প্রীতিলতা পর্ব -০১

বিয়ের পর প্রথম যেদিন শ্বশুর বাড়িতে পা রাখি সেদিন বুঝতে পেরেছিলাম এই নতুন জগৎটা আমার জন্য মোটেও সহজ হবে না। বাবার বাড়িটা দারিদ্র্যতায় পরিপূর্ণ থাকলেও সুখ শান্তি ছিল আকাশ ছোঁয়া। বাবা-মায়ের অতি আদরের সন্তান ছিলাম বলে অভাব শব্দটার সাথে তেমন পরিচিত ছিলাম না।

কিন্তু তাদের আদরও ভালোবাসা সুরক্ষা বলায় ভেঙে যখন এই আলিশান বাড়িতে পা দিলাম তখন বুঝেছিলাম এখানে রূপ-সৌন্দর্য ও অর্থ-আভিজাত্যের রাজত্ব চলে সুখ শান্তির পায়রাদের এখানে প্রবেশ নিষিদ্ধ।

স্বামী নামক যে মানুষটার হাত ধরে এই রাজত্বের প্রবেশ করেছিলাম। ধীরে ধীরে উপলব্ধি করতে শুরু করি মানুষটা ঠিক অপরিচিতা গল্পের অনুপমের মতো “মাকাল ফল”।রূপ সৌন্দর্য ও শিক্ষায় আইন বিষয়ে স্নাতকোত্তর পাশ করেও তা ব্যবহারিক ক্ষেত্রে কোন কাজেই লাগাতে পারেননি তিনি।

স্বাধীনচেতা ও বাউন্ডুলে স্বভাবের কারণে পরিবারের কাছে তার অবস্থান কোথায় তা সে উপলব্ধি না করতে পারলেও আমি বুঝতে পেরেছিলাম তার অবস্থান।

সোজা বাংলায় তাদের এই বাউন্ডুলে স্বাধীনচেতা বড়লোকের বিগড়ে যাওয়া ছেলেটাকে একটু হাতের আয়ত্তে আনার জন্য আমাকে বলির পাঠা বানানো হয়েছে। কিন্তু আদৌ কি তা সম্ভব।

বিয়ের পরের দিন সকালে ফুপু শাশুড়ি তো বেশ রসিয়ে রসিয়ে বলছিলেন রূপের জোড়েই নাকি আমি এ বাড়ির বউ হতে পেরেছি তা নাহলে আমার বাবার যে আর্থিক জোর আছে তা দিয়ে নাকি এ বাড়ির ত্রি সীমানায় আসার যোগ্যতা আমার ছিল না।

কথাগুলো শেষ করে ফুপু শাশুড়ি আভিজাত্যপূর্ণ একটা পরিতৃপ্তের হাসি হাসলেন। যার বিপরীতে কেউ উচ্চবাচ্য করলেন না। প্রমাণ করে দিলেন এখানে কেউই আমার আপন নয়। একান্ত আপন যিনি হয়েছেন তিনি এই সভার ধরাছোঁয়ার বাইরে ছিলেন।

মাথা নিচু করে শুধু কথাগুলো হজম করেছিলাম। কারণ গরিব মানুষদের অর্থের জোগান না থাকলেও আত্মসম্মান ও মর্যাদা বোধের জোর প্রবল। সম্মান রক্ষার্থে তারা নিজেদের জীবন বলিদান দিতেও পিছপা হয় না। কিন্তু যখন তারা এই জোর দেখাতে ব্যর্থ হয় তখন তারা মাথা নিচু করে অপমান হজম করতে শিখে যায়।যেমন আমিও শিখে গেছি।

এই বাড়ির প্রতিটা মানুষেরই আচার-আচরণ কেমন অদ্ভুত রকমের। মনে হয় সবাই যন্ত্রচালিত এক একটা যান্ত্রিক পুতুল। একটা নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যের পেছনে সবাই ছুটে বেড়াচ্ছে। না আছে কারোর মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক না আছে একে অপরের প্রতি সহমর্মিতা।

_______🌺🌺________

চোখের পলকে বিয়ের সপ্তাহটা ঘুরে গেল। এখনো পর্যন্ত ফেরানিতে বাবার বাড়িতে গেলাম না। একপ্রকার মনের অভিমান ও ক্ষোভ থেকেই যায়নি আমি। তাছাড়া যার সাথে জোট বেঁধে ফেরানিতে যেতে হয় তার সাথে মনের সম্পর্ক তো দূরের কথা চোখের সীমানাতেও তাকে বাঁধতে পারিনি এখনো।

দিনশেষে শুধু রাতের বেলাতেই তার সাথে আমার দেখা হয়। প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র এগিয়ে দেওয়া এই নিয়ে ই যা এক দুই কথা হয় মাত্র।

এখনো অব্দি উপলব্ধি করতে পারলাম না আমি কি তার অপছন্দ নাকি খুবই অপছন্দের তালিকায়। কারণ তার প্রতিক্রিয়া দেখে মোটেও মনে হয়নি তার পছন্দটা আমার সাথে যায়।

আমার সারাদিনটা কাটে বদ্ধ চার দেয়াল এর মাঝে। রান্নাঘরটা একছত্র শাশুড়ি মায়ের দখলে। আর তাকে সাহায্য করার জন্য রয়েছে দুজন গৃহ পরিচারিকা। আমার সারাদিনের কাজ বলতে নিজের এই ঘরটা গুছানো আর শ্বশুর মশাইকে সারাদিনের নিয়ম করে চার কাপ চা বানিয়ে খাওয়ানো।

হয়তো অনেকের মনে হতে পারে শাশুড়ি মা নিষেধ করলেই কেন রান্নাঘরের ছায়া মারানো যাবে না। কিন্তু উনার সাথে সাক্ষাৎ হলেই আমার কাজে বাধা দিয়ে প্রথমে জিজ্ঞাসা করেন উনার ছেলে কখন ফিরবেন, কোথায় আছেন , কি করছেন, যার একটার উত্তরও আমার কাছে নেই।

মুখের উপরে একনাগাড়ে না বোধক উত্তর দেওয়ার চেয়ে লুকিয়ে বেড়ানোই শ্রেয়। শাশুড়ি মা হয়তো মনে করেন বিয়ের পরের দিনই তার ছেলে শুধরে যাবেন।হিহি হিহি ব্যাপারটা সত্যি হাস্যকর তাই না।

আমার বিকালটা কাটে ছাদে, কিন্তু অন্যরকম ভাবে। এ সময়টা নিজেকে একজন মানুষ মনে হয় আমার । কারণ এই যান্ত্রিক মানবদের মাঝে একটা ছোট্ট ফুল বাস করে। তিনি আমার ছোট ননদ ক্লাস ফাইভে পড়ে।

সারাদিন স্কুল কোচিং শেষ করে বিকালের সময়টাতেই তার অবসর মেলে। তখন সে গুটিগুটি পায়ে আমার কাছে চলে আসে এবং আমরা ছাদে চলে আসি এই সময়টাকে উপভোগ করার জন্য।

আমার নাম শামসুন্নাহার প্রীতি। কিন্তু আমাকে ও প্রীতিলতা বলে ডাকে। আমিই ওকে ভাবি ডাকতে নিষেধ করেছি। তাই সে অনেক ভেবে চিন্তে এই নামটি বেছে নিয়েছে “প্রীতিলতা”। নামটা অনেক সুন্দর তাই না আমারও অনেক পছন্দ হয়েছে। আমি ওর একটা নাম দিয়েছি “পুতুল” কারণ ও দেখতে একদম পুতুলের মত।

আমি ওর সাথে বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়তে চেয়েছি ভাবি ননদের মধ্যকার ওই জটিল সম্পর্ক নয়।

_______🌺🌺________

শুক্রবার,

আজও বিকালে সবাইকে লুকিয়ে আমরা ছাদে চলে এসেছি। সবাই এখন যে যার রুমে। এই ফাঁকে ওই ছোট্ট দুটো পায়ের সাথে তাল মিলিয়ে আমিও গুটিগুটি পায়ে ছাদে চলে আসলাম।

আমার বিকালটা কাটে ওকে ঘিরে। মাঝে মাঝে ওর সাথে কানামাছি খেলে আবার মাঝে মাঝে ওর সারাদিনের গল্প শুনে। যখন আমার কোলে বসে আমার গলা জড়িয়ে ধরে ওর সারাদিনের গল্প বলে, তখন আমিও ওকে দুহাতে আলতো জড়িয়ে ধরে চোখ বন্ধ করে ভাবি,

” এই বাড়িতে এই মেয়েটা না থাকলে হয়তো এত দিনে দম বন্ধ হয়ে এই কাল কুটুরিতে অপমৃত্যু হতো আমার।”

আজ সে আমাকে তার অনেক অভিমানের কথা বলল। এতদিন নাকি তার কথা শোনার লোক বাড়িতে ছিল না। ছোট মানুষ বলে তার কথার কোন গ্রহণযোগ্যতা নেই।

আমি তার কথা শুনে তাকে জড়িয়ে ধরে হাসি, খুব হাসি।

কত পাকা পাকা কথা বলে মেয়েটা ।পাকা বুড়ি একটা।

কি সাংঘাতিক অভিযোগ !

এই পাকা বুড়ির কথা নাকি কেউ গুরুত্ব দেয় না। তার কথা শোনার কারোর সময় নেই।বলতে গেলে সত্যিই তাই

এতদিন আসলাম এই বাড়িতে এক জায়গায় বসে গল্প করা তো দূরের কথা খাওয়ার টেবিলেও পুরো পরিবারকে একসাথে পাওয়া যায় না। কত ব্যস্ততা এদের মাঝে , পরিবারকে সময় দেওয়ার মতো সময় নেই এদের কাছে।

ছোটবেলার কথা মনে পড়ে গেল। আমি এবং আমার ছোট ভাই সব সময় রাতের খাবারটা বাবার সাথে খেতাম। বাবার বাসায় আসতে অনেক দেরি হতো। আম্মু আমাদের কে খেয়ে ঘুমিয়ে পড়তে বলতো কিন্তু সেই রাত জেগে আমরা বসে থাকতাম। কখন আব্বু আসবে। আমি আর আমার ভাই খেতে খেতে আমাদের সারাদিনের গল্পগুলো আব্বুর সামনে উগরে দেব। আর সেই গল্প শুনে আব্বু খিলখিল করে হাসতেন। আমারও বেশ আনন্দ হতো।

পুরনো স্মৃতি, ঘাটতে ঘাটতে চোখের কোণে অশ্রু বিন্দু জমা হলো। এখন সব স্মৃতি হয়ে গেছে। আমার খুব জানতে ইচ্ছা করে বাবা কী এখন বাড়ি ফিরে তার মেয়ের গল্প গুলো মিস করে…

বাবা তো সব সময় বলতো আমি তো তার রাজত্ব বিহীন রাজকন্যা। তাহলে হঠাৎ এমন বোঝা হয়ে গেলাম কেন? কেন আমাকে তারা এত তাড়াতাড়ি পর করে দিল।তারা এত ভুলে গেল কেন আমাকে?

আমি বুঝি বড়লোক বাড়ির সাথে আত্মীয়তা করেছে, সৌজন্য সাক্ষাতে অনেক কিছু উপহার সামগ্রী দিতে হয়। যার সামর্থ্য আমার বাবা-মার নাই তাই এখন মেয়েটা ও আর তাদের নাই।

হায়রে কন্যা ভাগ্য…!

কন্যার পিতা হওয়া সত্যিই বড্ড কঠিন কাজ। তার উপরে যদি পিতা গরিব হন তাহলে তো আর কথাই নেই…

পুতুলের ডাকে হুস ফিরল আমার।

— কী হয়েছে প্রীতিলতা? তোমার ও কী আমার মতো চোখে পোকা ঢুকে গেছে। আমি ফু দিয়ে দেই।

চোখের অবশিষ্ট পানিটুকু মুছে ফেলে পুতুলের দিকে তাকিয়ে গাল ফুলিয়ে বললাম,

— পোকা তো বেরিয়ে গেছে পুতুল সোনা। তাই তো চোখ দিয়ে পানি ঝরছে। এই দেখো মুছে নিয়েছি আর পানি পড়বে না।

— তাহলে ঠিক আছে।

আমি পুতুলকে জড়িয়ে ধরে প্রশ্ন করলাম,

— আচ্ছা পুতুল সোনা তোমার ছোট ভাইয়া সারাদিন এমন বাইরে বাইরে ঘুরে বেড়ায় কেন? তুমি কি একটু বকে টকে দিতে পারো না।

পুতুল কিঞ্চিৎ হতাশ হওয়ার মতো করে বলল,

— ও তো কারোর কথা শুনে না প্রীতিলতা। সারাদিন বাইরে বাইরে ঘুরে বেড়ানো ওর কাজ। জানো ছোট ভাইয়া মাঝে মাঝে কি করতো?

— কি করতো?

— এক / দুই সপ্তাহ আবার মাঝে মাঝে এক মাস ও কোথায় জানি হারিয়ে যেত। আম্মুর ফোনেও পেত না ওকে। যখন বাড়িতে ফেরত আসতো, আর আম্মু ওকে বকতো তখন বলতো,

* ছোট ভাইয়াকে নাকি পাহাড়, সমুদ্র প্রতিনিয়ত হাতছানি দিয়ে ডাকে। সেই ডাকে সাড়া দিতে মাঝে মাঝে তাদের বুকে চলে যায়।*

— হিহিহি কি পাগল পাগল কথা তাই না।

আমিও একটু হাসার চেষ্টা করে বললাম ,

— হুম।

জানো, প্রীতিলতা ভাইয়া যখন প্রত্যেকবার বেড়ানো শেষে বাড়ি আসতো তখন আমার জন্য অনেক কিছু আনতো। আগে ওই তো ছিল আমার গল্প করার বন্ধু। সারাদিন বলতে গেলে আমাদের দেখাই হতো না। কিন্তু রাত্রে খাওয়া দাওয়ার পর আমি ওর রুমে চলে যেতাম আর বসে বসে ভাইয়ার গল্প শুনতাম। অ্যাডভেঞ্চারের গল্প….!

এখন তুমি আমার গল্প বন্ধু। তোমার সাথে কত গল্প করি তুমি একটুও বিরক্ত হও না। একদম ছোট ভাইয়ের মতো।

আমি ওর কথা শুনছি আর মিটিমিটি হাসছি।

কথা শেষ করে হঠাৎ পুতুল ঘুরে আমার গলা জড়িয়ে ধরে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল,

— তোমাকে আজ একটা সিক্রেট কথা বলবো প্রীতিলতা। কাউকে বলবে না কিন্তু।

আমি ইশারায় চোখ দিয়ে তাকে আশ্বস্ত করলাম।
দেখে সে আমার দিকে আরেকটু এগিয়ে এসে আস্তে আস্তে বললো,

— জানো প্রীতিলতা। ভাইয়া না তোমাকে বিয়ে করতে চাইনি। আম্মুর জন্য বাধ্য হয়ে তোমাকে বিয়ে করেছে।

চলবে…..❣️

#প্রীতিলতা ♥️

#লেখিকা:- Nowshin Nishi Chowdhury

#সূচনা_পর্ব

[ আসসালামু আলাইকুম। প্রিয় পাঠক গণ গল্পটা একটু নতুন ধরনের হবে। আশাকরি আপনাদের ভালো লাগবে।😊
প্রথম পর্বে আশা অনুরূপ সাড়া পেলে দ্বিতীয় পর্ব দিব ইনশাল্লাহ।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here