প্রেমনোঙর ফেলে পর্ব ১+২

দেহের সামনের দিকে পুরুষালি হাতের ধাক্কায় দু পা পিছিয়ে গেলো ইচ্ছে। অগনিত মানুষের পদচারনায় ব্যস্ত মহাসড়কের ঠিক মাঝখানে দাড়িয়ে,কোনো ছেলের এমন স্পর্শ কোনো মেয়ের কাছে সেটা কতোটা লজ্জার,তা শুধু সে মেয়েটিই জানে। রাগে,দুঃখে,অপমানে চোখ দিয়ে পানি পরতে লাগলো ইচ্ছের। শক্ত হয়ে দাড়িয়ে রইলো ও। সিক্ত পাপড়িতে চোখ চুলকাতে শুরু করেছে। ওদিকে একটা ছেলে হয়ে,কোনো মেয়ের সম্মুখদেহে ধাক্কা দেওয়ার মতো জঘন্য কাজ করেও সামনের মানুষটার কোনো খেয়ালই নেই। সে তো মার লাগাতে ব্যস্ত! বাবার বয়সের লোকটাকে বাজেভাবে মেরেই চলেছে অনবরত। আর সেই মারপিট বন্ধ করতে গিয়েই এভাবে অপমানিত হতে হলো ইচ্ছেকে। অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে গিয়ে পিছিয়ে আসতে হলো এই বাজে স্পর্শের দরুন। রাগে হাত মুঠো করে নিলো ইচ্ছে। দাতে দাত চেপে এবার আবারো এগোলো সামনে। মানুষটার কাধ চেপে ধরে নিজের দিকে ঘুরিয়ে সশব্দে চড় লাগিয়ে দিলো তার গালে।

থমকে আছে পুরো জায়গাটা। তীক্ষ্ম অনুভবে দুপুরের রোদটাও যেনো চড়া হয়ে উঠলো! রাস্তার কাকগুলো ডানা ঝাপটাচ্ছে। গাড়ির হর্নের শব্দ থেমে গেলো কিয়দক্ষনের জন্য। পথচারীদের পা থেমে স্থিরতার সঙ্গা লেপ্টে দিচ্ছে চারপাশে। স্তব্ধতায় আশপাশের সবার আটকে থাকা শ্বাসে এক বিমুঢ়তা আঁকা। পরিচিত মুখগুলোতে রাগ অথবা বিস্ময়। রাগটার কারন ওদের প্রিয় কারো গায়ে হাত ওঠা। আর বিষ্ময়ের কারন সে প্রিয়র নিরবতা। আরেকটা কারন আছে বিস্ময়ের। চড়দাতার দুঃসাহস! শ্বাসরুদ্ধ সে এক তীব্র অনুভব এ ভীড়ের মাঝে। সাদমান ইনাব প্রাপ্ত’র গালে চড় মেরেছে কেউ!

গালে হাত দিয়ে নিচদিক তাকিয়ে নিরবে আটকে আছে প্রাপ্ত। যেনো পাথর হয়ে গেছে ও সেকেন্ড পাঁচেকের ব্যবধানে। ওর গায়ে ফুলের টোকাটা পরলেও তার ভয়ানক দাম চুকাতে হয়,এটাই নিয়ম। প্রাপ্তর নিয়ম! সেখানে কেউ চড় মেরেছে ওকে! হিসাবে তিলপরিমান খাদ থাকতে দেবে না তো ও! অগ্নিশর্ম রাগ নিয়ে যেইনা মাথা তুলতে যাবে,দ্বিতীবারের মতো চড় পরলো ওর গালে। অপমানিত হওয়ার রাগ সামলে না উঠতে পেরে আবারো ওকে চড় মেরেছে ইচ্ছে। প্রাপ্তকে এবারেও মাথা তোলার সুযোগ না দিয়ে সোজা ওর কালো চেইকের শার্টটার কলার চেপে ধরলো। রীতিমতো ঝাকি দিয়ে চেচিয়ে বললো,

-তোর সাহস কি করে হলো ইচ্ছেকে ব্যাড টাচ করার? হাউ ডেয়ার ইউ!

পাশ থেকে জনপাঁচেক প্রায় হুমড়ি খেয়ে পরতে যাচ্ছিলো ইচ্ছের উপর। কিন্তু প্রাপ্ত দুহাত ছড়িয়ে ওদের থামতে বুঝাতেই থামলো ওরা। চড়দাতার দিকে চোখ তুলে তাকালো প্রাপ্ত। ওর মুখ থেকে ইঞ্চিপাঁচেক দুরুত্বে বেশ ফর্সামতোন এক মেয়ের চেহারা। তবে ফর্সা আর নেই এখন সে মুখটা। লালাভ হয়ে আছে। হয়তো রাগে। নাকের ডগা,চোখ রক্তিম হয়ে গেছে একদম। কান্নার দরুন ভিজে ওঠা পাপড়ি এতোটা কাছ থেকে প্রচন্ড ঘন দেখাচ্ছে। একদম সোজা চুলগুলোর সামনে কিছু ছোট করে কাটা বলে গালে এসে লেগে গেছে। হয়তো চোখের পানিতে ভিজে,নয়তো বা ঘামে। কানের বড় দুলটা চুড়ির সাইজের বড়। গলায় থাকা কালো চোকারে গিটার শেইপের লকেটটায় রোদ পরে চোখে লাগলো প্রাপ্তর।‌ আস্তেকরে ঘাড় ঘুরিয়ে চোখ বন্ধ করে নিলো ও। আর ওকে অন্যদিক ফিরতে দেখেই যেনো গায়ে আগুন লেগে গেলো ইচ্ছের। আবারো ওর কলার ঝাকিয়ে বললো,

-চোখ খোল বাস্টার্ড! অন্যদিক কেনো ফিরছিস তুই? চোখ কেনো বন্ধ করছিস? চোখ খোল! হাউ ডেয়ার ইউ টু টাচ মি লাইক দ্যাট! হাউ ডেয়ার ইউ?

ফু দিয়ে একটা শ্বাস ছাড়লো প্রাপ্ত। ইচ্ছের দিকে না তাকিয়ে শান্তভাবে এবার ওর হাতে নিজের শার্টের কলারটার দিকে তাকালো ও। কলার দেখার পরিবর্তে চোখ গেলো মেয়েটার হাতের দিকে। মুঠো করা হাত দুটোই কাপছে। বা হাতে থাকা কালো রঙের আংটি,ব্রেসলেট দুটোতেই টোন সিম্বল। কব্জিতে ছোট করে টোন সিম্বলের ট্যাটুও করানো। প্রাপ্ত হাত তুলে ওর মুঠো থেকে নিজের কলারটা ছাড়িয়ে নিলো। রাগে সর্বশক্তিতে কলার ধরে ছিলো ইচ্ছে। কিন্তু প্রাপ্ত এতো সাবলীলভাবে কলারটা ছাড়িয়ে নিলো,এতে আরেকদফায় রাগ হলো ওর। কিছু বলার আগেই প্রাপ্ত ইচ্ছের দিকে ফিরলো। ওর দুকাধ দুহাতে ঠেলে আরো পিছিয়ে দিয়ে আপাদমস্তক দেখে নিলো ইচ্ছেকে।

বয়সটা বাইশ তেইশের বেশি হবেনা মেয়েটার। পরনে কালো টপস্,জিন্স,উচু হিল। শার্টের হাতার মতো হাতাটা গুটিয়ে ভাজ দেওয়া। পুরোপুরি ছেলেদের মতোন করে।‌ একটা ক্ষুদ্রশ্বাস ফেললো প্রাপ্ত। মারপিটের সময় বাধা দিতে আসা,এমন শার্ট পরিহিত হাতটা কোনো মেয়ের হবে,মাথাতেই আসে নি ওর। কোনোদিক না তাকিয়ে ধাক্কা মেরেছে সে হাতের মালিককে। ফলশ্রুতিতে স্পর্শটা বেশ বাজেই হয়ে গেছে মেয়েটার জন্য। অবশ্য ওরও দোষ নেই। যেখানে এখানকার কোনো ছেলেই প্রাপ্তর সামনে দাড়ানোর সাহস পায় না,কেনো কোনো মেয়ে আসতে যাবে ওর কাজে বাধা দিতে? আর যখন রেগে থাকে,এমনিতেও কোনোকিছুর হুশ থাকে না প্রাপ্তর। তাই ওর কাজে বাধা দিতে আসা দোষ এই মেয়েরই। কলার ধরা,চড়দুটো তো আছেই! নিজেকে নির্দোষ অধিষ্ঠিত করে দুহাত পকেটে পুরে দাড়ালো প্রাপ্ত। গা ছাড়া ভাবে বললো,

-দোষটা তোমারই। প্রাপ্তর কাজে বাধা দিতে আসাটা উচিত হয়নি তোমার।

প্রাপ্ত। নামটা না চাইতেও ইচ্ছের মস্তিষ্কে বারকয়েক হানা দিলো। উজ্জ্বল শ্যামবর্ণের,সুঠাম দেহের অধিকারী মানুষটার যেকোনো কিছু প্রাপ্তির পুরোটা অধিকার আছে,এমন ভাবের ঝলক আছে চেহারায়। উচ্চতার সাথে মানানাই গরন তার। ভ্রুযুগল বেশ ঘন। কপালের সামনের চুলগুলোর নড়চড় বেশিই বলে মনে হয়। কালো চেইকের শার্টের কলারের কাছে খোলা বোতামদুটোর আদলে গলার দৃশ্যমান রগ ছুইয়ে ঘাম গরাচ্ছে। হাতে থাকা মোটা ফিতার ঘড়িটার চেয়ে ঘামে সিক্ত লোমগুলোর নিমীলিত শয়ন বেশ আকর্ষক বলে মনে হলো ইচ্ছের।

-তোমার ভুলে,তোমাকে সরিয়ে দিতে গিয়ে যেটা ঘটেছে,সেটা আমার আকস্মিকতায় ঘটেছে। আর তার বিপরীতে তুমি আমাকে একটা নয়,পরপর দু দুটো চড় মেরেছো! হিসাবটা কিন্তু এখানেই বাড়তি মিস। কিন্তু তাতেও থেমে থাকো নি তুমি। কলারও ধরেছো আমার। এখনো ভদ্রতা দেখাচ্ছি। সাদমান ইনাব প্রাপ্ত প্রথমবারের মতো আজ হিসাবে পাওনা রাখবে। বিনিময়ে দুটো কাজ করো জাস্ট। সে সরি,এন্ড লিভ।

কথাটা বলে পাশে তাকালো প্রাপ্ত। ওর অনবদ্য ধারনা,ইচ্ছে ভয়ে ওকে সরাসরি সরি বলতে পারবে না। তাই পাশ ফিরলো ও। সামনে দুটো ছেলে এক লোককে ধরে রেখেছে। পাশে তিনটে‌ মেয়েসহ আরো চারটে ছেলে। মেয়েদের একজন,ছেলেদের দুজন বেশ রাগী চেহারা করে ইচ্ছের দিকে তাকিয়ে। প্রাপ্ত ঘাড় নাড়িয়ে ইশারায় বুঝালো,আমি ঠিকাছি। বা হাতে ডানহাতাটা টান মেরে চোয়াল শক্ত করে এগোচ্ছিলো ধরে রাখা মানুষটাকে মারবে বলে। একজন একটা হকিস্টিক এগিয়ে‌ দিলো‌ ওর‌ দিকে। ওটা নিয়ে লোকটাকে‌ মার‌ লাগাবে বলে উদ্যত হলো প্রাপ্ত। কিন্তু থেমে যেতে বাধ্য হলো আবারো। আবারো বাধা পরেছে ওর কাজে!

প্রাপ্তর হাতের হকিস্টিক পেছন থেকে ধরে রেখেছে ইচ্ছে। রাগে ওর সবপ্রকার বোধ লোপ পেয়েছে যেনো। এই লোকটা আবারো স্পর্শ করেছে ওকে! ধাক্কা দিয়ে পিছিয়ে দিয়েছে। নিজে ভুল করেও দোষটা ওকেই দিচ্ছে। সরি বলার নুন্যতম ভদ্রতা না দেখিয়ে ওকেই সরি বলতে বলছে। আর তো‌ আর এতোটা‌ নিষ্ঠুরভাবে এই মধ্যবয়স্ক লোকটাকে‌ হকিস্টিক দিয়ে মারতে যাচ্ছিলো। দাতে দাত চেপে অগ্নিদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা মানুষটাকে একবিন্দু পরোয়া না করে একটানে হকিস্টিকটা কেড়ে নিয়ে পাশের নর্দমায় ফেলে দিলো ইচ্ছে। প্রাপ্তর পাশ থেকেই একটা মেয়ে এগিয়ে বললো,

-তোমার সাহস কি করে হয় প্রাপ্তর স্টিক ড্রেনে ফেলে দেওয়ার?

-অরি? থাম!

প্রাপ্তর শান্তস্বরে অরিত্রা থামার পরিবর্তে অস্থির হয়ে পরলো আরো যেনো। কোনাকুনিভাবে প্রাপ্তর দিকে তাকিয়ে বিস্ময়ে বললো,

-তুই কিছু বলবি না প্রাপ্ত?

-প্রাপ্তকে কিছু বলতে হবে না। আমরা‌ দেখছি এই মেমকে। প্রাপ্ত? তুই এটাকে দেখ!

মধ্যবয়স্ক ব্যক্তিটিকে ধাক্কা‌ মেরে অন্যদুজনের হাতে ধরিয়ে দিয়ে সাফোয়ান ইচ্ছের দিকে এগোচ্ছিলো। প্রাপ্ত থামালো না ওকে। চুপচাপ ইচ্ছের দিকে তাকিয়ে রইলো শুধু। ইচ্ছের তুখোড়‌ চাওনিটায়‌ রাগের সাথে বিস্মিতও‌ হয়েছে ও। এবার‌ দেখার‌ পালা,সাফোয়ানের কাজে কি জবাব দেয় এই‌ মেয়ে। অরিত্রা পাশ থেকে‌ বুকে হাত গুজে বললো,

-আজকের‌ জন্য না‌ হয় ওকে ট্রাফিকপুলিশ বানিয়ে দে‌ সাফোয়ান? সিটি মার,সিটি মার‌ সিটি মার…

অরিত্রার গান শুনে রাগটা তরতর করে‌ বেড়ে গেলো ইচ্ছের। আশেপাশে তাকালো ও। প্রাপ্তর গালে চড় মারা অবদি জায়গাটায় অনেকেই ছিলো। এখন আর কেউই নেই। প্রাপ্ত আর দুটো মেয়ে ছাড়া ওর‌ সাথের‌ বাকি সবাই ওকে দেখে অদ্ভুতভাবে হাসছে। সাফোয়ান কিঞ্চিত বাকা হেসে এগোলো ওর‌ দিকে। হাতের বাশিটা তুলে ধরে বললো,

-চলো মেমসাহেব? ট্রাফিক পুলিশকাকুর আজকে ছুটি পরে গেছে। তোমাকেই এখন তার দায়িত্ব নিতে হবে।

ইচ্ছে তীক্ষ্মচোখে তাকিয়ে রইলো সাফোয়ানের দিকে। তারপর তাকালো প্রাপ্তর দিকে। প্যান্টের দু পকেটে দুহাত গুজে তার শীতল চাওনি ওর দিকেই নিবদ্ধ। সাফোয়ান আবারো ইচ্ছেকে বাঁশিটা নেওয়ার‌ জন্য ইশারা করলো। ইচ্ছে ওটা নিয়ে তীব্র রাগে ছুড়ে মারলো নর্দমায়।‌ তারপর প্রাপ্তর দিকে এগোলো দুপা। চেচিয়ে বললো,

-রাস্তার মাঝে গুন্ডামি করতে,একটা মেয়েকে এভাবে হ্যারাস করতে লজ্জা করে না?

এতোক্ষন‌ও শান্ত থাকার তীব্র চেষ্টা করছিলো প্রাপ্ত। কিন্তু এবার ওর‌ ধৈর্যের বাধ ভেঙে গেছে। জোরেজোরে শ্বাস ফেলছে রাগে। ওর ভাব বুঝেই সাফোয়ান,অরিত্রা সরে দাড়ালো বাকিদের সাথে। ইচ্ছেকে এবার প্রাপ্তই দেখে‌ নেবে। প্রাপ্ত কিছু না বলে,ইচ্ছেকে পাশ কাটিয়ে কিছুটা দুরে পার্ক করে রাখা ওর বাইকের দিকে চলে গেলো। তারপর ওটার উপরে থাকা ঝলমলে কালো গিটারটা হাতে‌ নিলো। এটুকোতে কিঞ্চিত কেপে উঠলো ইচ্ছে। ওর কিছু বুঝে ওঠার আগে পাশের দেওয়ালে গিটারটা দিয়ে সর্বশক্তিতে বারি লাগিয়ে দিলো প্রাপ্ত। এর বারিতেই চুর্নবিচুর্ন হয়ে গেলো ওটা। তারপরও রাগ মেটাতে আরো দুটো বারি দিতে ভুললো না ও। গিটারটা একেবারে নিঃশেষ করে দিয়ে স্বাভাবিকভাবে হেটে এসে সেই লোকটাকে দুটো ঘুষি ছুড়লো। ঘলঘল করে রক্ত বেরিয়ে আসলো সে লোকের নাকমুখ দিয়ে। টাল সামলাতে না পেরে মাটিতে পরে গেছে মানুষটা। প্রাপ্ত সরে গেলো ওখান থেকে। বললো,

-এরা দুটো যদি দু‌মিনিটে এখান থেকে না সরে,আজ এই **বাজারে দুটো খুন বা তারচেয়েও জঘন্য কিছু হয়ে যাবে সাফোয়ান।

লোকটা তৎক্ষনাৎ‌ উঠে দৌড় লাগালো। কিন্তু ইচ্ছে ওভাবেই ঠায়। মাটিতে পরে থাকা গিটারটার দিকে নিষ্পলকভাবে তাকিয়ে আছে ও। অবাধ জল গরাচ্ছে ওর চোখ দিয়ে। ওর সঙ্গীতাঙ্গন ওর‌ আবেগ,ভালোবাসা সবকিছু। আর তাকে এতো বাজেভাবে অপমান করলো প্রাপ্ত! এরমাঝেই কেউ একজন কোমলস্বরে বললো,

-কেদো না। বাসায় ফিরে যাও।

….

-কি হলো? বাসায় ফিরে‌ যাও প্লিজ! কোনো অঘটন চাই না আমরা। প্লিজ!

ইচ্ছে তাকায়নি কোনোদিক। কথাটা বলে মিষ্টি প্রাপ্তর দিকে তাকালো। সে নির্বিঘ্নে বাইকে হেলান দিয়ে দাড়িয়ে চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছে। আর সাফোয়ানদের সাথে কথা বলছে। যেনো কিছু ঘটেই নি এখানে। বাকি ছেলেগুলোকে কিছু বলায়,ওরাও চলে গেলো। মিষ্টির মায়া হলো ইচ্ছের উপর। কিন্তু কিছু করারও নেই। একটা মেয়ে‌ কোত্থেকে ছুটতে ছুটতে এসে বললো,

-কিরে ইচ্ছে? কাদছিস কেনো? কি হয়েছে?

মিষ্টি লক্ষ্য করলো মেয়েটাকে। চেনাচেনা লাগলো মেয়েটাকে ওর। মাথার চুল ছেলেদের মতো ছোট করে কাটা। চোখে চিকন ফ্রেমের চারকোনা চশমা। হাতে মোবাইল,এয়ারফোন আর দুটো টিকিট। পুরোপুরি চিনে উঠতে পারলো না মিষ্টি। ইচ্ছে‌র কান্নাটা নেই। তবে বিমুর্তের মতো ও ভাঙা গিটারটা দেখে চলেছে। মিষ্টি ‌বললো,

-তোমার নাম কি? আর তুমি চেনো ওকে?

-হ্যাঁ মিষ্টি আপু। আমি রাকা,ব্লক টু তে থাকি। আর ও আমার কলেজফ্রেন্ড ইনায়াত নিক্কন। ডাকনাম ইচ্ছে। বিদেশ থেকে মিউজিক নিয়ে পড়া শেষ করে বিডিতে ফিরেছে কয়েকদিন হলো। আজকের ভার্সিটিতে যে কনসার্ট,ওখানে গাইবে বলে ওকে ডাকা হয়েছে।

মিষ্টি বুঝলো ও না চিনলেও মেয়েটা ওকে চেনে। স্থানীয় হলে চেনাটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। ওদের কয়েকজনকে চেনে না,এমন মানুষ কমই আছে এ এলাকায়। বললো,

-ও আচ্ছা। এখন তুমি ওকে নিয়ে যাও এখান থেকে রাকা। প্লিজ!

-কিন্তু হয়েছে টা কি আপু বলুনতো? আপনি…

-হয়নি।‌ হবে।

প্রাপ্তর গলা শুনে‌ ওর দিকে তাকালো রাকা। প্রাপ্তর ব্যস্ততা চায়ের কাপে। কিন্তু ওকে চিনতেই শ্বাস আটকানোর মতো অবস্থা রাকার। ওর বোঝা উচিত ছিলো,মিষ্টি এখানে,মানে প্রাপ্তও এখানে কোথাও থাকতে পারে। রোবটের মতো ইচ্ছের দিকে তাকিয়ে মনেমনে বুঝেই নিলো কিছু একটা ঘটিয়েছে ইচ্ছে। আর এজন্যই মিষ্টি মেয়েটা ওকে নিয়ে চলে যেতে বলছে। রাকা তড়িঘড়ি করে বললো,

-আ্ আসলে প্রাপ্ত ভাইয়া,ও্ ও এখানে ন্ নতুন। ক্ কিছুই‌ জানেনা আপনার বিষয়ে। আর…এইই ইচ্ছে? ক্ কি করেছিস তুই? সরি বল প্রাপ্ত ভাইয়াকে? বল?

-কিরে? সরি বল? বললল!

রাকা ধাক্কাতে শুরু করেছে ইচ্ছেকে। ইচ্ছে এখনো একধ্যানে কিছুটা দুরে পরে থাকা ওর ভাঙা গিটারটার দিকে তাকিয়ে। প্রাপ্ত চোয়াল শক্ত করে ইচ্ছের দিকে তাকিয়ে রইলো। মিষ্টি একটা ছোট শ্বাস ফেললো। রাকা যদি জানতো এখানে প্রাপ্তর কলার ধরা আর ওকে চড় দেওয়ার মতো কান্ড ঘটেছে,নির্ঘাত সব ছেড়েছুড়ে ছুটে পালাতো। এগিয়ে‌ বললো,

-তোমরা এসো রাকা। পরে‌ কথা হবে।

-কিন্তু আপু…

-আমি বলছি তো! এসো!

কাচুমাচু হয়ে মাথা নাড়লো রাকা। তারপর হাত টানতে টানতে নিয়ে গেলো ইচ্ছেকে ওখান থেকে। যতক্ষন দেখা যায়,ওই‌ভাঙা গিটারের‌ দিকেই তাকিয়ে থেকে টলতে টলতে চলে গেলো ইচ্ছে। ওরা চোখের আড়াল হতেই মিষ্টি প্রাপ্তর দিকে তাকালো। নিজের মতো করে ফোন স্ক্রল করছে প্রাপ্ত। অবাক না হয়ে পারলো না মিষ্টি। তুলনামুলক কমই ঘটেছে ইচ্ছের সাথে। তবুও যা ঘটেছে,একদমই ভালো ঘটেনি। বললো,

-বেশি রিয়্যাক্ট করে ফেললি না?

-প্রশ্নটা উল্টো হওয়া উচিত ছিলোনা?

দৃষ্টি ফোনে রেখেই বললো প্রাপ্ত। ঠিক,ঠিক! বলে বাকিসব সায় দিলেও মিষ্টি অবুঝের মতো করে তাকিয়ে রইলো ওর দিকে। পারিপার্শিকের কাছে ঠান্ডা স্বভাবের বিচক্ষন মেয়ে হয়ে স্বীকৃতি পেলেও,এই একটা মানুষের কাছেই অবুঝ সাজতে চেয়েছে ও। সবসময়। প্রচন্ড নির্বোধ হতে চেয়েছে ও প্রাপ্তর কাছে। আর তা বুঝে বলেই আরো বেশি নির্বোধ হয়ে থাকে প্রাপ্ত। বন্ধুদের একজন মাহীন বললো,

-বুঝলাম না! আজকে কি হলো প্রাপ্ত তোর? ব্যাটাকে দুটো ঘুষিতেই ছেড়ে দিলি কেনো?

সাফোয়ান বললো,

-ঠিক বলেছিস মাহীন! তোর উল্টোপ্রশ্নের উত্তর তো আমরা সবাই জানি। আরো বেশি রিয়্যাক্ট করার কথা ছিলো তোর প্রাপ্ত! কিন্তু তোর বিহেভ দেখে প্রশ্নটা কয়েকডিগ্রি এঙ্গেলে ঘুরে গেছে রে! নাও দ্যা কোশ্শেন ইজ,প্রাপ্ত কেনো কম রিয়্যাক্ট করলো?

অরিত্রা স্বতন্ত্রকন্ঠে বললো,

-আমার তো ভয় হচ্ছে ভাই! প্রাপ্ত ওর সেই অদৃশ্য অনুভবে থাকা গ্রামীন শ্যামাকন্যাকে এই ভীনদেশী শ্বেতাঙ্গী রকস্টারের মাঝে গুলিয়ে ফেললো কিনা কে জানে!

শব্দ করে হেসে দিলো তিনজনই। শুধু মিষ্টি আর প্রাপ্ত বাদে। মিষ্টি তাকিয়ে রইলো প্রাপ্তর দিকে। এই না দেখা মেয়েটার জন্য কতো ভালোবাসা গচ্ছিত করে রেখেছে প্রাপ্ত,দেখলে,শুনলে হিংসে হয় ওর। প্রাপ্ত মোবাইল পকেটে পুরলো। রাস্তার সামনের শিমুলগাছটায় অনেক ফুল ফুটেছে। সেদিক তাকিয়ে মৃদ্যু হেসে‌ বললো,

-সে গুলিয়ে ফেলার কেউ না অরি। সে তো অনুভবের কেউ! আর যেদিন তাকে অনুভব করবো,মনপ্রান উজার করে অনুভব করবো। আমার হৃদয় কেনো,চারপাশেও সেদিন একবিন্দু নিকষতা থাকবে না! ওই শিমুলের মতো রাঙা হবে সবটা। ট্রাস্ট মি! আপাতত চল এই রকস্টারের হিসাব মিটিয়ে আসি!

শেষ লাইনে পুরো স্বরই পাল্টে গেছে প্রাপ্তর। সানগ্লাসটা চোখে দিয়ে পকেটে দুহাত গুজে পা বাড়ালো কনসার্টের দিকে। প্রাপ্তর ঠোটের অদ্ভুত হাসিটা দেখে মিষ্টি মাথা নামিয়ে নিলো। হতাশার শ্বাস বেরোলো ওর‌ ইচ্ছের কথা ভেবে।‌ আর কি কি অপমান অপেক্ষা করছে মেয়েটার জন্য,কে জানে?
#প্রেমনোঙর_ফেলে
#লেখনীতে-মিথিলা মাশরেকা
#পর্ব-২

বসন্ত উৎসব পালন উপলক্ষে ভার্সিটিতে আজ কনসার্ট আছে। ক্যাম্পাসের সুবিশাল মাঠে সুই ধারনের জায়গাটাও নেই। পুরো মাঠে লোকে লোকারন্য। বন্ধুমহল নিয়ে প্রত্যেকে মেতে আছে মনের মতো করে উল্লাস করবে বলে। স্টেজের সামনে দর্শকসমাজ বাধভাঙা স্বরে চেচিয়ে চলেছে,ইচ্ছে! ইচ্ছে! হওয়ারই কথা! ভীনদেশের লাখো দর্শক নিয়ে যার গানের সাম্রাজ্য,সে আজ এসেছে এই ভার্সিটিতে! সরাসরি শুনবে সবাই তার গান,সে মুহুর্তের জন্য অধীর হয়ে আছে প্রত্যেকে। আর সে মেয়েটা? গ্রিনরুমের এককোনে গুটিয়ে বসে আছে ইচ্ছে। গলার গিটার শেইপের লকেটটা চেপে ধরে শক্ত হয়ে রয়েছে ও। চোখ দিয়ে পানি পরছে না। তবে কেপেকেপে উঠছে একটু পরপরই। রাকা হন্তদন্ত হয়ে লক খুলে ভেতরে ঢুকে আবারো দরজা লক করে দিলো। ওর সামনে এসে হাটুগেরে বসে বললো,

-ইচ্ছে? এই ইচ্ছে? আর কতোক্ষন এভাবে বসে থাকবি? তোর পার্ফরমেন্সের সময় হয়ে গেছে! অডিয়েন্সে এক্সাইটমেন্ট ওভারলোডেড ইয়ার!

খেয়ালি চোখ তুলে তাকালো ইচ্ছে। গলা দিয়ে গান বের করবে বলে এতোক্ষন হলো নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করেছে ও। পারছেই না! প্রতিবার গিটারটার সাথে হওয়া ঘটনার কথা মনে পরতেই বিষিয়ে উঠছে ওর চারপাশ। নিজের শরীরে প্রাপ্তর আকস্মাৎ স্পর্শের জন্য যেটুকো অপমানিত হয়েছিলো,সেটাও ভুলে গেছে ও গিটারের কথা ভেবে। রাকা ওকে মৃদ্যু ধাক্কা‌ মেরে বললো,

-কিরে? যাবি তো?

ইচ্ছে কিছু বলার আগেই দরজায় নক পরলো। রাকা গলা উচিয়ে বললো,

-কে?

-প্রাপ্ত।

নাম আর স্বর শুনেই তরিঘড়ি করে দাড়িয়ে গেলো রাকা। ইচ্ছের দিকে তাকালো অসহায়ভাবে। ইচ্ছে চোয়াল শক্ত করে মেঝেতেই বসে রইলো। আরো শক্ত করে চেপে ধরলো গলার লকেটটা। রাকা একটা শুকনো ঢোক গিলে কম্পিতহাতে দরজা খুলে দিলো। তৎক্ষনাৎ পকেটে দুহাত গুজে,হেলেদুলে ভেতরে ঢুকলো প্রাপ্ত। ওর পেছনে মিষ্টি,অরিত্রা,সাফোয়ান আর মাহীনও ঢুকেছে। অরিত্রার হাতে একটা ফুলের তোড়া,সাফোয়ান একটা মোড়কের গিফটবক্স আর মাহীন হাতে কিছু খাবার আর পানীয় এনেছে বলে মনে হলো। ইচ্ছে উঠে দাড়ালো এবার। প্রাপ্তর সাথে শীতল চাওনি বিনিময় হলো ওর। ওদের পেছনপেছন ইভেন্ট ম্যানেজার এসে বললেন,

-ইনায়াত? ইনি মিস্টার…

-সাদমান ইনাব প্রাপ্ত।

ইচ্ছের জবাব শুনে প্রাপ্ত মুচকি হেসে মাথা নাড়ালো। অরিত্রার হাত থেকে ফুলের তোড়াটা নিয়ে ওর দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,

-মিস রকস্টারের ব্রেইন অনেক শার্প দেখছি। গুড ফর ইউ। এনিওয়েজ! প্রাপ্তর এলাকায় স্বাগতম তোমাকে। প্রথম দেখার সময় বলা স্বাগতবানী আর অভ্যর্থনার কর্মযজ্ঞ হয়তো পছন্দ হয়নি তোমার। তাই আবার এলাম,তোমাকে ওয়েলকাম করতে।

হাত বাড়িয়ে তোড়াটা নিলো ইচ্ছে। বললো,

-আমার স্বাগত স্পর্শ তোমারও ভালো লাগেনি জানি মিস্টার। তবুও তোমার এই একাগ্রতাসম্পন্ন স্বাগতম আমি গ্রহন করলাম। ওয়েলকামের জন্য থ্যাংক ইউ।

ইচ্ছের স্পষ্ট জবাবে ওকে কষ্ট দেওয়ার জেদটা আরো নাড়াচাড়া দিয়ে উঠলো প্রাপ্তর। ইভেন্ট ম্যানেজার হাতের ঘড়িটা দেখে বললেন,

-মিস্টার প্রাপ্ত? আপনারা তবে কথা বলুন? ইনায়াতের পার্ফরমেন্সে এখনো পনেরো মিনিট লেইট। আমি বাকি দিকটা একটু…

-আসুন।

একদমই গুরুত্বহীনভাবে বললো সাফোয়ান। যেনো ও বিরক্ত এই লোকটার মাত্রাতিরিক্ত আপ্যায়ন দেখে। ইভেন্ট ম্যানেজার চলে যেতেই রাকা বললো,

-ই্ ইয়ে মানে,প্রাপ্ত ভাইয়া,ব্ বসুন না? মিষ্টি আপু আপনিও? সাফোয়ান ভাইয়া আপনারা…

-এত্তো সম্মান দেখাতে হবে না তোমাকে ম্যাডাম। অতিভক্তি চোরের লক্ষ্মন।

মাহীনের কথায় চুপসে কাচুমাচু হয়ে দাড়ালো রাকা। ততোক্ষনে ইচ্ছে-প্রাপ্তর কোনো সমর দৃষ্টি বিনিময় চলছে। মিষ্টি না এসব সমর্থন করতে পারছে,না চলে যেতে পারছে। ভুলটা ঠিক কার,কোথায়,কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না ও। রাস্তার লোকটা এক ফুলকুড়োনি বাচ্চা মেয়েকে বাজেস্পর্শ করেছিলো বলে তাকে মারছিলো প্রাপ্ত। আর ওকে আটকাতে এসেই বাজে স্পর্শের মুখোমুখি হতে হয় ইচ্ছেকে। যদিও এটা ইচ্ছের জন্য অনেক অপমানের,তবে তা ছিলো অনিচ্ছাকৃত। ইচ্ছে ছাড় দেয়নি প্রাপ্তকে। ওদিকে চড়,থাপ্পড়,কলার ধরা,এগুলো নিয়ে প্রাপ্তও ওর গিটার ভেঙেছে। কাকে কি বলবে,মাথায়ই ঢুকছে না মিষ্টির। এককোনে জানালার দিকে চলে গেলো ও। সাফোয়ান এগিয়ে গিফটবক্সটা ইচ্ছের সামনে ধরে বললো,

-এইযে বিদেশী ম্যাম? আপনার জন্য ইম্পর্টেড গিফট এনেছি। নিয়ে আমাদের ধন্য করুন!

ইচ্ছে তোড়াটা পাশের টেবিলে রেখে নিরবে গিটারটা নিলো। প্রাপ্তর কপাল কুচকে এলো এবার। ওর কলার ধরে,দু দুটো চড় লাগিয়ে দেওয়া সেই তেজী মেয়েটা এভাবে চুপচাপ উপহার মেনে নিচ্ছে? কেনো? গিফটবক্স নিয়ে খুলতে শুরু করে দিলো ইচ্ছে। পুরোটা খুলে ওতে চোখ বুলিয়েই চোখ বন্ধ করে নিলো ও। বড় বক্সটায় ওর গিটারের প্রতিটা টুকরো সযত্মে তুলে রাখা। ওর খিচে বন্ধ করে থাকা চোখজোড়াকে বিস্ময়ে আরো গভীরভাবে পর্যবেক্ষন করলো প্রাপ্ত। সেকেন্ড পাঁচেকের ব্যবধানে চোখ মেললো ইচ্ছে। শান্তভাবে বললো,

-মানুষ নামে কলঙ্ক।

চরম রাগে তাকালো সবাই ওর দিকে। ইচ্ছের ভাব পরিবর্তন হলো না একটুও ওতে। এবার রাগ হলো প্রাপ্তর। ও তো এসেছে মেয়েটাকে কষ্ট দিতে। এই মেয়ে গায়ে মাখছে না কেনো তবে বিষয়টা? উল্টো ওকেই‌ শোনাচ্ছে! প্রাপ্ত কড়াগলায় ডাক লাগালো,

-মাহীন? ড্রিংকগুলো দে!

টপাটপ দুটো কাচের বোতল এনে ইচ্ছের পাশের টেবিলে রাখলো মাহীন। ইচ্ছে তাকালো সেদিকে। টকটকে লালবর্নের পানীয়টা যে অবশ্যই পানযোগ্য না,তা বেশ বুঝতে পারছে ও। প্রাপ্ত বললো,

-হ্যাভ ইট!

-পার্ফরমেন্স আছে আমার।

-ফাইন।

কথাটা বলে প্রাপ্ত একটা বোতল নিয়ে রাকার সামনে তুলে ধরলো। বললো,

-তোমার বান্ধবীর পারফর্মেন্স আছে। তাই ওর পরিবর্তে,এটা তুমি খাবে।

রাকা শুকনো ঢোক গিললো। এই বোতল শেষ করতে গিয়ে ওউ শেষ হয়ে যাবে,তা বেশ বুঝতে পারছে ও। প্রাপ্ত ‌ঠান্ডা আওয়াজে বললো,

-খাবে তো? নাকি বলবে মিস রকস্টারের মতো তোমারও‌ পার্ফরমেন্স আছে?

রাকা একটাকিছুও বলার‌ মতো পেলো না। দোয়াদরুদ পড়তে পড়তে কাপাকাপা হাতটা বোতলের দিকে বাড়ালো ও। কিন্তু ও নেওয়ার আগেই সেটা নিয়ে নিলো ইচ্ছে। ছিপি খুলে মুখে পুরতেই যেনো আগুন ধরে গেলো ওর কন্ঠনালী জুড়ে। এতোটা ঝাল ওই পানীতে,যা অকল্পনীয় যে কারো। চোখের কোনা দিয়ে জল গরাতে লাগলো ইচ্ছের। রক্তিম হয়ে উঠেছে পুরো মুখচোখ ওর। তবুও ঢোকের পর ঢোকে পুরো বোতল শেষ করে দিলো ও। একটাকথাও কেউ বলছে না আর। বিস্ময়ে ইচ্ছেকে দেখছে প্রত্যেকে। জ্বলন্ত,টলোমলো শরীরটা নিয়ে,ইচ্ছে কোনোমতে বললো,

-গিটারটা না ভাঙলেও পারতে মিস্টার গ্যাংস্টার।

কথা শেষ করেই ঢলে পরলো ইচ্ছে। জ্ঞান হারিয়েছে। ঝাল খেতে পারে না ও কোনোকালেই। এতো ঝাল সইবে কিভাবে? তবে জ্ঞান হারিয়ে পরে যায়নি একেবারে। কাছেই দাড়িয়ে ছিলো বলে দুবাহুতে প্রাপ্তই ওকে আগলে নিলো। বাকিসবাই থমকে আছে যেনো। প্রাপ্ত কিয়দক্ষন তাকিয়ে রইলো ঝালে মরিয়া হয়ে থাকা ওই‌ চেহারার দিকে। ইচ্ছের গাঢ় খয়েরি লিপস্টিক দেওয়া ঠোট শুকিয়ে উঠেছে একদম। ধানি লঙ্কার মতো ঝাঝালো রকস্টারের ঝাল লেগেছে নাকি?- একবার মনে এই প্রশ্নটা উকিও দিয়েছে হয়তো প্রাপ্তর। কিন্তু পরপরই কি ভেবে ইচ্ছেকে ছেড়ে দিলো ও। সাধেসাথে ধপ করে‌ মেঝেতে পরলো ইচ্ছে। বাইরে এনাউন্সমেন্ট হলো,

-এবারে সময় আমাদের সেই হার্টথ্রোবের! গান গাইতে আসছে,ইনায়াত নিক্কন ইচ্ছে!

ইচ্ছের নামে মুখোরিত পুরো জায়গাটা। মিষ্টিরা সবাই এ ওর মুখ চাওয়াচাওয়ি করছিলো। প্রাপ্ত দেয়ালে ঠেকিয়ে রাখা একমাত্র গিটারটা নিয়ে দ্রুতপায়ে বেরিয়ে গেলো গ্রিনরুম থেকে। একটা ক্ষুদ্রশ্বাস ওকে সহসা‌ অভয় দিলো,ও যদি তোর কাজ বিগরাতে পারে,তুইও‌ ওর কাজ বিগরাতে পারিস প্রাপ্ত! ভুল করিসনি কোনো। গিটার নিয়েই সোজা ভার্সিটির বাইরে‌ বেরিয়ে যেতে চেয়েছিলো ও। পারলো না! চোখের সামনে ইচ্ছের মুখটা ভাসছে সেই কতোক্ষন হলো। কারন ওরই নাম উচ্চারন হচ্ছে চারপাশে! ও‌জানে,যতোক্ষন না ইচ্ছে স্টেজে আসবে,এটাই চলবে। রাগ নিয়ে এবার নিজেই স্টেজের দিকে এগোলো প্রাপ্ত। মিষ্টি এসে ওর‌ পথ আগলে‌ দিয়ে বললো,

-আর ঝামেলা করিস না প্রাপ্ত! প্লিজ! কনট্রোল ইউরসেল্ফ!

-পারবো না।

-মেয়েটার সেন্স না ফেরা অবদি এদেরকে সামলাতে হবে। পিয়ালী কল করেছিলো। আঙ্কেলের কিছু স্টুডেন্ট জানিয়েছে তাকে,তুই এসেছিস ভার্সিটিতে। পিয়ালী বারবার করে বলেছে,ইভেন্টটা সামলে নিতে।

পিয়ালী,আঙ্কেল শব্দদুটো শুনে আর কিছুই বলতে পারলো না প্রাপ্ত। মাথার চুলগুলো উল্টে কিছু একটা ভেবে সোজা স্টেজে উঠে গেলো ও। স্পিকারে বললো,

-গান আমি গাইবো!

চারপাশ স্তব্ধ। প্রাপ্তকে স্টেজে দেখে,ভয় বিস্ময়ে থেমে গেছে সব। তবে প্রাপ্ত নিজেই বুঝে উঠতে পারছে না কি করবে। উত্তেজনা সামলাবে জন্য বলে তো দিলো গাইবে,কিন্তু কি গাইবে? মিষ্টি বুঝলো ওর অবস্থা। এটুকো চেনে ও‌ প্রাপ্তকে। স্টেজের খানিকটা সামনে থেকে মৃদ্যু হেসে বললো,

-তোর কাল্পনিক শ্যামাকন্যাকে নিয়ে গা প্রাপ্ত?

প্রাপ্ত নিজেই মুচকি হাসলো এবার। এইতো কতোনা রোদ ছিলো আকাশে। কিন্তু সে অদৃশ্যময়ীর নামেই দমকা বাতাস শুরু হয়েছে আচমকা। সামনের দর্শকের ভাব উপেক্ষা করে প্রাপ্তর মনপ্রান জুড়ে ভালোলাগা হঠাৎই। তাকে নিয়ে ভাবতেও ভালোলাগে এমন এক উপলব্ধি ওর শরীরমন জুড়ে। পুরো স্বস্তিতে,গিটারে সুর তুলে প্রাপ্ত গাইতে লাগলো,

মন ভাবে তারে,এই মেঘলা দিনে
শীতল কুয়াশাতে,তার স্পর্শে
তার রিমঝিম নুপুরের সাজে
বাতাসে যেনো মৃদ্যু সুবাসে
নিটোল পায়ে রিনিকঝিনিক,পায়েলখানি বাজে
মাদল বাজে সেই সঙ্গেতে,শ্যামা মেয়ে নাচে(ii)
চাদের অধরে যেনো,তোমার হাসির মাঝে
সোনালী আবেশে তবে সাগর ধারে
হৃদয়ের মাঝে কবে বেধেছিলে বাধন
ভালোবাসা তবে কেন,মনের অগোচরে…

ভয় বিস্ময় সব ভুলে গানটা দর্শকশ্রোতারাও উপভোগ করছিলো। মেতে উঠেছিলো প্রাপ্তর গানে। কিন্তু এটুকো গেয়ে চোখ বন্ধ করার সাথেসাথেই চোখজোড়া খুলে ফেলতে বাধ্য হলো প্রাপ্ত। চোখ বন্ধ করার পর ইচ্ছের চেহারা আবারো সামনে এসেছে ওর। গান থামিয়ে, একটু দিশেহারার মতো প্রাপ্ত সামনের দর্শকস্রোতের পুরোটায় চোখ বুলালো একপলক। সত্যিই‌ অগোচরে সে ভালোবাসা। সে অনন্যা নেই এই আধুনিক বেশধারীদের ভীড়ে। থাকার সম্ভবনা নেই। তবে কোথাও নেই,এটা মানতে নারাজ প্রাপ্ত। কোথাও না কোথাও তো আছে সে। নিয়তির কোন অন্তরীক্ষে আছে সে, এই একটা প্রশ্নের উত্তরের অপেক্ষায় কাতর চোখজোড়া অন্যদিকে সরিয়ে নিলো ও। ইচ্ছেকে নিয়ে না,গানটা যে ওর শ্যামাকন্যাকে উদ্দেশ্য করে গাওয়া। ইচ্ছে কেনো ওর বন্ধ চোখের পাতায়? মনে যে সেই অদৃশ্যময়ীর জন্য সেই চেনা সুর,
নিটল পায়ে রিনিকঝিনিক,পায়েলখানি বাজে
মাদল বাজে সেই সঙ্গেতে,শ্যামা মেয়ে নাচে…

-তর সব নাচোন আজকা আমি বাইর কইরা দিমু খই! এই আইলাম কইতাছি মাছদাডা নিয়া! আইলাম!

মায়ের কর্কশ আওয়াজ শুনে খই সর্বোচ্চস্বরে বললো ‘আইতাছি মা!’ হন্তদন্ত হয়ে কোমড়ে গোজা ওড়না ছেড়ে দিলো। এখন যদি মা বাড়ি থেকে বেরোয়,সত্যিই মাছ কাটার বটিতে গর্দান যাবে ওর। পায়ের ঘুঙুরটা খুলে একটা চুমো দিলো ও দুটোতে। তারপর খোপা করা চুলগুলো ছেড়ে দিয়ে পাশে তাকালো। মেঘলা আকাশের নিচে,বটতলার বসে,মাদল বাজাতে থাকা আশির্ধো লোক। সে একেবারে মগ্ন হয়ে তাল তুলেছে যেনো। খই ঘুঙুরজোড়া মাদলে রেখে লোকটাকে ধাক্কা লাগিয়ে বললো,

-হইছে থামো! মেলা হইছে!

বদু ফকির থামলো। খই টগবগানো স্বরে বললো,

-হুনো ফকির কাকা! কাইল আবার আইবা শুকমরার এপারে! আজকার ধুয়ার দাম দিবার পারলাম না। কাইল আইলে তোমারে এই শুকমরার সবচাইতে বড় সরপুটি ভাজা দিয়া পান্তাভাত দিমু যাও! আর হুনো! কাইল সবচাইতে ভালো ধুয়া মুখস্ত কইরা আইবা! আর এই মাদলে যদি কাইলকা এক তিল্লি ফুটা পাই,ঘুঙ্গুর ফেরত দিমু না কইলাম! হুনছো?

বদু ফকির কিছুক্ষন ভাষাহীনভাবে তাকিয়ে রইলো ওর দিকে। বিশের এদিকওদিক বয়স নিয়ে এই‌ মেয়েকে পুর্নযুবতী বলা চলে। রঙের দিক থেকে বেশ চাপা। শ্যামবর্ন যাকে বলে। মাথা ভর্তি এলোকেশ,কপালের ছোটচুলগুলো এতো বেশি যে,কানের পাশ দিয়ে সবসময় পরে থাকবে। প্রতিবার কথা বলার সময় ওর নাকবালি নামের গয়নাটা দুইনাকের মাঝে সুন্দরমতো নড়তে থাকে। কানে দুল নেই কোনো। তবে কানের ছিদ্র ধরে রাখতে কুটো গুজে দেওয়া। কালো কুটোটা দেখতেও অমায়িক লাগে। খইয়ের সবচেয়ে প্রিয় গয়না ওর গলায় আটকে থাকা কালোসুতার ধানতাবিজ। এই ধানতাবিজে কালো রঙেরই একটা শঙ্খ ঝুলানো। শ্যামাঙ্গে এই অল্পবিস্তর সাজগুলো বরাবর মানানসই লাগে বদু ফকিরের। সেই ছোট্ট থেকে হাতেপায়ে এতো বড় হতে দেখলো সে এই মেয়েটাকে। শুধু গায়ের গরন বাড়া ছাড়া কোনো পরিবর্তন নেই। এখনো সেই ফড়িংয়ের মতোই লাফায়। খইয়ের মতোই বুলি ফোটে ওর। বদু ফকির একটা ছোট শ্বাস ফেলে বললো,

-ঘুঙ্গুর কি তোর? এইডা আমার মায়ের ঘুঙ্গুর! তুই না দেওয়ার কেডা?

-এইডা তোমার বাপজানে তোমার মায়রে দিছিলো। তো এইডা কিনছে তোমার বাপজানে! না তুমি! না তোমার মা! মরা মানুষের কবর ছাড়া আর কিছুই হয়না। আর এই ঘুঙ্গুর এই আক্কা ভাদুলগাঁয়ে খালি আমার পায়েই বাজে। তাই এই ঘুঙ্গুর আমার! খই ছাড়া এই ঘুঙ্গুর আর কেউ পরবো না হুনছো?

খইয়ের যুক্তি আর শাষনের ভঙিমা দেখে বদু ফকির শব্দ‌ করে হেসে দিলো। এই‌ গ্রামে একমাত্র ওর কাছেই বদু ফকিরের মাদলের তাল আর গানের ধুয়া পাগলামি না। নইলে সবাই ফকির কম,বদুপাগল বলেই‌ বেশি ডাকে তাকে। বদুফকির তাই সব পাড়াগায়েই‌ বলে বেরায়,ভাগ্য করে ভাদুলগাঁয়ে একটা মেয়ে পেয়েছে বটে!

ভাদুলগাঁও! শহরের কোলাহল পেরিয়ে এক ছোট্ট গ্রাম। আধুনিকতা বলতে এ‌ গ্রামের শুধু স্কুলবিল্ডিং আর গেরোস্ত মুন্সিবাড়ির দালান অবদিই চোখে পরবে। বাকিসব টিনের ঘরগুলো কাছারিবাড়ির একনামে জানাশোনা। কুমোরপাড়ায় মাটির ঘরও আছে। ঠিক মাঝখান দিয়ে,একরকম বুক চিরে একেবেকে চলা গ্রামের নামে মিল রেখে শাখানদীর নাম ভাদুয়া। লোকমুখে ওটা শুকমরা নামেই পরিচিত। স্রোতস্বীনী কোনো নদীর একাংশকে ভাদুয়াকে,মরা বলে ডাকার যথেষ্ট কারন আছে। কথিত আছে,এই ভাদুয়ার আগে অনেক তেজ ছিলো। প্রায়ই নৌকাডুবী হতো এখানে। সেটাও আবার শুক্লপক্ষের তিথিতে। শুক্লপক্ষের তিথিতে নৌকাযাত্রীদের সুখ মরতো বলে ওই শাখানদীকে সব শুকমরা বলেই ডাকে। বদু ফকির বললো,

-শুকমরার সরপুটি তোর সুহাগের লাগি রাইখা দে খই! বড় তো আর কম হইলি না! আর কতোদিন নাচবি আমার মাদল আর ধুয়ায়? একখান সোন্দর দেইকখা সুহাগ দেইকখা বিয়াশাদী করন লাগবো না?

খইয়ের সব কথায় ইদানিং বিয়ের কথা বলে বদুফকিরের অভ্যাসে দাড়িয়েছে। আর সাথে খইয়ের গালগুলো লাল হওয়ার অভ্যাসও‌ বানিয়ে নিয়েছে। প্রতিবারের মতো এবারও বিয়ে আর সুহাগ শব্দদুটো শুনে ছুট লাগালো খই। বদুফকির চেচিয়ে বললো,

-এতো লজ্জায় পরিস না খই! মেয়েলোকের লজ্জাই‌ কিন্তু প্রেমযমুনার প্রেমনোঙ্গর! একবার আটকাইলে,আর নিস্তার নাই! আর নিস্তার নাই!

একছুটে নদীপারে এসেছে খই। হাপাচ্ছে রীতিমতো। তীরে ভিড়ানো নৌকোয় বসে,ভাদুয়ারজলে পা ভিজিয়ে উষ্ণ গালজোড়া শীতল করার বৃথা চেষ্টা করলো ও। বদু ফকিরের কথা‌ মনে‌ করে দুহাতে মুখ লুকোতে যাচ্ছিলো। কিন্তু পাশের ডাঙায় তুলে রাখা নোঙরটা দেখে থেমে গেলো ও। সেদিকে মুগ্ধচোখে তাকিয়ে থেকে আস্তেধীরে বলতে লাগলো,

-ফকির কাকা কি সত্যই কইলো? মাইয়াগো লজ্জা সত্যই কি প্রেমযমুনার প্রেমনোঙ্গর? এই প্রেমনোঙ্গরে আটকাইলে সত্যই কি আর নিস্তার নাই? আমার মতো এই মুখপুড়ির প্রেমযমুনায় সত্যই কি আটকাইবো কেউ? এই এত্তোবড় দুনিয়ায়,সত্যই আছে কেউ এমন? কেউ কি সত্যই আইবো,প্রেমনোঙ্গর নিয়া? আমার প্রেমযমুনায় আটকাইতে?

#চলবে…

? ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here