#প্রেতপুরুষ
——————-(২য় পর্ব)
সেই রাতে আমি অদ্ভুত একটা স্বপ্ন দেখলাম, অচেনা একটা ঘরে ঘুমিয়ে আছি।হঠাৎ করে আমি চোখ মেলে তাকিয়ে দেখলাম সারা ঘর ধোঁয়ায় ভরে যাচ্ছে।তারপর কে যেন আস্তে আস্তে আমার কাছে এসে দাঁড়ালো তারপর ফিসফিস করে বললো, সাইয়ারা তোমার বিপদ, খুব বিপদ।আমি শুধু কথাগুলো শুনলাম কিন্তু কে কথাগুলো বলছে আমি তাকে দেখতে পেলাম না। কিন্তু আমি বুঝতে পারছি এই কন্ঠস্বর আমার খুব চেনা।কিন্তু কার কন্ঠস্বর এটা আমি কিছুতেই মনে করতে পারছি না।আমার ভিতর একটা অসস্তি হচ্ছিল মনে হচ্ছিল দম আটকে আসছে।আমি হাপাতে হাপাতে ঘুম থেকে জাগলাম।দ্রুত উঠে বসলাম।চম্পা আমার উঠে বসার শব্দে জেগে গেল।আমাকে ধরে জিজ্ঞেস করলো, কি হয়েছে তোর?
আমি কোন রকম নিশ্বাস নিয়ে বললাম, কিছু না মনে হয় খারাপ স্বপ্ন দেখেছি।তুই এক গ্লাস পানি এনে দে আমায়।
চম্পা দ্রুত উঠে গিয়ে গিয়ে পানি নিয়ে এলো।আমি এক চুমুকেই সবটুকু পানি খেয়ে নিলাম।
চম্পা কিছুক্ষণ নিশ্চুপ থেকে তারপর প্রশ্ন করলো,কি স্বপ্ন দেখেছিস ইরা?
-আমার মনে নেই চম্পা, তুই ঘুমা তো।মাঝরাতে তোর ঘুম নষ্ট করলাম।
-ঠিক আছে তুইও শুয়ে পড়। আমি আছি তো পাশে ভয় পেলে আমাকে ডাক দিস।
-আমি তোর মতো ভিতু না, ঘুমাও চম্পা রানী।
চম্পা উঠে গিয়ে বাতি জ্বালিয়ে তারপর শুতে এলো।আমি জানি চম্পা ভয় পাচ্ছে আর সে জন্যই স্বপ্নের কথা স্পষ্ট মনে থাকলেও আমি ওকে কিছুই বললাম না।এই ধরণের স্বপ্ন বলে ওর রাতের ঘুম হারাম করার কোন মানে হয় না।কিন্তু আমার অদ্ভুত রকমের অসস্তি হচ্ছিল।কিছুতেই আমি স্বপ্নটা ভুলতে পারছিলাম না।স্বপ্নটা যদি সত্যি হয় যদি সত্যি আমার কোন বিপদ হয় তবে সেটা কি? আর স্বপ্নের মানুষটা কে-ই বা ছিল।সেই কন্ঠস্বরটা আমার এত পরিচিত কেন লাগছিল।স্বপ্ন তো কখনও বাস্তব হয় না হয়তো আজকে সারাদিন বাবাকে নিয়ে খুব দুশ্চিন্তায় ছিলাম বলে এমন স্বপ্ন দেখলাম।এসব ভাবতে ভাবতেই আমি কখন ঘুমিয়ে গেছি খেয়ালই নেই।
চম্পার ডাকে ঘুম ভাঙলো অনেক ভোরে।আমাকে ডেকে তুলে বললো ফজরের নামাজটা পড়ে নে।রাত বিরাতে ভয় পাবি না আর।
চম্পা আর আমি দুজনেই ফজরের নামাজ আদায় করলাম।মন শান্ত হয়ে গেল।
আমি চা বানিয়ে নিয়ে বেলকনিতে বসলাম।
চম্পা এসে বসলো আমার সাথে, তারপর বললো, মামা ফোন দিয়েছিলেন ওনারা কিচ্ছুক্ষণ পরে বাসায় আসবেন।
-আর ওই যে অচেনা ছেলেটা তার কি অবস্থা কিছু বলেছে?
– হ্যাঁ ছেলেটাকে সাথে নিয়েই আসবে।সব টেস্ট হয়ে গেছে কিন্তু ছেলেটার কোন টেস্টেই ঠিক রিপোর্ট আসছে না।মামার পরিচিত ডাক্তার বলেছেন ছেলেটাকে বাসায় নিয়ে আসতে সে মোটামুটি সুস্থ এমন হতে পারে কয়েকদিন পর তার সব মনে পড়ে যাবে।বাসায় থেকেই বাকি ট্রিটমেন্ট হবে।
আমি অবাক হয়ে প্রশ্ন করলাম,- ঠিক রিপোর্ট আসছে না মানে?
-মানে কোন রিপোর্টে বুঝা যাচ্ছে না ছেলেটার কতটা কি হয়েছে।শুধু বুঝা যাচ্ছে মাথায় আঘাত পেয়েছে। আঘাতটা বুঝা গেলেও স্মৃতি শক্তি হারিয়ে যাওয়ার কারণ পাওয়া যাচ্ছে না বা এটা কি সাময়িক সময়ের জন্য নাকি দীর্ঘস্থায়ী কিছুই নাকি বুঝা যাচ্ছে না।
-ছেলেটাকে বাসায় এনে কি হবে এখন হাসপাতালে থাকলেই তো ভালো ছিল।
-গাধী, মামার কাজ আছে না? তাছাড়া মামীও তো প্রতিদিন ছেলের সাথে হাসপাতালে থাকতে পারবেন না, বাসা থেকে হাসপাতালে ছুটাছুটি অনেক ঝামেলা হয়ে যাবে তাই হয়তো নিয়ে আসছে।কিন্তু বাসায় আনলে তোর কি সমস্যা?
-কোন সমস্যা নেই এমনিই বললাম।
-ঠিক আছে আমি ভাত বসাই গিয়ে তুই থাক মামা মামী আসলে খেতে দিতে হবে।
-আমি আসবো তোকে হেল্প করতে?
-দরকার নেই রহিমা খালা তো আছে, আর মামীর রান্না করা তারকারিই আছে আমি শুধু ভাতটা রান্না করবো তোকে কিছু করতে হবে না আর।
চম্পা চলে গেল আমি বেলকনিতে একা বসে আছি। এই বেলকনি থেকে বাসার নিচটা গেট পর্যন্ত দেখা যায়।আমি চা খেতে খেতে উঠে দাঁড়িয়ে আমার লাগানো গোলাপ গাছ গুলো দেখছিলাম। হঠাৎ চোখ পড়লো একটা গাছে গোলাপ ফুল কেমন কালো দেখতে লাগছে।কিন্তু আমি তো কোনো কালো গোলাপ লাগাইনি।তাছাড়া আগেও তো কখনও কালো গোলাপ ফুটেনি।আমি গোলাপটাকে কাছ থেকে দেখতে গেলাম তখন মনে হলো স্বাভাবিক লাল টকটকে এটা গোলাপ ফুল।কিন্তু এই মাত্র আমি এটিকে কালো দেখে ছিলাম।হবে হয়তো চোখের ভুল। আমি ফিরে এসে বসলাম চায়ে চুমুক দিতে যাব তখনই হঠাৎ দমকা হাওয়া এসে আমার চুল গুলো উড়িয়ে দিলো।আমার সারা শরির শিরশির করে উঠলো।শীতল বাতাসে শরীর জুড়িয়ে আসছে।আমি চোখ বন্ধ করে নিলাম।সাথে সাথে মনে হলো যেন বলছে “সে এসে গেছে”। আচমকা অস্পষ্ট এই শব্দ কানে যেতেই আমি চোখ খুলে তাকালাম কিন্তু কোথাও কেউ নেই।তাহলে কে বললো সে এসে গেছে।আমার ঘাড়ের দাগটায় রাতের মতই ব্যথা অনুভব করলাম। কিন্তু কেন এখানটায় বার বার ব্যথা করছে!
গাড়ির হর্ন শুনে আমি বেলকনি থেকে নিচে তাকালাম বাবার গাড়ি ঢুকছে বাসায়। তাহলে কি বাবারা আসায় চম্পা বা রহিমা খালার গলা শুনলাম!
গলার স্বরটা মেয়েদের না ছেলেদের সেটাই তো বুঝলাম না।আমার মনে হলো বাসার পাশে খেলার মাঠ আছে ওখানে বাচ্চারা চিৎকারও চেচামেচি করে খেলে হয়তো ওরাই কথা বলছে তার মধ্যে একটা কথা কানে এসেছে আমার।যাই হোক বাবা মা এসে গেছে ভিতরে যাওয়া উচিৎ।আমি উঠে হাটা শুরু করলাম।
সেদিন বিকেল বেলা আমি আর চম্পা ছাদে গিয়ে বসেছি, খাওয়ার জন্য আচার আনতে নিচে গেল চম্পা।আমি একা একাই বসে আছি। হঠাৎ কারোর পায়ের আওয়াজ শুনে ভাবলাম চম্পা এসেছে পিছনে না তাকিয়েই জিজ্ঞেস করলাম আচার খুঁজে পেলি?
পুরুষের কন্ঠে জবাব এলো, কিসের আচার?
আমি দ্রুত পিছন ফিরে উঠে দাঁড়ালাম। এটা তো সেই ছেলেটা। ছেলেটা তো মনে হয় ঘুমাচ্ছিল জেগে উঠলো কখন,আর ছাদেই বা কি বুঝে এলো। আমি থতমত করে বললাম, -আপনি?
ছেলেটা মুচকি হেসে বললো আপনি সাইয়ারা তো চাচা চাচীর মেয়ে?
-চাচা চাচি কে?
-আপনার বাবা মা। আমি ওনাদের চাচা চাচী ডেকেছি।
-ও আচ্ছা।আপনার কি কিছুই মনে পড়েনি এখনও?
ছেলেটি এবার দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, – না।
-আপনার নিজের নামটাও মনে নেই?
-নাম? হ্যাঁ নামও তো মনে আসছে না।আমার মাথায় প্রচন্ড ব্যথা করছে কিছুই মনে করতে পারছি না।
ছেলেটির চোখে মুখে অসহায়ত্ব দেখে আমার খুব মায়া হলো, আমি নরম গলায় বললাম,
– থাক আপনাকে আর কিছুই মনে করতে হবে না।মনে আসলে এমনিতেই আসবে।আপনি কোন চিন্তা করবেন না বাবার পরিচিত অনেক ডাক্তার আছেন ওনারা আপনার ট্রিটমেন্ট করলে আপনি আস্তে আস্তে সব মনে করতে পারবেন।
কিন্তু আপনার তো একটা নাম দেয়া দরকার যে নামে সবাই আপনাকে ডাকবে।
ছেলেটি আমার কথা শুনে মৃদু হেসে বললো,আপনি পছন্দ করে একটা নাম দিয়ে দিতে পারেন।
কি সুন্দর করে হাসে মানুষটা।এই ছেলেটাকে আমার খুব বলতে ইচ্ছে করছে দয়া করে আমার সামনে এসে এভাবে হাসবেন না।কিন্তু ছেলেটার জন্য আমার এত মায়া লাগছে কেন?এর আগে তো পৃথিবীর কোন ছেলের জন্য এরকম কোন অনুভূতি হয়নি আমার।তাহলে এই ছেলেকে মাত্র একবার দেখেই এরকম কেন লাগছে। অপূর্ব এক মায়ায় পড়ে গেছি আমি, এর নাম অপূর্ব হওয়া উচিৎ। “কি ভাবছেন?”
ছেলেটির কথা শুনে আমি ভাবনার রাজ্য থেকে বেরিয়ে এলাম।তারপর নিজের অজান্তেই বললাম, অপূর্ব।
ছেলেটি অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো, কি?
-আপনার নাম দেই অপূর্ব?
ছেলেটি এবার মাথা নেড়ে বললো,আপনার যা ইচ্ছা,কথা শেষ করে অদ্ভুত ভাবে হাসলো তারপর দ্রুত পায়ে হেটে চলে গেল।
আমার জন্মদাগটায় আবার প্রচন্ড ব্যথা লাগলো।অস্থির হয়ে আমি ছাদ থেকে নেমে বাসায় চলে এলাম।এসে চম্পাকে না পেয়ে রান্না ঘরে গিয়ে দেখি সে আচার খুঁজছে অথচ আচার তার চোখের সামনেই রাখা।অবাক হয়ে চম্পাকে আচারটা হাত ইশারায় দেখালাম।সেও প্রচন্ড অবাক হয়ে হা করে তাকিয়ে আছে কারণ এই জায়গাতেই সে এতক্ষণ আচার খুঁজেছে।হঠাৎ মায়ের চিৎকার শুনতে পেলাম…
চলবে..
লিখা: উম্মেহানি মিমন