প্রীতিলতা পর্ব -২৬+২৭

#প্রীতিলতা❤️

#লেখিকা:- Nowshin Nishi Chowdhury

#২৬_তম_পর্ব🍂

গোধূলি বেলায় প্রিয় মানুষটার বুকে মাথা রেখে সাগর কন্যার পাড়ে দাঁড়িয়ে সূর্যাস্ত দেখা এ যেন এক প্রকার স্বর্গীয় সুখানুভূতি। বুক ভরে একমুঠো প্রশান্তির বায়ু টেনে নিলাম নিজের মধ্যে। তার সাথে নাকে ধাক্কা খেলে সেই চির পরিচিত মানুষটার গন্ধ। মুখে এক চিলতে হাসি ফুটে উঠলো। মনে মনে কয়েক বার আওড়ালাম একটা শব্দ।” আমার মানুষ” “আমার একান্ত মানুষ”।

মুখটা আরো গুজে দিলাম তার বুকে।

কিছুক্ষণের মধ্যেই সূর্যটা সাগরে অতলে তলিয়ে গেল। চারিদিকে কেমন অন্ধকারচ্ছন্ন হয়ে উঠলো। সাফওয়ান এবার আমাকে তার বুক থেকে সরিয়ে সোজাসুজি দার করিয়ে মুখটা কিছুটা নিচে নামিয়ে এনে আমার নাকের সাথে নাকের একটা ঘষা দিয়ে বললো,

— চলুন ম্যাডাম এবার কটেজে ফিরে যাওয়া যাক।

আমি না বোধক মাথা নাড়ালাম অবুঝ শিশুর মত। তা দেখে সেও ছোট বাচ্চাদের মত মুখ করে প্রশ্ন করল কেন?

আমি তার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললাম,

আমি আরো কিছুক্ষণ থাকবো।

বলে তার কানের কাছ থেকে মুখটা সরিয়ে এনে মুখোমুখি দাঁড়িয়ে মাথা হ্যা বোধক নাড়ালাম। মুখটা কুচকে অনুরোধ করে বললাম প্লিজ।

সাফওয়ান আমার মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে হঠাৎ হেসে দিয়ে বলল,

— আচ্ছা ঠিক আছে।

ইশ্ আবার সেই হৃদয় বিগলিত হাসি। এই হাসিরই তো পাগল হয়েছিলাম আমি। এসব ভাবতে ভাবতে হঠাৎ মাথায় একটা প্রশ্ন চলে আসলো। তার থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে তাকে প্রশ্ন করলাম,

— আচ্ছা সাফওয়ান আমি এখানে আসলাম
কিভাবে?

কিছুক্ষণ ভাবুক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে থেকে বলল ,

— এভাবে।

মুহূর্তের মধ্যে নিজেকে শূন্যে অনুভব করলাম। হঠাৎ এমন হওয়ায় ভয়ে তার ঘাড়ের কাছে কোটটা খামচে ধরলাম।

— এই নামাও নামাও পড়ে যাব আমি।

আমাকে কোলে করে নিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বলল,

— এত বড় সাহস তোমার আমার কোল থেকে পড়ে যাবে তুমি। পড়লে আগে আমি ফেলব তোমাকে তার পরে তুমি পড়বে । নিজে থেকে পড়লে তোমার খবর আছে।

আমি বিস্ময়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ়। এই ছেলে বলে কি মাথা টাথা গেছে নাকি?

আমাকে কোলে করে নিয়ে সি বিচ এর ছাতাওয়ালা লম্বা চেয়ার টিতে গিয়ে বসলো। নিজে হেলান দিয়ে বসলো আর আমাকে টেনে তার বুকে আধার শোয়া করে বসিয়ে দিল।

দুজনেই সমুদ্রের ঢেউয়ের দিকে তাকিয়ে আছি। হঠাৎ আমি তাকে প্রশ্ন করলাম,

— বললেনাতো এখানে কিভাবে আসলাম? আর এক রাতের মধ্যে তোমার আচরণ এত পরিবর্তন হলো কিভাবে? কি হয়েছিল কাল রাতে?

আমাকে তার বুকের সাথে আমার একটু শক্ত করে জড়িয়ে ধরে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,

— অনেক কিছু হয়েছে গতকাল রাতে। বাবার হাতে থাপ্পড় খেয়েছি, তোমাকে নিয়ে বাড়ি থেকে পালিয়েছি তারপরে কোলে করে নিয়ে এই কটেজ এসে উঠেছি।

আমি তাকে ঝাড়া দিয়ে উঠে বসে এক প্রকার চিৎকার করে বললাম,

— কিহ…!!

তোমাকে বাবা মেরেছে। তুমি আমাকে নিয়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছো?

সাফওয়ান আমার দিকে কিছুক্ষণ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থেকে সোজা হয়ে ওঠে বসে নিজের পরনের কোটটা ঠিক করে বলল,

— তো কি হয়েছে? পরের মেয়ে নিয়ে তো আর পালাইনি নিজের বউ নিয়ে পালিয়েছি।

আমি যেন আকাশ থেকে পড়লাম,

— কি সর্বনাশ তুমি সবাইকে না বলে আমাকে নিয়ে চলে এসেছ ওদিকে তো তাহলে সবাই আমাদেরকে খুঁজছে। ফোন করে জানিয়েছ ওদেরকে?

সাফওয়ান দায় সারাভাবে উত্তর দিল,

— তাদেরকে জানানোর প্রশ্নই আসে না। আর খুঁজুক যত পারে খুঁজুক। কি সর্বনাশী কথা আমার বউকে আমার সামনেই আবার বিয়ে দেবে। দেওয়াচ্ছি বিয়ে।

এখানে আগে আমরা দুজন আবার বিয়ে করবো। হানিমুন করবো। একটা দুটো বাচ্চা কাচ্চা হলে তারপরে সেগুলো কোলে করে নিয়ে বাড়ি যাবো। তখন এই সেকেন্ড হ্যান্ডকে আর কেউ বিয়ে করতে চাইবে না।

কথাটা শেষ করে আমাকে একটা চোখ মারলো সাফওয়ান। ওর কথার মুখের ভঙ্গিমা দেখে আমার বিষম লেগে গেল। এই সাফওয়ান কী সেই সাফওয়ান। আমি কিছুটা তার দিকে এগিয়ে গিয়ে ভালো করে দেখে বললাম,

— এতক্ষণ আমার ডাউট হচ্ছিল কিন্তু এবার আমি একদম শিওর যে তুমি মানুষ নও সাফওয়ানের ভূত হবে অথবা আমি কল্পনা করতেছি ।

কথা শেষ হওয়ার আগেই কোমর পর্যন্ত চুলে বেশ জোরেশোরে টান পরলো আমার। ব্যথায় মৃদু আর্তনাদ করে উঠলাম। মাথা ডোলে চোখ গরম করে সাফওয়ানের দিকে তাকালাম।

সাফওয়ান গাল বেঁকিয়ে হেসে বললেন,

— কি এবার স্বপ্ন মনে হচ্ছে।

দাঁত কটমট করে বললাম,

— না। এত জোরে কেউ চুল ধরে টানে।

হেলান দিয়ে শোয়া থেকে উঠে বসে আমার উদ্দেশ্যে বলল,

— তোমার তো সব চুল টেনে ছিড়ে ফেলে দেওয়া উচিত ফাজিল মেয়ে। সবাইকে দেখায় বেড়াও না দেখো আমার কোমর পর্যন্ত চুল সবাই আমাকে দেখে ফিদা হয়ে যাও ।

আর ওই সায়েম আরেক ফাজিল ব্যাটা । ওর সাথে অত হা হা হি হি করার কি আছে? ইচ্ছা তো করতো ওটার ঘুষি মেরে দাঁত ফেলে দেই আর তোমার মুখে কসটেপ মেরে রেখে দি।

আমি আশ্চর্য হয়ে বললাম,

— আমি কখন হাহা হিহি করলাম। স্বাভাবিকভাবেই কথা বলেছি ভাইয়ার সাথে। তাছাড়া ওনাকে আমি আগে থেকেই চিনতাম। ডাক্তার ভাইয়া বলে ডাকি আমি ওনাকে।

উহ ভাইয়া। ডাক্তার ভাইয়া। তোমার মায়ের পেটের ভাই না। যে অত খাতিরদারি করা লাগবে। সেদিন দেখলাম তো একেবারে মাথার কাপড় ফেলিয়ে দিয়ে চায়ের কাপ নিয়ে তার হাতে গিয়ে দিলে।

আরে ওটা তো আমি ইচ্ছা করে দেইনি। ভাইয়া ডেকেই আমার হাত থেকে চায়ের কাপ নিয়ে নিয়েছিল কিন্তু আমি কি কর…

মাথার মধ্যে হঠাৎ একটা শয়তানের বুদ্ধি খেলে গেল। চুলগুলো কানের পিছনে গুজে তার দিকে আরো কিছুটা এগিয়ে গিয়ে বললাম

— জেলাসি…! জ্বলে তাই না। আপনি তো আবার আমাকে পছন্দই করেন না তাহলে এত জ্বলতেছে কেন আপনার?

ভুরু কুঁচকে আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে হাতের কনুই ধরে হেচকা টান দিয়ে নিজের সাথে মিশিয়ে নিয়ে বলল,

আমার পেছনে লাগা হচ্ছে, তাই না। আমি একবার তোমার পেছনে লেগে গেলে না জীবন কয়লা বানিয়ে দেবো কিন্তু। লাগবো নাকি?

আমি তার হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বললাম,

— আরে না না ছেড়ে দিন। বাবা আগে আনরোমান্টিক ছিল ওটাই ঢের ভালো ছিল। এখন রোমান্টিক হোল কিউব হয়ে গেছে। জীবনটা আগে তো তেজপাতা ছিল এখন আরো বেশি তেজপাতা হয়ে যাবে।

আচ্ছা আপনি বলুন না গতকালকে কি হয়েছিল।

নিজে সেই লম্বা চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে আমার বাম হাতটা টেনে নিয়ে তার বুকের বা পাশে রেখে দু হাত দিয়ে জড়িয়ে নিয়ে চোখ বন্ধ করে ফেললেন। কিছুক্ষণ পর নিজে থেকেই বলতে শুরু করল,

— আমি প্রথমে সত্যিই খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম যেন। তুমি আসলেই কালকে উন্মাদের মত আচরণ করেছ। তারপর যখন সেন্সলেস হয়ে গিয়েছিলে। তখন তো আমার ভয়ে হাত পায়ে ঠান্ডা হয়ে গিয়েছিল। আমার পৃথিবী যেন থমকে গিয়েছিল।

তখন কি করব ভেবে না পেয়ে তোমাকে তাড়াতাড়ি কোলে করে নিয়ে বিছানায় শুয়ে দিয়েছিলাম দরজা খুলে আম্মু আব্বুকে জোরে জোরে চিৎকার করে ডেকে যাচ্ছিলাম।

কিছুক্ষণ পর তারাও ঘরে এসে উপস্থিত হল বিছানায় তোমাকে ওইভাবে শোয়া দেখে আম্মু আর ভাবি দৌড়ে চলে গিয়েছিল তোমার কাছে।

ভাবি যখন বলল সেন্সলেস হয়ে গেছ তুমি।

বাবা তৎক্ষণাৎ থাপ্পড় মেরে দিলেন আমার বা-গালে। ছিটকে কিছুটা দূরে সরে গিয়েছিলাম আমি। আব্বু বলতে শুরু করলেন,

— কুলাঙ্গার জন্ম দিয়েছি আমি। না হলে এমন হবে কেন সে। কি করেছিস তুই মেয়েটার সাথে। এমনিতেই তো তোকে নিয়ে ভাবতে ভাবতে মেয়েটা আধমরা। সরিয়েই তো দিচ্ছি তোর জীবন থেকে। আর কি চাচ্ছিস তুই। পরের মেয়েকে মেরে ফেলবো আমি।

আম্মু এসে ওকে আটকে দিলেন। ভাব নিও জোরে চিৎকার করে বলল,

— তেমন কিছু হয়নি আব্বু। মনে হয় অনেক স্ট্রেসের মধ্যে ছিল তাই এখন সেন্সলেস হয়ে গেছে। খাওয়া দাওয়া হয়তো ঠিকমতো করেনি। তার থেকেই এমন হয়েছে।

বাবা ভাবীর উদ্দেশ্যে বললেন,

— দ্রুত জ্ঞান ফেরাও। ওকে আমি রাত্রি বেলায় ফ্ল্যাটে রেখে আসবো। এই ছেলের আশেপাশে আর এই মেয়েকে রাখবো না। মেয়ের উপরে তোর ছায়াও যাতে না পড়ে সেই ব্যবস্থা করছি আমি।

বলে আব্বু রুম থেকে চলে গেলেন। আম্মু আর ভাবি আমার দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ভাইয়া আর সায়েম বেরিয়ে গেছে কিছুক্ষণ আগে। ভাবির কথা মত আম্মু তোমার জন্য স্যুপ বানাতে গিয়েছিল। সেই ফাঁকে আমি গিয়ে তোমার মাথার কাছে বসলাম। ভাবি আমার দিকে তাকিয়ে বলল,

— তুই কিন্তু ভুল করছিস সাফোয়ান। মেয়েটা কিন্তু অনেক ভালো। তুই এভাবে ওকে ইগনোর করতে পারিস না। দেখ অতীতে যা হয়েছে হয়েছে সবকিছু ভুলে এবার তো নিজের জীবনে এগিয়ে যায়।

আমি ভাবির দিকে এক ঝলক তাকিয়ে নজর সরিয়ে তোমার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলেছিলাম,

— অনেক আগেই এগিয়ে এসেছি আমি ভাবি। আর এতটা এগিয়েছি যে এই মেয়েটার থেকে দূরে যাও আমার পক্ষে সম্ভব না। কোন ভাবেই সম্ভব না।আমি শুধু সঠিক সময়ের অপেক্ষায় ছিলাম। কিন্তু ও যে বড্ড ছেলেমানুষই করে।

ভাবি আমার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,

— সঠিক সময় মানে!

সেটা তোমাকে এখন আমি বলবো না। তুমি শুধু আমার একটা হেল্প কর।

— কি হেল্প?

— ওর যদি জ্ঞানও ফেরে খাইয়ে দাইয়ে আবার ঘুম পাড়ানোর ব্যবস্থা করে দাও।

— মানেই….!

— উফ এতটা হাইপার হওয়ার কিছু নেই। আমি ওকে নিয়ে বাড়ি থেকে পালাবো। জ্ঞান থাকা অবস্থায় সেটা সম্ভব না। আর বাইরে একটা গাড়ির অ্যারেঞ্জ করে দাও। কোথায় যাব জিজ্ঞাসা করো না ওটা আমি তোমাকে বলতে পারব না।

— তুই পাগল হয়ে গেছিস এই অসুস্থ মেয়েকে নিয়ে কোথায় যাবি তুই?

— বললাম না আমার বউকে সুস্থ করার দায়িত্ব তোমার সুস্থ করে দাও আর একটা গাড়ির অ্যারেঞ্জ করে দাও আর কিছু নিয়ে ভাবতে হবে না তোমার আমার বউ আমি দেখে নেব।

— নিজে তো মরবি সাথে আমাকেও মারবি না।

— প্রবলেম নাই কেউ জানতে পারবে না তুমি আমাকে হেল্প করেছ। করবে কিনা বল।না হলে তোমার জামাইয়ের কিন্তু খবর খারাপ করে দেবো।

— থাক। তোমাকে আর কিচ্ছু করা লাগবে না। যা ভালো বোঝো তাই কর। যা যা করতে বলছো করবো কিন্তু কেউ যেন জানতে না পারে।

— নিশ্চিন্তে থাকো।

তারপরে আর কি তোমার মাঝখানে একটু জ্ঞান ফিরেছিল। মা যত্ন সহকারে নিজের হাতে করে তোমাকে চিকেন সুপ খাইয়ে দিয়েছিল। তারপরে শরীর দুর্বল থাকার কারণে তুমি আবারও শুয়ে পড়েছিলে। আমার কথা মত ভাবি তোমাকে ইনজেকশন দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিয়েছিল।

তারপরে আর কি ফজরের আযানের পরে তোমাকে কোলে করে নিয়ে বেরিয়ে এসেছিলাম বাড়ি থেকে। এত কষ্ট করে ব্যাগ গোছালে তুমি। হানিমুনে যাবো না তা কি করে হয় সোনা ।

তাইতো তোমাকে কোলে করে নিয়ে সোজা কুয়াকাটা চলে এসেছি তুমিই তো বলেছিলে সমুদ্র তোমার খুব পছন্দের। তাই হানিমুন করার জন্য সমুদ্রের পাড়টাকেই বেছে নিলাম।

তাই ড্রাইভারকেউ টাকা খাইয়া মুখ বন্ধ করে রেখে এসেছি।

আপাতত ওই বাড়িতে ভাবি বাদে সবাই তোমাকে খুঁজছে। আর ভাবি, একটু একটু নাটক করছে।

আমি মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লাম। কি করেছেন আপনি এগুলো। ওই বাড়ির সবাই হয়তো টেনশনে টেনশনে অজ্ঞান হয়ে গেছে।আর এতক্ষণে তো আমার মা বাবার কানে ওই কথা চলে গেছে। না জানি কি করতেছে সবাই ঐদিকে সবাই। আর আপনি এখানে সটান হয়ে শুয়ে চিল করতেছেন।

সাফওয়ান বিরক্তিতে চ এর মত উচ্চারণ করে বলল,

— আরে ধুর। তোমার কি মনে হয় ভাবির যা পেট পাতলা তা এতক্ষণ না বলে বসে আছে সে। এতক্ষণে ওই বাড়ির সবাই জেনে গেছে তুমি আর আমি হানিমুনে এসেছি । আর বাচ্চাকাচ্চা নিয়েই ফিরবো।

আমি তার ডান বাহুতে চাপড় মেরে বললাম,

— ধ্যাত! বেশররম ব্যাটা।খালি আবোল তাবোল কথা বলে।

বলে আমি সী-বিচের দিকে তাকালাম। কিন্তু সী-বিচ এত সুনসান কেন? এত নিরব তো সমুদ্র সৈকত হয় না।

সাফওয়ানের বহু ঝাঁকিয়ে বললাম,

— সমুদ্র সৈকত তো এত নীরব হয় না। আজ এমন লাগছে কেন?

— তোমার দ্বিতীয় বিয়ে উপলক্ষে আমার সাথে সমুদ্র সৈকত ও নিরবতা পালন করছে।

— আরে ফাজলামি বন্ধ করে বলো না কি হয়েছে এখানে?

সাফওয়ান চেয়ারে বসে নিচু হয়ে নিজের শুয়ে ফিতে বাধতে বাডধতে বললো,

— একজন সাব জজ তার প্রিয়তমাকে নিয়ে এখানে সমুদ্র বিলাস করতে এসেছে ।তাই প্রশাসনের পক্ষ থেকে বিশেষ অনুমতি নেওয়া আছে।

আমি চারিদিকে নজর বুলিয়ে কোথাও কাউকে দেখতে না পেয়ে বললাম,

— কোথায় তারা। দেখতে পাচ্ছি না তো তাদের।

সাফওয়ান তার জুতো বাধা শেষ করে আমার সামনে এসে নিজের কোট ঠিক করে বলল,

— সেই সাব জজ তোমার সামনেই দাঁড়িয়ে আছে আর তার প্রিয়তমা আমার সামনে বসে আছে।

কথাটা কানে পৌঁছাতেই যেন স্থম্ভিত হয়ে গেলাম আমি। কথা বলতে ভুলে গেছি যেন। অবাক হয়ে তার দিকে ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি।

জড়ানো কন্ঠে মুখ বলে উঠলাম,

ত্ তার ম্ মানে…..

স্বপন আমাকে থামিয়ে দিয়ে বলল,

— জ্বী আগ্গে। আপনি যেদিন আমার ওপরে রাগ করে বাপের বাড়ি চলে গিয়েছিলেন সেদিন দুপুরেই নিউজটা পেয়েছিলাম দশদিন পরে জয়নিং এর ডেট। তাই আপনার জন্মদিনটাকে স্পেশাল করার জন্য ই এতকিছু মুখ বুজে সহ্য করে গেছি।

কিন্তু তুমি তো তুমিই না বুঝে না শুনে। ঘরবাড়ি ছেড়ে দিয়ে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে বসে আছো। পুরো পরিবারের গালাগালি শুনিয়েছো। নিজে অজ্ঞান হয়েছে সাথে আমাকেও থাপ্পড় খাইয়েছো। সিরিয়াসলি ডেঞ্জারেস মেয়ে তুমি।

আমি না থাকলে তোমার এগুলো যে কে সহ্য করত একমাত্র উপরওয়ালাই জানে।

আমি বসে বসে কলের পুতুলের মত তার কথাগুলো শুনছি। ও আমার জন্মদিনটাকে স্পেশাল করার জন্য এত কিছু সহ্য করার পরেও ধৈর্য ধরে এই দিনটার জন্য ওয়েট করেছিল। আর আমি কিনা কথাগুলো ভাবতেই চোখের কান্না আসবে এক ফোটা নোনা জল গড়িয়ে পড়ল।

হঠাৎ কোন কিছু না বলেই আবার আমাকে কোলে তুলে নিল। আচমকা এমন হওয়ায় আমিও কিছুটা ভরকে গেলাম।

কী হলো আবার কোলে নিচ্ছ কেন আমায়?

— এইটুকু সারপ্রাইজে কাবু হলে চলবে ম্যাডাম। তোমার জন্য আর সারপ্রাইজ অপেক্ষা করে বসে আছে।

নাকে না ঘসে দিয়ে বলল,

— এবার চলুন ম্যাডাম আমাদের দেরি হয়ে যাচ্ছে।

সে আমাকে কোলে তুলে নিয়ে অজানায় হারিয়ে যাচ্ছে, আমি তার গলা জড়িয়ে ধরে ঘাড় ঘুরিয়ে পিছে দেখলাম সমুদ্রের বিশালতা ততই বৃদ্ধি পাচ্ছে।
#প্রীতিলতা❤️

#লেখিকা:- Nowshin Nishi Chowdhury

# ২৭_তম_পর্ব🍂

অন্ধকারে নিমজ্জিত হয়ে আছে চারপাশ। কিছুক্ষণ পরপর ঝিঝিপোকার ডাক এবং সাথে সমুদ্রের কলকল শব্দ মুখরিত করে তুলছে এই জায়গাটিকে। এই মুহূর্তটাকে যদি একটু তৈলচিত্রের মাধ্যমে উপস্থাপন করা হতো।

তাহলে দেখা যেত এক চমৎকার প্রেমিক পুরুষ তার প্রিয় রমণীকে কোলে করে নিয়ে সমুদ্রের পাড় দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। অসাধারণ হতো কিন্তু চিত্রটি।

সাফওয়ান হেটেই যাচ্ছে। আস্ত একটা মানুষকে যে সে কোলে করে আছে তার জন্য চেহারায় কোন বিরক্তিভাব বা ক্লান্তি নেই তার। এ যেন এক নতুন মানুষকে আবিষ্কার করেছি আমি।

কত কিছুই ভেবেছি কত কিছুই করেছি সেগুলো ভেবে এখন ভারী লজ্জিত হচ্ছি আমি। মানুষটা আমাকে ভালবেসে ছিল কিন্তু নীরবে নিভৃতে। যার অদৃশ্য দেওয়াল আমি ভেদ করতে পারিনি। কি লজ্জা কি লজ্জা আসলেই কি আমি তার ভালোবাসা পাওয়ার যোগ্য ছিলাম।

আমার দৃষ্টির সাফওয়ানে নিবদ্ধ আর সাফওয়ানের দৃষ্টি দূর অজানায়। তার বাম গালের দিকে তাকালাম। কাল নাকি বাবা এখানেই থাপ্পড়টা মেরেছিলেন।

ইশ্ আমার জন্য তাকে মার ও খেতে হয়েছে। ডান হাতটা উঁচু করে তার বা গালে রাখলাম। ধীরে ধীরে ছুঁয়ে দিতে লাগলাম তার খোঁচা খোঁচা দাড়িগুলো। কিঞ্চিৎ কেঁপে উঠলেন যেন সাফওয়ান।

তার পা জোড়া থেমে গেল। তিনি পূর্ণ দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালেন। কিঞ্চিৎ সময় পর আমাকে সহ তার ডান বাহুটা কিছুটা উঁচু করে বেশ সময় নিয়ে আমার কপালে ঠোঁট ছোঁয়ালেন। আবেশে চোখ বুজে নিলাম আমি। প্রিয় মানুষের স্পর্শ গুলো নিদারুন সুন্দর হয়।

আমাকে কোল থেকে নামিয়ে দিলেন তিনি। পকেট থেকে তার রুমাল বের করে মুহূর্তের মধ্যেই আমার চোখ জোড়া বেঁধে দিলেন। ব্যাপারটিতে আমি খানিকটা হকচকিয়ে গেলাম। এবার পেছন থেকে আমার দুই বাহু ধরে সামনে এগোতে এগোতে বললেন,

— আমাকে বিশ্বাস করো তো প্রীতিলতা? না মানে এখন যদি তোমাকে এই সমুদ্রে ফেলে দেই।

আমি কিটকিট করে হেসে উঠে বললাম,

— তা ফেলে দিন না আপনার হাত জোড়াও কিন্তু আমার হাতের মধ্যে আছে। সো সমুদ্রের পানি আমি একা খাব না সাথে আপনিও খাবেন। এখানে আবার দেখলাম দুজনের নোনা পানি খাওয়ার ওপরে ডিসকাউন্ট আছে।

সাফওয়ান হো হো করে হেসে উঠে বললেন,

— রেলস্টেশনের মত এখানেও তাহলে ডিসকাউন্ট আছে।

বলে এক ঝটকায় চোখের উপর থেকে রুমালটা সরিয়ে দিলেন। একটা বেশ কড়া আলোর ঝলকানি এসে লাগল আমার চোখে। ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম একটা উঁচু ঢিবির মতো জায়গায় খুব সুন্দর করে ডেকোরেশন করা হয়েছে।

যার মাঝখানে একটা গোল টেবিল লাল কাপড়ের মোড়া এবং দুপাশে দুটো চেয়ার রাখা আছে এবং মাথার উপর থেকে নিচ পর্যন্ত স্টিকের সাথে ছোট ছোট লাইট লাগিয়ে সুন্দর করে ডেকোরেশন করা। পুরো জায়গাটাকে আকাশী এবং সাদা বেলুন দিয়ে খুব সুন্দর করে সাজিয়ে তোলা হয়েছে।

আমার হাত ধরে সেই বেলুনের মধ্য দিয়ে হাঁটিয়ে নিয়ে এসে টেবিল ঘেঁষে দাঁড়ালেন সাফওয়ান। আমাকেও মাঝ বরাবর দাঁড় করালেন। টেবিলটার উপরে বড় একটা বক্স রাখা। বক্সের ফ্রিতে ধরে টান দিতে চারিপাশ থেকে বক্সটা খুলে পড়ে গেল।

সাথে সাথে বেরিয়ে আসলো একটি ওশান ব্লু এবং চকলেট ফ্লেভার কম্বিনেশন এর একটি তিন পার্টের কেক। সে কেকের সামনে ক্রস করে দুটো ছোট ইস্টিক লাগানো আছে। যার একটার উপরে লেখা হ্যাপি বার্থডে অন্যরাতে লেখা হ্যাপি ওয়ান মান্থ অ্যানিভার্সারি।

লেখাটা দেখেই চমকে উঠলাম। এক মাস হয়ে গেছে আমাদের বিয়ের। আজকের এই দিনে গত মাসে বিয়ে হয়েছিল আমাদের। আবোল তাবোল চিন্তাভাবনার উদ্ভট কাজের চাপে এই ব্যাপারটা তো আমার মাথা থেকেই বেরিয়ে গিয়েছিল।

আমি সাফয়ানের দিকে তাকাতেই সে আমার বা গালে ছোট্ট একটা চুমু দিয়ে বলল হ্যাপি ওয়ান মান্থ অ্যানিভার্সারি সুইটহার্ট।

আমি হতাশ গলায় তাকে বললাম,

— এটাও মনে ছিল আপনার।

সে বক্সগুলো টেবিলের উপর থেকে সরিয়ে সাইডে রাখতে রাখতে বলল,

— হুম। এই তারিখে একটা গোটা মানুষকে নিজের নামে দলিল করেছিলাম ।তা মনে থাকবে না তারিখ টা। ইনফ্যাক্ট আমি তো চিন্তা করে রেখেছি আগামী এক বছর এভরি মান্থ তোমরা সেলিব্রেশন করব।

অবাক হলাম আমি এগুলো তো আমার পরিকল্পনা ছিল। উনি জানলেন কি করে। সাফওয়ান বক্সগুলো সরিয়ে রেখে সোজা হয়ে আমার দিকে দাঁড়িয়ে বললেন,

— কি অবাক হচ্ছো। প্রিয় মানুষকে শুধু ভালবাসলেই হয় না মনের কথা বুঝতে পারার ক্ষমতা থাকতে হয় , চোখের ভাষা বুঝতে হয়, মনের আবেগ অনুভব করতে হয়। তারপরেই প্রেমিক পুরুষ হওয়া যায়।

সাফোয়ানের কথাগুলো আমার মনের মধ্যে একটি সূক্ষ্ম যন্ত্রনা সুত্রপাত ঘটালো। আমিও ভালোবেসেছি । কিন্তু এতটা অনুভব করে নয়। আমি ভালোবাসার স্বীকৃতি চেয়েছি কিন্তু কিন্তু উনি আমাকে অনুভব চেয়েছেন‌‌।ইশ্ এভাবেও ভালোবাসা যায়।

চোখের কোণে অশ্রু গুলো ভিড় জমালো। তা দেখে সাফওয়ান আমার কাছে আরো কিছুটা এগিয়ে এসে আমার মুখটা আঁজলা করে নিজের বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে চোখের পাতা মুছে দিয়ে বললেন,

— তোমার ভালবাসার নিদারুণ ক্ষমতা আছে প্রিয়তমা। আমার মরু মনে তোমার ভালবাসা রহমতের বৃষ্টি হয়ে নেমেছে বলেই আজ আমি আমার অস্তিত্বকে খুঁজে পেয়েছি। রাগ হিংসা এগুলো মনের মধ্যে পুষতে পুষতে এক সময় নিজেই পাথরে পরিণত হয়েছিলাম আমি।

তুমি ঠিক বলেছিলে রাগ হিংসা এগুলো মনের মধ্যে যত বাড়ে আপনজনরা তত বেশি দূরে সরে যায়। সরেই তো গিয়েছিলাম সবার থেকে। নিজের চারিপাশে একটা অদৃশ্য প্রাচীর তৈরি করে নিয়েছিলাম আমি।

কিন্তু সেই দুর্ভেদ্য প্রাচীর তুমি ভেদ করতে সক্ষম হয়েছিলে। তোমাকে যতই দূরে সরাতে চেয়েছি তুমি তত বেশি কাছে এসেছো। তোমাকে যত বেশি ঘৃণা করতে চেয়েছি তুমি তত বেশি ভালোবাসায় মুরিয়ে দিয়েছো আমাকে।

আগে যে তোমার ছায়াও সহ্য করতে পারত না। সে এখন তোয়ায় বুকে করে নিয়ে না ঘুমাতে গেলে ঘুম আসে না। তোমার রান্না ছাড়া এখন অন্য কোন রান্না খেতে পারেনা, ঘরে ঢুকলে তোমার সুবাস না পেলে দম বন্ধ হয়ে যায় তার, জিনিসগুলো তুমি গুছিয়ে না দিলে সবকিছু অগোছালো হয়ে যায়।

তোমার হাসির শব্দ, তোমার করা মজা গুলো, তোমার সম্মোধন টাও প্রতিদিন সকালে তোমার স্নিগ্ধ স্পর্শ গুলো সবকিছু কেমন যেন অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে আমার

ইদানিং কল্পনাতেও আসা যাওয়া বেড়েছে তোমার। আমারও পুরো অস্তিত্বের সাথে মিশে গেছো তুমি। তুমি বিহীন শ্বাস নিতেও এখন আমার কষ্ট হয় প্রিয়তমা।

ভাবলে কি করে প্রিয় , তুমি আমার জীবনের বোঝা হয়ে গেছো। যখন থেকে তোমাকে ভালবাসতে শুরু করেছি তখন থেকেই নিজের মধ্যে তোমাকে হারানোর একটা ভয় সৃষ্টি হয়ে গিয়েছিল আমার। তোমাকে কারো সাথে সহ্য হতো না আমার।

সেদিন খালামনির বাড়িতে সায়েমের সাথে তোমার সাধারণ কথাও আমার চোখে লেগেছিল। রাগ হয়েছিল তোমার উপর তাই সেদিন রাতে তোমার সাথে অমন আচরণ করেছিলাম। পরে সায়েম জানিয়েছিল তোমার আর ওর ব্যাপারে।

তার পরেও ওর পাশে তোমাকে দেখলে কেন জানি আমার সহ্য হতো না। তারপর তুমি যখন তার পরের দিন সকালে তোমার বাড়িতে চলে গিয়েছিলে তখন উপলব্ধি করেছিলাম।

যে আমার মনের অনুভূতিগুলো এবার তোমাকে জানানোর সময় এসে গেছে না হলে সত্যিই অনেক দেরি হয়ে যাবে। তাই সামিরা আর আমার ব্যাপারটা সম্পূর্ণ ক্লিয়ার করে দিয়েছিলাম তোমার কাছে। যাতে তুমি আমাকে ভুল না বোঝো।

আমি স্বভাবত অনেকটা নিরব স্বভাবের। মনে করেছিলাম তুমি হয়তো বুঝতে পারবে। কিন্তু না তুমি তো উল্টো বুঝে বসে আছো। এবং মনে মনে চক কষেছো কিভাবে আমার থেকে দূরে চলে যাবে।

ভালবাসতে শিখিয়ে এভাবে চলে যাবে তা তো হয় না বেইবি ।তাই মনে মনে আমিও একটা ছক কষে নিলাম। তোমাকে নিয়ে এই বাড়ি থেকে পালাবো। এন্ড সি পালিয়ে এসেছি তোমাকে নিয়ে।

আর জানো তুমি আমার জন্য খুব লাকি। সেদিন দুপুরে তুমি বাপের বাড়ি যাওয়ার পরে রেজাল্ট টা পেয়েছিলাম। যদি সত্যি তুমি ওখানে উপস্থিত থাকতে না আমি কিন্তু উঠে গিয়ে তোমাকেই জড়িয়ে ধরতাম প্রথমে।

বিয়ের পরে কত তালবাহানায় আমার কাছে ঘেষে থাকতে চাইতে তুমি। আর সেদিন তোমাকে যে একটু জড়িয়ে ধরলাম ছিটকে দৌড় দিলে। সত্যি বলতে সেদিন আমার মধ্যকার সমস্ত আনন্দগুলো আমি তোমার সাথে ভাগ করে নিতে চেয়েছিলাম। তোমাতেই বিলীন হতে চেয়েছিলাম।

আমি তার বাহু জোড়ার মধ্যে দাঁড়িয়ে তার শ্রুতি মধুর কথাগুলো শুনছি। আর নীরবে চোখের জল ফেলছি। সত্যি অপেক্ষার ফল সুমিষ্ট হয়। যে মিষ্টতা এখন আমার সর্বাঙ্গকে পুলকিত করছে। মন জুড়ে আনন্দের জোয়ার বইছে। আর সেই আনন্দের জোয়ারে স্রোত ধারা হয়ে গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে।

স্বপন আমার দিকে আরও কিছুটা এগিয়ে এসে চোখের পানি মুছে দিয়ে বললেন,

— আজ মনে হচ্ছে যেন তোমার চোখের পানির বাঁধ ভেঙেছে। অস্রু গড়িয়েই যাচ্ছে গড়িয়ে যাচ্ছে থামার নামই নেই। চলো এসো এবার কেক কাটবে।

কথাগুলো বলে আমার গালের রাখা তার হাত সরিয়ে নিতে গেলে আমি হাত জোড়া চেপে ধরে বললাম,

— আমাকে এতটা ভালবাসলে কবে কুমড়া পটাশ?

সাফওয়ান স্নিগ্ধ হেসে আমার নাকের নাক ঘষে বললেন,

— আমিও তো দিনক্ষণ দেখে তোমাকে ভালবাসিনি সোনা। আমি নিজেও বলতে পারব না সেই নির্দিষ্ট দিনটা কবে এসেছিল। শুধু এটুকু জানি অনুভূতিটা জন্মে গেছে ভেতর থেকে ‌। যাকে প্রতিরোধ করা আমার পক্ষে আর সম্ভব নয়।

আমি শব্দ করে কেঁদে উঠলাম। দুহাত দিয়ে সাফওয়ানকে জড়িয়ে ধরে তার বুকের মাথা রেখে অশ্রু বিসর্জন দিতে লাগলাম। কিছুক্ষণ পর তিনি আমাকে সোজা করে দাঁড় করিয়ে বললো,

— অনেক কেঁদেছো তুমি।আর না। আমি তোমাকে প্রমিস করছি। এরপরে থেকে আর এক ফোঁটাও অশ্রু তোমার চোখ থেকে গড়াতে দেবো না আমি।

এসো আমার সাথে। আমি অনেক কষ্ট করে তোমার জন্য ডেকোরেশন করেছি। দয়া করে এখন কান্নাকাটি করে এই সুন্দর মুহূর্তটাকে নষ্ট করো না।

কেকটা কাটলাম। একে অপরকে অতি ভালবাসার সাথে খাইয়ে দিলাম। আর এই সুন্দর মুহূর্তটাকে নিজের মুঠো ফোনে ক্যাপচার করে রাখলেন সাফওয়ান।

ভালোবাসা তখনই সুন্দর যখন দুটি মানুষ একে অপরকে শ্রদ্ধাবোধের সাথে আপন করে নেয় দুই দিক থেকেই বরাবর প্রেম থাকে। যেটা আজ আমি অনেক সাধনার পরে পেয়েছি। হ্যাঁ সত্যিই তাকে আমি পেয়েছি। একদম নিজের করে।

_________🌺🌺_________

সন্ধ্যা সাতটা বাজে,

নিজের রুমে বিছানার ওপরে আদর্শোয়া হয়ে বসে চায় চুমুক দিচ্ছেন সাখাওয়াত হোসেন। পাশে তার অতি পছন্দের উপন্যাস শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সমগ্র আধা ভাঁজ করে রাখা আছে।

মাগরিবের নামাজ পড়ে কেবল বসে ছিলেন উপন্যাসের পাতায় ডুব দিতে কিন্তু তৎক্ষণাৎ মিসেস শায়লা হোসেন স্বামীর জন্য চায়ের কাপ নিয়ে রুমে প্রবেশ করলেন। স্বামীর হাতে চায়ের কাপটা ধরিয়ে দিয়ে বিছানার পাশে থাকা জায়গায় বসে স্বামীকে প্রশ্ন করলেন,

— এটা কি হলো সাফওয়ান এর আব্বু। আমাদেরকে সব প্ল্যানই তো ভেস্তে গেল। কী ভেবে রেখেছিলাম আমরা আর কি হয়ে গেল। হাহুতাশ করে বলে উঠলেন তিনি।

মোঃ সাখাওয়াত হোসেন নির্বিঘ্নে চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে তৃপ্তির শ্বাস ফেলে বললেন,

— মূল উদ্দেশ্য যেটা ছিল সেটা তো পূরণ হল। এখন কোথায় আর কিভাবে পূরণ হলো সেটা ভেবে লাভ কি। বরং আয়োজন করো তোমার ছেলে আবার বিয়ে করে বউ নিয়ে আসছে।

মহা ধুমধামে আমি এবার বৌভাত এর আয়োজন করব। বিয়েটা যেমনই হয়েছে কিন্তু আমার ছেলের বৌভাতটা জমজমাট হওয়া চাই ।সাব জজ এর বৌয়ের বৌভাতের অনুষ্ঠান বলে কথা।

মিসেস শায়লা হুসাইন চোখ ছোট ছোট করে বললেন,

— তুমি এতটা শিওর হলে কি করে তোমার ছেলে প্রীতিকে আবার বিয়ে করে তারপরে আসবো।

মিস্টার সাখাওয়াত হুসাইন রহস্য করে হেসে বললেন,

— ছেলেটা তো আমার। সব দিক থেকে স্বভাবটাও আমার মত পেয়েছে। আমার ছেলেকে আমার থেকে আর কে বেশি চিনবে। এইজন্যই তো প্রীতিকে এনেছি ওর জীবন সঙ্গিনী করে আমার বিশ্বাস ছিল এই মেয়েই পারবে তোমার ছেলেকে সোজা করতে। এবং পেরেছেও।

মিসেস শায়লা হোসেন হেসে বলে উঠলেন,

— জানো সকালবেলায় যখন ওদের রুমে গিয়ে দেখলাম প্রীতি বিছানায় নেই। আমি তো আঁতকে উঠেছিলাম। পুরো রুমটা তন্ন তন্ন করে খুঁজে কাউকে না পেয়ে আমার তো মাথা কাজ করাই বন্ধ করে দিয়েছিল। সাফওয়ান যে প্রীতি কে নিয়ে এভাবে চলে যাবে এটাতো আমার মাথাতেই আসিনি।

তারপর তুমি যখন বললে সকালবেলায় প্রীতিকে নিয়ে তুমি সাফওয়ানকে বেরিয়ে যেতে দেখেছ বাড়ি থেকে। তার পরেও কেন যেন আমার বিশ্বাস হচ্ছিল না। পরে সামিরাও একই কথা বলল। আমি এখনো ভাবতে পারছি না সাফওয়ান এমন একটা কাজ করবে।

আমরা তো ভেবে রেখেছিলাম প্রীতিকে প্রথমে অন্য ফ্ল্যাটে গিয়ে রাখবো। কয়দিন পরে সাফওয়ান নিজে গিয়ে প্রীতিকে নিয়ে চলে আসবে। কারণ আমি তো মা আমার ছেলের চোখে আমি প্রীতির জন্য অন্যরকম কিছু দেখেছিলাম সেটা কখনো ভুল হতে পারে না। আমি বুঝতে পেরেছিলাম আমার ছেলে পেতে কে ভালোবেসে ফেলেছে। কিন্তু ও যে এমন পাগলামি করবে এটা আমার ধারণার বাইরে ছিল।

মিস্টার সাখাওয়াত হোসেন পাশের ডেক্সের এর উপরে চায়ের কাপটা রেখে বললেন,

— ফজরের নামাজ মসজিদে পড়ার জন্য যখন ঘর থেকে বাইরে বের হলাম তখন দেখি সামিরা সদর দরজার কাছে দাঁড়িয়ে এদিক-ওদিক নজর বুলাচ্ছে। পরে সদর দরজার দিকে না গিয়ে দোতলার বারান্দায় পিছন সাইডে গিয়ে দেখলাম। তোমার ছেলে বৌমাকে কোলে করে নিয়ে গাড়িতে ঢুকছে আবার দারোয়ান কেউ কিছু টাকা দিয়ে গেছে মুখ বন্ধ রাখার জন্য।

তাইতো ফজরের নামাজটা ঘরেই পড়েছি আজকে। তার সাথে দুই রাকাত শোকরানা নফল নামাজ পড়েছি আল্লাহর উদ্দেশ্যে। আমার পাগল ছেলেকে বুঝদার বানানোর জন্য। নাও তাড়াতাড়ি শুরু করো আমার মন বলছে তোমার ছেলে কাল সকালেই বৌমাকে নিয়ে চলে আসবে। আর আমি দেরি করতে চাই না কালকে বৌভাতের অনুষ্ঠান হবে। সবাইকে প্রায় ইনভাইট করা হয়ে গেছে। আর কিছু বাকি আছে কাগজ-কলম নিয়ে এসো ফোন করে করে জানিয়ে দেই।

এর মধ্যে হাতের ট্রে করে সন্ধ্যার নাস্তা নিয়ে ঘরে ঢুকলো সামিরা। তার পেছন পেছন ঢুকলো পুতুল এবং সাকলাইন ‌। সেন্টার টেবিলটা টেনে এনে মাঝখানে রেখে নাস্তার ট্রেটা টেবিলের উপরে রাখল সামিরা। সাকলাইন আর পুতুল বিছানার ওপরে বসলো, আর স্বামীরা সোফা সেটের উপরে।

সাক লাইনের দিকে তাকিয়ে সাখাওয়াত হোসেন বললেন,

— ক্যাটারিং এর দায়িত্ব কিন্তু তোমার। নাস্তা খেয়ে বেরিয়ে পড়ো এখন। বাজার ঘাট সদাই পাতে সবকিছু বাকি আছে একে একে করতে হবে।

বলে পাকড়াও বাটিটা তুলে এক এক করে খেতে লাগলেন।

সাকলাইন চায়ের চুমুক দিতে দিতে বলল,

— চিন্তা করো না বাবা তুমি শুধু ইনভাইট লিস্ট টা ভালোভাবে চেক করো আর কাদের কাদের ইনভাইট করতে বাকি আছে তাদের ফোন করে জানিয়ে দাও এদিকে আর যা আছে সব কিছু আমি সামলে নেব আর আমি একা তো নয়, আমার সাথে সায়েম আছে। ও একটু হসপিটালে গেছে, কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে আসবে বলেছে। এখনো তো সারারাত পড়ে আছে। কাল ওরা আসার আগেই সবকিছু গোছানো হয়ে যাবে। কাল চমৎকার একটা সারপ্রাইজ দেওয়া হবে ওদেরকে।

পুতুল হৈহই করে বলে উঠলো। আম্মু প্রীতিলতা আর ছোট ভাইয়ার কি আবার বিয়ে হবে। শায়লা হোসেন মেয়েকে কোলের দিকে টেনে নিয়ে বললেন,

— বিয়ে তো তোমার ভাইয়ার হয়ে গেছে সোনা। এবার তোমার ভাইয়া আর ভাবির বৌভাতের অনুষ্ঠান হবে।

না ও আমার প্রীতিলতা হয়। আমি সারা জীবন ওকে প্রীতিলতা বলে ডাকবো।

পুতুলের কথা শুনে উপস্থিত সবাই হেসে উঠল। সামিরা বলে উঠলো,

— বাবা কালকে প্রীতিকে পড়ানোর জন্য কিছু ড্রেসও তো কিনতে হবে। তাছাড়া কালকে অনুষ্ঠানের জন্য আমরা মেয়েদের কিন্তু নতুন ড্রেস চাই।

মিস্টার সাখাওয়াত হোসেন মুচকি হেসে সামিরার দিকে তাকিয়ে বললেন,

— আমার বাড়ির সব মেয়েরা কালকে নতুন পোশাক পরবে। তোমরা মেয়েরা সবাই বেরিয়ে পড়ো, শপিংয়ের জন্য আর আমরা এদিকে আমাদের কাজ সেরে আসি। দশটায় ডিনারের টেবিলে সবার সাথে বাকী কথা হবে।ঠিকাছে।

সবাই ঘাড়বাঁকিয়ে সম্মতি জানালো। পুতুল তো বায়না জুড়ে দিয়েছে সে নাকি পছন্দ করে তার প্রীতিলতার জন্য বৌভাতের পোশাক কিনবে। সে তার সেটা তো সে অবশ্যই কিনবে। আফটার অল প্রীতিলতার পুতুল সে।

হঠাৎ ফোনে মেসেজ এর শব্দ আসায় সবাই কিছুটা থেমে গেল। সাখাওয়াত হোসেন ফোনটা তুলে নিয়ে দেখলেন মেসেজে লেখা

Assalamualaikum, baba
finally your plan has succeeded. Coming back very soon… “Preeti”

চলবে…!

[ চাইলেও তাড়াতাড়ি গল্পটা দিতে পারছি না। তার জন্য আন্তরিক ভাবে দুঃখিত। গল্পটা একেবারেই শেষের দিকে তাই অনেক ভেবেচিন্তে গুছিয়ে লিখতে গিয়ে অনেকটা সময় লাগছে আমার প্রিয় পাঠকগণ। ব্যাপারটা ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।😊

আর হ্যাঁ সাফওয়ান এবং প্রীতির বৌভাতের অনুষ্ঠানের সবাইকে সাদর আমন্ত্রণ। সবাই গিফট নিয়ে চলে আসবেন। আশা করছি খুব তাড়াতাড়ি আগামী পর্ব নিয়ে চলে আসব আপনাদের মাঝে।

👉আর দয়া করে অবশ্যই গল্পটা সম্পর্কে কয়েকটা লাইন জানিয়ে যাবেন।। আমি অধীর আগ্রহে বসে থাকি আপনাদের সুন্দর সুন্দর কমেন্ট পড়ার জন্য। যেটা আপনারা করতে কার্পণ্য করেন😐]
#চলবে…..❣️

[ আমি জানি গল্প দিতে আমার এবার অনেক দেরি হয়ে গেছে। সত্যি বলতে অনেক অসুস্থ ছিলাম। লেখাটাও বারবার এলোমেলো হয়ে গেছে আমার। আজ আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি। তাই গল্পটা লিখে পোস্ট করলাম।

অনেক কষ্ট করেই লিখেছি এইটুকু। আশা করি সবাই রেসপন্স করবেন। আপনাদের গুরুত্বপূর্ণ মন্তব্য গুলোর মাধ্যমে আমার এই কষ্টটা সার্থক হবে। ধন্যবাদ সবাইকে শুভরাত্রি 😊]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here