প্রেমের উষ্ণ ধোঁয়াতে পর্ব -০৬

#প্রেমের_উষ্ণ_ধোঁয়াতে
#লেখিকাঃ আসরিফা সুলতানা জেবা
#পর্ব___৬

নিশাতের গ্রামের এক পরিচিত কুসুম আপা বলেছেন মনের মধ্যে যন্ত্রণা হইলে কি করবি নিশু জানস?নিশাত তখন ক্লাস সেভেনে পড়ে। বিভিন্ন বিষয়ে প্রবল কৌতূহল ওর। কুসুম আপা কথাটার সমাপ্তি টানা মাত্র জিজ্ঞেস করল, ‘ কি করব আপা?’

কুসুম আপা হাতের পান টা মুখে পুড়ে বলল,’ মিষ্টি পান খাবি সাথে খাবি রতন জর্দা। তোর আশপাশের সব ঘুরব কিন্তু মনের মধ্যে যন্ত্রণা ঘুরব না। ‘

নিশাত আগ্রহী হয়ে ওঠে। চোখে বিস্ময়। অবিশ্বাস্য চক্ষে তাকিয়ে ফের প্রশ্ন করে, ‘ সত্যি আপা?’

কলেজ পড়ুয়া কুসুম আপা গ্রামের বড় আমগাছ টায় টানানো দুলুনিতে বসে সায় জানিয়ে উত্তর দেয়,’ এক্কেবারে সত্য। আমি লুকিয়ে লুকিয়ে খাই। বাড়িতে খেলে আম্মা দেখে ফেলব। তুই আবার বলে দিস না। ‘

কুসুম আপার বিয়ে হয়ে গিয়েছে শহরে। জামাই পেশায় প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষক। নিশাত এখনও তাঁর বলা কথাগুলো ভুলল না। এই দুই এক বছরে ও আড়ালে তিন বার মিষ্টি পান খেয়েছে। মা যদি পান খেতে দেখে তাহলে রক্ষে নেই। তবে ওর এখনো রতন জর্দা টা টেস্ট করা হলো না। শুনেছে এটা দিয়ে পান খেলে নিজেকে মাতাল মাতাল লাগে। কিন্তু আজ যে ওর কষ্টের পরিমাণ গভীর। প্রত্যাশা করে ব্যর্থ হলে সেদিন কষ্টের সমুদ্র সৃষ্ট হয় অন্তর্দেশে। অবর্ণনীয় কষ্টে কাটে প্রতিটা মুহুর্ত। কত সুন্দর প্ল্যান করল কাশবনে যাওয়ার সবই বিফলে। এখন পান না হলে চলবেই না। সম্ভবপর হলে আজ রতন জর্দা সমেত পান খাবে বলে ঠিক করল। অথচ কে জানত বাজারের মুখে এসে এমন আ ত ঙ্কগ্রস্ত হতে হবে?

ওই তো সুস্পষ্ট চক্ষে ভাসছে শ্বেত পাঞ্জাবি পরিধান করা প্রহরকে সৌরভের দিকে এগিয়ে যেতে। ঠোঁটের কোণে সুপ্ত হাসি। এটা চোখে পড়তেই দুই পা মাটিতে আঁটকে গেল নিশাতের। নড়ছে না এক বিন্দুও। দৃষ্টি অনঢ়,ভয়া””র্ত। প্রহর ও সৌরভ মুখোমুখি মানে বিশাল কান্ড। বছর চারেক পূর্বেকার ঘটনা। আলতা ফুপুর একটা বিষয় নিয়ে দু’জনে রাগা”””রাগি থেকে মা”রপিটের পর্যায়ে চলে যায়। সেই বেলায় প্রহরের শক্ত,পেশিবহুল হাতের ঘু”ষি”তে সৌরভের অধর কেটে তরল লাল বর্ণ বেরিয়ে আসে। মনে মনে প্রচন্ড ক্ষিপ্ত হয় রফিক আজম। প্রহরের সঙ্গে তিনি কথা পর্যন্ত বলেন না। সেইবারও এক খানা শব্দ ব্যয় না করে নিশ্চুপে সৌরভকে নিয়ে উপজেলার স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স মুখী হন। নিশাত ভেবে পায় না ওর বাবার এত ধৈর্য্য কেন?কিভাবে পারে হুলস্থূল কান্ডগুলোও চুপচাপ হজম করতে?রা”গের ছিটেফোঁটারও বহিঃপ্রকাশ হয় না ভুলবশত।

টুনির হাতে টাকা টা ধরিয়ে দিয়ে শঙ্কিত কন্ঠে আওড়ালো নিশাত,
‘ তুই পান আনতে পারবি?তোর জন্য চকলেটও আনিস। ‘

চকলেটের কথা কর্ণধার হতেই টুনি খুশিতে লাফিয়ে উঠল। সরব করে বলল,’ পারমু নিশু আপা। তুমি দাঁড়াও। ‘

বলতে দেরি দৌড়ে বাজারের ভিতরে চলে যেতে এক মিনিটের বেশি নষ্ট করল না টুনি। নিশাত নিজের জায়গা ছেড়ে বাজার থেকে দক্ষিণের তেঁতুল গাছের নিচে এসে দাঁড়িয়ে রইল। এটা ওদের বাড়ি যাওয়ার পথে পড়ে। বুকটা ঢিপঢিপ করছে। অবিন্যস্ত লাগছে সবকিছু। যদি কোনো হট্টগোল বেঁধে যায়?ভাই ও প্রহর ভাই আবার মা””রামা””রি করলে?ভাবতে ভাবতে মস্তিষ্কের সমস্ত ধারণ শক্তি যেন কমে আসছে। এতটুকু মাথায় কত বড় বড় চিন্তার সমাহার! বিপন্ন চোখে ডান দিকে তাকাতেই তড়াক করে লাফিয়ে উঠল হৃদপিণ্ড। স্পন্দন লাগামহীন। প্রহর আসছে, পেছনে টুনি। হাতে ওর মোটামুটি বড় একটা কাগজের পলিথিন। উজ্জ্বল শ্যামবর্ণ লোকটা যতই আসছে সন্নিকটে ততই রূদ্ধশ্বাস অবস্থা নিশাতের। ভিতর হাসফাস করছে। পানি পান করতে পারলে শুষ্ক স্বরনালীতে শান্তি মিলত।

প্রহর তীক্ষ্ন নজরে নিশাতকে দেখল। মেয়েটার চেহারা রক্তশূণ্য। অধর জোড়া শুকিয়ে ফেটে গেছে। নত বদনে মৃত্তিকায় চেয়ে স্থির।

‘ তুই পান খাস?’

কঠোর, তেজী কন্ঠের প্রশ্নে অঙ্গ প্রত্যঙ্গে কাঁপুনি ছুটে গেল নিশাতের। মাথা তুলতে হিমশিম খাচ্ছে। আজকে হয়তো রেহাই মিলবে না। প্রহর ভাই কীভাবে জানল ও পান খায়?নিশ্চয়ই এর পশ্চাতে টুনির হাত। অস্থিরমাখা কন্ঠে জবাব দিতে সক্ষম হলো না। স্রেফ মাথা উপর নিচ করল।

নিমেষেই একটা তপ্ত বাক্য শ্রবণনালিতে প্রবেশ করে,’ মাথা তোল। ‘

কার সাধ্য আছে এমন স্বর, আদেশ অবজ্ঞা করার?নিশাত অনতিবিলম্বে সোজা হয়ে দাঁড়ায়। ভীতু আখিঁদ্বয় মেলে ধরে সামনের যুবকের দিক।

প্রহর মোবাইল বের করে কাকে যেন বলে,’ একটা চেয়ার নিয়ে আয় বাজারের যাওয়ার পথের তেঁতুল গাছ টার কাছে। ‘

নিশাত উঁকি দিয়ে প্রহরের পেছনে ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকা টুনি কে দেখতে চায়। তখনই প্রহর বলে,’ তেঁতুল গাছের নিচে বস। ‘

‘ কেন? ‘– নরম কন্ঠ ভেদ করে প্রশ্নাত্মক শব্দ বের হয়ে আসে। অবাক নয়নে চেয়ে আছে নিশাত।

প্রহর রেগেমেগে উঠল। হু ম কিধা”মকি দিল,’ বসতে বলেছি বস। নয়তো টুনির সামনেই তোকে কানে ধরিয়ে দাঁড় করিয়ে রাখব। এই পুচকি মেয়েটার সামনে তোর এক গ্লাস পানির সমান মান সম্মান খোয়াতে চাস?’

নিশাত ঠাহর করতে পারছে আসন্ন বিপদ। ভেজা গলায় বলল,

‘ এই গাছে পে”ত্নী আছে শুনেছি। বসলে যদি ধরে?’

‘ তোর থেকে বড় পে”ত্নী? ‘

পে”ত্নী!প্রহর ভাই ওকে পে”ত্নী বলল?ও ভয় পাচ্ছে সৌরভের,অন্য লোকজনের। আর প্রহর সৌরভের সাথে কি কথা বলল?এত তাড়াতাড়ি চলেও আসল!বিস্ময়ের অন্ত নেই। একটা ছেলে কাঠের একটা চেয়ার নিয়ে দ্রুত গতিতে পা চালিয়ে এদিকে আসছে। ওকে দেখেই দাঁত কেলাল। ছেলেটাকে চিনে ও। এ গ্রামেরই। চেয়ারে বসে প্রহর ধা””রালো গলায় ছেলেটার উদ্দেশ্যে বলে,

‘ স্যরি বল। নিজের গালে নিজের হাতে কষিয়ে দুইটা থা–প্পড় মা**রবি। যেন আমি তোর গাল লাল দেখতে পাই। জলদি কর। ‘

ছেলেটা হকচকালো। সেই সঙ্গে নিশাতও। করুণ কন্ঠস্বর শোনা গেল,’ ভাই,’

প্রহর সটান হয়ে বসল। বলল,’ অন্যায় করেছিস। অ””পরাধ কি জানতে চাস না৷ আমার হাত কিন্তু এখনও তোর ধারে কাছে যায় নি। ‘

ছেলেটা অচিরেই নিজের কপোল রক্তাভ করে ফেলে। টুনি হেসে ওঠে খিলখিল করে। পোকা খাওয়া দাঁত গুলো দেখা যাচ্ছে ওর। নিশাতও মিটমিটিয়ে হাসল। ছেলেটা লজ্জা পেল খুব।

‘ শোন,তুই বাজারের মোড়ে থাক আর সাঈদকে এই রাস্তার মোড়ে থাকতে বল। কেউ আসতে নিলে জানাবি। ‘

বাধ্য শিষ্যের ন্যায় সম্মতি জানিয়ে চলে যায় ছেলেটা। প্রহর চোখ গরম করে তাকাল নিশাতের দিক। অচিরেই গাছের গা ঘেঁষে ঘাসের ওপর বসে পড়ল মেয়েটা। দৃষ্টি প্রশ্নবিদ্ধ। টুনি কে ইশারা মাত্র নিশাতের কোলের মধ্যিখানে কাগজের পলিথিন টা রাখল। প্রহর ওকে বলে,’ এবার তুই বাড়িতে যা। ‘
টুনিও হেলেদুলে চলে যায় নিশাতকে বাঘের খাঁচায় রেখে। প্রহরের ঝাঁঝালো স্বর,’ প্যাকেট টা খোল। ‘

প্যাকেট খুলে কপাল কুঁচকে এলো নিশাতের। অনেকগুলো পান বানিয়ে রাখা।

‘ এগুলো?’

‘ খাবি। ‘– নিরলস জবাব।

‘ এত্তগুলা? ‘

‘ এখনই খাবি। না খেলে তোর হাল কি করব জানিস?’

নিশাত নির্বোধ হলো। মাথা নাড়াল। প্রহর রাগান্বিত গলায় বলে ওঠে,’ তোর দেহ লাল করে ফেলব। ‘

‘ কি?’

পাল্টা প্রশ্নে বিরক্তবোধ হয় প্রহরের। গম্ভীরতা এঁটে বলে,’ তুই দুধের বাচ্চা এসব বুঝলে আমার আর এত অস্থিরতা নিয়ে বাঁচা লাগত না। পান খাওয়া শুরু কর। ‘

নিশাতের পানের প্রতি রুচি উঠে গেল। কুসুম আপাকে মনে মনে একশত গালা–*গাল দিতে ইচ্ছে করল। না পান খাওয়ার জন্য উদগ্রীব হতো আর না পে**ত্নীর মতো তেঁতুল তলায় বসে পান খাওয়া লাগত। মিষ্টি পান টাও তেঁতো লাগছে। আক্কেল হলে আর কোনোদিনও পান খাবে না৷ কখনও না। প্রহর আজ ওকে পান খাওয়ার শাস্তি দিয়ে দিল। ত্যাড়া জাতের লোক। সোজাসাপ্টা বলবে না পান খাবি না। ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে পানের ওপর থেকে আকর্ষণ কেড়ে নিল,শা”””স্তিও দিল।
—————————-

পান খেয়ে দাঁত ব্যথায় অতিষ্ঠ নিশাত। বাড়ির আঙিনা থেকে শোরগোলের আওয়াজ আসছে। বালিশে মুখ গুঁজে প্রহর গুণছিল প্রহর কবে এ গ্রাম ছেড়ে আবার শহর যাবে। কিন্তু তা-ও ঠিকঠাক পারছে না। নিচে নেমে দৌড়ে আঙিনায় আসতেই নয়নযুগলে চমক। মেজো কাকি পিংকি কে মা”রছেন। রোকেয়া থামাতে চেষ্টা করছেন কিন্তু পারছেন না। বাড়িতে এ সময় কোনো পুরুষ লোকও থাকেন না। পিংকি হাউমাউ করে কেঁদে যাচ্ছে। ব্যথায় ককিয়ে ওঠছে। থেমে গিয়ে চোখ বুলিয়ে মোটা একটা লাঠি এনে আ””ঘাত করতে উদ্যত হলো পিংকির মা। নিশাতের চক্ষু কোল ছাপিয়ে জল নেমে এলো। কারো কষ্ট সহ্য করতে পারে না ও। থামাতে গেল কাকি কে। তখনই ভুলবশত লাঠির বারি গিয়ে পড়ল ওর গলায়। সেকেন্ডে চামড়া ছিড়ে বেরিয়ে আসল লালচে রক্ত।

#চলবে,,,!
(ভুল-ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here