#প্রীতিলতা❤️
#লেখিকা:- Nowshin Nishi Chowdhury
#২য়_পর্ব🍂
দেখেছ কতটা কে*টে গেছে তোমার হাত , ইশ্ র*ক্ত ও পড়ছে তোমার হাত থেকে। তুমি নিজের একটুও খেয়াল রাখো না প্রীতিলতা।
গাল ফুলিয়ে অভিমানী ভঙ্গিতে কথাগুলো বলে পুতুল তুলো দিয়ে আমার হাতের কেটে যাওয়ার অংশটুকু মুছে দিতে লাগলো।
আমি কিছুক্ষণ ওর দিকে তাকিয়ে থেকে আমার অশ্রু সিক্ত নয়নজোড়া অন্যদিকে ঘুরিয়ে বাঁ হাতের তালুতে চোখ মুছে তাকে বললাম,
— তুমি আছো তো আমার খেয়াল রাখার জন্য। তাহলে মিছে সময় নষ্ট কেন করব।
ও তুলো দিয়ে হাত মুছতে মুছতে আমার দিকে আর চোখে তাকিয়ে “চ” এর মত উচ্চারণ করে বলল,
— উফ ও প্রীতিলতা। আমি না থাকলে যে তোমার কি হত?
বলার ধরন দেখে আমার ভারি হাসি পেল। কিঞ্চিত হেসে উত্তর দিলাম,
— কী আর হতো বলো, তুমি যদি এই বাড়িতে না থাকলে এতদিনে হয়তো ম’রে’ই যেতাম।
পুতুল নিজের কাজ বন্ধ করে কোমরে দুই হাত বাধিয়ে রাগান্বিত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে এক আঙুল উঁচিয়ে বলে উঠলো,
— এই তুমি পঁচা পঁচা কথা কেন বলছ প্রীতিলতা? তুমি ম*রে যাবে না। আমি সব সময় তোমার সাথে সাথে থাকবো তাহলে তো তুমি আর মরে যাবে না তাই না?
ওর হাত ধরে টেনে নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে মুখে উত্তর দিলাম,
— উহু তাহলে আর ম’রে যাব না।
*তোমার হাতে খুব ব্যথা করছে তাই না প্রীতিলতা? তখন আমায় অত জোরে কেন জড়িয়ে ধরতে গেলে তুমি?তাহলে কাঁচের চুড়ি গুলো আর ভেঙ্গে তোমার হাতের মধ্যে ঢুকে যেত না।
আমিতো শুধু সিক্রেট কথা বলছিলাম। ভুতের গল্প তো বলছিলাম না যে ওমনি ভাবে জড়িয়ে ধরতে হবে। আমার দম নিতেও কষ্ট হচ্ছিলো।বাবাহ্
তুমি হাতের যন্ত্রণার কথা বলছো পুতুল সোনা! কই সেখানের য*ন্ত্র*ণা তো আমি অনুভব করতে পারছি না। নাকি হাতের য’ন্ত্র’ণার তুলনায় বক্ষপিঞ্জরের য’ন্ত্র’ণা বেশি হয়ে গেল। তাই হয়তো অনুভব করতে পারছি না।
তুমি তো বোঝো না পুতুলসোনা মনের য/ন্ত্র/না কতটা ভ/য়/ঙ্ক/র। যে য/ন্ত্র/না কাউকে না দেখানো যায়, না কাউকে বলে বোঝানো যায়। এ তো শুধু একান্ত ভাবে নিজেকে অনুভব করতে হয়।যা প্রতিনিয়ত তার অদৃশ্য লেলিহান শিখা দিয়ে দ*গ্ধ করতে থাকে অন্তঃস্থকে।
আচ্ছা। তুমি একটু বসো আমি আসছি। একদম কোথাও যাবে না কিন্তু আমি এক্ষুনি আসছি প্রীতিলতা।
— আবার কোথায় যাচ্ছ তুমি। হাতের ব্যথা এমনিতেই সেরে যাবে তুমি আমার এখানে এসে বসো যেও ন…
তার মধ্যে এক ছুটে চোখের আড়াল হয়ে গেল পুতুল।
_________🌺🌺_________
রাতে খাওয়ার টেবিলে সবাই একসাথে দেখে অনেকটাই অবাক হলাম আমি । এই বাড়িতে নয়টার মধ্যে রাতের খাবার খাওয়া হয় কিন্তু বড় ভাইয়া এবং ভাবী দুজনে ডাক্তার হওয়ার কারণে তাদের চেম্বার থেকে আসতে দেরি হয় যার ফলে তারা নিজেদের রুমেই ডিনার সেরে নেন।
আর সাফওয়ান তো অনেক রাত করে বাড়ি আসেন। অনেক সময় বাহিরে থেকেও খেয়ে আসেন। আবার যখন না খেয়ে আসেন। নিচে ডাইনিং টেবিল থেকে খেয়ে আসেন। উঁকি দিয়ে দেখেছি শাশুড়ি মা বসে থেকে যত্ন করে তার ছেলেকে খাওয়ান। তাই আর খাওয়ার ব্যাপারে আমি আর তাদের মাঝে যাই না।
তবে আজ হয়তো বিশেষ কোনো কারণ আছে নাহলে এই অদ্ভুত গ্রহগুলোকে একই কক্ষপথে পাওয়া যেত না। আমার ভাবনার মাঝেই সাফওয়ান চেয়ার টেনে বসে পড়লেন।
টেবিলের উপরে তার জন্য বরাদ্দকৃত প্লেটটা সোজা করতে করতে আমার দিকে এক ঝলক তাকালেন তাতেই আমাদের দৃষ্টি বিনিময় হল কারণ আমি তার দিকেই তাকিয়ে ছিলাম। তিনি দ্রুত দৃষ্টি সরিয়ে নিলেন।
সবাইকে পরিবেশন করা হলো। আমি মাকে হাতে হাতে সাহায্য করছিলাম। ভাবী বাহিরে থেকে আসায় তাদের সাথে ক্ষেত্রে বসে পড়ল। খাওয়ার সময় কথা বলা বাবা পছন্দ করেন না। তাই সবাই চুপচাপ খাবারে মনোনিবেশ করল।
খাওয়া দাওয়া শেষে বাবা বললেন,
— আগামীকাল সকালের ট্রেনে আমি আর তোমাদের মা ঢাকায় যাচ্ছি। তিন দিন তোমাদের খালামণির বাসায় থাকবো। তারপর ওখান থেকেই আমরা ওমরা হজের জন্য ক্যাম্পের সাথে যোগ দেব।
সবাই একেবারে আকাশ থেকে পড়ল যেন। বড় ভাইয়া সাকলাইন বললেন,
— বাবা তুমি তো আমাদের আগে জানাওনি যে তোমরা হজে যাচ্ছ।
পুতুলকে জানিয়েছি। সে তো তার প্রীতিলতাকে ছেড়ে কোথাও যাবে না। তাকে সাথে করে ঢাকায় তোমাদের খালামনির বাসায় রেখে যেতে চেয়েছিলাম কিন্তু সে বলল সে তার প্রীতিলতার কাছেই ভালো থাকবে। বলে বাবা আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলেন।
তারপর আমার দিকে নরম দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন,
— মামনি, পুতুলের খেয়াল রেখো তুমি। খুব শিগগিরই ফিরে আসার চেষ্টা করব।
— জ্বী বাবা।
তারপর বাবা আবার বড় ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন,
—- তোমাদের সবাইকে তো আগে বলে রেখেছিলাম সাফওয়ানের বিয়ের পর আমি আর তোমাদের মা ওমরা হজের জন্য মক্কায় যাব। আমি যাওয়ার প্রসেসিং অনেক আগে থেকেই শুরু করেছিলাম গতকালকেই কনফার্ম হলাম।
তোমরা তো বাবা খুব ব্যস্ত মানুষ। এতসব ব্যাপার মাথায় রাখা সম্ভব না। আড় চোখে সাফওয়ান দিকে তাকিয়ে বললেন,
— আর কেউ কেউ তো কোনো কিছু না করেই খুব ব্যস্ত মানুষ।
সাফওয়ান কিছুক্ষণ বাবার দিকে নিরব দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে চোখ নামিয়ে নিজের ফোনে কি করতে লাগলেন যেন।
তোমাকে বলেছিলাম প্রীতি মামনি কে নিয়ে তার বাবার বাড়ি থেকে ঘুরে আসতে যাওনি কেন?
*সাফওয়ান নিশ্চুপ হয়ে বসে রইলেন।
আমি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকলাম। বাবার বাড়ির কথা শুনে ভিতরের কষ্টগুলো কেমন যেন মাথা চারা দিয়ে উঠলো।
বাবা এবার একটু ধমকের স্বরে বলে উঠলেন,
— আমি তোমার সাথে কথা বলছি সাফওয়ান।
এবার তিনি নম্র দৃষ্টিতে বাবার দিকে তাকিয়ে শিতল কন্ঠে বললেন,
— আমি তো সেই শুরু থেকে আপনার কথাই শুনে আসছি বাবা। আপনি বলুন আমি শুনছি বাবা।
ছেলের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে হতাশার শ্বাস ফেলে বাবা আবার বললেন,
— তোমাকে বলেছিলাম প্রীতি মামনি কে নিয়ে তোমার শশুর বাড়ি থেকে ঘুরে আসতে। তুমি গেলে না কেন? লজ্জায় রমজান ভাইয়ের ফোন রিসিভ করতে পারছি না আমি।
সাফওয়ান চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
— প্রীতি যদি যেতে চান, যেতে পারেন। কিন্তু আমি যাব না। আমার কাজ আছে।
উচ্চস্বরে ধমকে উঠলেন সাখাওয়াত সাহেব বললেন ,
— কী রাজকার্য কর তুমি? সারাদিন থাকো তো বন্ধুদের সাথে আড্ডা নিয়ে নয়তো যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে কোথাও হারিয়ে যাও। এইভাবে জীবন চলে নাকি?
সাকলাইন ভাই সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে সাফওয়ানের উদ্দেশ্যে বলল,
— এখন বিয়ে করেছো তুমি। বিয়ের আগে যা করেছ করেছ। এবার চাকরি বাকরি খোজ এবং সংসারী হও। তোমার একটা ভবিষ্যৎ আছে। এখন থেকে চিন্তাভাবনা শুরু করো।
সাফওয়ান ঠোঁট বাঁকিয়ে তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বললেন,
— হ্যাঁ বাবার আদর্শ ছেলে তুমি। তার সমস্বরে ই তো কথা বলবে।
কখনো কি জানতে চেয়েছ আমি কি চাই। তোমাদের ইচ্ছা অনিচ্ছাটাকে সেই ছোটবেলা থেকেই আমার উপরে চাপিয়ে এসেছে তোমরা। আমার জীবনের প্রতিটা স্তরে তোমাদের কথাই শেষ কথা। এমন কেন করো তোমরা আমার সাথে।
যা বলেছ তাই শুনেছি। হঠাৎ করে বিয়ে করতে বলেছ নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়েও বিয়ে করেছি আমি। আর কি চাও তোমরা আমার কাছে। এবার তো আমাকে একটু মুক্তি দাও।( হাত জোড় করে)
কথাগুলো একনাগাড়ে বলে আর এক মুহূর্ত দাঁড়ালেন না সাফওয়ান। দ্রুত পায়ে সিঁড়ি ভেঙ্গে উপরে চলে গেলেন। ছেলের যাওয়ার পানে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন সাখাওয়াত সাহেব। তারপর স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললেন ,
— ছোট ছেলেটাকে একদম মানুষ করতে পারলাম না।
কথাগুলো বলে আমার দিকে হতাশার দৃষ্টিতে এক ঝলক তাকিয়ে বাবা নিজের ঘরে চলে গেলেন। মাও তার পেছন পেছন ছুটলেন তাকে সামলানোর জন্য। সবাই যে যার রুমের দিকে চলে গেল।
বাকি রয়ে গেলাম শুধু আমি। পুরো ডাইনিং রুম জুড়ে পিন পতন নীরবতা। তবুও কানে বজ্র ধ্বনির মত বেজে চলেছে
*বিয়ে করতে বলেছ নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়েও বিয়ে করেছি আমি। আর কি চাও তোমরা আমার কাছে। এবার তো মুক্তি দাও আমায়।
________🌺🌺_______
রাতের আকাশে ধূসর মেঘের ঘনঘটা। সারা আকাশ জুড়ে ভেসে বেড়াচ্ছে তারা। দেখে মনে হচ্ছে যেন সূর্য সারা দিন পৃথিবীটাকে যে উনুনে গনগনে আঁচে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে নিঃশেষ করেছে, অস্ত যাওয়ার পূর্বে সেই উনুনের আগুন চাপা ছাইটা সারা আকাশে ছড়িয়ে দিয়ে গেছে পৃথিবীটাকে নতুনভাবে সতেজ করে তোলার জন্য। শো শো করে বাতাস বইছে। ঝড়ের পূর্ব লক্ষণ।
আজ আকাশটার ও বুঝি আমার মত মন খারাপ করেছে। তাইতো আমার বুকের মত তার বুকে ও ঝড় বইছে। শুধু একটাই পার্থক্য আকাশ তার নিজের বুকের যন্ত্রণাটা চিৎকার করে পুরো ধরণীকে জানাতে পারবে কিন্তু আমি তা পারছি না নিজের বুকের যন্ত্রণাগুলো নিজের মধ্যেই পৃষ্ঠ করে বুক ফুলিয়ে শ্বাস নিতে হচ্ছে আমাকে। ইশ্ আমিও যদি তার মত চিৎকার করে একটু কাঁদতে পারতাম কতই না ভালো হতো।
ছাদের রেলিং ঘেঁষে দাঁড়ালাম। দূরদূরান্ত পর্যন্ত কৃত্রিম আলোয় আলোকিত পুরো শহর। চাঁদের আলো এখন আর এই শহরের দরকার নেই।হঠাৎ ঝমঝমিয়ে বৃষ্টির আবির্ভাব হলো পুরো শহর জুড়ে।
আকাশের দিকে তাকিয়ে আপন মনে বলতে শুরু করলাম,
আজ নিজের উপর নিজেরই প্রচন্ড করুণা হচ্ছে আমার। আজ সবাই আমাকে আমার নিজের অবস্থান আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে কতটা বোঝা আমি তাদের জন্য। আচ্ছা এই বোঝাটা কি আমি ছোট থেকেই ছিলাম নাকি হঠাৎ করেই হয়ে গেলাম।
শ্লেষের হাসি হেসে নিজেকেই নিজে বলতে শুরু করলাম,
প্রথমে ছিলাম বাবার ঘাড়ের বোঝা। একটা সময় পর এসে তিনি আর বোঝা বইতে না পেরে। আরেকজনের অনিচ্ছা সত্ত্বেও তার ঘাড়ে চাপিয়ে দিলেন এই বোঝাকে। সেই আগুত্তক বোঝা বইতে না পেরে হুংকার দিচ্ছে মুক্তি পাওয়ার জন্য। আচ্ছা এই শহরের কোন এক কোণে কী এই বোঝার জায়গা হবে না। একটু কী জায়গা হবে না সবার দৃষ্টির অগোচরে চলে যাওয়ার জন্য।
শরীর ক্রমশ উষ্ণ হতে শুরু করলো আমার। চোখ জ্বালাপোড়া করছে। গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে।
কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে আমার। কেমন যেন জড়িয়ে যাচ্ছে কন্ঠনালী। তারপরে ও আজ নিজের ব্যর্থতা অপারগতাকে মুখে প্রকাশ করতে ইচ্ছা করছে।
কষ্ট হলেও যতদূর চোখ গেল জোর করে তাকিয়ে খুজলাম নাহ..! এ শহরে এই বোঝা টার কোন জায়গা হবে না। আবার বিদ্রুপের হাসি খেলে গেলো আমার ঠোঁট জুড়ে। আকাশের দিকে তাকিয়ে আপন মনে আবার বলতে লাগলাম,
–সৃষ্টি যখন তুমি করেছ তোমার ছায়া তলেই না হয় আমায় একটু জায়গা দাও। এ শহরে প্রীতিলতার কোন জায়গা নেই। কোথাও ন….
আর বলতে পারলাম না কন্ঠনালী রুদ্ধ হয়ে গেল। নিজের ভারসাম্য ছেড়ে দিলাম । হঠাৎ খুব জোরে আছড়ে পড়লাম কোথাও। বুঝতে পারলাম না কোথায় আছি। নিজের মধ্যেকার সর্বশক্তি দিয়ে জোর খাটিয়ে চোখ জোড়া মেললাম স্পষ্ট কিছুই দেখতে পেলাম না শুধু অস্পষ্ট একটা প্রতিবিম্ব। হাতড়ে ধরার চেষ্টা করলাম। কিন্তু না সত্যিই অস্পষ্ট।বিরবির করে বললাম,
প্রীতিলতা তুমি পদ্য
পাতা ঝিমঝিমানো গদ্য
তোমার আমার সন্ধি
না পাওয়া ছকে বন্দী।🍂
#প্রীতিলতা❤️
#লেখিকা:- Nowshin Nishi Chowdhury
#৩য়_পর্ব🍂
পিপাসায় বুকের ছাতি ফেটে যাচ্ছে আমার। গলাটা শুকিয়ে ধুদু মরুভূমি হয়ে গেছে যেন। তাই পানির সন্ধানে অনেক কষ্টে ভারী চোখের পাতা টা মেলে তাকালাম। শরীরের উপর দুই পার্টের কম্বল দেওয়া। শরীর টা কেমন যেন ম্যাজ ম্যাজ করছে।
দেখতে পেলাম মাথার ওপরে সিলিং ফ্যানটা ভন ভন শব্দ করে ঘুরছে। মাথা ঘুরিয়ে তাকিয়ে দেখলাম জানালার পর্দা ফিনফিন করে উঠছে। বাহিরে তাকিয়ে সঠিক সময় অনুধাবন করতে পারলাম না এখন রাত নাকি ভোর।
শারীরিক ক্লান্তিতে আবার চোখ বুজে এলো আমার।শরীরে কোন জোর পাচ্ছি না আমি যে উঠে বসবো। শরীরটা এমন লাগছে কেন আমার?
হঠাৎ মস্তিষ্কের নিউরন গুলো সতর্ক করল আমাকে। গত রাতের ঘটনা গুলো এক এক করে মনের পর্দায় ভেসে উঠলো। আমি তো ছাদে ছিলাম এখানে এলাম কিভাবে। আর একটু কিছু মনে করার জন্য ব্রেনের উপরে প্রেসার দিতেই মাথাটা কেমন যন্ত্রণায় শির শির করে উঠলো।
ব্যথাটা সহ্য করতে না পেরে মুখ দিয়ে ব্যাথাতুর আওয়াজ বের হয়ে আসল। তৎক্ষণাৎ মাথার পেছনে কারোর হাতে স্পর্শ অনুভব করলাম কিঞ্চিত উঁচু করে ধরে আমার মুখের খুব নিকটে শীতল কন্ঠে একটা প্রশ্ন শুনলাম,
— আপনার কি আবার শরীর খারাপ লাগছে? কি অসুবিধা লাগছে আমাকে বলুন?
কণ্ঠস্বরটায় কিছু একটা ছিল। যা আমার সারা শরীর জুড়ে শীতল একটা শিহরণ প্রবাহিত হল। হালকা কেঁপে উঠলাম আমি। চোখ মেলতে কষ্ট হলেও মনের মধ্যে আগুত্মক কে দেখার বাসনা প্রবাল ধারণ করল।
অল্প অল্প পলক ফেলে চোখ মেলে তাকালাম আমি। বেশি দূরে খুঁজতে হয়নি তাকে। নিজের মুখের উপরেই কিঞ্চিৎ দূরে একটা পুরুষয়ালী লম্বাটে অবয়ব ভেসে উঠলো।যার হালকা লালচে বর্ণ চোখ এবং ঠোঁট জোড়া শুষ্ক।
সম্পর্কের সে আমার স্বামী হলেও জীবনে প্রথমবার নিজেরা এত কাছে কোন পুরুষের উপস্থিতি আমাকে বড্ড অস্বস্তিতে ফেলে দিয়েছিল। তারপরও বেহায়া চোখ জোড়া তার অবয়বে আটকে পড়েছিল। ঘনঘন কয়েকটা ঢোক দিলাম।
উনি হয়তো কোন কিছু একটা আন্দাজ করতে পেরেছিলেন। তাই মাথাটা আরেকটু উঁচু করে ধরে , সোজা করে বালিশের সাথে হেলান দিয়ে বসিয়ে দিলেন আমাকে। হাত বাড়িয়ে খাটের পাশের ল্যামশেড টেবিল থেকে পানির গ্লাসটা তুলে আমার মুখের সামনে ধরে বললেন,
— খাইয়ে দিতে হবে নাকি আপনি নিজে পারবেন?
এতক্ষণ আহাম্মকের মত তাকিয়ে থেকে তার কর্মকাণ্ডগুলো দেখছিলাম। আমার দুটো জিনিস মনে হচ্ছে। এক আমি স্বপ্ন দেখছি, নতুবা আপন মনে কল্পনা করছি। আসলে ব্যাপারটা কি?
— কী হলো পারবেন?
আবার সেই কণ্ঠস্বর …! নিজের লোপ পাওয়া বোধশক্তি ফেরত এসেছে, কিন্তু মুখ দিয়ে কোন আওয়াজে বের করতে পারলাম না শুধু কাঁপা কাঁপা হাতে পানির গ্লাসটা ধরলাম। খেতে গিয়ে বেশ খানিকটা পানি নিজের গায়ে এবং কম্বলের উপর ফেললাম। চ্যাহ…!কী করলাম এটা।
অপরাধীর দৃষ্টিতে সাফওয়ানের দিকে তাকালাম। তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। তারপর পানি গ্লাসটা আমার হাত থেকে কেড়ে নিয়ে ধীরে ধীরে খাইয়ে দিলেন আমাকে।
একটা মানুষের এমন আকস্মিক পরিবর্তন এবং তার লালচে চোখ জোড়া দেখে ভয় আমার পেটের ভেতরের কেমন যেন গরগর করতে লাগলো। ওয়াশরুমে যাওয়া প্রয়োজন।
পানির গ্লাসটা পাশের টেবিলে রেখে আমার দিকে চোখ দিয়ে ইশারা করে বলল,
— কি হয়েছে?
ভাঙ্গা গলায় অনেক কষ্টে উত্তর দিলাম,
— ওয়াশরুমে যাব।
— আসুন।
বলে হাত ধরেও আমাকে উঠে দাঁড়াতে সাহায্য করলেন। উঠে দাঁড়াতে গিয়ে বুঝতে পারলাম শরীরটা অনেক দুর্বল হয়ে গেছে। মাথার মন থেকেও কেমন চক্কর দিয়ে উঠলো।
সাফওয়ানের হাত ধরেই ওয়াশরুম পর্যন্ত গেলাম। তিনি আমাকে ওয়াশরুমের দেওয়ালের সাথে হেলান দিয়ে দাঁড় করিয়ে রেখে রুম থেকে একটা টুল এনে দিলেন। এবং সেখানে বসেই ফ্রেশ হতে বললেন আর কোন দরকার পড়লে তাকে ডাক দিতে বললেন। তিনি বাহিরে আছেন।
আমি মাথা নাড়িয়ে সায় জানালাম। কিন্তু তার কোন কথাই আমার বোধগম্য হলো না।
কথাগুলো বলে ওয়াশরুমের দরজা চাপিয়ে তিনি বাহিরে চলে গেলেন।
আমি বেশিন ধরে টুলের উপরে বসলাম। আমি বুঝতে পারছি না আমি কি জেগে আছি নাকি এখনো ঘুমিয়ে আছি। মনে তো হচ্ছে নির্ঘাত ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছি। কারণ এখন তো রাত দিবার স্বপ্ন দেখা তো সম্ভব নয়। কয়টা বাজে তাও বুঝতে পারছি না।ধ্যাত…!
বেশি করে মুখে পানি দে প্রীতি আর নিজের ঘুম ভাঙ্গা না হলে কয়দিন পরে পাগলা গারদেই তোর ঘুম ভাঙবে।
________🌺🌺________
আবোল তাবোল চিন্তা শেষে ফ্রেশ হয়ে নিলাম। পরনে কলাপাতা রং এর থ্রি পিস।ফ্রেশ হতে গিয়ে ব্যাপারটা লক্ষ্য করলাম। আমার পোশাক কে চেঞ্জ করল…!
বাহিরে বের হয়ে এসে দেখি সেন্টার টেবিলে খাবারের প্লেট রাখছেন সাফওয়ান। আমি বেরোতে আমার দিকে এক ঝলক তাকালেন। তারপর গ্লাসে পানি ঢেলে দিয়ে বললেন,
—- দ্রুত খেয়ে নিন। খাওয়ার পরে আপনার একটা মেডিসিন আছে।
নাহ আমি তো ঘুমিয়ে নেই আর স্বপ্নও দেখছি না। নির্ঘাত এই ব্যাটার মাথা খারাপ হয়ে গেছে।
আমাকে স্ট্যাচুর মতো দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে কিঞ্চিৎ ভ্রু কুঁচকে সাফওয়ান প্রশ্ন করলেন,
— কি ব্যাপার এখন তো আপনাকে দেখে সুস্থ মনে হচ্ছে, তারপরও এখন কি আবার ভাত মাখিয়ে আপনাকে খাইয়ে দিতে হবে?
মুখে বিড়বিড় করে বললাম,
— না থাক। এত সৌভাগ্য আমার হয়নি। এমনিতেই যা চমক দেখালেন তাতেই থমকে গেছি। আর দরকার নেই বাবা।
চুপচাপ গিয়ে সোফায় বসলাম। খাবারে হাত দিয়ে বুঝলাম খাবার গরম। ভেতরের কৌতূহল আর দমন করতে না পেরে প্রশ্ন করেই বসলাম,
— কয়টা বাজে?
স্বাভাবিকভাবে উত্তর দিলেন,
— ভোর চারটা।
আমি চমকে উঠলাম। তারপর বললাম,
—- খালা এখনো জেগে আছেন?
ভুল কুঁচকে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
— কেনো?
— মানে খাবারটা গরম দেখছি, তাই আর কী
আমার কথার বিপরীতে তিনি একটা হতাশাজনক দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,
— না খালা এখন জেগে নেই। তিনি অনেক আগেই ঘুমিয়ে পড়েছেন। কেন আমাকে কি আপনার চোখে পড়ছে না নাকি আমাকে মনুষত্বহীন বলে মনে হয় আপনার? কোনটা?
বিস্ময়ের চরম পর্যায়ে চলে গেলাম।
— হ্যাঁ মানে। আপনি খাবার না মানে আপনি আমার জন্য খাবার গরম করে নিয়ে এসেছেন?
— খাবারটা ঠান্ডা হওয়ার আগে খেয়ে নিন।
আমিও আর কথা বাড়ালাম না চুপচাপ খাবার মনোযোগ দিলাম। খাওয়া শেষে ওষুধের পাতা থেকে তিনটে ট্যাবলেট আমার দিকে এগিয়ে দিলেন তিনি। আমি ওষুধের সাইজ দেখে ওনাকে প্রশ্ন করলাম । এর থেকে ছোট ওষুধ আর নাই বাজারে।
তিনি আমার দিকে চোখ ছোট ছোট করে তাকিয়ে টিটকারী করে বললেন,
— কি আর করা যাবে বলুন। না আমার আর না আপনার কারোর বাপেরই দুর্ভাগ্যবশত ঔষধ তৈরির কারখানা নেই যে তারা আপনার জন্য আপনার পছন্দসই আকার আকৃতি দিয়ে ওষুধ তৈরি করবে।
— নাহ। ঠিক আছে।
— কী?
— কিছু না।
এরপর আর কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ ওষুধ খেয়ে নিলাম। মুখ থেকে পানির গ্লাসটা টেবিলে নামিয়ে রেখে সাফওয়ানকে প্রশ্ন করলাম,
— আচ্ছা আপনি আমাকে এত ওষুধ খাওয়ালেন কেন? কি হয়েছিল আমার?
স্বাভাবিকভাবে উত্তর দিলেন,
— ভুতে ধরেছিল।
— কীহ..!
— সঠিকভাবে বলতে পারছি না, জিন ও হতে পারে। না হলে রাত বারোটার সময় কোন সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ এমনভাবে ছাঁদে দাড়িয়ে তো আর বৃষ্টিতে ভিজতে পারেনা তাই না…!
* তা আপনার এই জিন ভূতের সমস্যা কী ছোটবেলা থেকে নাকি হঠাৎ করেই উদয় হল।তার উপর আবার জ্বরের ঘোরে উদ্ভট বকবক করারও রোগ আছে আপনার।
আমার মনে পড়ল আমি তখন ছাদে থাকলেও একটা ঘোরের মধ্যে চলে গিয়েছিলাম। কিন্তু কি করেছি আর কি বলেছি তার কিছুই আমার মনে নেই।
তার উপর ছোটবেলা থেকেই বৃষ্টিতে ভিজলেই আমার জ্বর আসবে কনফার্ম আর জ্বরের ঘোরে উদ্ভট কথা বলি এটাও সত্যি।
তাই আমি মুখটা কাচুমাচু করে অতি বিনয়ের সাথে নিজের ভুল স্বীকার করে বললাম,
— সরি। আসলে ত…
আমাকে থামিয়ে দিয়ে কটমট চোখে আমার দিকে তাকিয়ে সাফওয়ান বললেন,
— আপনার সরি, আপনার কাছেই রাখুন। ওই সরি আমার কোন কাজে আসবে না। জানেন আপনার এই উদ্ভট কাজের জন্য আমার বাবা আমাকে কি…
কথা বলতে বলতে থেমে গেলেন সাফোয়ান।
— কি হলো বলুন বাবা আপনাকে কি?
— না । কিছু না।
চুপচাপ শুয়ে পড়ুন আর আমাকেও একটু ঘুমাতে দিন। সারারাত কত সুন্দর হাত পা ছড়িয়ে ঘুমিয়ে ছিলেন পুরো বিছানা জুড়ে আর আমাকে আপনার চৌকিদারির দায়িত্ব পালন করতে হয়েছে সারা রাত। এবার দয়া করে আমাকে একটু ঘুমাতে দিন।
যতসব উদ্ভট ঝামেলায় এসে জোটে আমার কপালে।
লাস্টের কথাটা বির বির করে বলে বালিশ নিয়ে খাটের ওপর পাশে শুয়ে পড়লেন। আমিও গায়ে কম্বল টেনে শুয়ে পড়লাম।
হঠাৎ গত রাতের কথাগুলো মাথা চাড়া দিয়ে উঠতেই মুখ ফুটে তাকে প্রশ্ন করেই ফেললাম,
আচ্ছা আপনি কি কাউকে পছন্দ করেন?
বালিশে মুখ গুজে শুয়ে ছিলেন তিনি। আমার প্রশ্ন শুনে ঘাড় ঘুরিয়ে ভুরু কুঁচকে তাকালেন তিনি।
আমি শুকনো কয়টা ঢোক গিলে বললাম প্লিজ আমি যে প্রশ্নটা করেছি তার সঠিক উত্তর দেবেন। আপনাকে আর বিরক্ত করবো না।প্রমিস।
সাফওয়ান গম্ভীর গলায় বললেন,
— না আমি কাউকে পছন্দ করি না।
বুকের উপর থেকে যেন বড় একটা পাথর নেমে গেল আমার।সেই খুশি হলাম আমি। আহা কি শান্তি..! যাক বাবা তাহলে কোন শাকচুন্নীর ঝামেলা নাই।
কিন্তু তারপরেই মাথার মধ্যে একটা প্রশ্ন উদয় হল। না চাইতেই কৌতূহলবশত মুখ থেকে প্রশ্ন বেরিয়ে গেলো
— তাহলে আমাকে অপছন্দ করার কারণ কি?
আমার প্রশ্ন তার কানে যাওয়ার কিয়ৎক্ষণ পরে পাশ ফিরে হঠাৎ আমার উপর চড়াও হলেন তিনি। আমাকে বিছানার সাথে চেপে ধরে দাঁতে দাঁত চেপে ফিসফিসিয়ে বললেন,
— কারণ তুমি আমার বাবার পছন্দ….!
চলবে….❣️
[