প্রেমের খেয়া পর্ব ১৮

#প্রেমের_খেয়া
#লেখিকা_জান্নাতুল_মীর
#পর্ব_১৮

সামরান শেহেরজাদের রুমের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। দরজা হাত দিয়ে হালকা ঠেলে দিতেই খুলে গেল। ভেতরে প্রবেশ করতেই দেখল শেহেরজাদ টাওয়াল পরা অবস্থায় আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। সামরান পেছনে গিয়ে দাড়ালো। শেহেরজাদের পিঠে চোখ পড়তেই ভ্রু কুঁচকে এলো সামরানের। অজস্র নখের আঁচড়। শেহেরজাদ চুল হাত দিয়ে উল্টো ব্রাশ করতে করতে আয়নায় সামরানের দিকে নজর পড়ে। পেছনে ফিরে সামরানের দিকে তাকালো শেহেরজাদ। সামরান কফিতে চুমুক দিয়ে বলল,

–আমি ছাদে আছি।
কথা শেষ করেই সামরান চলে গেল। শেহেরজাদ জলদি একটা টি শার্ট আর ট্রাউজার পড়ে ছাদের উদ্দেশ্য হাটা দিল। ঘর থেকে বের হতেই সিমির সাথে প্রচন্ড জোরে ধাক্কা খেল শেহেরজাদ। ধাক্কা খেয়ে সিমি দেওয়ালের সাথে বারি খাওয়ার আগেই শেহেরজাদ একটানে নিজের সাথে মিশিয়ে নিল। তারপর দেয়ালের সাথে ঠেকিয়ে শক্ত হাতে কোমর চেপে ধরলো।

–দেখে শুনে চলতে পারো না।

–আমি খেয়াল ককরিনি! সরি!

–সরি মানে কি? সরি আবার কি হ্যা?

–কেউ এসে পড়বে প্লিজ!!

–ওহ হো! নিউ বাহানা। কেউ এসে পড়বে, কেউ দেখে নেবে এসব কি হ্যা।

–আপনি কোথায় যেন যাচ্ছিলেন।

–হ্যা,এসে ধরছি তোমাকে। বি রেডি। বলেই শেহেরজাদ চলে গেল। শেহেরজাদ চলে যেতেই সিমি বুকে থু থু দিয়ে বড় নিঃশ্বাস টেনে নিল।

–আপনি এসে আমাকে পাবেনই না। আমি আগে ভাগেই ঘুমিয়ে পড়বো। বলেই সিমি রুমের ভেতর চলে গেল।

ছাদে পা রাখতেই দেখলো কফির মগ টেবিলে পড়ে আছে। আর সামরান দুই পা সেন্টার টেবিলের উপরে রেখে সিগারেটে টান দিচ্ছে। সামরানকে এইভাবে দেখে অনেক অবাক হলো শেহেরজাদ। সামরান অন্যরকম ছিল। এই কেমন পরিবর্তন। ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে সামরানের সামনে বসে পড়ে শেহেরজাদ। সামরান হাতের সিগারেট ফেলে দুপাশে ঘাড় বাকিয়ে হেলান দিয়ে বসলো। শেহেরজাদ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলো।

–কেমন কাটলো লন্ডনে এত বছর?

–ভালোই!

–তা দেখেছি আমি।

শেহেরজাদ শান্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে সরস গলায় বলল,

–কিভাবে?

–আয়নার একবার নিজের পিঠ দেখবি। তারপর বুঝবি। বলেই অন্যদিকে তাকালো সামরান।

–তুই অনেক বদলে গেছিস।

–যতটা বদলালে মানুষ শয়তান উপাধি দেবে।

–ভাইইই!! দৃঢ় কন্ঠে বলে শেহেরজাদ।

সামরান বিগলিত হাসি হাসলো। সামরানের হাসি দেখে শেহেরজাদ ঝুকে বলল,

–তোর হাসি টা রহস্যময়।

— স্বাভাবিক। ৩টা বছরে নিজের আশেপাশে এত রহস্যের বেড়াজাল দিয়েছি যা ভেদ করে আসল জায়গায় পৌঁছানো অসম্ভব।

–একজনের জন্য এতকিছু?

–মোটেই না। সে একজন আমাকে ছেড়েছে। আমাকে আমার অক্ষমতা আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়েছে আর আমি প্রমাণ করেছি আমি অক্ষম নই। কিছুক্ষণ থামলো সামরান। এমন কোনো ধর্মের মেয়ে নেই যারা আমার বিছানায় আসেনি। বলেই শেহেরজাদের দিকে তাকালো সামরান।

–হোয়াটটটট!! উঠে দাঁড়িয়ে গেল শেহেরজাদ। এসব কি শুনছে ও? ওর যে ভাই মেয়েদের সাথে কথা বলা দূর চোখ তুলে তাকাতো ও না সে কি না বলছে কোনো ধর্মের মেয়ে বাদ যায়নি? কি হয়ে গেল এসব?

সামরান উঠে দাড়ালো,

–রাত অনেক হয়েছে। যা ঘুমিয়ে পড়। হ্যাভ এ সুইট ড্রিম। বলেই দু-হাত পকেটে ঢুকিয়ে হাটা দিল সামরান। শেহেরজাদ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। এই মানুষটা শেহেরজাদের অচেনা। যে মানুষটাকে রেখে শেহেরজাদ দেশ ছেড়ে ছিলো সে এমন ছিল না। কেন এমন হলো? শেহেরজাদ মনে মনে নিজেকে দোষী সাব্যস্ত করতে লাগলো।

শীতকাল ঘনিয়েছে। খুব ভোর বেলায় কুয়াশার দেখা মেলে। ঘাসে লেপ্টে থাকে শিশিরবিন্দু। সকালের রোদটা গায়ে লাগার মত না। যথেষ্ট মিষ্টি রোদের তাপ। আজ সারাদিন আমীর আর শেহনাজ মিলে মায়ার বিয়ের সমস্ত কেনাকাটা করেছে। কাল বাদে পরশু যে বিয়ে। ঘরোয়া ভাবেই হোক একমাত্র মেয়েকে খুব ধুমধামের সাথে বিদায় দেবেন আমীর। বিয়ের জমজমাট কেনাকাটা করে দুপুরে ক্লান্তি মাথায় নিয়ে বাড়ি ফিরলো দুজন। মায়া দরজা খুলে দুজনকে বসতে দিলো। পানির গ্লাস এগিয়ে দিলো। ঠান্ডা পানি খেয়ে নিজেদের ভেতরটা ঠান্ডা করে নিল দুজনেই। শান্ত হয়ে বসে একের পর এক জিনিসপত্র মায়াকে দেখাচ্ছে। দুজনের চোখে মুখে খুশির ছাপ। দুজনেই প্রবল আনন্দের সহিত সব নিজের হাতে মায়াকে দেখাচ্ছে। মাহা মানুষ দুটির দিকে তাকিয়ে রইলো। দুজনের চেহারায় সেই আনন্দ দেখতে পাচ্ছে যা মায়া আজীবন দেখতে চেয়েছিল। মায়া নিজেই যে তার মাধ্যমে হবে তা মায়ার জানা ছিল না।

–আচ্ছা সব বুঝলাম। তোমরা কি খাবে না নাকি? আমার খিদে পেয়েছে অনেক। চলো না খেতে..

–আচ্ছা আয়। আমাদেরও পেয়েছে। সবাই খেতে বসলো।

খাওয়া দাওয়া শেষে আমীর আর শেহনাজ আবারো ব্যস্ত হয়ে পড়ে। মায়া নিজের রুমেই চলে যায়। হঠাৎ ফোন বেজে উঠলো। ফোনের দিকে তাকাতেই দেখলো আননোন নাম্বার। রিসিভ করে কানে ধরতেই ওপাশ থেকে ভেসে এলো চিরচেনা সেই কন্ঠস্বর।

–কুম্ভকর্ণের মত কি ঘুমাচ্ছেন নাকি জেগে আছেন?

–কথায় কথায় অপমান করেন কেন?

–আয়হায়!! স্যার হই আমি, এইটুকু রসিকতা সহ্য করার ক্ষমতা রাখেন না?

–আপনি রসিকতা তো করেন না! রসিকতার নাম করে তীর ছুড়েন।

ওপাশ থেকে গগন কাপানো হাসির শব্দ ভেসে এলো। মায়া চোখ মুখ কুঁচকে ফোন কান থেকে একটু দূরে সরিয়ে নিল। সামরান মোলায়েম কন্ঠে বলে–

–আসুন একবার দেখা করি। আপনার তো বিয়ে আপনাকে কিছু গিফট দেওয়া উচিৎ। বিয়ের দিনতো যেতে পারবো না তাই আগেই দিয়ে দেওয়া উচিৎ।

–হুম।

–হুম কি?

–মায়া চুপ করে রইলো।

–কাদঁছেন কেন অলকানন্দা?

মায়ার শ্বাস আটকে এলো অলকানন্দা শব্দটি শুনে। ইচ্ছে করছে সামরানকে বলে দিতে যে এই বিয়ে সে করতে চায় না। কিছু একটা ভেবে পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিল মায়া। মৃদুস্বরে বলল,

–সন্ধ্যায় কোচিং শেষে দেখা করবো।

–অপেক্ষায় রইলাম।

মায়া চুপচাপ ফোন রেখে দিল। কান্নার শব্দ না শুনেও সামরান কি করে বুঝে নিলো যে মায়া কাদঁছে? কেন মনে হয় হৃদয়ের খুব কাছেই সামরানের বাস। মায়া নিচে বসে বিছানায় মাথা রেখে চোখ বন্ধ করে নিল।

মায়ার কোচিং শেষ হতেই বেরিয়ে যায় মায়া। কোচিং থেকে কিছু দূর আসতেই সামরানের গাড়ি দেখলো মায়া। গাড়িতে বসে বসে বাদাম খাচ্ছে সামরান। মায়াকে দেখে দরজা খুলে দিল। মায়া গাড়িতে বসতেই কপালে ভাজ পড়ে গেল। সামরান বাদাম খাচ্ছে তাও গাড়িতে বসে বসে। মায়া গাড়ির দরজা লাগাতেই সামরান কিছু বাদাম মায়ার হাতে দিল। মায়া কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে একটি বাদাম ছুলে মুখে দিল। সাথে সাথে সামরান মায়ার দিকে ফিরে গেল,

–আপনাকে খেতে কে বলল?আমাকে ছুলে দেওয়ার জন্যই তো দিয়েছিলাম।

মায়ার অপমানবোধ হলো। এ কেমন লোক? দেওয়ার আগে অন্তত একবার বলা উচিৎ ছিল। এইভাবে দিলে যে কেউ ভাববে খেতে দিয়েছে।

–দেখুন ভুল আপনার! তাই দোষও আপনার। দেওয়ার আগে বলা উচিত ছিল। কিন্তু আপনি বলেন নি..

সামরান একটু ঝুকে বাকা হেসে বলল,

–বললেই পারতেন আমার বাদাম আপনার ভালো লেগেছে। এই ভাবে ছলচাতুরী করে খাওয়ার কি দরকার?

তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকালো মায়া–

–আপনি কিন্তু বেশি….

–ভালো! আমি জানি তো আমি ভালো। আপনি আর প্রশংসা করবেন না।

–বাচ্চাদের মত এমন বাদাম খান কেন?

–আমার অন্য কোনো নেশা থাকলে সেটাই খেতাম। লাইক সিগারেট, ওয়াইন,হুইস্কি…

–ওহহ, ভালোই।

একটি নদীর পাড়ে বসে আছে মায়া। সামরান গাড়ির সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মায়া একা একা নদীর পাড়ে বসে আছে। সামরান এগিয়ে গিয়ে পাশে বসলো,

–কি ব্যাপার মুড অফ যে?

— অফ না।

–ওহহ বুঝেছি!

–কি বুঝেছেন?

–আপনি ভাবছেন বিয়ের পর বর এর সাথে কিভাবে…

-এক মিনিট!!আমি এসব কিছুই ভাবছি না।

সামরান হাসলো।

–বর কে বলবেন! বিয়ের আগে এক স্যার আমার এত ক্লোজ ছিল!

–কত? তীক্ষ্ণ দৃষ্টি নিক্ষেপ করে জিজ্ঞেস করলো মায়া।

–এইযে এত। বলেই সামরান একটু কাছ ঘেঁষে বসলো মায়ার। মায়া দূরে সরে যেতে নিলেই হঠাৎ ধপাস করে একটি শব্দ হয়। উপরে তাকাতেই দেখল ব্রিজের উপরে একটি গাড়ি দাঁড়িয়ে। নদীতে বস্তা বেধে কিসব ফেলছে।
বস্তা দুটি ফেলে গাড়িটি চলে গেল। মায়ার কৌতুহল হলো। ফোনের ফ্ল্যাশ অন করে নদীর পানিতে নামতে গেলেই সামরান বাধা দিলো,

–এই রাতে পানিতে কেন নামছেন?

–দেখি এসব কি?

–দেখতেই হবে?

–হ্যা।

–আচ্ছা চলুন। বলে সামরান প্যান্ট হাটু অবধি ভাজ করে মায়ার সাথে পানিতে নামলো।

হাটু সমপরিমান পানিতে নেমে মায়া পানির দিকে ফ্ল্যাশ লাইট ধরতেই দেখলো পানি লাল হয়ে আছে। সম্ভবত রক্ত। মায়া বুকে হাত রেখে একটু পিছিয়ে গেল। সামরান মায়ার দিকে একবার তাকিয়ে পানির দিকে তাকালো।
থরথর করে কাঁপছে মায়া। সাথে কাঁপছে শুষ্ক ঠোঁট জোড়া। মায়ার বুঝতে বাকি রইলো না লোকগুলো লাশ ফেলে গেছে নদীতে। লাশ হয়তো ক্ষত-বিক্ষত যার কারণে পানিতে রক্ত মিশে লাল বর্ণ ধারণ করেছে। লাশের কথা ভাবতেই অন্তরআত্মা কেঁপে উঠলো মায়ার। হাত পা ঠকঠক করে কাপঁছে।

তৎক্ষনাৎ জ্ঞান হারিয়ে ফেলে মায়া। পড়ে যেতে নিলেই সামরান ধরে নেয়। মায়া লুটিয়ে পড়ে সামরানের বুকে। সামরান মায়াকে কোলে তুলে নিলো। মায়ার ফোন পানিতে পড়ে গেল। রক্তাক্ত পানির দিকে একবার তাকিয়ে মায়ার মুখের দিকে তাকালো সামরান। তারপর পানি থেকে উঠে এসে মায়াকে গাড়িতে বসিয়ে দেয়। চোখ মুখে পানির ছিটা দিয়েও লাভ হলো না। সামরান গাড়ি স্টার্ট দেয়। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া ছাড়া আর কোনো পন্থা সামরানের জানা নেই। গাড়ি চালাতে চালাতে মায়ার দিকে বারংবার তাকাচ্ছে সামরান। অচেতন অবস্থায় মায়া বিড়বিড় করতে থাকে,

–রক্ত! পানিতে রক্ত! আব্বু আমার ভয় লাগছে। আমার ভয় লাগছে আব্বুউউ!!
সামরান এক হাত বাড়িয়ে মায়ার গাল স্পর্শ করলো। মায়া অচেতন অবস্থায় পড়ে আছে। মায়ার এমন বিবর্ণ চেহারা দেখে সামরানের বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠলো। মুহুর্তের মাঝে একি হাল হলো তার অলকানন্দার।

চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here