প্রীতিলতা পর্ব -১৪+১৫

#প্রীতিলতা ❤️

#লেখিকা:- Nowshin Nishi Chowdhury

#১৪_তম_পর্ব🍂

আপনাকে তো আমি খুব বুদ্ধিমতী আর প্রখর স্মৃতিশক্তি সম্পন্ন মেয়ে মনে করেছিলাম প্রীতি। কিন্তু আপনি যে আমাকে ভুল প্রমাণিত করলেন। এত বোকা কবে হয়ে গেলেন?

সায়েম এর কাছ থেকে মলমটা নিয়ে আমি নিজের হাতে লাগাচ্ছিলাম। হঠাৎ কানে তার কথাগুলো আশাতে আমি তার দিকে তাকিয়ে পরলাম।

— মানে?

— মানে এই যে তিন বছর আগে যে প্রীতিকে দেখেছিলাম আমি। চেহারা আদলে একই রকম হলেও প্রখর মেধা সম্পন্নকারী সাহসী ও চমৎকার ব্যক্তিত্বের সেই প্রীতিকে তো খুঁজে পাচ্ছি না।

আমি চমকে উঠলাম। তাড়াতাড়ি নজর ঘুরিয়ে সায়েমের দিকে তাকালাম। চশমার আড়ালে চোখ জোড়া এবার একটু বেশি পরিচিত মনে হচ্ছে। কিছুক্ষণ এক নজরে তাকিয়ে থেকে হঠাৎ আমার মুখে হাসি ফুটে উঠলো।

— ডাক্তার ভাইয়া…!

সায়েম এবার শব্দ করে হেসে উঠলেন। গালে আবারও সেই টোল পড়া।হায় টোল ওয়ালা ভাইয়াকে আমি এত তাড়াতাড়ি ভুলে গেলাম কি করে।

হাসি থামিয়ে ভাইয়া বলে উঠলেন,

— যাক ম্যাডামের এতক্ষণে আমাকে তাহলে মনে পড়েছে। তো ম্যাডাম আপনার স্মৃতিশক্তি এত নড়বড়ে হয়ে গেল কি করে?

আমি কপোট রাগ দেখিয়ে বললাম,

— মোটেও আমার স্মৃতিশক্তি নড়বড়ে হয়নি। তুমি বরং গড়বড়ে হয়ে গেছো।

— যেমন?

— আগেতো পাটকাঠির মত চিকন ছিলে এত বডি মাসেল বানালে কি করে?

—আগে হোস্টেলের খাবার খেতাম তাই পাটকাঠি ছিলাম। এখন মায়ের রান্না খাই তাই চেঙ্গিস খান হয়ে গেছি।

আমি ভাইয়ার কথা শুনে এবার হেসে দিলাম। ভাইয়া কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন,

— এই প্রীতিকেই তো এতোক্ষণ খুজছিলাম। ওইখানকার বারান্দায় দাঁড়ায় থাকা প্রীতিকে তো চিনতেই পারিনি। মিস ভয়ঙ্করী নাকি আবার কাঁদতেও পারে। ভাবা যায়।

যে কিনা আমার সহকারীকে ধরে সারা বিল দৌড় করিয়ে পিটিয়েছিল কি দোষ ছিল কাঁচা আম চুরি করেছে তাই।

তোমার এখনো মনে আছে ভাইয়া।

— না মনে তো থাকবে না। এমন মিস ভয়ঙ্করী পৃথিবীতে কয় পিস আছে যে তোমাকে ভুলে যেতে হবে।

প্রতিউত্তরে আমি শুধু হাসলাম।

ডাক্তার সরফরাজ আহমেদ। খুলনা মেডিকেলের নামকরা নিউরো সার্জন। তিন বছর আগে আমাদের গ্রাম কেশবপুরে গিয়েছিলেন। সেখানেই আলাপ হয়েছিল নাটকীয় ভাবে।

আমাদের বাড়ির পেছনে আমার আব্বুর হাতে লাগানো একটা ফল বাগান ছিল। যেটা আমি নিয়মিত পরিচর্যা করতাম। এই ফল বাগানেরই আম গাছের কাঁচা আম চুরি করছিলেন তার সহকারী।

কত যত্ন আর পরিচর্যার ফল এই কাঁচা আম গুলো। আম্মু আচার তৈরি করবে।আর সে কিনা নির্বিচারে চুরি করে নিয়ে যাচ্ছে। ধরেছিলাম ব্যাটাকে আচ্ছা মত গাছের উপরে লম্বা লাঠি দিয়ে পিটিয়েছিলাম।। পরের লাফ দিয়ে পিছনের বিল দিয়ে দৌড়েছিল।

আমিও কম কিসে আমিও লাঠি নিয়ে তাড়া করেছিলাম তাকে। পুরো বিল দৌড় করিয়ে অবশেষে আমাকে মেডিকেল ক্যাম্পে নিয়ে গিয়েছিল ওই সহকারি। সেখানেই ডাক্তার ভাইয়ার সাথে দেখা। ডাক্তার ভাইয়াই আমার হাত থেকে ওই সহকারীকে বাঁচিয়ে ছিল না হলে ওটা কে পিটিয়ে আমি স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করতাম। আলাপ করে ভালো লেগেছিল বলে আমগুলো ফ্রিতে দিয়ে এসেছিলাম।

তারপর প্রায়ই মেডিকেল ক্যাম্পে যেতাম।ডাক্তারি পেশার উপর আমার খুব কৌতুহল ছিল। ভাইয়া সবার রোগ জিজ্ঞাসা করতো আমি পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুনতাম। ওষুধ লিখে দিত। সেগুলো দেখতাম। ইনজেকশন কিভাবে পুশ করতে হয় প্রেসার কিভাবে মাপতে হয়। সেগুলো ভাইয়ের সাথে থেকে থেকে শিখে নিয়েছিলাম।

আমি একা যেতাম না। আমার ভাইও সাথে যেত।ধীরে ধীরে আম্মু আব্বুর সাথেও ডাক্তার ভাইয়ার পরিচয় হয়েছিল। উনি যেদিন আমাদের গ্রাম থেকে চলে যাবেন সেদিন আব্বু ওনাকে দাওয়াত দিয়েছিলেন দুপুরে। উনি এবং ওনার অ্যাসিস্ট্যান্ট দুপুরে খেয়েছিল আমাদের বাড়িতে। সেখানেই হয়েছিল আমাদের শেষ দেখা।

মাঝখানে তিন-তিনটা বছর কেটে গেছে। কতকিছুর পরিবর্তন হয়ে গেছে। আমি ভাবতেই পারিনি তিন বছর আগের সেই মেয়েটা আজ আমার সামনে আমার ভাইয়ের বউ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

আমিও ভাবতে পারিনি, এত বছর পরে এভাবে আমাদের দেখা হবে আবার।

কথাটা বলে মলমটা তার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললাম,

—থ্যাংকস ফর ইউর ট্রিটমেন্ট।

বলে বেরিয়ে আসছিলাম আমি তখন পেছন থেকে সায়েম বলে উঠলেন,

— মনের অসুখটা তাড়াতাড়ি সেরে ফেলার ব্যবস্থা কর প্রীতি। মানসিক অশান্তি নিয়ে মানুষ বেশিদিন সুস্থভাবে বাঁচতে পারে না।

আমি তাকে কিছু বলতে যাব তার মধ্যে তিনি থামিয়ে দিয়ে বললেন,

— আমি তোমার আর সায়মার কথোপকথন শুনেছি। দেখো সাফওয়ান আমার বন্ধু প্লাস ভাই হলেও ওর ব্যাপারে খুব কম জানি আমি। স্বভাবত ও খুবই চাপা। নিজের মনের কথা নিজের মধ্যে রেখে দিতে পারে অনায়াসে। মুখ দেখে কিছুই বোঝা যায় না ভেতরে কি চলছে।

আর আমার স্টাডি লাইফটা প্রায় বাইরে বাইরেই কেটেছে। ফ্যামিলির সাথে অতটাও কানেক্টেড ছিলাম না আমি। সেজন্য সাফওয়ান সায়মার ব্যাপারে তেমন কিছুই বলতে পারব না। সাইমা যদিও বলে সাফওয়ান কে সে পছন্দ করে। কিন্তু আসলে তাদের মধ্যে কি হয়েছিল সেটা একমাত্র সাফওয়ানই তোমাকে বলতে পারবে।

তাই বলছি হঠকারী কোন সিদ্ধান্ত না নিয়ে ভালোভাবে ভেবেচিন্তে ঠান্ডা মাথায় চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নাও। ঝোঁকের মাথায় এমন কোন ভুল সিদ্ধান্ত নিও না যা নিয়ে ভবিষ্যতে পস্তাতে হয়।

যদি কোন দরকার পড়ে তবে আমাকে জানিও আমি তোমাকে যত সম্ভব সাহায্য করবো।

— আচ্ছা।

বলে আমি রুম থেকে বেরিয়ে চলে আসলাম।

হ্যাঁ অনেক হয়েছে। এবার একটা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতেই হবে।

_________🌺🌺______

খালামনির সাথে দেখা করে কাঠের বাক্সটা হাতে নিয়ে নিচে নেমে আসলাম। খালামণিকে সাহস করে কিছু জিজ্ঞাসা করতে পারলাম না। আর চাইছিলাম না। আমার তো চাই সাফওয়ানের উত্তর। খালামণি কাঠের বাক্স টা হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন,

— শেষ নিশ্বাস পর্যন্ত আমি যেন তার সাফুর পাশে থাকি।
আমি কোন প্রতি উত্তর করতে পারিনি। চুপচাপ তার কথা শুনে বাক্সটা নিয়ে চলে এসেছি। এসে দেখি সাফওয়ান সোফা সেটের উপর বসে আছেন। চেহারায় স্পষ্ট গাম্ভীর্য ফুটে উঠেছে। আমি নিচে গিয়ে দাঁড়াতেই পুতুল দৌড়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল,

— বাসায় যাব প্রীতিলতা আমার খুব ঘুম পেয়েছে।

আমি ওর দিকে তাকিয়ে শুকনো একটা হাসি দিয়ে বললাম,

— এইতো এখনই যাবো।

আমার কথা শুনে সাফওয়ান সোফা থেকে উঠে দাঁড়ালেন। ভাইয়া ভাবীরা আজ এই বাড়িতেই থাকবেন। সবার থেকে বিদায় নিয়ে সাফওয়ান পুতুলের হাত ধরে গাড়ির উদ্দেশ্যে চলে গেলেন। আমিও সদর দরজায় পেরিয়ে বেরিয়ে এসেছি। তখন খালামনি পিছন থেকে আমার হাত জড়িয়ে ধরে বললেন,

— অনেক কিছু বলার ছিল কিন্তু আমি তোকে বলতে পারিনি। তার জন্য আমাকে ক্ষমা করে দিস তুই। শেষের শুধু একটা কথাই বলবো। আমার সাফু বাবু কোন অন্যায় করিনি বরং অনেক কষ্ট পেয়েছে। ওকে কখনো কষ্ট পেতে দিস না। সকল মান-অভিমান ভেঙে আমার সাফু বাবুকে নিয়ে নতুন করে জীবন শুরু কর। ইনশাল্লাহ আল্লাহ তোদের মঙ্গল করবেন।

আমি বরাবরের মতন নীরব ছিলাম। হ্যাঁ ও বলেনি না ও বলিনি। কারণ আমার অনেক কিছু জানার আছে। সত্যিটা আমাকে আগে জানতে হবে ।

হেঁটে চলে এসে গাড়িতে উঠলাম। পুতুল দেখি গাড়িতে ঘুমিয়ে গেছে ।ওকে নিজের বুকের মাঝে জড়িয়ে ধরে গাড়ির সিটে মাথাটা এলিয়ে দিলাম। সাফওয়ানের দিকে না তাকিয়েও বুঝতে পেরেছি তিনি আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি ভুলেও তার দিকে তাকালাম না। কোন কথাও বললাম না।

সাফওয়ান জোরে একটি নিঃশ্বাস নিয়ে গাড়িটা স্টার্ট করলেন। আমি চোখ বুঝে নিলাম। মনে মনে নিজেকে শক্ত করছি। আজকেই সমস্ত লুকোচুরির সমাপ্তি করব। অনেক হয়েছে আর না। আজ রাত্রে সাফওয়ানকে ফয়সালা করতে হবে। কাল সূর্যোদয়ের সাথে তার আর আমার সম্পর্কের শুভ সূচনা হবে নাকি পরিসমাপ্তি ঘটবে…..!
#প্রীতিলতা ❤️

#লেখিকা:- Nowshin Nishi Chowdhury

#১৫_তম_পর্ব🍂

রাত প্রায় 12 টা বাজে। গাড়িটা বাড়ির গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। সাফওয়ান হর্ন বাজাচ্ছেন। কিন্তু গেট খোলার কোন নাম গন্ধ নেই। প্রায় দশ মিনিট পর হন্তদন্ত হয়ে দারোয়ান চাচা গেট খুলে দিলেন।

তার চোখ দেখে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম তিনি। সাফওয়ান গাড়ি ভেতরে ঢোকাতেই গেটে তালা ঝোলালেন তিনি। এতক্ষণ আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলেন।

সাফওয়ান গাড়ি পার্কিং লটে গিয়ে থামালেন। ইঞ্জিন বন্ধ করে দরজা খুলে বের হলেন। ঘুরে আমার সাইডে এসে গাড়ির দরজা খুলে পুতুলকে আমার সাইড থেকে নিয়ে নিলেন। পুতুল ঘুমিয়ে গেছে তাই কোলে তুলে নিলেন। আমার দিকে তাকালেন তিনি মুহূর্তেই নজরের বিনিময় হলো। গাড়ি থেকে বের হয়ে দাঁড়ালাম।

সাফওয়ান মেইন ডোর বেল আর বাজালেন না। খালা এতক্ষণে শুয়ে পড়েছেন। চাবি ঘুরিয়ে লক খুলেই ঘরে ঢুকলাম আমরা। সাফওয়ান পুতুলকে নিয়ে তার ঘরে চলে গেল আমি দরজাটা ভালো করে লক করে ডাইনিং টেবিলের চেয়ারে গিয়ে বসলাম। এক গ্লাস পানি ঢেলে নিয়ে খেয়ে নিলাম।

তারপর ওপরের রুমে চলে আসলাম। সোজা গিয়ে ঢুকলাম ওয়াশরুমে। একেবারে ফ্রেস হয়ে ড্রেস চেঞ্জ করে বিছানায় বসলাম। তখন রুমে প্রবেশ করলেন সাফওয়ান। পরনের কোটটা বাম হাতে ঝুলছে, গলার টাইটাও ঢিল। চেহারা দেখে বোঝা যাচ্ছে তিনি বড্ড ক্লান্ত। আমার দিকে এক নজর তাকালেন তারপরে আলমারির কাছে গিয়ে টি-শার্ট আর ট্রাউজার বের করলেন। ওয়াশরুমে ঢোকার আগ মুহূর্তে আমি তাকে বললাম,

— আপনার সাথে আমার কিছু কথা আছে,
তাড়াতাড়ি ফ্রেশ হয়ে আসুন।

তিনি মুখে কিছু বললেন না। ওয়াশরুমে চলে গেলেন। প্রায় ১৫-২০ মিনিট পরে ফ্রেশ হয়ে বের হলেন। হাতমুখ মুছতে মুছতে বিছানায় বসলেন। হাত বাড়িয়ে নিজের ফোনটা চার্জে লাগালেন। আমি চুপচাপ তার কর্মকাণ্ডগুলো দেখছি। তিনি বারবার আরে আরে তাকাচ্ছেন আমার দিকে। হয়তো বলতে বলছেন আমাকে কি বলার আছে। নাকি অন্য কিছু বোঝাতে চাইছেন বুঝতে পারছি না।

আমি আর এক মুহূর্ত অপেক্ষা না করে সাফওয়ান এর হাত ধরে টেনে রুমের বাইরে নিয়ে চলে আসলাম। পুরো বাড়িটা নিস্তব্ধ ও ঘুমন্ত পুরীতে পরিণত হয়েছে। খালাতো অনেকক্ষণ আগেই ঘুমিয়ে গেছে আর কিছুক্ষণ আগে দেখেও এসেছি পুতুলও ঘুমিয়ে পড়েছে প্রগাঢ়ভাবে।

করিডরের স্বল্প আলোর মধ্য দিয়ে সাফানের হাত ধরে ছাদের সিঁড়িতে পা রাখলাম। সাফওয়ান এমন আকস্মিকতায় কিছুটা অবাক হয়েছেন বোধহয়। সিঁড়ি দিয়ে ছাদে ওঠার পর ঘাড় ঘুরিয়ে সাফয়ানের দিকে তাকালাম এতক্ষণ তিনি নিস্তব্ধ ছিলেন আমি তাকাতেই আমাকে প্রশ্ন করলেন,

— এত রাতে ছাদে নিয়ে এসেছে কেন আমাকে?

ছাদে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে আছে আমরা আকাশে আজ আবারো কালো মেঘের ঘনঘটা। ঝিরঝির করে বাতাস বইছে। যা আমার শরীরকে কম্পিত করছে। ছাদে থাকা ডিজাইনার লাইটগুলোর আলো য় স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি সাফওয়ান আমার দিকে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।

আমার সেদিকে কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। আমি তার চেহারার মানদন্ড মাপতে ব্যস্ত। আমাকে এমন শান্তভাবে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে সাফওয়ান বিরক্তিতে চ্যাহ শব্দ করে আমাকে বলল,

— দেখো আমি কিন্তু খুব ক্লান্ত। তোমার এই সকল ফাজলামি করার ইচ্ছা হলে অন্য সময় করবে। এখন কিন্তু এসব ভালো লাগছে না আমার।

তাই বলে ছাদের দরজার দিকে এগিয়ে যেতে গেলে আমি হাত ধরে টেনে ধরে বলি,

— এই মানুষটাকেই তো আপনার ভালো লাগেনা কুমড়ো পটাশ।তাহলে তার কর্মকান্ড কিভাবে আপনার ভাল লাগতে পারে বলুন।

আমার কথাগুলো শুনে তিনিও নিজ গরজে এগিয়ে আসলেন আমার দিকে। কপাল কুঁচকে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,

— মানে….!

আমি দীর্ঘশ্বাস ছাড়লাম। শুকনো হেসে তার দিকে এগিয়ে এগিয়ে তার চোখে চোখ রেখে বললাম,

— আপনি সেদিন আমাকে মিথ্যে কথা কেন বললেন কুমড়ো পটাশ?

— মিথ্যে বলেছি?

— হ্যাঁ অনেক বড় মিথ্যে কথা বলেছেন।

কথাটা বলতে গিয়ে গলা কেঁপে উঠল আমার। দমকা হাওয়া এসে গায়ে লাগতেই চুল গুলো সব এলোমেলো হয়ে গেল দুহাতে চুল গুলো একটা হাত খোপা করে নিলাম। তার দিকে তাকিয়ে দেখলাম

তিনি এখনো নিশ্চুপ হয়ে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।

তা দেখে আমি আবারও শুকনো হাসলাম।

এগিয়ে গেলাম তার দিকে। তাকে অবাক করে দিয়ে আমি তাকে জড়িয়ে ধরলাম। কিছুক্ষণ তার বুকে মাথা রেখে চোখ বুঝে নিজেকে কিছুটা স্বাভাবিক করে নিলাম।

ঘাড় উঁচু করে তার দিকে তাকাতেই আমার চোখের কার্নিশ দিয়ে দু ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। তার দিকে তাকাতে দেখলাম সে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।

— আপনি কি কখনো আমাকে ভেতর থেকে ফিল করেছেন কুমড়ো পটাশ? কখনো কি আপনার মনটা আপনাকে বলেছে এই মেয়েটাকে আপনার প্রয়োজন। একান্তভাবে প্রয়োজন।

কি হয়েছে তোমার। হঠাৎ এসব আবোল তা…

ঠোঁটে আঙুল দিয়ে তাকে থামিয়ে দিলাম।

— আহ্ আ যেটা জিজ্ঞাসা করছি তার উত্তর দিন না। আবোল তাবোল তো আমি সারা দিন বকি।

সাফওয়ান চুপ হয়ে গেলেন। আমি সাফোয়ানের দিকে আরো এগিয়ে গেলাম। আরো ঘনিষ্ঠ হলাম তার সাথে। মুখটা তার কানের কাছে নিয়ে গিয়ে বললাম

— কি হল বল? চুপ হয়ে গেলে কেন?

ঘাড় নিচু করে সে আমার মুখ পানে তাকালো। আমি অধীর আগ্রহে তার উত্তর শোনার জন্য দাঁড়িয়ে আছি। মন থেকে বড্ড চাইছি। উত্তরটা যেন হ্যাঁ হয়। ওর অতীতে যাই হয়ে থাকুক না কেন। সবকিছু ভুলিয়ে দেবো আমি। শুরু করব আমাদের জীবনের পথ চলা।

তৎক্ষণাৎ কানে প্রতিধ্বনি হয়ে ফেরত আসলো একটা শব্দ

— না…!

এই একটা শব্দ ই আমার শরীরটাকে নিঃশেষ করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট ছিল। সাফওয়ানের থেকে আলিঙ্গন মুক্ত হলাম। হাতটা আপন ইচ্ছাতে ই নেমে আসলো তার পিঠ থেকে।

আমার দিকে কঠোর দৃষ্টিতে তাকিয়ে চোয়াল শক্ত করে উত্তর দিল,

— পেয়ে গেছো তোমার উত্তর। এবার নিচে চলো।

আমি শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছি নিজের অবস্থানে। নিজের অবস্থানটা ঠাওর করতে পারছি না। বসে আছি নাকি দাঁড়িয়ে আছি কিছুই বুঝতে পারছি না চোখের সামনে পুরো দুনিয়াটা যেন ঘুরছে এমন লাগছে। সাফওয়ান নিচে যেতে গিয়েও আবারো ফিরে এলেন। আমার হাত ধরে টান দিতে আমি কিছুটা নড়ে উঠলাম।
অশ্রুসিক্ত নয়নের ডান দিকে তাকিয়ে বললাম,

— বড্ড ভালোবাসেন সায়মাকে তাই না…!

মুহূর্তে ওনার চেহারার রঙের পরিবর্তন ঘটল।

— তোমাকে বলার প্রয়োজন বোধ করছি না।

আমি এবার ক্ষেপে উঠলাম। দু কদমে গিয়ে এসে তার টি-শার্টের কলার দুহাতে চেপে ধরে চিৎকার করে বললাম,

— কেন প্রয়োজন বোধ করছেন না? আপনাকে আমার সব প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে। এখন এবং এক্ষুনি। কেন ভালবাসেন না আপনি আমাকে? আমার জন্য আপনার মনে কেন জায়গা নেই…..

— এর উত্তর আমি আগেও দিয়েছি।

— ওসব লেইম এক্সকিউজ। আমি ছোট বাচ্চা না। যে যা বুঝাবেন তাই বুঝে যাব।

— আর কোন কারণ নেই।

আছে। অনেক বড় কারণ আছে।আর এর পেছনে আসল কারণ তো অন্য সাফোয়ান । ভালবাসেন তো সাইমাকে তাই না। আমি আপনাদের দুজনের মাঝে চলে এসেছি। যার কারনে আপনাকে আমায় এত অপছন্দ।

মনে যা আসছে তাই বলে যাচ্ছে । যা বলছ ভেবে বলছ তো। নাকি এসব দোষ আমার কাঁধে চাপিয়ে মুক্ত হতে চাইছো।

আমি ভুককে সাফওয়ানের দিকে তাকিয়ে বললাম,

— মানে…! এখন নিজের দোষ ঢাকতে আমাকে দোষী বানাচ্ছেন। আমি আপনার কথাগুলো জানতে এসেছি এখানে এসব লেইম এক্সকিউজ দেওয়া বন্ধ করুন।

বাবা মা পছন্দ করে আমাকে এই বাড়িতে নিয়ে এসেছে বলে আপনার এত অপছন্দ। এটা আবার হয় নাকি? এটা কোন যুক্তিসঙ্গত কারণ হলো।

যুক্তিসঙ্গত..! ঠিক বলেছ তুমি । এটা আসলে কোন যুক্তিসংগত কারণেই হতে পারে না। তুমি বলছো না আমি তোমাকে কখনো ভেতর থেকে ফিল করেছি কিনা। একটা কথা বলতো তুমি কি আদৌ কখনো আমাকে ভেতর থেকে ফিল করেছো।

আমি নির্বাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি।তা দেখে তিনি আবার বলতে শুরু করলেন,

তোমার কথা তো ছাড়ো আমার আপন কেউ কখনো আমার ভেতরটা ফিল করিনি। সবাই সব সময় আমার উপরে একটা বিষয়ে চাপিয়ে দিতে চেয়েছে। একটা বার ও কেউ ভেবে দেখেনা যে আদৌ আমি সেটা বহন করতে পারব কিনা।

আপনি এটা কেন বুঝতে চাইছেন না বাবা মা যা করেন তার সন্তানের মঙ্গলের জন্য করেন। তাছাড়া এ পর্যন্ত আপনার মা-বাবা আপনার জন্য যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে তাতে আপনার কি ক্ষতি হয়েছে বলুন।

হ্যাঁ আপনার মতের মিল হয়নি তাই বলে আপনাদের দুজনেরই রেষারেষির মধ্যে ফেলে আমার জীবনটা কেন নষ্ট করছেন? কি পেয়েছেন টা কি আমাকে? বলুন তো।

বাবা মার মনে হয়েছে মেয়ে বিয়ে দেওয়ার দরকার। আর বোঝা টানতে পারছি না। বিয়ে দিয়ে দিয়েছে। যার হাতে তুলে দিয়েছে সেই প্রথম মুখ ফিরিয়ে নিল আমার থেকে।

বিয়ের পরের দিন জানতে পারছি তাদের এই উড়নচণ্ডী বাউন্ডুলে ছেলেকে নিজেদের আয়ত্তে আনার জন্য আমাকে এ বাড়ির বউ করে আনা হয়েছে। চেষ্টা করছি। বিয়ে হয়েছে প্রায় এক মাস হয়ে গেছে। তার ভালোবাসা পাওয়া তো দূর, মনের এক কোনায় এখনো কোন জায়গাই তৈরি করতে পারিনি আমি।

আমার ভবিষ্যৎ টা কি বলতে পারেন। কাকে আঁকড়ে ধরে বাঁচবো আমি। বলুন।

সাফোয়ান কোন কথা না বলে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছেন। আমি তার কলার ছেড়ে দিয়ে কিছুটা দূরে সরে গিয়ে বললাম।

— আপনি যান গিয়ে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়ুন। আমার যা জানাজানা হয়ে গেছে। সকল প্রশ্ন উত্তরের পালা শেষ। উত্তর তো খুব সুন্দর করে দিয়েই দিলেন।

আপনার অনিচ্ছা সত্ত্বেও আপনার বাবা আমাকে ঘাড়ে আমাকে চাপিয়ে দিয়েছে।তাই তো। ঠিক আছে আমি নিজ দায়িত্বে আপনার ঘাড় থেকে আমার সকল বোঝা আমি নামিয়ে নিলাম। এখন থেকে আপনি সম্পূর্ণ মুক্ত। শুনতে পেয়েছেন আপনি। সম্পূর্ণ মুক্ত। এনজয় ইউর সেল্ফ।

মেঘের ঘর্ষনের আলোতে সাফওয়ান কে এক ঝলক দেখলাম আমি। অবাক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন তিনি। অস্পষ্ট স্বরে বলে উঠলেন,

— কী বলতে চাইছো?

— সময় হলে বুঝতে পারবেন।আর হা আপনাকে বিরক্ত করার জন্য দুঃখিত। এবার যেতে পারেন আপনি।

কথাটা বলে উল্টোদিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে আছি। কি আশ্চর্য এখনো চোখে কোন অশ্রু নেই আমার। কিন্তু মনে হচ্ছে বুকের ভেতরটাকেও চেপে ধরেছে। স্বাভাবিক শ্বাস-প্রশ্বাসেও যেন বুকের বা পাশটা চিন চিন ব্যথা করছে। এত খারাপ লাগছে কেন আমার।

সে তো আমাকে ভালবাসিনি। আমাকে কখনো অনুভব করাইনি যে সে আমাকে ভালোবাসে। বরং সে সব সময় অকপটে বলে গেছে আমাকে তার ঘাড়ে জোর করে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে।

একতরফা আমি শুধু বোকার মত ভালোবেসে ফেলেছি। এখানে তো আমার দোষ। না না স্বামীকে ভালোবাসা কখনো অন্যায় হতে পারে না। আসলে এটা আমার ভাগ্যের দোষ।

কি হলো আপনি এখনো দাঁড়িয়ে আছেন কেন? ভয় নেই ছাদ থেকে লাফ দিয়ে মরতে যাব না আমি। আপনাকে ভালোবেসে প্রথম ভুল তো করেই ফেলেছি। আত্মহত্যার মতো দ্বিতীয় ভুল আমি কখনোই করব না। নিশ্চিন্তে গিয়ে ঘুমাতে পারেন আপনি।

কথাগুলো বলে অন্য দিকে তাকিয়ে নিজের হাত ঘষতে লাগলাম। আবার ঘাড় ঘুরিয়ে পাশে তাকিয়ে দেখি সাফওয়ান এখনো দাঁড়িয়ে আছে।

কী হলো?ধ্যাত…!

বলে সিড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসলাম। আর পেছনে ফিরে তাকাইনি আমি। পুতুলের রুমে গিয়ে দরজা আটকে দিলাম। বিছানায় পুতুল গুটিসুটি মেরে শুয়ে আছে। সত্যি বলতে এই মেয়েটাই আপন মনে আমাকে ভালোবেসেছে। বিছানায় গিয়ে পুতুলের পাশে শুয়ে পড়লাম। এক হাতে টেনে ওকে আমার কাছে নিয়ে আসলাম। হালকা নড়ে ওঠে আমাকে জড়িয়ে ধরে আবার ঘুমে তলিয়ে গেল। আমি ওর কপালে ছোট করে চুমুকে দিয়ে বললাম,

— পৃথিবীতে এই একটা জিনিস কোন বাজারে কিনতে পাওয়া যায় না। ভালোবাসা ।যেটা মনের অন্তস্থল থেকে বের হয়ে আসে কিছু বিশেষ মানুষদের জন্য।

আমি তোর ভাইয়ের সেই বিশেষ মানুষ হতে পারিনি পুতুল সোনা।আদৌ কারোর হতে পেরেছি কিনা জানিনা।

চোখের কার্নিশ বেয়ে কয়েক ফোটা অশ্রু বালিশে পড়লো। পুতুলকে আরেকটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম নিজের বুকের সাথে। এই আলিঙ্গন টা আমার বড্ড দরকার।মনে হচ্ছে নিজেরই দুঃখগুলো একটু হলেও এই নরম শরীরটা শুষে নিচ্ছে।

আমি তোকে সারা জীবন মনে রাখব পুতুল সোনা। তুই একমাত্র ব্যক্তি যে নিঃস্বার্থভাবে আমাকে ভালবেসেছিস। হয়তো এখন জেগে থাকলে বলতিস

— কেঁদো না প্রীতিলতা। আমি ভাইয়াকে খুব করে বকে দেব।

কষ্টের মধ্যেও হেসে দিলাম। তোর কথাগুলো আমার খুব আদর আদর লাগেরে পুতুল সোনা। তুই ছাড়া যে আমার এই বাড়িতে আপন বলতে আর কেউ নেই।
কেউ নেই।

চলবে……❣️

[

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here