প্রেমের উষ্ণ ধোঁয়াতে পর্ব -০৪

#প্রেমের_উষ্ণ_ধোঁয়াতে
#লেখিকাঃ আসরিফা সুলতানা জেবা
#পর্ব___৪

” তোদের বাড়িতে কি চুমু বিতরণ করা হয়?”

নিশাত পারছে না মাথায় হাত দিয়ে মাটিতে জায়গা দখল করে রাখা দূর্বাঘাসের ওপর বসে যেতে। কানের পাতায় প্রহরের নিঃশ্বাসের উষ্ণ ধোঁয়া, বেসামাল কথা ওর সমগ্র কায়ায় সুর তুলছে। কিশোরী প্রাণে আবেগী সুর। রণডাক বাজছে হৃদয়স্থে। শিরশির করছে রন্ধ্রে রন্ধ্রে। তখনও প্রহর ওর দিকে ঝুঁকে আছে। কিসব বলছেন উনি?প্রহর তার দিকে ঝুঁকে থাকায় ওর মুখশ্রী প্রহরের কর্ণধারে। মিন মিন করে লজ্জামিশ্রিত কন্ঠস্বরে বলে,

” চুমু বিতরণ করা যায় না কি প্রহর ভাই? ”
” তাহলে অহেতুক প্রশ্ন করিস কেন?তোর হাতে একটা প্যাকেট দিয়েছি,তার মানে সেটাই দিতে এসেছি। শুধু শুধু প্রশ্ন করিস। সাহসও দেখছি বাড়ছে দিন দিন। ”

নিশীথের অন্ধকারে দু’টো দেহ একে অপরের অতীব কাছাকাছি। মুক্ত পরিবেশে বাধাহীন সমীরণের খেলা চলছে। নিশাতের ঝুঁটি বাঁধা চুলগুলো তোরজোর করে চলেছে উন্মুক্ত হবার নিমিত্তে। তন্মধ্যে এক দু’টো প্রচন্ড ত্যাড়ামো করে বেরিয়েও পড়েছে। চোখে, কোমল চেহারায়,ললাটে স্পর্শ করার জন্য পা”গ”লপ্রায় হয়ে উঠল। একে অপরের এত কাছাকাছি, ঈষৎ তফাত মাত্র নেই তবুও ছুঁইল না কেউ কারো শরীর। হুট করে হৃদযন্ত্রের গতি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলার উপক্রম নিশাতের। গভীর এক ডাক পৌঁছায় কর্ণকুহরে,

” নিশু!”
” হু। ”
” কত বড় হয়ে গেলি তুই। তিন বছর আগেও কত পিচ্চি ছিলি। পুতুল বিয়ে খেলতি। বড় কেন হচ্ছিস?তুই বড় হয়ে নিজের ক্ষ”তি ডেকে আনছিস নিশু। আমাকে দো”ষ দিবি না কখনও। ”

নিশাত স্তব্ধ, কিংকর্তব্য বিমূঢ়। আর পারছে না দাঁড়িয়ে থাকতে। আরেকটু হলেই চিরতরে শ্বাস-প্রশ্বাস ক্রিয়া থমকে যাবে হয়তো। প্রহর ভাইয়ের কথাগুলো ভ”য়া”নক ঝড়ের সৃষ্ট করছে অন্তঃপুরে। এতটুকু একটা মেয়ে হয়ে সে কি করে সামলাবে এমন ঝড়?ঝড়ে উড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা প্রকট। সরে যেতে নিলে চাপা গলায় ধ”ম”ক আসে শ্রবণগ্রন্থিতে,

” নড়বি না। ”
নিশাতের পেছানো বা পা টা নিমিষেই আগের জায়গা দখল করে। কলিজা একটুখানি হয়ে যায়। ভয় ভয় কন্ঠস্বর ওর,
” কেউ দেখে ফেলবে। ”
” আমি কি তোর সাথে প্রেম করছি যে কেউ দেখে ফেলবে,ভ”য় পাচ্ছিস। ”
নিশাত তৎক্ষনাৎ মাথা নেড়ে বলে উঠল নিম্নস্বরে,
” বাড়ির কেউ দেখে ফেলবে। ”
প্রহর তাচ্ছিল্য গলায় বলল,
” তোর ফুপু,আমার পেটুক মামা বহুত অ”ন্যা”য় করছে আমাদের সাথে,বুঝলি?যত কান্ড ঘটালো তোর ফুপু, তোর বাপ। মাঝখান থেকে ফা”সলা”ম আমরা। একদিন তোর বাপকে কঠিনভাবে ফা”সিয়ে দেবো দেখে নিস। ”

নিশাতের মস্তিষ্ক সজাগ হলো। চট করে প্রশ্ন করল,
” আমার আব্বাকে ফাঁ”সা”বেন কেমনে?”

প্রহর বিরক্ত হলো। এত এত প্রশ্ন ভাল লাগে না তার। হাত তুলে ঠাস করে মা”র”ল নিশাতের মাথায়। আকস্মিক এহেন ঘটনায় ব্যথাতুর আর্ত”নাদ করতে গিয়েও নিশাত থমকে গেল পরিস্থিতি বিবেচনা করে। এগুলোর অভ্যেস আছে ওর ছোট থেকে। এই নি”র্দয় লোকের হাতের মা”র খেতে খেতেই তো এতটুকু হলো। মাঝে তিনটে বছর সবকিছু নিরব ছিল,এখন আবার শুরু। প্রহর উত্তরে বলে ওঠে,

” মামুর ভাগিনা মামুর মেয়ের একমাত্র জামাই হলে। ”

মাথায় মৃদু যন্ত্রণা তার ওপর প্যাঁচানো বাক্য শ্রবণ হতেই সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেল নিশাতের। কিছুই বুঝল না। ভাবভঙ্গি অত্যন্ত বোকা বোকা। প্রহর তীক্ষ্ণ চক্ষে সবটা দেখে বলল,

” মাথা ঢলতে হবে না। ঢং কম কর। এত জোরে দেই নি আমি। কান টা আরেকটু কাছে আন আমার। ”

নিশাতের জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে জাগে, ” এত কাছে আছি আর কত কাছে নেবো প্রহর ভাই? ” কিন্তু করল না। পরে দেখা যাবে আরেকটা মে”রে বসেছে। কি শক্ত হাত!আস্তে মা”র”লেও মনে হচ্ছে যেন মাথার খুলি উড়ে যাবে। রাজনীতি করে নিশ্চয়ই মা”র”পিট করে। সৌরভ ভাইয়া বলেছে রাজীনিবিদ রা বেয়া”দব হয়,গু”ন্ডা হয়। স্বভাবে হয় বেপরোয়া। কথাগুলো যেন হারে হারে ফলছে। প্রহর এর জ্বলজ্যান্ত উদাহরণ। একটুখানি উঁকি দিয়ে দুই দেহের মধ্যবর্তী সামান্য, অত্যন্ত সামান্য যে ফাঁক ছিল?সেটাও নিশাত দুরুদুরু বুক নিয়ে এগিয়ে গিয়ে নিঃশেষ করে ফেলল। শরীরের উত্তাপে পায়ের নিচ জ্বলতে আরম্ভ করে। পিটপিট চাউনিতে নিজেকে আবিষ্কার করে প্রহরের বুকে। নিজের ভিতরকার অবস্থা বুঝতে অক্ষম ও। মন শুধু বলছে আজ প্রহর ভাইয়ের সান্নিধ্য অন্য রকম লাগছে ওর। অনুভূতিরা কেমন দলবদ্ধ হয়ে ছুটছে দিশেহারা,অজানা পথে।

” গান শুনবি নিশু?”
অবিশ্বাস্য চাহনি নিক্ষেপ করল নিশাত। তবে সেই চাহনি অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। এত বছরে সে শুনেই গেল লোকটা ভালো গান গাইতে পারে কিন্তু কখনও সেই পা”গ”ল করা সুর ওর শোনবার সৌভাগ্য হয় নি। যেই মেজাজওয়ালা মানুষ, বলতেও ভ”য় করে। আজ সুযোগ টা লুফে নিল। তড়িঘড়ি করে প্রতুত্তর করল,

” হু। ”
” দুধে আলতা গায়ে বরণ
রূপ যে কাঁচা সোনা
আঁচল দিয়া ঢাইকা রাখো
চোখ যেন পড়ে না
আমি প্রথম দেখে পাগল হইলাম
মন তো আর মানে না
কাছে আইসো,আইসো রে বন্ধু
প্রেমের কারণে,,, ”

নিচুস্বরে গানটা গাইতে গাইতে সরে গেল প্রহর। অকস্মাৎ বলে উঠল,
“নিজেকে কিভাবে উদ্ধার করবি ভাবতে থাক তিলবতী। ”

নিশাত নিস্তব্ধ প্রহরে ডুবে গেল। দেখল সিগারেট জ্বালিয়ে পুকুর পাড় দিয়ে সোজা হেঁটে প্রহরের চলে যাওয়া। ওদের বাড়িটার চারদিকে কোনো প্রাচীর নেই। সবদিক থেকে আসা যায়। ওই তো অদূরে প্রহরের গাড়ির আলো দেখা যাচ্ছে। কিন্তু ওর মনটা এখনও সেই গানে নিমজ্জিত। কপোলদ্বয়ে তাপ অনুভব করছে।
প্যাকেট টা হাতে নিয়ে সলজ্জে সবার দৃষ্টি লুকিয়ে ঘরে আসল। ভাগ্যিস আজ রাত্রি বেলায় কেউ পুকুর পাড়ে যায় নি। নয়ত অন্য সময় সৌরভ যায়। যদি প্রহরকে এ বাড়িতে কেউ দেখত তাহলে তুমুলযুদ্ধ লেগে যেত নিশ্চিত। যুদ্ধে রাজা হতেন বাবা। গ্রামে রটে যেত। যুদ্ধের নাম হতো মামা-ভাগ্নে যুদ্ধ।

কিন্তু একটা প্যাকেট দিতে নিজে আসল প্রহর ভাই। কি এমন আছে এতে?ঝটপট প্যাকেট টা খুলল নিশাত। একটা সাদা স্কার্ফ বেরিয়ে এলো,সাথে একটা অয়েন্টমেন্ট। সঙ্গে সঙ্গে মোবাইলে বার্তার শব্দ আসে।
” অয়েন্টমেন্ট লাগিয়ে নিস হাতে লাল হওয়া জায়গাটায়। তোকে একটু স্পর্শ করলে যদি এ দশা হয় আমি বাকিসব করব কিভাবে বল তো?কে বলল তোকে এমন সুন্দর হতে?আমি না থাকায় সুযোগে কি কি মেখে ফর্সা হয়েছিস কে জানে,আগে তো পাতিলের তলার মতো কালো ছিলি। ”

অধর জোড়া আলগা করে অপলক, অনিমেষ তাকিয়ে রইল নিশাত মোবাইলর স্ক্রিনে। কথার ধরনে বুঝতে বেগ পোহাতে হলো না এটা প্রহরের মেসেজ। ও কোনদিন কালো ছিল?ফর্সা হয়েই বা কি দো”ষ করল?আর বাকিসব করলে, এর দ্বারা কি বুঝিয়েছে?এমনিতেই ছোট মাথা, ছোট বয়সে এতকিছুর মানে কেমনে বুঝবে ও?স্কার্ফ আর অয়েন্টমেন্ট টা গুছিয়ে সকালের চিঠিটা বের করল। হিসেব কষল। মাথামোটা বলে আজ কত কষ্ট করতে হচ্ছে ওর। কেন যেন মন বলছে চিঠিটা প্রহর ভাই দিয়েছে। উনি ছাড়া ওকে এভাবে কেউ বলে না,থ্রে”””ট দেয় না। কিন্তু পেটের ওপর আসল কিভাবে?মা বলেছিল সকালে গ্রামের নামকরা বাবুর্চি মকবুল মিয়ার ছোট মেয়ে টুনি আসছিল। কেমন রহস্য রহস্য গন্ধ বের হচ্ছে। এখন টুনি হলো এ রহস্যের সমাধান।
———————

প্রত্যয় প্রভাতের সূচনা হতে না হতেই বেরিয়ে পড়ল গাড়ি নিয়ে। আজ যে করেই হোক মৃন্ময়ীকে ধরতে হবে। গত চারদিন ধরে তাকে দেখতে পাচ্ছে না। বাড়ির কাছেও উঁকি ঝুঁকি দিয়ে এসে লাভ হয় নি। এ মেয়ের জন্য সারাদিন রাত হন্য হয়ে ছুটে বেড়ায় তবুও কি ওর ভালোবাসা টা কখনও বুঝবে না?গতকালও চাচার কাছে ধম””ক শুনেছে। আজকাল রাজনীতিতে সময় দিচ্ছে না, সারাক্ষণ একটা মেয়ে মেয়ে করে জীবন ন”ষ্ট করে ফেলছে। কিন্তু সে কাউকেই বুঝাতে পারছে না মেয়েটাকে না পেলে ওর জীবন ন””ষ্ট হয়ে যাবে। ঢিলেঢালা গেঞ্জি টা পড়ে রাস্তার মোড়ে এসে গাড়িতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে রইল। অপেক্ষা মৃন্ময়ীর।

প্রতিদিন ঠিক ৬ টায় এই পথে হাঁটে মৃন্ময়ী। গন্তব্য কোথাও না। তবে দুই বান্ধবীকে সাথে নিয়ে ভোর লগ্নে হাঁটতে বেশ ভালো লাগে ওর। তিমু ও কাজলের সাথে মাঝে মাঝে দু একটা কথা বলছে। এরা দু’জন ওদেরই বাড়িতে ভাড়াটে হিসেবে থাকে। পরিচয় ভার্সিটিতে। দু’জনের বাড়ি কিশোরগঞ্জ।
সময়টা শরৎকাল। চারদিকে কুয়াশা। শীতের আগমন ঘটবে ঘটবে ভাব ধরনীতলে। প্রকৃতির নির্জীব রূপ দু’টো সময়ে দেখে মৃন্ময়ী। এক দিনের প্রাতঃকালে,আরেক শীতকালে। কথা বলতে বলতে মোড়ে এসে তিন জোড়া পা থমকে যায়। অল্পস্বল্প, আবছা কুয়াশায় উষ্কখুষ্ক চুল, ঘুমে ফোলা ফোলা চোখ নিয়ে,অগোছালো হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা প্রত্যয়কে দেখে বিরক্তিতে পাশ কাটিয়ে যেতে চাইল মৃন্ময়ী। কিন্তু তার আগেই সম্মুখে এসে পথ আগলে দাঁড়িয়ে যায় প্রত্যয়। কন্ঠে তীব্র রাগের ছোঁয়া,

” কোথায় ছিলে তুমি?ভার্সিটিতে আসছো না কেন?”
মৃন্ময়ী ওর দৃষ্টিতে চক্ষু নিবদ্ধ করল। সেকেন্ড, মিনিট কেটে গেল। অথচ চাহনি একটুও টলে নি। কঠিন গলায় জবাব দিল,” আপনার জন্য। পথ ছাড়ুন। ”

” এমন করছো কেন?”– কিছুটা নরম করল প্রত্যয় কন্ঠস্বর।
তাতে আশকারা পেল মৃন্ময়ী। দ্বিগুণ জ্বলে উঠল। বলল,” কি করছি?ভার্সিটির বড় ভাই বলে যথাযথ সম্মান পাচ্ছেন। আমার পথ ছাড়ুন। লজ্জা করে না একটা মেয়ের এত অবহেলা সত্ত্বেও পিছু পড়ে থাকতে?”

” না করে না। “– শক্ত জবাব প্রত্যয়ের।
মৃন্ময়ী ছাড় দিল না। একটুও ভয় পায় না ও। মুখের ওপর বলে বসল,” বেহায়া। ”
প্রত্যয় তিমু ও কাজলের দিকে এক পল চেয়ে ফের দৃষ্টি রাখল মৃন্ময়ীর চেহারায়। সানন্দে বলল,” বেহায়া তুমি বানাচ্ছ। আমার হয়ে যাও সকল বেহায়াপনা ছেড়ে দেবো। ”

গলা খাদে নামিয়ে পুনর্বার বলে, “তুমি চাইলে বিয়ের পর বেহায়াপনার জন্য নোবেলপ্রাপ্ত হতে রাজি। তবুও তোমাকে চাই মৃন্ময়ী। ”

#চলবে,,!
(ভুল- ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here