প্রেমের খেয়া পর্ব ১৮

#প্রেমের_খেয়া
#লেখিকা_জান্নাতুল_মীর
#পর্ব_১৯

হাসপাতালে মায়ার পাশেই বসে আছে সামরান। মায়া ভয়ে সেন্সলেস হয়ে পড়েছে। মায়ার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে সামরান। ১০৪°ডিগ্রি জ্বর মায়ার। শরীরে হাত রাখা যাচ্ছে না। মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। ডাক্তার কিছু ওষুধ লিখে মায়াকে রিলিজ করে দিলো। সেন্স আসলেও জ্বরের কারণে মায়া চোখ খুলতে পারছেনা। প্রায় ৩ঘন্টা হয়ে গেল। সামরান অনেক চেষ্টা করেও চোখ খোলাতে পারেনি। মায়াকে নিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্য রওনা দিলো সামরান। বাড়ির লোক হয়তো চিন্তা করছে।

সন্ধ্যা পেরিয়েছে অনেক্ষণ। মায়া এখনো ফিরে নি। শেহনাজ এর ভেতর অজানা ভয় নাড়া দিয়ে উঠলো। কোচিংয়ের পর পরই তো মায়া বাসায় চলে আসে। তবে আজ কি হলো? মেয়ের চিন্তায় অস্থির হয়ে আছে শেহনাজ। বারান্দায় হেটে হেটে বার বার গেইটের দিকে তাকাচ্ছে শেহনাজ। হঠাৎ গাড়ির হর্ণ শুনে শেহনাজ থমকে দাড়ালো। গেইট এর সামনে দাড়িয়েছে বিশাল কালো রঙের গাড়ি। গাড়ি থেকে সামরান বেরিয়ে পাশের সিটের দরজা খুলে মায়াকে কোলে তুলে নিলো। উত্তপ্ত শরীরের তপ্ত আভাসে সামরান নিজেও অবাক হলো। এত টা জ্বর।সামান্য ভয়ে এত জ্বর কি করে এলো। মায়ার ফ্যাকাশে মুখের দিকে একবার তাকালো সামরান। ঠোঁট জোড়া শুকিয়ে গেছে। থেমে থেমে নিঃশ্বাস ছাড়ছে মায়া। মায়াকে নিয়ে ভেতরে পা রাখতেই শেহনাজ কে দেখলে সামরান।
শেহনাজ বারান্দা ছেড়ে নেমে আসে,

–ওর কি হলো?

–আগে ভেতরে নিয়ে চলুন আমি সব বলছি।

–চলো চলো। শেহনাজ মায়ার রুমে সামরানকে নিয়ে গেল। মায়াকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে যায় সামরান। মায়ার দিকে একবার তাকিয়ে বলে,

–আমার গাড়ির সামনে এসে পড়েছিলো । গায়ে অনেক জ্বর। বুঝতে পারছিনা,আমি ডাক্তার কাছেও নিয়ে গেছি। শরীর দুর্বল থাকায় একটু বেশিই উইক। এই হলো ওষুধ এই নিন। উঠলে খাইয়ে দেবেন আন্টি। শেহনাজের হাতে ওষুধ দিয়ে মায়ার দিকে তাকালো সামরান।

ওষুধ রেখে শেহনাজ বাটি আর পট্টি নিয়ে হাজির হলো।
সামরান পাশেই বসে পড়ে। সামরান কে বসতে দেখে শেহনাজ ভাবলো ছেলেটাকে নাস্তা দেওয়া উচিৎ। এই প্রথম এসেছে। শেহনাজ ভাবলো সামরান হয়তো জানেনা এই বাড়িতেই সামরানের বিয়ে ঠিক হয়েছে। কারণ সামরান তো আসেইনি।

–তুমি বসো আমি তোমার জন্য একটু খাবার নিয়ে আসি।

–না না আন্টি আপনি অস্থির হবেন না। আমি কিছু খাবো না।
শেহনাজ সামরানের দিকে তাকিয়ে রইলো। সামরান কথা তো বলছে কিন্তু দৃষ্টি জোড়া মায়ার মুখপানে আটকে আছে। শেহনাজের ফোন বেজে উঠতেই শেহনাজ ফোন রিসিভ করতে গেলো। সামরান উঠে এসে মায়ার পাশে বসলো। মায়ার কপালে হাত রাখলো তাপমাত্রা এতোটাই প্রখর যে সামরান দ্রুত হাত সরিয়ে নিলো। তাড়াতাড়ি বাটি থেকে পট্টি তুলে মায়ার কপালে রাখলো। মায়ার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে একটু ঝুকে মায়ার মুখোমুখি হলো সামরান,

–মুহুর্তেই এত জ্বর কিভাবে হয়ে গেল। আমি কিছুই বুঝতে পারছিনা। একটা মানুষ এতটা সরল কি করে হয়। পানিতে রক্ত দেখে যার এই হাল সে কিভাবে….সামরান থেমে যায়। চোখ বন্ধ করে চোয়াল শক্ত করে নিলো। চোখ খুলে মায়ার দিকে আবারও তাকালো।

–সুস্থ হয়ে উঠুন না। এই দু-তিন ঘন্টায় আপনার চেহারা কেমন হয়ে, গেছে একরাত থাকলে না জানি কি হবে? প্লিজ সুস্থ হয়ে যান। আমি আপনাকে এইভাবে দেখতে চাই না। কাল বাদে পরশু বিয়ে আর আজ আপনি? কেন নামলেন পানিতে আমিতো নিষেধ করেছিলাম। আপনি কেন এমন? সামরান সোজা হয়ে বসে। কপালের পট্টি বাটির পানিতে ডুবাতেই পানি কুসুম গরম হিয়ে উঠলো। বাটির পানি ফেলে দিল সামরান। জগ থেকে বাটিতে পানি নিয়ে আবারো মায়ার কপালে রাখল। ভেজা হাত দিয়ে মায়ার মুখ মুছিয়ে দিলো। হাত সরিয়ে নিতেই মায়া বিড়বিড় করে বলে ওঠে,

–রক্ত!আব্বু পানিতে অনেক রক্ত! ওরা কাকে যেন মেরে ফেলল আব্বু। আমি দেখেছি আব্বু অনেক রক্ত। আব্বু আমার ভয় করছে।

সামরান মোলায়েম কন্ঠে বলল–

— ভয় পাওয়ার কিছুই নেই। আমি আছিতো। আমি থাকতে কেউ আপনার কিছু করতে পারবে না। আপনি ভয় পাবেন না।

–রক্ত!র-রক-রক্ত! মায়া বার বার জ্বরের ঘোরে বিড়বিড় করতে থাকে। সামরান মায়ার দিকে তাকিয়ে রইলো। খুব৷ বেশি ভয় পেয়েছে মেয়েটা। সামরান উঠে দাড়ালো। এখানে থাকা যাবে না। সন্দেহ করতে পারে। কিছুতেই কাউকে বুঝতে দেওয়া যাবে না মায়া সামরান কে চেনে। সামরান সরে আসে। বেরিয়ে যাওয়ার সময় পড়ার টেবিলের সাথে ধাক্কা লাগে। কিছু বই পড়ে গেল। সামরান বইগুলো তুলে নিতে মাটিতে বসলো। সব বই তুলে রেখে ফিরে আসতেই থমকে দাড়ালো। পেছনে ফিরে একটি বই হাতে নিল সামরান। বইয়ের মলাটের উপর ঘাড় কালি দিয়ে দুটি নাম লিখা,”মায়া★ফাইজা”। বই হাত থেকে রেখে সামরান দু কদম পিছিয়ে গেল। নিঃশ্বাসের গতি বেড়ে গেল সামরানের। এক হাতে নিজের মুখ চেপে ধরে সামরান। চোখ দুটি চিকচিক করছে। গলার পাশের রগ গুলো ফুলে উঠেছে। কপালের রগ দপদপ করছে। বইয়ের দিকে তাকিয়ে মায়ার দিকে একবার তাকালো। চেয়ারের হাতল চেপে ধরে সামরান। থরথর করে কাপঁছে ছেলেটা। রাগ দমন করতে একহাতে নিজের মাথার চুল চেপে ধরলো। আর এক মুহুর্ত ও দেরি না করে সামরান বেরিয়ে পড়ে। রুম থেকে বের হওয়ার সময় শেহনাজের মুখোমুখি হয় সামরান।

–একিই তুমি চলে যাচ্ছো?

— হ্যা আসসলে আমার কাজ আছে একটু। আসছি কেমন। বলেই সামরান দ্রুতগতিতে বেরিয়ে পড়লো। শেহনাজ সামরানের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো। হঠাৎ কি হলো ছেলেটার? এইভাবে কেন চলে গেল? এসব ভাবতে ভাবতে মায়ার কথা মনে পড়ে। শেহনাজ ভেতরে গিয়ে দেখলো মায়ার কপালে পট্টি। পট্টি ছুঁয়ে দিতেই ঠান্ডা পট্টি দেখে ভ্রু কুঁচকালো শেহনাজ। বাটিতে পানির পরিমানও বেশি। তবে কি সামরান মায়ার কপালে পট্টি দিয়েছে?

দ্রুতগতিতে গাড়ি চালিয়ে সামরান চলে আসে। একটি খোলা মাঠের মাঝখানে গাড়ি থামিয়ে গাড়ি থেকে নেমে লম্বা পা ফেলে কিছু দূর এগিয়ে যায়। তারপর মাটিতেই হাটু গেড়ে বসে পড়ে। মাটিতে দু হাত ঠেকিয়ে জোরে চিৎকার দিলো সামরান,

–ও কেন ফিরে এসেছেএএ? আমি ঘৃণা করি ওই মানুষকে। আমার মায়ার সাথে এত ভালো সম্পর্ক কি করে হয়ে গেল। আম আমি আমার অলকানন্দা কে হারাতে পারবো না। অক্ষম না আমিইই…আমি বিশ্রী নইই!আমি কুৎসিত নইইইইই। আমি আমার অতীতের মুখোমুখি হতে চাইইই না। সেই ভয়ংকর দিনগুলোর মুখোমুখি আমি আবারও হতে চাইইই না। এসব কি হচ্ছে। ওই একটা মানুষ আমাকে আজ শয়তান বানিয়ে দিয়েছে। ঘৃণা করতে শিখিয়েছে নারী জাতি কে। আমি তার মুখোমুখি হতে চাই না। কিছুতেই না। মাটিতে জোরে জোরে ঘুষি দিয়ে কথা গুলো বলতে থাকে সামরান। দুহাতে নিজের মাথা চেপে ধরে।

–আমি পারছি না। আম আমার খাখারাপ লাগছে। আমার অসহ্য লাগছে। আই–আই নিড এ মেডিসিন। আমার ওষুধ লাগবে। হ্যা -হ্যা ওষুধ। কোথায় আমার ওষুধ। আমার ওষুধ। হ্যা-গাগাড়িতে, গাড়িতে আছে আমার ওষুধ। আমি মেডিসিন নেব। মেডিসিননন!!উঠে দাঁড়িয়ে যায় সামরান। লম্বা পা ফেলে গাড়িতে আসে। দরজা খুলে গাড়ির ভেতর খুঁজতে থাকে। খুঁজতে খুঁজতে পেয়েও গেল। তাড়াতাড়ি ওষুধ মুখে দিয়ে পানির বোতলের ডাকনা খুলে ঢকঢক করে অর্ধেক বোতলের পানি পান করে বোতল দূরে ছুড়ে ফেলে দিল। গাড়িতে পিঠ ঠেকিয়ে মাটিতে বসে পড়ে সামরান। চোখ বন্ধ করে মাথা গাড়ির সাথে ঠেকিয়ে রাখে। কপালের রগ ফুলে আছে। গলার পাশের রগ গুলো সবুজ বর্ণ ধারণ করেছে।
স্বরনালী একবার ভেতরে দেবে আবারো উঠে আসছে। গলার দুপাশের হাড় বার বার ভেসে উঠছে। শ্যামবর্ণ মুখটির মায়াবী রেশ কাটিয়ে তীব্র ভয়ংকর দেখাচ্ছে।

সেলিনা মালিক সিমিকে শাড়ি পড়িয়ে দিলেন। সিমি শাড়ি পড়ে আয়নার সামনে নিজেকে দেখছে। চুল গুলো হাতে পেঁচিয়ে খোপা করে শাড়ির আঁচলের বাড়তি অংশ কাধে তুলে দিল। পেছন থেকে শাড়ির আঁচলের কোনা টেনে কোমরে গুঁজে দিলো। দুহাত কোমরে ঠেকিয়ে এই পাশ ওপাশ দেখে মিষ্টি হাসি হাসলো সিমি,

–বাহহ!আমাকে বউ বউ লাগছে। মা কি সুন্দর শাড়ি পড়িয়ে দিলো।

শেহেরজাদ রুমে ঢুকতেই সিমিকে আয়নার সামনে দেখে দু কদম পিছিয়ে আড়ালে গিয়ে দাঁড়ায়। মাথা বাকিয়ে সিমির কান্ড দেখতে থাকে। আয়নার সামনে নিজেকে খুটিয়ে খুটিয়ে দেখছে সিমি। শেহেরজাদ হেসে চোখ সরিয়ে নিতে চাইলে চোখ গিয়ে পড়লো সিমির অনাবৃত পেটের দিলে। শাড়ি গুঁজে রাখায় কোমরের সাইডের অনেকটা অংশ দেখা যাচ্ছে। নিজের হাতের মুঠো শক্ত করে নিলো শেহেরজাদ। যতই দূরে থাকতে চায় এই মেয়ে ততই কাছে যাওয়ার বাহানা বের করে। আর কাছে গেলেই হাসফাস শুরু করে। ধীর পায়ে আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে সিমির পেছনে গিয়ে দাড়ালো শেহেরজাদ। আয়নায় পেছনে দাড়িয়ে থাকা শেহেরজাদ কে দেখে সিমি শুকনো ঠোঁট জোড়া জিহ্বা দিয়ে ভিজিয়ে নিলো। শেহেরজাদ সিমিকে পেছন থেকেই জড়িয়ে ধরলো। শেহেরজাদের হাতের স্পর্শ সিমির অনাবৃত পেটে লাগতেই শিউরে উঠলো সিমি। দুহাত দিয়ে নিজের শাড়ি খামছে ধরে। শেহেরজাদ সিমির কাধে থুতনি রেখে চোখ বন্ধ করে। গলার সাইডে গাল ঘষতে ঘষতে বলে এত সুন্দর করে শাড়ি কে পরিয়ে দিলো,

–ম –মা..

–একদম মন মতো হয়েছে। এবার লাগছে শেহেরজাদ মালিকের বউ।

–সিমি চুপ..

সিমিকে চুপ থাকতে দেখে একটানে নিজের দিকে ফিরিয়ে নিলো শেহেরজাদ। খোপা সাথে সাথেই খুলে সারা পিঠে ছড়িয়ে পড়লো কিছু কাটা চুল সিমির সামনে চলে আসে। শেহেরজাদ মুচকি হেসে চুল গুলো কানের পাশে গুঁজে দিলো।

–আমার বউ তাই না?

–হহ্যা!

–খুব মায়াবী দেখাচ্ছে।

–সিমি ঢোক গিললো। শেহেরজাদ কোলে তুলে নিল। বিছানায় শুইয়ে দিয়ে এক হাত বাড়িয়ে বেড সাইড টেবিলে জ্বলতে থাকা ল্যাম্প বন্ধ করে দিলো। তারপর সিমির কপালে চুমু দিলো। ঠোঁটে আলতো ভাবে চুমু দিয়ে সরে আসে। বুকে নিয়ে সিমির মাথায় হাত বুলাতে থাকে,

–তুমি ঘুমাও কেমন? একদম নড়াচড়া করবে না ঠিক আছে বেইবি।

–হু। চুপটি মেরে শেহেরজাদের বুকে শুয়ে রইলো সিমি।
শেহেরজাদের হৃদপিণ্ডের ধুকধুক শব্দ সিমি স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে। সিমি একবার মাথা তুলে শেহেরজাদ কে দেখলো আবারও শুয়ে পড়লো। হৃদপিণ্ড বুঝি এখনই বেরিয়ে আসবে। চোখ বন্ধ করে নিলো সিমি। শেহেরজাদের হৃদপিণ্ডের শব্দের সাথে তাল মিলিয়ে নিঃশ্বাস নিতে থাকে। একটা সময় গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল সিমি।

বিঃদ্রঃ সামরান চরিত্র কি খুব বেশি খারাপ লাগছে? অনেকেই বাজে মন্তব্য করছেন আমার ভালো লাগছে না। এই চরিত্রটি আমি খুব যত্নে,অনেক কিছু নিয়ে সাজিয়েছি। তাই প্লিজ খারাপ মন্তব্য করার হলে একেবারে শেষে করবেন। আগে দেখুন কি হয়। জরুরী না যে প্রতিটি চরিত্র ভালো হবে। দুনিয়ায় যেমন সব মানুষ ভালো না। ঠিক উপন্যাস,গল্পেও সব চরিত্র একসমান হয় না। ভিন্নতা থাকবেই। ভুল ক্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন।

হ্যাপি রিডিং ❤️

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here