প্রেমাঙ্গনা পর্ব -১৪+১৫

#প্রেমাঙ্গনা
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
১৪।

‘হ্যালো, কোথায় আছেন আপনি?’

পৃথার এমন উত্তেজিত গলার স্বর শুনে অর্ণব চিন্তিত হয়ে পড়ল। জিজ্ঞেস করল,

‘আমার বাসায়। কেন, কী হয়েছে?’

পৃথা শ্বাস টেনে বলল,

‘আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছি, আমি আপনার সাথে পালাব। আজ আর এক্ষুনি।’

অর্ণব শুয়ে ছিল। কথাটা মস্তিষ্কে পৌঁছাতেই সে চট করে উঠে বসল। বিচলিত হয়ে বলল,

‘এক্ষুনি? এখন রাত একটা বাজে, পৃথা।’

‘তো? আপনি পালাবেন কিনা বলুন? আর নয়তো আমি একাই পালাব।’

‘কেন পালাব না? কিন্তু, এইসময় আপনি বাসা থেকে বের হবেন কী করে?’

‘সেটা আমি ম্যানেজ করে নিব। আপনি এগারোটা ত্রিশ এর মধ্যে আমাদের বাড়ির গেইটের বাইরে এসে অপেক্ষা করবেন, আমি আপনাকে এড্রেস পাঠিয়ে দিচ্ছি।’

‘ঠিক আছে, আপনি সাবধানে বের হবেন। আপনার বাবা যেন বুঝতে না পারে।’

‘আচ্ছা।’

কল কেটে, পৃথার তার গুছিয়ে রাখা ব্যাগটার দিকে চাইল। মনে মনে প্রচুর দুশ্চিন্তা হচ্ছে তার। ভয়ও হচ্ছে খুব। অর্ণবকে কি বিশ্বাস করা যায়? যদি ছেলেটা ভালো না হয়? এত দুশ্চিন্তার মাঝেও মন যেন বলছে, অর্ণব কে একবার বিশ্বাস করা উচিত। ছেলেটা খারাপ হলে তো সেদিন সাজেকেই তার সাথে সে খারাপ কিছু করতে চাইতো, কিন্তু তখন তো সে কিছুই করেনি বরং তাকে সাহায্য করেছে।
মনকে বুঝিয়ে পৃথা আস্তে করে উঠে গিয়ে দরজা খুলে। দরজার বাইরেই খালা দাঁড়িয়ে ছিলেন। পৃথা উনাকে ইশারা দিয়ে ডাকে। খালা ভেতরে আসার পর সে জিজ্ঞেস করে,

‘বাবা ঘুমিয়েছেন?’

‘জি, খালা।’

‘আচ্ছা, তাহলে আমি যা বলেছি এখন গিয়ে তাই করুন।’

খালা চুপসে যাওয়া মুখে বলেন,

‘আমার তো ভয় করে, খালা।’

‘ভয় পাবেন না, খালা। আমি আছি তো। কিচ্ছু হবে না। প্লীজ, আমায় সাহায্য করুন।’

পৃথা খালার সামনে দুই হাত জোড় করতেই খালা হাত দুটো ধরে বলে,

‘হাত জোড় করতে হইব না। আপনার খুশির জন্য আমি সব করতে পারমু। আপনি বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ান, আমি ইশারা দিলে বাইর হইয়েন।’

‘ঠিক আছে।’

খালা বাইরে গেল। দারোয়ান মামা খালার স্বামি হোন। স্বামীকে কোনোভাবে ভুলিয়ে ভালিয়ে গেইটের সামনে থেকে সরাতে পারলেই কাজ হয়ে যাবে। খালা কিছুক্ষণের মধ্যেই সেই কাজটা করে ফেলল। সাথে গেইটের সামনে থেকে পৃথাকে ইশারা দিয়ে বলল, তাড়াতাড়ি নেমে আসতে। পৃথা আর দেরি করল না, দ্রুত তার ব্যাগ নিয়ে বাইরে বেরিয়ে গেল। গেইটের সামনে গিয়ে একবার পেছন ফিরে তার বাড়ির দিকে চাইল, কেন যেন খুব কষ্ট হচ্ছে তার। কিন্তু, তাও আজ পালাতে হবে তাকে। তাই সামনের দিকে চেয়ে জোরে শ্বাস টেনে দ্রুত পায়ে গেইট ছেড়ে বেরিয়ে যায়। কিছুটা পথ যেতেই থমকে দাঁড়ায়। এদিক ওদিক চেয়ে দেখে, অর্ণব এসেছে কিনা। কিন্তু, সে অর্ণব কে খুঁজে পায় না। তাই আরেকটু পা এগুতে নিলেই কেউ একজন তার হাত ধরে জোরে টান মেরে গাছের আড়ালে নিয়ে যায়। এমনিতেই এতসব কাছে পৃথার বুক ধুকধুক করছিল, এখন তো ভয়ে বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠল। সে সঙ্গে সঙ্গে পেছনে ফিরে। তাকিয়ে অর্ণব কে দেখে কিছুটা স্বস্তি পায়। রেগে গিয়ে বলে,

‘এভাবে টান দিলেন কেন? ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম তো।’

অর্ণব বলে,

‘টান না দিলে তো, হাঁটতে হাঁটতে মেইন রাস্তায় চলে যেতেন। আর তখন সেখানের সি . সি ক্যামেরাতে আপনার ফুটেজ জমা হয়ে যেত। আর সকাল হলেই আপনার বাবা সেই ফুটেজ দেখেই বুঝে ফেলতেন, আপনি কোন দিকে গিয়েছেন। তাই আটকালাম আপনাকে।’

‘কিন্তু, এইদিকে না গেলে কোনদিকে যাব?’

‘মেইন রোড দিয়ে যাওয়া যাবে না। আমরা অন্য একটা রাস্তা দিয়ে যাব।’

‘কোন রাস্তা দিয়ে?’

‘চলুন আমার সাথে, গেলেই বুঝবেন।’

অর্ণব পৃথার হাত ধরে টান দিতেই পৃথা হাত ছাড়িয়ে বলল,

‘আপনি যান, আমি আপনার পেছন পেছন আসছি।’

অর্ণব পৃথার দিকে মুখ করে তাকিয়ে বলল,

‘যদি বিশ্বাস না হয়, তাহলে বাড়িতে ফিরে যান।’

পৃথা ভ্রু কুঁচকে বলে,

‘বিশ্বাস করি বলেই তো বেরিয়েছি।’

‘তাহলে এত কথা না বলে আমার সাথে চলুন।’

এই বলে অর্ণব পৃথার হাতটা আবারও শক্ত করে ধরল। তারপর দুজনেই হাঁটতে লাগল অজানা গন্তব্যের পথে।

কিছুটা পথ এগিয়ে গিয়ে অর্ণব কাকে যেন একটা কল করল। তার কল করার কিছুক্ষণের মধ্যেই সেখানে একটা মাইক্রো এসে হাজির হলো। মাইক্রোটা দেখে পৃথার কিছুটা ভয় হলো যেন। কত শত নিউজ সে দেখেছে, এখন আবার তার সাথে ঐরকম কিছু হবে না তো?

কিন্তু, গাড়ির দরজা খুলে বেরিয়ে আসা মানুষগুলোকে দেখে আত্মা ফিরে এল তার। তার সব বন্ধুরা এখানে কী করছে? সে অবাক হয়ে চেয়ে রইল। সারা হেসে বলল,

‘কেমন সারপ্রাইজ দিলাম, হু?’

‘তোরা আসবি, আমাকে একবার বলবি না?’

সারা কোমরে হাত দিয়ে বলল,

‘তুই যে আজ পালাচ্ছিস, সেটা আমাদের একবারও বলেছিস? তাহলে আমরা কেন বলব?’

‘আমি তো নিজেই জানতাম না যে আমি আজকে পালাব। তাই তোদের কাউকেই কিছু জানাতে পারিনি।’

নিলয় বলে,

‘এখন এসব কথা থাক। তোরা গাড়িতে উঠ তাড়াতাড়ি। আর ভাইয়া, আমি কাজী অফিসে যোগাযোগ করে রেখেছি, আপনারা গেলেই বিয়ে পড়ানো শুরু হবে।’

পৃথা থতমত খেয়ে বলে,

‘কার বিয়ে?’

রুহা জবাবে বলে,

‘কেন, তোর আর অর্ণব ভাইয়ার।’

পৃথা আঁতকে উঠে বলে,

‘ওমা, বিয়ে কেন?’

‘আশ্চর্য, আপনি আমায় বিয়ে না করেই আমার সাথে থাকবেন? ডু ইউ ওয়ান্ড অ্যা লিভ ইন রিলেশনশীপ?’

পৃথা মাথা ঝাঁকিয়ে বলে,

‘না না, একদমই না। বিয়ে ছাড়া একসাথে থাকা ইম্পসিবল।’

‘সেজন্যই আমরা বিয়ের ব্যবস্থা করেছি। এখন আর দেরি না করে তাড়াতাড়ি গাড়িতে উঠ তো। পরে কিন্তু কাজী সাহেবকেও আর পাওয়া যাবে না।’

রুহার কথা শেষ হতেই সবাই দ্রুত গাড়িতে উঠে বসে। তারপর সবাই রওনা দেয় কাজী অফিসে।

এক টাকা দেনমোহরে পৃথা আর অর্ণবের বিয়ে হয়। তবে আশ্চর্যের বিষয় হলো, কবুল বলার সময় পৃথার একটুও খারাপ লাগেনি, উল্টো মনে যেন একটা প্রশান্তি ফিরে পাচ্ছিল সে। মনে হচ্ছিল, অনেকদিন পর হারিয়ে যাওয়া কোনো কিছু একটা সে ফিরে পেয়েছে। এই সবকিছু খুব পরিচিত লাগল তার কাছে। মনে হচ্ছিল, এর আগেও এমন কিছু হয়েছে। কিছু ঝাপসা ছবি বার বার যেন তার দৃশ্যপটে ভেসে উঠছিল। এমন কেন হচ্ছিল, সেটা বুঝেনি পৃথা। মনের ভুল ভেবে সেসব জিনিস কে এতোটা পাত্তাও দেয়নি। অথচ সে জানেও না, আজ আবার দ্বিতীয়বারের মতো তার বিয়ে হয়েছে। দ্বিতীয়বারের মতো আজ আবার সে বউ হয়েছে।

অর্ণব কিছুক্ষন থ মেরে বসে থাকে। পৃথা ভ্রু কুঁচকে চেয়ে থাকে তার দিকে। সে বুঝে না ছেলেটার কী হয়েছে। সে কি তাকে বিয়ে করে কষ্ট পাচ্ছে, নাকি অন্যকিছু? এমন মনমরা হয়ে আছে কেন? পৃথা তার পাশে গিয়ে বসে। বনিতা না করে সরাসরি বলে,

‘আমি কি বলেছিলাম, আমাকে বিয়ে করুন। বিয়ে করে এখন কষ্ট পাচ্ছেন কেন?’

অর্ণব মাথা তুলে তাকায়। বলে,

‘আমি যে বিয়ে করে কষ্ট পাচ্ছি সেটা আপনাকে কে বলল?’

‘আপনার মুখ দেখেই আমি বুঝতে পারছি।’

‘আপনি তো সবসময়ই একটু বেশি বুঝেন। যাকগে, গাড়িতে গিয়ে বসুন, আমি কাজী সাহেবের সাথে কথা বলে আসছি।’

‘বেশি বুঝি না, ঠিকটাই বুঝি। আমার মনে হচ্ছে, আমি নিজেকে আপনার উপর চাপিয়ে দিয়েছি, নয়তো বিয়ে হয়ে যাওয়ার পরেও আপনি এখনও আমাকে আপনি করে বলছেন কেন?’

অর্ণব কিছুক্ষন ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থেকে বলল,

‘তুমি না কখনও বদলাবে না, যাও গাড়িতে যাও।’

পৃথা মুখ ভার করে গাড়ির কাছে গিয়ে অভিমানের সুরে রুহাকে বলল,

‘আমার মধ্যে খারাপ কী আছে যে আমাকে বদলাতে হবে? উনাকে বিয়ে করাটাই আমার ভুল হয়েছে, আমি বলেছিলাম না, উনার সাথে আমার জীবনেও ভাব হবে না। এমন গায়ে পড়া ঝগড়াটে লোক আমি জীবনেও দেখিনি।’

‘চিন্তা করো না, এখন থেকে সব সময়ই দেখতে পাবে।’

পৃথা অর্ণবের দিকে ফিরে চেয়ে বলল,

‘আপনি আসলেই একটা খারাপ লোক। আমি আপনার সাথে কোথাও যাব না।’

‘বিয়ে হয়ে গিয়েছে, এখন যাব না বলেও লাভ নেই। চুপচাপ গাড়িতে গিয়ে বসো।’

পৃথা রাগে ফোস ফোস করতে করতে গাড়িতে উঠে বসল। অর্ণব বসতেই গাড়ি চলতে আরম্ভ করল। পৃথা অবাক হয়ে বলল,

‘আমার বন্ধুরা যাবে না?’

অর্ণব বলল,

‘ওরা আর গিয়ে কী করবে? বাসরের ব্যবস্থা আমি একাই করতে পারব।’

পৃথা চোখ মুখ কুঁচকে কিছুক্ষন অর্ণবের দিকে চেয়ে থেকে মুখ ঘুরিয়ে মনে মনে বলল,

‘লোকটা ভীষণ অসভ্য।’

চলবে….#প্রেমাঙ্গনা
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
১৫।

বাড়িটা পুরোনো। তবে দেখতে ভীষণ সুন্দর। চারদিকে গাছপালা আর সুন্দর আলোকসজ্জায় সাজানো। এই বাড়ির মালিক নিশ্চয়ই খুব শৌখিন মানুষ। কী সুন্দর করে সবকিছু সাজিয়ে রেখেছেন।

গাড়ি থেকে নেমেই পৃথা উৎফুল্ল কন্ঠে জিজ্ঞেস করল,

‘এটাই কি আপনার বাড়ি?’

অর্ণব তার দিকে চেয়ে বলল,

‘না, এটা অন্য একজনের বাড়ি। আমরা আজ থেকে এই বাড়িতেই ভাড়া থাকব।’

পৃথা মুখ ছোট করে বলল,

‘ওহহ।’

ভেবেছিল, এটাই বোধ হয় তার শ্বশুরবাড়ি। ছিমছাম, তবে চমৎকার সুন্দর।

অর্ণব পৃথাকে নিয়ে বাড়ির গেইটের সামনে যায়। কেচি গেইটে ঝুলে থাকা তালাটা দুবার বাড়ি দিয়ে ডাকে,

‘চাচা, আমরা এসেছি। গেইট খুলুন।’

তার ডাকের কিয়ৎক্ষণের মাঝেই একটা মধ্যবয়সী লোক গেইটের সামনে এলেন। তিনি চশমাটা ভালো ভাবে মুছে চোখে লাগিয়েই দাঁত বের করে চমৎকার ভাবে হাসলেন। আহ্লাদ নিয়ে বললেন,

‘বউমা, তুমি এসেছ?’

পৃথা অবাক হলো। তাকে বউমা বলল? তাও আবার এতটা আবেক নিয়ে। কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল সে। অর্ণব ব্যাপারটা বুঝতে পেরে চাচাকে হেসে বলল,

‘জি চাচা, বউমা এসে পড়েছে। আজ থেকে আপনার বউমা এখানেই থাকবে।’

চাচা খুশি হয়ে দ্রুত গেইটের তালা খুলে দিলেন। অর্ণব পৃথাকে নিয়ে ভেতরে প্রবেশ করল। চাচা বললেন,

‘আজকে আমার এখানে থাক। আমি খাবার রেঁধে রেখেছি। খাওয়া দাওয়া করে আজ আমার সাথেই ঘুমাবে।’

‘না না চাচা, আমি উপরে সব ব্যবস্থা করে ফেলেছি। আপনাকে কষ্ট করতে হবে না। এমনিতেই আমাদের জন্য এতক্ষণ জেগে ছিলেন, এখন গিয়ে শুয়ে পড়ুন।’

‘বউমা, তোমার কোনোপ্রকার কষ্ট হলে আমাকে বলবে কিন্তু।’

পৃথা মাথা হেলিয়ে বলল,

‘আচ্ছা।’

‘ঠিক আছে বাবা, যাও বউমাকে নিয়ে উপরে যাও। আমি গেইটে তালা দিয়ে রুমে যাচ্ছি।’

অর্ণব সিঁড়ি বেয়ে পৃথাকে নিয়ে দুতালায় গেল। উপরে উঠতেই পৃথা বুঝতে পারল, বাড়িটা আসলে একটু বেশিই পুরোনো। দরজাটাও নিচের দিকে ভেঙে আছে। ভেতরের অবস্থা কেমন কে জানে।

অর্ণব তালা খুলে। পৃথাকে বলে,

‘চলো।’

পৃথা অর্ণবের পেছন পেছন বাসার ভেতরে প্রবেশ করে। তবে বাসার ভেতরে প্রবেশ করে তার ধারনা সব পাল্টে যায়। বাসার ভেতরের অবস্থা পুরো অন্যরকম। কী সুন্দর, পরিপাটি। কোথাও একটুও বিশৃঙ্খলাও নেই। সবকিছু নিঁখুত ভাবে গুছানো। খুব বেশি কিছু না থাকলে একটা ছোট্ট সংসার পাতার জন্য যা যা প্রয়োজন তার সবই আছে। পৃথা বেশ অবাক হয়। ঘুরে ঘুরে সবকিছু দেখে। অর্ণব বলে,

‘পছন্দ হয়েছে?’

পৃথা অবাক হয়ে বলে,

‘এসব কিছু কি আপনি এনেছেন? নাকি আগে থেকেই ছিল?’

‘আগে থেকে কী করে থাকবে। সব আমাদের জিনিস।’

‘আমাদের মানে? আপনার সাথে কি এখানে আগে আর কেউ থাকত? এই, আপনি আবার আগে থেকেই বিবাহিত নন তো? এসব দেখে তো মনে হচ্ছে, আপনি আগে থেকেই সংসার করে আসছেন। আমাকে সত্যি করে বলুন তো, আপনি কি বিবাহিত?’

অর্ণব শব্দ করে হাসে। পৃথার দিকে তাকাইতেই সে আরো জোরে হাসতে আরম্ভ করে। মেয়েটার চোখ মুখ কেমন কুঁচকে আছে, যেন এক্ষুনি সে কেঁদে ফেলবে। পৃথা রাগ দেখিয়ে বলে,

‘আশ্চর্য, হাসছেন কেন? আমি কি কোনো হাসার কথা বলেছি?’

অর্ণব হাসি থামায়। বলে,

‘হ্যাঁ, আমার আগে একটা সংসার ছিল। একটা সুন্দরী বউ ছিল। তবে হুট করেই একদিন আমার বউ আমাকে ভুলে যায়। আর তার আমার কথা একটুও মনে পড়ে না, এই সংসারের কথা মনে পড়ে না। সে আমার থেকে অনেক দূরে সরে যায়। আমি চেয়েও আর তাকে ফেরাতে পারিনি। তাই আজ তার প্রতি অভিমান করে তোমায় বিয়ে করেছি। এখন সেও বুঝুক, আমি তাকে ছাড়া ভালো থাকতে পারি। তাকে আর আমার প্রয়োজন নেই, কারণ এখন আমার পৃথা আছে।’

পৃথার মনটা বিষাদে ভরে যায়। সে কখনও ভাবেওনি যে লোকটা বিবাহিত হতে পারে। আগে জানলে এমন বিবাহিত ছেলেকে সে কখনোই বিয়ে করত না। পৃথার চুপসে যাওয়া চোখ মুখ দেখে অর্ণব বলল,

‘কী হলো, কষ্ট পেলে?’

‘আপনি আমায় আগে কেন বলেননি যে আপনি বিবাহিত?’

‘বললে বিয়ে করতে?’

‘না, করতাম না। কখনোই করতাম না।’

‘সেই জন্যই বলিনি। সেসব কথা এখন থাক। তুমি রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নাও। আমি খাবার আনছি।’

পৃথা কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ রুমে চলে যায়। অর্ণব বুঝতে পারে, পৃথা কষ্ট পেয়েছে। পাক, সাময়িক কষ্টে কারোর খুব বেশি ক্ষতি হয়না।

পৃথা শোয়ার রুমে গিয়ে দেখে, সেই রুমটাও বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। ছোট্ট একটা খাট পাতা। পাশে ছোট এক টেবিল। ডানপাশে একটা আলমারি। আর তার পাশেই একটা বড়ো আয়না। রুমের এক কোণে একটা বুক সেলফও আছে।

পৃথা তার ব্যাগটা বিছানার উপর রেখে ব্যাগ থেকে তার একটা জামা বের করে ওয়াশরুমে চলে যায় ফ্রেশ হতে।
ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে দেখে, অর্ণব তার জন্য খাবার নিয়ে অপেক্ষা করছে। লুঙ্গি আর একটা পাতলা টি শার্ট গায়ে অর্ণবকে বেশ স্বামী স্বামী লাগছে। পৃথা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল মুছতে মুছতে বলে,

‘আপনার আগের বউ যদি এখন হুট করে আবার ফিরে আসে, তখন?’

অর্ণব তাকিয়ে বলে,

‘তখন কী, দুই বউ নিয়ে সুন্দর সংসার করব।’

পৃথা ক্ষেপে যায়। অর্ণবের দিকে ফিরে বলে,

‘যদি এমন চিন্তা করে থাকেন, তাহলে আগেই বলে দিন, আমি আবার বাবার কাছে চলে যাব।’

অর্ণব মৃদু হেসে বলে,

‘চলে যাও।’

পৃথা রাগে গদগদ হয়ে বলে,

‘এখন তো বলবেনই, চলে যাও। বিয়ে তো হয়ে গিয়েছে, এখন তো আর চাইলেই কিছু করতে পারব না। জেনে শুনে এখন আমি আমার সাথে এমন করবেন। আমার আপনাকে বিশ্বাস করাটাই ভুল হয়েছে।’

অর্ণব খাবারটা পাশে রেখে পৃথার কাছে এগিয়ে যায়। পৃথা রাগে ফুঁসছে। অর্ণব আস্তে করে গিয়ে তার গালে স্পর্শ করে। পৃথা ভ্রু কুঁচকে হাত সরিয়ে দেয়। অর্ণব তার দিকে আরো এগিয়ে গিয়ে তার আধ ভেজা চুলে হাত বুলিয়ে বলে,

‘তুমি আমার কত মেহনতের প্রেম, তোমাকে আমি এমনি এমনি কী করে যেতে দেই বলো? একবার হারিয়েছি বলে কি বার বার হারাতে দিব? কখনোই না। আর হারাতে দিব না। নিজের সবটুকু দিয়ে তোমায় আগলে রাখব।’

পৃথার মন গলে যায়। রাগ হাওয়া হয়ে উড়তে থাকে। নরম সুরে বলে,

‘তাহলে বলছিলেন কেন, আগের বউ ফিরে এলে তাকে নিয়ে সংসার করবেন? আমি কখনোই সতীনের ঘর করতে পারব না।’

অর্ণবের খুব হাসি পায় পৃথার কথা শুনে। কিন্তু, এখন হাসলে পৃথা আরো রেগে যাবে, এই ভেবে সে চেপে যায়। বলে,

‘মজা করছিলাম। আমি জানি, সে আর ফিরবে না। আর ফিরলেও কী, আমি তো আমার প্রেমাঙ্গনা কে পেয়েই গেছি।’

‘আচ্ছা, কথাটা যেন মনে থাকে।’

‘হু, থাকবে। এখন খেতে চলো।’

পৃথা খেতে বসে। খাবার হিসেবে ছিল, দুই পিস মাছ ভুনা, এক বাটি ডাল, আর দুইটা ডিম ভাজা।

পৃথা অনেকদিন পর আজ পেট ভরে একটু ভাত খেল। এতদিন তো খাবার আগেই সব বমি করে ভাসাতো। আজ আর বমি হয়নি। খেয়ে দেয়ে শরীরটা একটু সুস্থ লাগছে। খাবার শেষ করে পৃথা প্লেটগুলো তুলতেই অর্ণব বলে,

‘তুমি রেস্ট নাও। আমাকে দাও, আমি সব রেখে আসছি।’

পৃথা হেসে অর্ণবের হাতে সব প্লেট দিয়ে দিল। মনে মনে খুশি হলো, এমন একটা জামাই থাকলে আর কী লাগে।

সব প্লেট পরিষ্কার করে গুছিয়ে এসে অর্ণব দেখে, পৃথা শুয়ে শুয়ে মোবাইল দেখছে। সে হাত মুছে এসে পৃথার পাশে শুয়ে পড়ে। পৃথার দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে বলে,

‘তো, এবার শুরু করা যাক।’

পৃথা মুখের সামনে থেকে ফোনটা সরিয়ে জিজ্ঞেস করে,

‘কী?’

অর্ণব ঠোঁট কামড়ে হেসে বলে,

‘কী আবার, বাসর।’

পৃথার শরীর নিমিষেই জমে যায়। চোখে মুখে ছেয়ে আসে ভীষণ অসহায়ত্ব।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here