প্রেমের খেয়া পর্ব ১৭

#প্রেমের_খেয়া
#লেখিকা_জান্নাতুল_মীর
#পর্ব_১৭

আনমনেই হাটছে মায়া কলেজ ক্যাম্পাসে। ক্লাসে মন বসবে না আজ তাই মায়া বাহিরে এদিক ওদিক হাটছে। ফাইজা সারা ক্যাম্পাস মায়াকে খুঁজেছে। কিন্তু পায়নি!
বারান্দায় দাঁড়িয়ে নিচে তাকাতেই দেখল মায়া বসে আছে রাউন্ড ট্রির নিচে। ফাইজা মায়াকে দেখে হাসল।

–কি ব্যাপার এখানে বসে আছিস যে?

আনমনেই বসে ছিল মায়া। ফাইজার কন্ঠস্বর কানে আসতেই পেছনে ফিরে তাকালো। মায়ার চেহারা দেখে ফাইজার মুখের হাসি উধাও হয়ে গেল। মায়ার পাশে এসে বসলো ফাইজা।

–একিই!চেহারার এই হাল কেন তোর? কি হয়েছে?

— বাবা আমার বিয়ে ঠিক করেছে ফাইজা। মাথা নিচু করে বলল মায়া।

–কি বলছিস? এখন কি করবি? বিয়ে করে নিবি?

–এছাড়া আর উপায়ও নেই।

–কিন্তু এত তাড়াতাড়ি বিয়ে?আর তাছাড়া ছেলেকে দেখেছিস তুই?

–না দেখিনি। আমি দেখতেও চাই না।

–দেখ। বিয়েতে যেহেতু মত দিয়েছিস তাহলে ছেলের সাথেও দেখা করে নে। ছেলে কেমন? নাহলে পরে কোনো দুর্ঘটনা হলে।

–ধুর, বিয়েই হয়ে যাচ্ছে আবার দুর্ঘটনা!! তাচ্ছিল্যের সুরে হাসলো মায়া।

ফাইজা আর কথা বাড়ালো না। মায়ার মন মেজাজ যে খুব খারাপ তা আন্দাজ করতে পেরে চুপ করে রইল ফাইজা।

সেলিনা মালিক আর সামাদ মালিক দুজনেই আমীর আর শেহনাজের সাথে বসে বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক করে নিল। তিন দিন পর বিয়ে। তেমন কোনো অনুষ্ঠান হবে না। ঘরোয়া ভাবেই বিয়েটা সম্পন্ন করতে চান মালিক পরিবার। বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক হতেই মিষ্টি এনে সামনে রাখলো শেহনাজ।

–মিষ্টি মুখ করুন।

–হায় আল্লাহ!এদিকে আমি ডায়বেটিস এর রোগী।

–আচ্ছা মিষ্টি খেতে হবে না বাকি খাবার খান। হেসে বলল শেহনাজ।
সেলিনা মালিক হাসলো। চারপাশ দেখে একটু চুপসে গেল,

–ভাবীজান মেয়ে কে দেখছি না। বাড়ি নেই নাকি?

— নেই ভাবী। কলেজ গেছে।
মায়ার কথা বলতেই শেহনাজের মন খারাপ হয়ে গেল

–মেয়ে রাজি তো?

–হ্যা রাজি। আমার মেয়ে আমাদের মুখের উপর কথা বলে না।

— যাক একটা লক্ষির পা তাহলে আমার ঘরে পড়বে।

সেলিনা মালিকের কথা শুনে হাসল শেহনাজ।

পুরো মালিক বাড়ি সিমি দেখতে থাকে। খুবই সুন্দর বাড়িটি। সিমির মনে ধরেছে। কিন্তু সারাজীবন থাকার ইচ্ছে সে পোষণ করে না। শেহেরজাদ জানতে পারলে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে ভেবেই দ্বীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল।
সামরানের রুমের সামনে এসে দাঁড়িয়ে গেল সিমি। দরজা ঠেলে ভেতরে উঁকি দিল। নাহ!সামরান নেই। চারপাশ একবার দেখে বেরিয়ে আসে সিমি। সামরানের রুম থেকে বের হতেই শেহেরজাদের মুখোমুখি হয় সিমি। শেহেরজাদ কে দেখে জোর করে মুখে হাসির রেখা টেনে নিল।

–আপপনি এখানে?

–কি দেখছিলে?

–না বাড়ি দেখছিলাম। চারপাশে তাকিয়ে বলে সিমি।

–ওহহ! পছন্দ হয়েছে?

–হ্যা! হওয়ার মতই।

–ভাই বাড়ি নেই।

সামরানের কথা শুনে সিমি শেহেরজাদের দিকে তাকালো।

–মিস করছেন?

— নাহ!ওর আর আমার মাঝে দাঁড়ানো দেওয়াল কখনোই ভাঙ্গবে না। যতই ভেঙ্গে দিতে চাই তা আরো মজবুত হয়ে যায়।

— সরি!!

–তুমি কেন সরি বলছো?

–কেন জানিনা মনে হলো বলা উচিৎ। আম্মা, আব্বা ওনার বিয়ের দিনক্ষণ ঠিক করতে গেছেন।

— হ্যা!তুমিও যেতে।

— না পরে যাবো।

–ওহহ।

–ভাইয়া কি বাড়ি আর আসবেন না?

–না এসে যাবে কই? এসে যাবে।

–ওহহ!!

ড্রাইভিং করছিল সামরান। হঠাৎ ফোন বেজে উঠলো। ফোনের দিকে তাকাতেই দেখলো বড় অক্ষরে “maa” লিখা। মৃদু হেসে রিসিভ করলো সামরান।

— মা!!

–তুমি কোথায়?

–এইতো রাস্তায় আছি!

–ড্রাইভ করছো?

–হুম।

–গাড়ি থামাও!

–কেন মা?

–আমি বলেছি তাই।

সামরান গাড়ি থামিয়ে দিল।

–বলো!

–তুমি পাত্রীর সাথে দেখা করতে চেয়েছিলে না?

–হ্যা..

— আমি তোমাকে ছবি পাঠিয়েছি দেখো।

–আমি ছবি দেখবো বলিনি।

–আমার মনে হচ্ছে ছবি দেখার পর আর তুমি দেখতে চাইবে না। তাই জলদি ছবি দেখে জানাও কেমন হয়েছে?

সামরান কিছু বলার আগেই সেলিনা মালিক ফোন কেটে দিল। ফোন হাতে নিয়ে হোয়াটসঅ্যাপে যেতেই দেখলো ছবি এসেছে। সামরান ক্লিক করলো। ছবি দেখে সামরান বিস্ময়ের উচ্চ সীমায় পৌছে গেল। জুম করে দেখছে ছবিটি। সেলিনা মালিক আবারও ফোন করেন। সামরান রিসিভ করলো।

–কেমন লেগেছে?

–তোমার হাত এত দূর কিভাবে গেল? সিটে মাথা এলিয়ে দিয়ে বলে সামরান।

–তোমার মা তো? আর তাছাড়া ছেলের ভালো মন্দ আমারই দেখতে হবে।

–হুম। বলেই সামরান ফোন রেখে দিল।

–এই ভালোটা যদি ৪বছর আগে দেখতে আজ আমি এমন হতাম না মা। আমি ইচ্ছে করে এমন হইনি। আমার চারপাশের মানুষ আমাকে হতে বাধ্য করেছে। আমি আগুন ছিলাম না। আমিতো পানির মত ছিলাম। তবে কেন যন্ত্রণাদায়ক আগুনে পরিণত হলাম আমি? কেউ জানতে চায় নি। ক’জন দেখে ভেতরের দহন?
গাড়ি স্টার্ট দিতে যাবে এমন সময় দেখল মায়া রাস্তার ওপারে দাঁড়িয়ে আছে। সামরান গাড়ি ঘুরিয়ে মায়ার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। গাড়ির গ্লাস নামিয়ে মায়ার দিকে তাকালো,

–উঠে আসুন…

সামরান কে দেখে মায়া চমকে উঠল,

–এখন?

— অবশ্যই।

মায়া আর কিছু না বলে গাড়িতে উঠে বসলো। গাড়িতে বসে সামরানের দিকে তাকালো,

–হাত কেমন আছে?

–হাত কে জিজ্ঞেস করুন। সামনে তাকিয়ে বলে সামরান।

মায়া ভ্রু কুঁচকে নিল,

-আমি হাতের মালিককে জিজ্ঞেস করেছি।

–হাতের মালিক বলতে আগ্রহী না।

মায়া মুখ ফিরিয়ে নিল। সামরান মৃদু হেসে বলল,

— এমন রাগ, জেদ দেখালে স্বামীর সংসার বেশিদিন টিকবে না।

মায়া তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো,

–না টিকলো।

–কি সর্বনাশী কথা।

–রসিকতাও জানেন দেখছি।

–আমি রসিক মানুষ।

–আজ জেনেছি।

–বাই দ্যা ওয়ে, সামনে আমার বিয়ে আসবেন কিন্তু!

মায়া সামরানের দিকে আবারো তাকালো,

–আপনারও বিয়ে?

— কেন বিয়ে শুধু আপনি করতে পারবেন? আর আমরা করলে দোষ?

–আমি এটা কখন বললাম? ভ্রু জোড়া কুঁচকে এলো মায়ার

— আমি কখন বললাম আপনি বলেছেন। মায়া এক রাশ রাগ নিয়ে মুখ ফিরিয়ে নিল। একটা লোক এত ত্যাড়া কথা কিভাবে বলতে পারে? একটা সোজা কথা সোজা ভাবে কেন নিতে পারে না। এমন লোকের সাথে কোনো মেয়েই থাকবে না। মায়া সামরানের দিকে তাকিয়ে দাতেঁ দাতঁ চেপে হাসলো,

–এই যে একটু আগে বললেন স্বামীর সংসার টিকবে না। মানলাম। কিন্তু আপনি জানেন কি কোনো মেয়ে এমন ঘাড়ত্যাড়া লোকের সাথে থাকে না। দুদিনেই ছেড়ে চলে যাবে। সামরান সাথে সাথে ব্রেক কষলো। মায়াকে একটানে নিজের কাছাকাছি নিয়ে এল

— মেরে ফেলবো। আমাকে ছেড়ে যাওয়ার কথা মাথায় আনলে তাকে আমি খুন করে দেব। না থাকবে প্রাণ না বলবে ছেড়ে যাওয়ার কথা।

আচমকা এমন হওয়াই মায়া ভড়কে গেল। দৃষ্টি নত করে মৃদুস্বরে বলল,

–আপনার হাত খুব শক্ত!আমি ব্যাথা পাচ্ছি। সামরান সাথে সাথে ছেড়ে দিল মায়াকে। সিটে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে,

–সে আমাকে অনেক ভালোবাসবে। তার ভালোবাসা পেতে যা যা দরকার তা সব আমি করবো। বিনিময়ে সে শুধু আমাকে ভালোবাসবে। তার কাজ শুধু আমাকে ভালোবাসা। আমাকে ভালো না বেসে সে থাকতেই পারবে না। সে বাধ্য হবে আমার মায়ায় পড়তে। আর যদি পড়ে যায় তাহলে তো হয়েই গেল..বলেই মায়ার দিকে তাকালো সামরান। সামরান তাকাতেই মায়া দৃষ্টি সরিয়ে নিল।

দিনের আলো এখনো মুর্ছা যায়নি। রাতের অন্ধকার নামতে এখনো ঢের বাকি। নিজের রুমে বসে আছে সামরান। দরজার ঠকঠক আওয়াজ শুনে সেদিকে না তাকিয়েই বলল,

–ইয়েস!!

–ভাইয়া আপনার কফি।

কন্ঠস্বরটি কানে পৌঁছাতেই সামরান চট জলদি পেছনে ফিরে তাকালো। কফির ট্রে হাতে দাঁড়িয়ে আছে সিমি। সিমিকে দেখে ভ্রু কুঁচকালো সামরান। সিমি এগিয়ে গিয়ে টেবিলে ট্রে রাখলো।

–আসুন কফি খাবেন। আমি খুব ভালো কফি বানাই।

সামরান সিমির দিকে তাকিয়ে রইলো। সামরান কে তাকিয়ে থাকতে দেখে সিমি আবারো ডাকল,

–কি হলো আসুন? দেখুন কেমন হয়েছে।

সামরান এসে একটি সোফায় বসে পড়ে। সিমি মুখোমুখি অন্য সোফায়। কফির মগ সামরানের সামনে রেখে মৃদু হাসলো সিমি। সামরান কফির মগ নিয়ে চুমুক দিল।

–ভাইয়া!!

–হুম!

— এখনো রেগে আছেন?

— আমি রেগে নেই।

— আমি জানি আপনি রেগে আছেন।

পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালো সামরান।

–ভাইয়া! আম’সরি।

–তুমি কেন সরি বলছো? তোমার দোষ নেই।

— যদি তাই হয় তাহলে কেন আপনি আমাদের উপর রেগে আছেন?

–আমার রাগ নেই। একটা কথা শুনেছি আমি যে, উপরওয়ালা যা করেন ভালোর জন্যই করেন। ভালোটা একটু দেরীতেই হয়েছে! তবে হয়েছে। আর আমি রেগে নেই। যা হয়েছে তা আমি মেনে নিয়েছি। ভাগ্য কে বদলাতে পারে। শুধু মাঝখানে কয়েকটা বছর চাইলেও আমি মুছে দিতে পারবো না। পারবো না ৪টা বছর মুছে আবারো আগের মত হতে। সব বদলে গেছে। কেটে গেছে অনেকটা সময়।

–ভাইয়া! শেহের কে আর দূরে সরিয়ে রাখবেন না। ও আপনার এমন ব্যবহার দেখে অনেক কষ্ট পাচ্ছে।

সামরান বিগলিত হাসি হাসলো,

–আমার নামে বিচার দিয়েছে?

— না! তবে অভিমান করেছে অনেক ভাইয়া।

— তোমার ভাইয়া ডাকের জন্য ওকে মাফ করলাম নাহলে কিন্তু করতাম না। বলেই কফি মগ হাতে নিয়ে উঠে দাড়ালো সামরান।

— যাক আমি একটা ভাই পেলাম।
সামরান হাসলো,

–কোথায় ও?

— রুমে আছে।

হালকা হাসি হেসে সামরান বাহিরে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো। সিমি পেছন থেকে ডেকে উঠে,

— ভাইয়া!!

–হুম”

-কংগ্রেচুলেশন।

সামরান হাসল,

–থ্যাংক ইউ।

সামরানের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো সিমি।

–এমন মানুষকে ছেড়ে তুই শান্তিতে আছিস? কিভাবে পারলি? কি নেই এই মানুষটার? তোর একটা কাজের জন্য কত কিছু বদলে গেল। আমার ভিত নড়ে গেল। অতীত বাদ! দোয়া করি মানুষটার জীবনে এমন কেউ আসুক যে আজীবন তাকে আগলে রাখবে। ছেড়ে যাবে না।

মায়া বসে বসে সামরানের স্কেচ আকঁছে। অর্ধেক একে রেখে দিল। অর্ধ চেহারার মানুষটির দিকে তাকিয়ে রইল মায়া। মুখে মুচকি হাসি, ভ্রু কুঁচকানো,তীক্ষ্ণ দৃষ্টি। মায়া এক হাত বাড়িয়ে হাত বুলিয়ে দিল।

–এটা আপনার উপহার। বলেই উঠে দাড়ালো মায়া।

ফ্লোরে এক কর্ণারে বসে পড়লো মায়া। দুহাতে হাটু জড়িতে থুতনি ঠেকিয়ে একটি বড় দ্বীর্ঘশ্বাস নিল। চোখ থেকে টুপ করে কয়েক ফোটা জল গড়িয়ে পড়লো।

–আমি কেন শান্তি পাচ্ছি না। আমার এত কষ্ট কেন হচ্ছে। বিয়ে তো সবার হয় তাহলে আমারই কেন এমন হচ্ছে? আমি শান্তি চাই। আমি আর এই কষ্ট নিতে পারছি না। আর পারছিনা। আমি কি করে থাকবো তোমাদের ছেড়ে? তোমরা কেন একবার আমার কথা ভাবলে না? কান্নার গতি বাড়তে থাকে মায়ার। চারদেয়ালের ভেতরে বসে কাদঁতে থাকা মেয়েটির ভেতরটা কেউ দেখেনি। কতটা কষ্ট চেপে সে পরিবারের কথায় রাজি হয়েছে। দেখেনি অন্তঃকরণের রক্তক্ষরণ। যার হয়, সেই সয়!!

বিঃদ্রঃ নেক্সট, নাইস বাদ দিন🙂
গল্প নিয়ে গঠনমূলক মন্তব্য করুন। আপনাদের ছোট ছোট মন্তব্য আমার লেখার প্রতি আগ্রহ বাড়িয়ে দেয়….

চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here