প্রেমের খেয়া পর্ব ২০

#প্রেমের_খেয়া
#লেখিকা_জান্নাতুল_মীর
#পর্ব_২০

সময় আপন গতিতে বয়ে চলেছে। মায়ার জ্বর কমছে, বাড়ছে। দুর্বলতা কিছুতেই কাটছেনা মায়ার। এই জ্বরের জন্য মায়ার গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান টা ঠিকঠাক ভাবে হয়নি। আমীর অনেক চিন্তিত। একবার ভেবেছিলো বিয়ের ডেট পিছিয়ে দেবে। কিন্তু সেলিনা মালিক ডেট বদলাতে দেয়নি। ঠিক সময়েই বিয়ে হবে। কিন্তু এত দুর্বল শরীর নিয়ে কিভাবে কি করবে মায়া।

দেখতে দেখতে বিয়ের দিন চলে এলো। এখনো মায়া সম্পুর্ণ সুস্থ হয়নি। হালকা সাজেই মায়াকে বউ রুপে সাজিয়েছে। ভারী মেকাপ,ভারী গহনা কিছুই মায়া পরেনি। শরীরের অশান্তির কারণে মায়া খুবই সাধারন ভাবেই একটি সাজে নিজেকে সাজিয়েছে। এই হালকা সাজেও মায়াকে দেখার মত লাগছিলো। চোখের পাতা ফুলে আছে। সেই চোখেই কাজল, শুষ্ক ঠোঁটটিতে গালকা গোলাপি লিপস্টিক দেওয়াতে আরো সুন্দর দেখাচ্ছে। সব মিলিয়ে হালকা সাজেই মায়াকে অসম্ভব সুন্দর দেখাচ্ছে।
এই হালকা সাজেও মায়ার অস্বস্তি শুরু হয়ে যায়। ঝরঝর করে ঘাম ছুটে গেল মেয়েটার। শরীর কাপঁছে। বসে থাকার মত কোনো ক্ষমতা মায়ার নেই। হেলান দিয়ে মাথাটা সোফার সাথে ঠেকিয়ে বসে আছে। চেহারা জুড়ে একরাশ অস্বস্তি আর ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট বিদ্যমান। বরযাত্রী এসে গেছে। বিশাল হলরুমের মাঝখানে পর্দা টাঙানো হয়। পর্দার এ পাশে বর আর ওপাশে কনে। কাজী সাহেব ধর্মীয় নীতি অনুসরণ করে বিয়ে পড়াতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। প্রথমে মায়াকে কবুল বলতে বলা হয়। মায়ার প্রচন্ড খারাপ লাগা শুরু হয়। গরমে অস্বস্তি হতে থাকে। আশে পাশে এত মানুষ যে চোখ মুখে অন্ধকার লাগছে। ঝাপসা হয়ে আসছে চারিপাশ। কাজী সাহেব আবারো কবুল বলতে বলেন। কিন্তু মায়া?আশেপাশের কোনো আওয়াজই যেন মায়ার কানে যাচ্ছে না। শেহনাজ মায়ার পাশেই বসে ছিলো, মায়ার কানে কানে ফিসফিস করে বলে–

–মায়া কবুল বল। সবাই অপেক্ষা করছে।
মায়ের কথা শুনে মায়া আস্তে করে তিনবার “কবুল” বলে দেয়। মায়ার কবুল বলার শব্দ সবার কানে পৌঁছাতেই সবাই হাসি মুখে আলহামদুলিল্লাহ বলে উঠেন। মায়া শেহনাজের কাধে মাথা রেখে দিলো। হাত পা ছেড়ে দিয়েছে। অপরপক্ষের কবুল বলা মায়া শুনতেই পেল না।
সামরান হাসি মুখেই কবুল বলে। ধর্মীয় নিয়মনীতি মেনেই মায়া আর সামরানের বিয়ে সম্পন্ন হয়ে গেল। কিন্তু মায়া সে সেন্সলেস হয়ে পড়েছে। আশেপাশের কোনো কিছুরই হুশ মায়ার নেই। সেলিনা মালিক বলেছিলো সেন্স আসা পর্যন্ত মায়াকে রাখতে। কিন্তু আমীর রাজী হলো না। কারণ মেয়ের সেন্স এলে মেয়েকে বিদায় দিতে মন সায় দেবেনা। আর মেয়ের কান্না তিনি সইতে পারবেন না। তাই মায়াকে বিদায় দিয়ে দিলো। মায়ার অজান্তেই মায়া পিত্রালয় ছেড়ে পাড়ি দিলো শশুর বাড়ির উদ্দেশ্যে।

সিমি অসুস্থ হয়ে পড়েছিলো তাই বিয়েতে যেতে পারেনি। বাড়িতে বসেই নতুন বউয়ের আগমনের জন্য অপেক্ষা করতে থাকে সিমি। গেইট দিয়ে গাড়ি প্রবেশ করতেই সিমি দরজা খুলে আগেভাগেই বসে রইলো। অন্যরকম এক আনন্দ সিমিকে জড়িয়ে রেখেছে। সামরানের কোলে লাল বেনারসী শাড়ি পরিহিতা মেয়েকে দেখে হাসি মুখে সামনে এসে দাড়ালো সিমি।

–কি হয়েছে?

–অসুস্থ তো, তাই সেন্সলেস হয়ে পড়েছে।

— ওহহ আচ্ছা! তুমি রুমে নিয়ে যাও আমি আসছি।

–হুম। সামরান মায়াকে নিয়ে নিজের রুমের দিকে পা বাড়ালো। মায়াকে বিছানায় শুইয়ে দিয়ে সামরান ফ্রেশ হতে চলে যায়। ট্রে ভর্তি নতুন বউয়ের জন্য খাবার নিয়ে রুমে হাজির হলো সিমি। খাবারের ট্রে টেবিলে রেখে বিছানায় গিয়ে বসলো। বউয়ের মুখের দিকে তাকাতেই এক ঝটকায় বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে গেল সিমি। অজান্তেই নিজের চোখে পানি চলে এল সিমির। এ কাকে দেখছে ও? এ যে তারই আদরের ছোট বোন। দুহাতে নিজের মুখ চেপে ধরে সিমি। ইশশ!কেন গেল না সিমি। মা বাবাকে একটিবারের জন্য দেখতে পেত। মায়াকে দেখে সিমি খুশিতে আত্মহারা হয়ে পড়ে। কখন মায়ার জ্ঞান ফিরবে সেই অপেক্ষায় বসে রইলো।

রাত ১০টাই মায়ার জ্ঞান ফিরে। চোখ খুলে নিজেকে বিশাল এক রুমে আবিষ্কার করলো। দু হাতে ভর দিয়ে শোয়া থেকে উঠে বসে মায়া। পরনে শাড়ি দেখে বুঝেই ফেলল বিয়ে হয়ে গেছে। কিন্তু এটা কি হলো? বিদায় হওয়ার আগে একবারও বাবা মায়ের মুখ দেখলো না। এ কেমন দুর্ভাগ্য? ভাবতেই চোখ থেকে পানি পড়ে গেল।

–কি নতুন বউ এখনো কাদঁবেন?

একটি মেয়েলি কন্ঠস্বর শুনে মায়া চট করে মাথা তুলে সামনে তাকালো। সামনে বসে থাকা সিমি কে দেখে মায়ার চোখ বড় বড় হয়ে গেল। মুখ অটোমেটিক হা হয়ে গেল। অস্ফুটস্বরে বলে উঠলো–

–আপুহ্!!

সিমি মায়াকে জড়িয়ে ধরে। মায়াও শক্ত করে সিমিকে জড়িয়ে ধরে কেদেঁ দিলো।

–কোথায় ছিলে আপু? কত অপেক্ষা করেছি আমি? তোমাকে কত মিস করেছি জানো?

–আমিও করেছি। আমার ছোট বোনটা দেখতে দেখতে কত বড় হয়ে গেল। মায়ার কপালে চুমু দিয়ে বলে সিমি।

–কিন্তু তুমি এখানে?

সিমি হালকা হাসলো।

–আমি তোর ছোট জা!!

মায়া আবারো বিস্ময়ের চরম সীমায় পৌছে গেল।

–কি বলছো আপুহ্?

–হ্যা! আর আমি এতদিন এখানে ছিলাম না। লন্ডন ছিলাম। অনেক কষ্টে বুঝিয়ে সুঝিয়ে এখানে এসেছি।

–ওহহ!যাক ভালোই হলো। আমি তোমাকে ফিরে পেলাম। এবার দেখো ছোট মা ছোট আব্বুউ ও তোমাকে মেনে নেবে। আর কোনো সমস্যা হবে না।

সিমির মুখ কালো হয়ে যায়। মলিন মুখে ম্লান হেসে বলল,

–বাবা মা আমার কথা জিজ্ঞেস করে?

–করে না। রেগে আছে। তবে আমার বিশ্বাস তুমি সামনে গিয়ে দাড়ালে ওরা সব ভুলে যাবে সব।

–বুঝলাম। সেসব পরে হবে। আপাতত তুই শাড়ি বদলে নে। জ্বর হয়েছে শুনলাম। খাবার খেয়ে ওষুধ খেতে হবে তো।

–আমার কি শাড়ি পরতে হবে আপু?

–উমমম!!পরতেই হবে। বাড়ির বড় বউ বলে কথা।

— ধুর!বার বার বড় বউ বউ কেন করছো। আমি এখনো আমার বর কেই দেখলাম না।

–একিই!!কি বলছিস? দেখিস নি?

দুপাশে না বোধক মাথা নাড়ালো মায়া। সিমি হেসে দিলো।

–আচ্ছা ঠিক আছে। তুই ফ্রেশ হয়ে আয় আমি দেখাচ্ছি।

–আচ্ছা।

মায়া ফ্রেশ হয়ে আসে। সিমি মায়াকে সুন্দর করে শাড়ি পরিয়ে দিলো। সেলিনা মালিক এর কাছ থেকে শাড়ি পড়াটা আয়ত্ব করে নিয়েছে সিমি। মায়াকে খাবার খাইয়ে, ওষুধ খাইয়ে দিলো।

–আপু! বাড়ির বাকিরা কোথায়? কাউকে দেখছিনা..

–সবাই নিচে আছে। মা তোকে অনেক বার দেখে গেছে তখন তোর সেন্স ছিলো না। চল নিচে যাবি

–আপুহ্!!সিমির হাত ধরে আটকায় মায়া।

–কি হলো?

–আমার ভয় করছে।

–ধুর পাগলি..আম্মা অনেক ভালো মানুষ। শুধু আম্মা না এই বাড়ির সবাই অনেক ভালো। চল।

সিমির কথা শুনে মায়া সিমির সাথে নিচে গেল।

মায়া ড্রয়িংরুমে পা রাখতেই সেলিনা মালিক হাসি মুখে উঠে দাড়ালো–

— এইতো আমার নতুন বউ চলে এসেছে।

সেলিনা মালিকের কথা শুনে সামরান দাড়িয়ে যায়। সাথে শেহেরজাদ ও। দুজনে একে অপরের দিকে তাকালো। কেউই মায়ার সামনে ফিরছে না। সেলিনা মালিক মায়ার পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। সিমি আর মায়া দুইপাশে আর সেলিনা মালিক মাঝখানে। সামাদ মালিক কে সালাম দিলো মায়া। হাসি মুখে সামাদ মালিক সেই সালাম গ্রহন করলেন।

–কি হলো এদিকে ফিরছো না কেন? এদিকে তাকাও দুজন।

সামরান আর শেহেরজাদ একে অপরের দিকে একবার তাকিয়ে পেছনে ফিরে দাড়ালো। মায়া মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। সিমি হাসছে। সেলিনা মালিক হেসে মায়াকে বলল–

–কি হলো উপরে তাকাও!

মায়া মাথা তুলে উপরে তাকাতেই সামরান কে দেখে চরম একটা ধাক্কা খেল। চোখ গুলো বড় বড় করে তাকিয়ে রইলো সামরানের দিকে। সামরান মুচকি হেসে তাকালো।
মায়া শুকনো ঢোক গিলল। পাশেই দাঁড়িয়ে থাকা শেহেরজাদের দিকে একবার তাকিয়ে অস্ফুটস্বরে বলল,

–জ–জমজমজ?

সেলিনা মালিক হেসে দিলো।

–হ্যা আমার দুই ছেলে জমজ। চিনতে পেরেছো নিজের বর কে?

মায়া শুকনো ঢোক গিলে মাথা নাড়ালো। সেলিনা মালিক সিমি কে ইশারা দিয়ে বলল মায়াকে যেন রুমে দিয়ে আসে। সিমি মায়াকে রুমে নিয়ে আসে। রুমে আসতেই মায়া অস্থির হয়ে পড়লো,

–আপুরে ওনারা জমজ?

–হ্যা, প্রথমবার আমারও এমন হয়েছিলো।

–কিন্তু উনি তো বললেনই না।

–আগে থেকে চিনতি তাই না? ভ্রু কুঁচকে বলে সিমি।

–না না তেমন না। উনি তো আমার কলেজের অনুষ্ঠানে গিয়েছিল। ওখানেই…

–হুম বুঝেছি। এবার আমি যাই আমার ঘুম পাচ্ছে। বর এর সাথে আড্ডা দে।

মায়া সিমির হাত ধরে নিল। শুকনো ঢোক গিলে বলল,

–তোমার কি যেতেই হবে?

–ওমা!আমি এখানে কোথায় থাকবো? আমার বর আমার জন্য অপেক্ষা করবে না বুঝি?

–কিন্তু আমি??

–কিন্তু কি! এত ভয় পেলে চলবে? সহজ ভাবে নে। সব ঠিক হয়ে যাবে।

মায়া অসহায়ের মত তাকিয়ে রইলো। সিমি মুচকি হেসে চলে গেল।

রুমের মাঝেই পায়চারী করতে থাকে মায়া। কিছুক্ষন বিছানায় তো কিছুক্ষণ বারান্দাহ অস্থিরতা যেন কমছেই না। হঠাৎ দরজা খোলার শব্দে চমকে উঠলো। দ্রুত গতিতে গিয়ে বিছানায় বসে পড়লো। সামরান রুমে প্রবেশ করে দরজা লাগিয়ে দিল। আয়নার সামনে গিয়ে নিজের চুল ঠিক করতে থাকে। সামরানের এর এমন ভাব দেখে মায়ার রাগ হলো। বিছানা ছেড়ে দাঁড়িয়ে গেল,

–আপনি আমাকে এত বড় ধোকা কিভাবে দিলেন?

–কিসের ধোকা? মায়ার দিকে তাকিয়ে বলল সামরান।

মায়া একটু পিছিয়ে গেল,

–দে দেখুন। আমাকে একদম ভয় দেখাবেন না।

–কে ভয় দেখাচ্ছে? এক পা এগিয়ে এসে বলে সামরান।

মায়া আবারো নিঃশ্বাস টেনে নিলো,

–আপনি জানতেন তাই না? জেনেও আমাকে বললেন না।

–কি জানতাম? আরো একপা এগিয়ে এসে বলে সামরান।

–উপ্স!আপনি কেন সামনে আসছেন? ওখানে দাড়িয়েই বলুন না!

–কেন? সামরান আরো এক পা এগিয়ে সামনে গেল।

–আম আমি কিন্তু!

–কি? পিছিয়ে যেতে যেতে দেওয়ালের সাথে পিঠ ঠেকে যায় মায়ার। আর যাওয়ার যায়গা নেই। সামরানের দিকে তাকিয়ে মাথা নিচু করে নিলো মায়া।

–আপনি না অসুস্থ? আসুন ঘুমাবেন।

মায়া মাথা তুলে তাকালো,

— আপনি আমার সাথে ঘুমাবেন না তো?

–কোথায় যাবো আমি?

— আমি আপনার সাথে কিকিভাবে?

–এইভাবে। বলেই একটানে মায়াকে নিজের সাথে মিশিয়ে নিলো। কোলে তুলে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিলো। পাশে শুয়ে মায়ার দিকে তাকালো সামরান। মায়া চোখ মুখ খিচেঁ বন্ধ করে রইলো। সামরান মৃদুস্বরে বলল–

–এমন এক্সপ্রেশন দিলে আমি কিন্তু একটু পর সব এলোমেলো করে দেব!
সামরানের এমন কথা শুনে মায়া সামরানের দিকে তাকাল। কি বলে এই লোক এসব? মায়া কেন এই লোকের কথা সহজ ভাবে নিতে পারে না,কেন?…

বিঃদ্রঃ বিয়েএএএএএ ডান💃💃💃
রি-চেইক করা হয়নি। ভুল ক্রুটি ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন!!
চলবে…..😒

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here