প্রেমময়ী বর্ষণে তুই পর্ব -০২

#প্রেমময়ী_বর্ষণে_তুই(০২)

বাহিরে তুমুল ঝড় হচ্ছে। বর্ষণের পরিমাণ কমছে তো আবার বাড়ছে। বৃষ্টির ফোটায় থাই গ্লাসে খটখট শব্দ হচ্ছে। এদিকে লিলি কলম কামড়াচ্ছে আর বাইরের বৃষ্টি দেখছে। বৃষ্টির ফিলটা আসছে না কারণ, সে এখন পরীক্ষার হলে বসে আছে।ফিজিক্স প্রশ্ন দেখে তার এখন জিলাপির প্যাচও সহজ লাগছে। কিছুই তো পড়ে নাই তাই এতো কঠিন প্রশ্ন দেখে কলম কামড়ানো শুরু করেছে। কলম মুখ থেকে সরিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,

-“কারো সাবানা তো কারো বেদনা! বৃষ্টির সাবানা দেখা দিয়েছে আর আমার বেদনা। হায়রে! ডিয়ার বৃষ্টি, আমায় এভাবে ইনসাল্ট না করলেই পারতে।”

আবারও সে প্রশ্নের দিকে তাকালো। এবারও মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠলো তার। লিলি আগে পিছে তাকিয়েও বেশি সুবিধা করতে পারলো না।

-“নাহ! খালি খাতা তো জমা দেয়া যাবে না, কী লেখা যায়?

ভাবতেই ভাবতেই সে কয়েকটা ছন্দ আর গান লিখলো। আর যে কয়টা ম্যাথ ছিলো সেগুলা উল্টোপাল্টা সলভ করলো। ছন্দগুলো ছিলো এমন,

“ঘোড়ায় খায় ঘি,
ফিজিক্স আমার ঝি!”

“লাল নীল ইলিশ,
অপদার্থ এবার ফিনিশ!”

“তড়িৎ করে উড়ু উড়ু,
প্রশ্নে লাফায় সরু সরু।”

“স্যার ফিজিক্স পারি না,
এবারের মতো পাস করিয়ে দিয়েন!
পাস করিয়ে দিলে সুন্দর একটা ছেলের বউ পাইবেন দোয়া দিলাম! আমিন।”

স্যার এসব দেখলে নির্ঘাত হার্ট অ্যাটাক করবে। ভাবতেই জিহবায় কামড় দিলো। কিন্তু আপাতত এসব ছাড়া তার মাথায় কিছুই আসছে না। এভাবেই পরীক্ষার সময়টা পার হয়ে গেলো। কলি, ইরা এবং লিলি একসাথে বেরিয়েছে। ইরা হাঁটতে হাঁটতে বলে,

-“আঙ্কেল গতকাল কী সারপ্রাইজটাই না দিলো ইয়ার! আগামী টি-টোয়েন্টি সিরিজের প্রথম ম্যাচের টিকিট নিজে কিনবে আমাদের জন্য! মানে ভাবতে পারছিস, আমরা আমাদের ফেভারিট রায়াফকে সামনে থেকে দেখবো!! হাউ লাকি উই আর!”

-“ঠিক বলেছিস ইরা। আমার তো তর সইছে না, কবে যে এই ২টা মাস পার হবে ধুর!”

লিলি ভেংচি কেটে ভাবলো,”ইশ! ম্যাচ আসতে আরও ২মাস বাকি এদিকে সব এখনই লাফাচ্ছে। বাবাই! তুমি কাজটা একদম ঠিক করলে না, দুই মাসের জন্য আমার মাথাটা শেষ হয়ে যাবে। পরে তোমার মেয়েকে তুমি পাবনা পাঠাবা শিওর!”

-“কীরে লিলি? চুপ করে আছিস কেন?”

-“না এমনি তোদের কথা শুনছিলাম।”

-“ওহ। তা রিকশায় করে বাসায় যাবি?”

-“নাহ। আম্মু বলেছে আদনানকে ওর স্কুল থেকে নিয়ে ফিরতে।”

-“ওহ, তাহলে আমরা যাই। আমাদের শপিং করা লাগবে।”

বলেই দুজন একমুহূর্ত না দাঁড়িয়ে চলে গেলো। লিলি সেখানে কিছুক্ষণ ওদের মিনমিন করে বকে আদনানের স্কুলের দিকে চলে গেলো। সেখান থেকে আদনানকে নিয়ে বাসায় ফিরতে লাগলো। আদনান ক্লাস ফাইভে পড়ে। আদনান হাঁটতে হাঁটতে ফুচকা দেখে লিলির হাত ধরে থামিয়ে দিলো।

-“কী সমস্যা? আটকালি কেন?”

-“ফুচকা খাবো!”

-“নিজের টাকায় কিনে খা। আমি জানি আম্মা তোরে টাকা দিছে।”

আদনান গাল ফুলিয়ে বলে,”তুমি কেমন বড় বোন যে কিনা এভাবে নিজের টাকায় খেতে বলো?”

-“আমি তোর মতো এত বড়লোক না যে তোরে আমি খাওয়াতে যাবো। এহ ন্যাকা!”

-“তুমি আমার খবর রাখো আমি বুঝি তোমার খবর রাখি না? আমি জানি তুমি এখন ঘড়ি কেনার জন্য টাকা জমাচ্ছো। আম্মুকে খবরটা লিক করলে কিন্তু তোমার সব টাকা ফিনিশ!”

লিলি দাঁতে দাঁত চেপে আদনানের দিকে তাকালো। আদনান তার বোনের মুখমন্ডলের দিকে তাকাতেই ভয়ে শুকনো ঢোক গিললো। বেশি রাগিয়ে ফেলেছে সে। আদনান এমনেই গতকাল ঘুমের ভান ধরে লিলির হাত থেকে বেঁচেছে, আজ তো কপালে শনি থাকবে। যতোই হোক লিলি বড় আর আদনান ছোট। সে একা তো লিলির সাথে পারবে না। তাই সে মুখ ঘুরিয়ে বললো,

-“আচ্ছা যাও, আজকের মতো মাফ করলাম। আজ আমি নিজের টাকাতেই খাবো!”

-“এই ছেলে! তুই আমার কোন মহারাজা যে তুই আমায় মাফ করবি? থাপ্পড় একটাও মাটিতে পরবে না বলে দিলাম। চল ফুচকা খাবি! খাবি তুই টাকাও দিবি তুই!”

বলেই আদনানকে নিয়ে ফুচকার গাড়ির সামনে আসলো। আদনান ফুচকা খাচ্ছিলো তখনই লিলি ওর প্লেট থেকে একটা মুখে পুরে নিলো। আদনান অস্ফুট সুরে “আপু!” বলে উঠলো। লিলি খিলখিলিয়ে হেসে দিলো। আদনানকে জ্বালাতে তার সেইরকম লাগে।
কিছুদিন পর,

রায়াফ ডান হাতে সিগারেট ফুঁকছে আর জানালা দিয়ে বাইরের ব্যস্ত শহরটা দেখছে। তখনই রায়াফের রুমে প্রবেশ করলো ফাহান, হাতে তার ল্যাপটপ। ফাহান কিছু বলতে গিয়েও থেমে নির্বাক হয়ে তাকিয়ে রইলো রায়াফের দিকে। ফাহান যে এসেছে সেদিকে রায়াফের কোনো হেলদোল নেই, সে সিগারেট ফুঁকতে ব্যস্ত। তখনই ল্যাপটপ থেকে পরিচিত কন্ঠে কেউ বলে উঠে,

-“কী হলো ফাহান? থামলি কেন? আমার রায়ু কোথায়?”

দাদীর কন্ঠসর শুনে রায়াফ তৎক্ষনাৎ সিগারেট ফেলে গলায় ঝুলানো ব্যান্ডেজটা ঠিক করে পরে নিলো। রায়াফ এখন ইনজুর্ড! তার বাম হাতে প্লাস্টার করা। খেলায় বল ক্যাচ করতে গিয়ে ফাহান বাস্তবে ফিরে এসে বললো,

-“এইতো দাদী এসেছি তোমার রায়ুর রুমে। রায়াফ কথা বল।”

রায়াফ একহাতে ল্যাপটপটা নিয়ে সোফায় গিয়ে বসলো। টি-টেবিলে ল্যাপটপ রেখে নিষ্পলক তাকিয়ে রইলো ল্যাপটপের পর্দায়৷ দাদী কিছুক্ষণ চুপ করে মন ভরে তার নাতিটাকে দেখে নিলো। দেখতে দেখতে কখন যে চোখের কোণ বেয়ে জল গড়িয়ে পরলো, ঠাহর করতে পারলো না। রায়াফ অতি শীতল সুরে বলে উঠলো,

-“ভালো আছো দাদী?”

এবার দাদী হুঁ হুঁ করে কেঁদে উঠলো,
-“ভালো কীভাবে থাকি ভাই? আমার ভাইটার এ অবস্থা কী মানা যায়? সুস্থ-সবল গেলি অথচ এ অবস্থা? কতোবার বলেছি সাবধানে থাকবি, শুনিস না কেন তুই?”

-“সাবধানেই ছিলাম, এমন কিছু হবে কে জানতো? আমার ভাগ্যে এটা ছিলো তাই হয়েছে তাই এভাবে ভেঙ্গে পরিও না। আমি আগামী তিনদিনের মাঝেই দেশে ফিরছি। এখানে মন টিকছে না একদম!”

-“ঠিক আছে তাহলে আয়। তোর জন্য অপেক্ষায় রইলাম!”

তখনই দাদীর পাশে এসে বসলো মামনি অর্থাৎ ফাহানের মা। মুখটা শুকনো করে বললো,

-“হাতে কী বেশি ব্যথা অনুভব হচ্ছে? ঠিকমতো মেডিসিন নিচ্ছিস তো?”

-“হ্যাঁ মামনি, সবই নিচ্ছি। শুধু একটাই কষ্ট, মাঠে ১ বছরের জন্য…”

বলেই রায়াফ মাথা নিচু করলো। মামনি ছলছল নয়নে ল্যাপটপের স্ক্রিনে তাকিয়ে রইলো। ছেলেটার রক্তে মিশে আছে এই ক্রিকেট। সেখানে একবছর খেলতে পারবে না, এ ভেবেই তার ভেতরটা হুঁ হুঁ করছে। না জানি ছেলেটার কী অবস্থা! রায়াফ ক্রিকেটের কথা বাদ দিয়ে অন্য টপিকে কথা বলতেলাগলো। ২০ মিনিটের মতো কথা বলে কল কাটলো এবং ফাহানের দিকে তাকালো। ফাহান ফোনে ক্লায়েন্টের সাথে কথা বলছে। ফাহান এবং রায়াফ সমবয়সী। যেমন বন্ধু তেমনই চাচাতো ভাই। ফাহান কখনোই রায়াফকে ছাড়া থাকেনি, রায়াফও না। রায়াফের প্রতিটা ম্যাচেই ফাহান তার পাশে ছায়ার মতো থেকেছে। ফাহানের বিজনেস আছে, তাও সে সেটায় পরোয়া না করে রায়াফের সাথে চলে আসে। ফাহান কথা শেষে রায়াফের দিকে তাকালো এবং বললো,

-“লন্ডনের এক ক্লায়েন্টের সাথে কনফারেন্স আছে। তুই আমার সাথে আসবি?”

-“অফিস তো তোর, আমি গিয়ে কী করবো?”

-“দেখ রায়াফ! একদম ত্যাড়া কথা বলবি না! অফিস আমার একার নয় তোর নিজেরও।”

রায়াফ ফাহানের কথায় কোনোরকম প্রতিক্রিয়া করলো না। সে চুপ করেই বসে রইলো। ফাহান নিরাশ হয়ে রায়াফের দিকে তাকালো। তখনই চার পায়ে কেউ ছুটে এসে ডিরেক্ট রায়াফের কোলে গিয়ে উঠলো। হাতে জোরে চাপ লাগায় রায়াফ চোখ মুখ কুচকে ফেলে। জিনি রায়াফের ভাবভঙ্গি দেখে কোল থেকে নেমে যায় এবং মুখটা বেক্কলের মতো করে লেজ নাড়তে লাগলো। জিনি হচ্ছে রায়াফের পোষা কুকুর। ফাহান জলদি রায়াফের দিকে ছুটে এসে বললো,

-“আর ইউ ওকে ব্রোহ? এই জিনি দেখিস না রায়াফের হাতে চোট! এভাবে কেউ কোলে উঠে?”

জিনি মুখটা বেজার করে লেজ নাড়া বন্ধ করে দিলো। রায়াফ নিজেকে সামলে বলে,

-“ইট’স ওকে, তুই ওকে বকিস না। জিনি তুই এতক্ষণ কই ছিলি?”

-“ওরে আমি আমার রুমে রেখেছিলাম, যাতে করে এরকম কোনো অঘটন না ঘটে। সে তো ঘটেই গেলো। দুটো আবেগে আপ্লুত হয়ে এখন গলায় ঝুল!”

বলেই ফাহান হনহন করে বেরিয়ে গেলো। জিনি সেখানেই জিহবা বের করে লেজ নাড়ছে। ভাব-ভঙ্গি এমন, ফাহান তাকে কৌতুক শুনিয়েছে। জিনির রিয়েকশন দেখে রায়াফ নিশব্দে হাসলো। জিনিকে রায়াফের বাবা তাকে উপহার দিয়েছিলেন। তখন ছিলো জিনি একদম বাচ্চা। এখন জিনি অনেকটা বড়, তাকে বিশেষ প্রশিক্ষণ দিয়েছে রায়াফ। বাবার কথা মনে হতেই রায়াফের হাসি বন্ধ হয়ে গেলো। সে তার পকেট থেকে ওয়ালেট বের করলো। এই বয়সে রায়াফের ওয়ালেটে কোনো সুন্দরী মেয়ের ছবি থাকার কথা ছিলো, সেখানে একটা সুখী পরিবারের ছবি। যেখানে মা, বাবা এবং মাঝে একটা বাচ্চা ছেলে। সকলের মুখেই তৃপ্তির হাসি। রায়াফ একপলক ছবিটার দিকে তাকিয়ে রইলো। কিছুক্ষণ বাদে সে বমে উঠে,

-“আই হেইট ইউ মা!”

৩ দিন পর রায়াফ, ফাহান এবং জিনি দেশে ফিরলো। মামনি যে কতো ধরণের খাবারের আইটেম রেঁধেছে, রায়াফ বেচারা খেয়ে কুলাতেই পারছে না। অনেকদিন পর রায়াফ তার বিছানায় গা এলিয়ে শান্তির ঘুম দিলো। রায়াফের পায়ের নিচে জিনিও আরামে ঘুমিয়ে যায়।
পরদিন এলার্মের শব্দে রায়াফের ঘুম ভেঙ্গে যায়। ঘড়িতে তাকিয়ে দেখে ৪ঃ৫০ মিনিট। চারপাশে আযানের ধ্বনি। রায়াফ এক হাত দিয়ে খুব কষ্টে উঠে বসলো। জিনি এখনো ঘুমে কাত। রায়াফ তার পরিহিত শার্টটি খুলে ওয়াশরুমে চলে গেলো। ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে ফাহানকে গিয়ে ডেকে আনলো। ফাহান বেচারা ঘুমে ঢুলতে ঢুলতে রায়াফের হুডি পরাতে সাহায্য করলো। রায়াফ একটা মাস্ক এবং টুপি নিয়ে বেরিয়ে গেলো মসজিদের উদ্দেশ্যে। ফাহান নিজের ঘুমের কান্ট্রোল রাখতে না পেরে রায়াফের বিছানাতেই ধপ করে শুয়ে পরলো। ফাহানের আচমকা শব্দ করে শোয়াতে জিনি লাফ দিয়ে উঠে বসলো এবং চোখ বড় বড় করে ফাহানের দিকে তাকালো। তার এখন একটাই প্রশ্ন ফাহান এখানে কেন?

রায়াফ নামাজ শেষে আনমনে হাঁটছে। সূর্যের আলো অনেকটাই ফুটেছে। রায়াফ উপরের দিকে তাকাতেই দেখলো কোথা থেকে একটা বল রায়াফের দিকেই আসছে। রায়াফ তৎক্ষনাৎ বলটা ক্যাচ ধরে ফেলে। অতঃপর চারপাশে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করে কে বল ছুঁড়েছে?

®লাবিবা ওয়াহিদ

~চলবে।

করে❤

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here