, ভাগ্য আমার অনেক সহায় ছিল এবং এখনও আছে। তাই তো আজ তোমাকে পেলাম।”
“ভাগ্য সবটায় সায় দেয়নি নবাব। অন্তত আমার সেটা মনে হচ্ছে না। তুমি জোর করে আমায় না আনলে কী ভাগ্য সহায় হতো?”
“হ্যাঁ, হতো। তবে তোমাকে একটা নাম যোগ করতে হতো।”
“নাম?”
“হ্যাঁ, ডিবোর্সি।” শব্দটা উচ্চারণ করতে গিয়ে সোহেলের প্রতি এক ধরণের ক্রোধ অনুভব করলো নবাব। কিন্তু সেটাকে মুহুর্তেই ঘুম পাড়িয়ে মিষ্টিকে বললো, “তোমার থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেওয়ার চেষ্টা তখনই শুরু করেছিলাম, যখন পাত্রপক্ষ তোমাকে দেখতে আসে। জানো, তোমাকে হারানোর ব্যথা হৃদয় এমনভাবে ভেসে উঠেছিল যে আমি বাধ্য হয়ে সেদিন W-e-e-d খেয়েছিলাম।”
“W-e-e-d?”
“গা-ঁজা।”
“মানে? এই, কী বলছো তুমি এসব?” আঁতকে উঠলো মিষ্টি।
“হ্যাঁ, আমি সত্যি বলছি মিষ্টি। আমি তোমাকে হারানোর ব্যথা ভুলিয়ে দিতে তাই খেয়েছিলাম। জীবনে যা ছুঁড়ে দেখিনি তাই শরীরে ঢুকিয়ে ছিলাম। এরপর সিগারেট খাওয়া শুরু করলাম। যেদিন ইফাদের সাথে তোমার বাগদান অনুষ্ঠান ছিল, তার আগের রাতে তোমার সাথে কথা শেষ করে সারারাত বাইরে ছিলাম।”
“কেন?” বুঝতে না পেরে।
ফিকে হেসে নবাব বললো, “ঘরে সিগারেট খেলে যে বাড়ির লোকে টের পেয়ে যাবে। তাই বাইরে থেকে একের পর এক সিগারেটের ধোঁয়ায় নিজেকে শান্ত করতে চেয়েছিলাম। নেশা হয়েছিল কিনা জানি না। তবে তোমাকে ভুলা হয়নি। তোমাকে হারানোর বিষয়টা আমি মেনে নিতে পারিনি মিষ্টি। তাই তোমাকে ফেলে চলে গিয়েছিলাম বিদেশে। বিশ্বাস করো এছাড়া আমার কোনও পথ ছিল না। মাঝে মাঝে তখন মরে যেতে ইচ্ছে করতো। কিন্তু আমি মরে গেলে হয়ত তুমি নিজেকে দোষী করতে৷ বিনাদোষে তোমাকে দোষী করতে চাইনি বলে পালিয়ে গিয়েছিলাম।”
“এরপর ফিরে এলে? কেন? আমার ওপর দয়া দেখাতে?” মুখ ফিরিয়ে নিলো মিষ্টি। কন্ঠে ভাসছে গাম্ভীর্য।
এক গাল হাসলো নবাব, “অভিমান হচ্ছে খুব, না? কিন্তু ফিরে আসার পর যে হাউমাউ করে কেঁদে আমাকে জড়িয়ে ধরেছিলে তা কিন্তু ভুলে যেও না। সবার সামনে আমার মিষ্টি আমার বুকে ঠাঁই নিয়েছিল ঠিক কালকের বিকালের মতো।”
“তুমি কিন্তু লাগামহীন হচ্ছো নবাব।” দাঁতে দাঁত চাপলো মিষ্টি।
“কেন? অস্বীকার করছো?” নবাবের প্রশ্নে এবার মিষ্টির মাঝে হতাশা হাতছানি দিচ্ছে, “নাহ, অস্বীকার কেন করবো? তোমার কোনও কিছুতে রাগ করতে পারি না বলেই তো তুমি সবসময় এমন করো আমার সাথে। হঠাৎ করে বিদেশে চলে গিয়েছিল। যোগাযোগও বন্ধ করে দিয়েছিলে এরপর আবার হুট করে দেশে এলে। আমার পাশে থেকে আমাকে সাপোর্ট দিলে এরপর চলে গেলে। যখন দ্বিতীয়বার বিয়ের কথা উঠলো তখনও আবার গায়েব হয়ে গেলে।”
…চলবে