#প্রেমের_খেয়া
#লেখিকা_জান্নাতুল_মীর
#পর্ব_৩০
ছাদে বসে আছে সিমি। চারপাশে হালকা হালকা কুয়াশা। শীতের ঠান্ডা বাতাস সিমির সারা শরীর বরফের ন্যায় ঠান্ডা করে দিচ্ছে। কিন্তু সেইদিকে সিমির খেয়াল নেই। অন্যমনস্ক হয়ে বসে আছে। সারা রাত ঘুম হয়নি সিমির। শেহেরজাদ রাতে ফিরে এসে কাউচে্ শুয়ে পড়েছিলো। ভয়ের চোটে সিমি শেহেরজাদ কে বিছানায় শোয়ার কথা বলতে পারেনি। সারারাত নির্ঘুম কেটেছে মেয়েটির। যেই মানুষটির স্পর্শ থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে চেয়েছিলো এত দিন,সেই মানুষের দূরে সরে যাওয়া যেন মেনে নিতে পারছে না। সারাটা রাত যেন মনে হচ্ছিলো কি নেই, কি নেই! ভোরের আলো ফুটতেই বিছানা ছেড়ে উঠে যায়৷ নামাজ পড়ে ছাদে চলে আসে। ভেতরটা খালি খালি লাগছে। কেন এমন হচ্ছে জানা নেই?
হঠাৎ কারো আভাস পেয়ে সিমি পেছনে ফিরে তাকালো। মায়াকে দেখে উঠে দাড়ালো সিমি। মায়া একটি শাল সিমির গায়ে জড়িয়ে দিলো। সিমি শাল কে দুইহাতে ধরে টেনে পুরো শরীর ঢেকে দিলো। মায়া পাশে থাকা ট্রে তুলে নিয়ে সিমির সামনে ধরলো,
–কফি চলবে? গরম আছে কিন্তু..
–দে..হাত বাড়িয়ে একটি কফির মগ নিলো সিমি। ট্রে পাশের টেবিলে রেখে দিয়ে বসে পড়লো মায়া। ছাদের একপাশে বেতের এক সেট সোফা আছে। ছাদে কেউ এলে এখানে বসেই আড্ডা দেয়। আর অন্য পাশে একটি বিশাল দোলনা। অন্যপাশ জুড়ে নানান রকম ফুলের চারা গাছ। মায়া কফিতে চুমুক দিয়ে সিমির দিকে তাকালো মায়া,
–এই ঠান্ডায় এতক্ষণ এখানে কিভাবে বসে ছিলি আপু?
–কি জানি…
–টের পাস নি, তাইতো?
সিমি মায়ার দিকে তাকালো,মায়া হালকা হাসলো। হাতে থাকা কফির মগ নিয়ে উঠে দাড়ালো,
–চল ওইদিক টা যাই, আম্মা নাকি অনেক গাছ লাগিয়েছে? দেখি কি কি ফুল ফুটেছে?
মায়া হাটা দিলো,মায়াকে অনুসরণ করে সিমি ও গেল। ফুল গাছের পাশে গিয়ে দাড়াতেই মিষ্টি গন্ধ ভেসে এলো। মায়া চোখ বন্ধ করে নিলো,
–উমম! সুন্দর স্মেল না?
–হুম! অনেক গুলো ফুলের সুভাষ একত্রিত হয়েছে, তাই আরো বেশি ভালো লাগছে।
মায়া সিমির কথার উত্তর দিলো না। একটু এগিয়ে গিয়ে গোলাপ ফুলের পাশে দাড়ালো,
–আপু? এই দেখ, গোলাপ ফুল গুলো অনেক সুন্দর দেখাচ্ছে তাই না?
হাতে গোলাপ স্পর্শ করে মায়া। সিমি কিছু বলার আগেই মায়া মৃদু আর্তনাদ করে উঠল,
–আহহ্!!
সিমি ছুটে গিয়ে মায়ার হাত ধরে দেখলো হাতে কাটা বিধেঁছে।
–ইশ্ দেখে চলবি তো? দেখেছিস কাটা বিধেঁ গেল এখন?
–জিনিস যেটা একটু সুন্দর তা একটু যন্ত্রণা তো দিবেই আপু! মায়ার কথা শুনে সিমি মায়ার দিকে তাকালো। মায়া হালকা হাসলো,
–গোলাপ সবচেয়ে সুন্দর ফুল। ভালোবাসার প্রতীক। প্রিয়জনকে ভালোবাসার কথা বলতে গেলে সবার আগে গোলাপের প্রয়োজন হয়। প্রিয় মানুষকে ভালোবাসার কথা বলতে গেলে গোলাপ লাগবেই!নাহলে মনে হয় কিছু না কিছু অসম্পূর্ণ থেকে গেল। অথচ দেখ? এই গোলাপ অসাবধানতা বশত ছুয়ে দিলে কাটা বিধেঁ যায়। আমরা জানি আমাদের ঘুরে ফিরে গোলাপের কাছেই আসতে হবে, তারপরও রেগে আমরা চলে যাই। কিন্তু আপু? ফিরে তো ঠিকই আসি! তাই একটু সাবধানতা অবলম্বন করলে এই যে যন্ত্রণার মুখোমুখি হচ্ছি এটা আর হতে হবে না।
কথাগুলো বলতে বলতে মায়া খানিকটা এগিয়ে যায়। সিমি এখনো ঠাঁই দাঁড়িয়ে রইলো।
–তুই কি বোঝাতে চাইছিস?
মায়া মৃদু হাসির রেখা মুখে টেনে পেছনে ফিরে তাকালো,
–তুই বুদ্ধিমতী! এতটাও অবুঝ তুই না। সিমি চুপ করে রইল। সিমি কে চুপ করে থাকতে দেখে মায়া এগিয়ে আসে।
–অনেক বছর পেরিয়ে গেল। কেন জন্মালো না ভালোবাসা? মানুষ টা ভালোবাসার যোগ্য না, এমন কিন্তু না.. ওমন মানুষ খুঁজে পাওয়া মুশকিল। তারপরও কেন দিনের পর দিন এত অবহেলার মুখোমুখি সে হচ্ছে। সে এসবের যোগ্য না।
চোখ ভর্তি পানি নিয়ে মাথা তুলে তাকালো সিমি। সোজা হতেই চোখের পানি গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়লো। মায়া সিমির চোখের পানি মুছে দিলো,
–আমি জানি আমার বোন এতটা পাষাণ না। ভালো সেও বাসে কিন্তু প্রকাশ করতে পারছে না। কেন?
–আমি এতদিনে একবারও বুঝতে পারিনি যে আমি ওনাকে…ফুঁপিয়ে কেঁদে দিলো সিমি।
কাল সারারাত আমার ঘুম হয় নি। উনি এতটা নির্দয় কি করে হলেন। যেই আমি এই কয়েকটা বছর তার বুক ছাড়া ঘুমাইনি, সেই আমি কিভাবে তাকে ছাড়া ঘুমাবো। উনি একবারও ভাবলো না। উনি আমাকে ভালোই বাসে না। বাসলে এমন করতেই পারতো না।
–তুই বাসিস?
–হ্যাঁ আমি বাসি….সিমি মায়ার দিকে তাকালো। মায়া ফিক করে হেসে দিলো।
–গোপন কথা আর গোপন রইলো না।
সিমি চুপ করে রইলো। মায়া হালকা হেসে বলল,
–বলে দে না আপু! লোকটা কে বলে দে যে,তুই তাকে ভালোবাসিস। ততটা, যতটা ভালো তুই কাউকে বাসিস নি। তোর প্রথম আর শেষ প্রেম উনিই। বলে দে…
–আমি পারবো?
–পারবি! যা বলে দে।
সিমি আর এক মুহুর্তও দাড়ালো না চলে গেল। মায়া হালকা হেসে ছাদের রেলিং এর পাশে গিয়ে দাড়ালো। শাল আরো ভালো করে জড়িয়ে নিলো। স্বচ্ছ নীল আকাশের দিকে তাকিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল। মৃদু বাতাস গায়ে লাগতেই চোখ বন্ধ করে নিলো মায়া। একজোড়া শক্ত হাতের স্পর্শ পেয়ে মায়া ভ্রু কুঁচকে নিল। পেছনে ফিরতেই সামরান কপালে চুমু বসিয়ে দিলো।
–এত সকালে উঠে পড়লেন? বিস্মিত কণ্ঠে বলে মায়া।
— হ্যাঁ উঠে পড়লাম। কারণ… মায়ার একটু কাছে গিয়ে সামনে থাকা চুল কানের পেছনে গুঁজে দিলো সামরান।
–দূর থেকে বলা যায় না? ভ্রু কুঁচকে বলে মায়া।
–বিয়ে কি দূরে থাকার জন্য করেছি?
–বিয়ে করলে সবসময় কাছে থাকতে হবে, কোথায় লিখা আছে?
–আমার দলীলে। বলেই হাসলো সামরান।
–কেন যে বিয়েটা আপনাকে করলাম… বলেই ফোস করে নিঃশ্বাস ছাড়লো মায়া।
–কেন? আমাকে বিয়ে করে কি লাভ হয়নি?
–লাভ লসের জন্য কে বিয়ে করে?
–আমি…
–আপনার দ্বারাই সম্ভব।
–আমি এক পিস। বলেই চোখ টিপ মারলো সামরান। সামরানের হাতের বাধনে আবদ্ধ থেকেও মায়া একটু দূরে সরে গেল।
— অসভ্য লোক! আপনাকে ছেড়ে আমি চলে যাবো,আপনার জ্বালাতন সহ্য হচ্ছে না।
–গেলে নিজেরই কপাল পুড়বে। আমার মত এত আদর কেউ করবে না।
–হুহ!ভালোবাসা দিলে আদর করার মানুষের অভাব হবে না।
–মানলাম আমার মত হাজার জন পাবেন।
কিন্তু সেই হাজার জনের মাঝে আমায় পাবেন না।
আমার অভাব আপনাকে শেষ করে দেবে।
–এত কথা কে শেখালো? ভ্রু কুঁচকে বলে মায়া।
মাথা উঁচু করে হেসে দিলো সামরান। মায়া সামরানের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। সামরান হাসি থামিয়ে ভ্রু নাঁচিয়ে প্রশ্ন করে,
–কি দেখছেন?
— এক মায়াবী পুরুষ কে। মুখ ফসকে কথাটা বেরিয়ে যাওয়ার পর মায়া চোখ কুঁচকে বন্ধ করে জিহ্বায় কামড় বসালো। সামরান হেসে মায়ার নাকের ডগায় কামড় দিল। মায়া সামরান কে আস্তে করে চড় দিলো।
–আহহ!এসব কি? কামড় দিচ্ছেন কেন?
–শুধু নাক না আমার ইচ্ছে করে পুরো আপনিটাকেই খেয়ে ফেলি।
–শখ কত..ভেঙচি কাটলো মায়া।
সামরান হাসলো।
শেহেরজাদ ওয়াশরুম থেকে বের হতেই দেখলো বিছানায় জামা কাপড় রাখা। বিছানায় রাখা কাপড় গুলো শেহেরজাদ নিলো না। আলমারি খুলতেই পেছন থেকে সিমি বলে উঠল,
–সব কাপড় ধোয়ার জন্য নিয়েছি। এগুলো পরুন। পেছনে ফিরে চোখ ছোট ছোট করে তাকালো শেহেরজাদ। সিমি এগিয়ে এলো। বিছানায় থাকা কাপড় তুলে শেহেরজাদের দিকে এগিয়ে দিলো,
–এই নিন..
–লাগবে না।
–কেন? এইভাবে টাওয়াল পরেই অফিসে যাবেন?
শেহেরজাদ ভ্রু কুঁচকে নিলো। কথা না বাড়িয়ে শেহেরজাদ কাপড় নিয়ে ওয়াশরুমে চলে। সিমি হেসে দিলো।
জামা কাপড় পরে শেহেরজাদ রুমে এসে এদিক ওদিক কে যেন খুঁজতে শুরু করে। সিমি পেছন দিক থেকে ডাক দেয়,
–এটা খুঁজছেন?
শেহেরজাদ পেছনে ফিরতেই দেখলো সিমির হাতে টাই। এগিয়ে এসে টাই নিতে হাত বাড়ালেই সিমি হাত সরিয়ে ফেলে।
–আমি পরিয়ে দিই?
–নাহ! বলে আবারও টাই নেওয়ার জন্য হাত বাড়ালো শেহেরজাদ। সিমি এবারও সরিয়ে নিলো।
— শুনেছি বউরা অনেক যত্নে স্বামী কে টাই পরিয়ে দেয়।
–আমার টাই দাও।
–আমি পরিয়ে দেব। দাতেঁ দাতঁ চেপে অন্যদিকে তাকালো শেহেরজাদ। সিমি এগিয়ে গিয়ে শার্টের কলারে হাত দিতেই শেহেরজাদ সিমির দিকে তাকালো। মুচকি হাসি মুখে একেঁ শেহেরজাদ কে টাই পরিয়ে দিলো সিমি। টাই পরানো শেষে শেহেরজাদ চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই সিমি কলার ধরে টেনে সামনে এনে দাড়ঁ করায়। ত্রস্ত নয়নে শেহেরজাদ নিজের কলারের দিকে একবার তাকালো তারপর সিমির দিকে একবার। গত কয়েকবছরে যেই মেয়ে সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলতে ভয় পেত সেই মেয়ে কি না কলার ধরে টানাটানি করছে,অবিশ্বাস্য ব্যাপার। সিমি একটু এগিয়ে মাথা বাকা করে হাসি মুখে গেয়ে উঠলো,
Cham cham ambra de taree
Kehnde ne sajna..
Tu hi chan mere is dill daa
Maan le ve sajnaa..
Tere binaa meraa
Hovee na guzaraaa
Chadd ke na javi meinu
Tu hi hein saharaa…
এক দৃষ্টিতে সিমির মুখপানে চেয়ে রইলো শেহেরজাদ। গান গাইছে সিমি,এই প্রথম কোনো জড়তা ছাড়াই শেহেরজাদের সামনে গান গেয়েছে। পরক্ষণেই রাতের কথা মনে পড়ে যায় শেহেরজাদের। একটু দূরে সরে গিয়ে হাতের উল্টো পিঠে গালের পাশ মুছে নিলো শেহেরজাদ তারপর ত্রস্তপদে বেরিয়ে গেল রুম ছেড়ে।
#প্রেমের_খেয়া
#লেখিকা_জান্নাতুল_মীর
#পর্ব_৩১
বিয়ের পর ১৫দিন নিমিষেই কেটে গেল। সামনেই এক্সাম মায়ার। পড়ালেখার চাপ বেড়েছে। রেগুলার কলেজ না গেলেও পড়াটা ঠিকই রেগুলার পড়তে হচ্ছে। সামরান জোর দাবী জানিয়েছে, মায়ার স্বপ্ন মায়াকে পূরণ করতেই হবে। ব্যারিস্টারের আসনে মায়াকে সামরান দেখতে চায়। যার কারণে পড়া লেখা বিয়ের পর আবার শুরু করেছে।
পড়তে পড়তে টেবিলে মাথা রেখে দিলো মায়া। রাত অনেক হয়েছে,ইদানিং সামরান দেরীতে বাড়ি ফেরে। সন্ধ্যায় বাসায় আসার পর দুই ভাই একসাথে বেরিয়ে যায়। শেহেরজাদ জলদি ফিরে এলেও সামরানের ফিরতে ফিরতে রাত ১০টার পর ধরে। মায়ার রুমে এসে সেলিনা মালিক দেখলো মায়া টেবিলে মাথা রেখে পড়ছে। রুমে আর প্রবেশ করলো না সেলিনা মালিক। রান্নাঘরে গিয়ে কড়া করে এক কাপ চা বানিয়ে নিয়ে এলো। মায়ার মাথায় হাত দিয়ে স্পর্শ করতেই মায়া চমকে উঠে পড়ে। সেলিনা মালিককে দেখে মৃদু হাসি হেসে বলল,
–আম্মা কিছু বলবে?
–পড়তে পড়তে ক্লান্ত লাগছে নাকি?
–নাহ্! ঠিক আছি। তুমি খেয়েছো?
–সামরান আসে নি তো। আমি সামরান ছাড়া খাই?
মায়া হালকা হাসলো,
–তোমার গুণধর ছেলের সেই খেয়াল আছে। কোথায় কোথায় ঘুরে বেড়ায়।
–অফিসে ইদানিং কাজের চাপ বেশি,তাই হয়তো একটু বেশিই ব্যস্ত।
–ওহহ! আচ্ছা থাক। চলো খেয়ে নেবে, আজ আমার সাথে খেয়ে নাও।
–তুই আজ আগেই খেয়ে নিবি?
–ওমা খাবো না কেন? তোমার ছেলের জন্য বসে থাকতে থাকতে আমার পেটে শিল পড়ে।
মায়ার কথা শুনে সেলিনা মালিক ফিক করে হেসে দিলেন।
–চল।
খাওয়ার টেবিলে সিমি,মায়া আর সেলিনা মালিক বসেছেন। শেহেরজাদ আর সামরান বাহিরে। সামাদ মালিক পার্টির কাজে ঢাকা গেছেন ৩দিন হলো। সামরান আর শেহেরজাদের বসার চেয়ারের দিকে একবার তাকিয়ে সেলিনা মালিক প্রশ্ন করেন,
–ওরা কেউই ফেরে নি তাই না?
–নাহ আম্মা ফেরে নি। চেয়ার টেনে পাশে বসে বলে সিমি
–আচ্ছা আয় খেয়ে নে। আজ আমি খাইয়ে দি চল। এক প্লেটে ভাত নিয়ে সেলিনা মালিক দুজনকেই খাইয়ে দিলেন। শাশুড়ী আর বউয়ের এমন সম্পর্ক খুব কমই দেখা যায়। সেলিনা মালিক শুধু একজন আদর্শ মা না, একজন দায়িত্ববান শাশুড়ী ও।
খাওয়া দাওয়া শেষ করে মায়া নিজের রুমে চলে গেল। সিমি ও নিজের রুমে গিয়ে বারান্দায় বসে পড়ে। শেহেরজাদের পুরোনো দুষ্টু – মিষ্টি আবদার গুলোর কথা মনে পড়তেই নিজেই অজান্তেই খিলখিলিয়ে হেসে উঠে সিমি। হঠাৎ মাথায় একটা বুদ্ধি চলে আসে সিমির। বারান্দার দরজা বন্ধ করে দিলো,সাথে রুমেরও।
বইয়ের পাতা উল্টাতেই ফোনের রিং বেজে উঠল মায়ার। একটা আননোন নাম্বার থেকে ফোন এসেছে। ঘড়ির দিকে তাকাতেই দেখলো রাত ১১ঃ৫৭! এই রাতে কে ফোন করলো। বই বন্ধ করে দেয় মায়া। রিসিভ করে ফোন কানে ধরতেই ওপাশ থেকে সেই কন্ঠটি ভেসে আসে।
–হ্যালো!
এই কন্ঠ মায়া আগেও শুনেছে। এক মধ্যরাতে এই আকুল কন্ঠের ব্যাকুল সুর শুনে মায়া ঘুমাতে পারে নি। চট করেই চেয়ার ছেড়ে দাঁড়িয়ে গেল মায়া। কান থেকে ফোন সরিয়ে ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকাতেই দেখল সেই নাম্বারটি। খুব মনে না পড়লেও, আবছা আবছা কিছুটা মনে আছে মায়ার। শুকনো ঢোক গিলে মৃদুস্বরে বলল,
–কে?
–চিনতে পারেন নি? দিস ইজ নট ফেয়ার অলকানন্দা। আমি ভোলার মত মানুষ নই বলুন। তারপরও আপনি ভুলে গেলেন। ঘোর অপরাধ! কঠোর শাস্তি হবে!
মায়া চোখ বন্ধ করে জোরে নিঃশ্বাস টেনে নিলো। জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে নিয়ে কাপাস্বরে বলল,
–সামরান?
–ছাদে অনেক ঠান্ডা। আমাকে কি এই ঠান্ডায় মেরে ফেলবেন?
সামরানের কথা শুনে মায়া আর এক মুহুর্ত ও দেরী করলো না। ছাদের উদ্দেশ্যে পা বাড়ালো। ছাদে প্রবেশ করতেই ঠান্ডা বাতাসে পুরো শরীর অসাড় হয়ে এল। দুইহাতে নিজের দুই বাহু চেপে ধরে মায়া সামনে এগিয়ে গেল।
পুরো ছাদ অন্ধকার। এই ঘুটঘুটে অন্ধকারে ভয় লাগছে মায়ার। ভয়ে হৃদস্পন্দন বেড়ে গেল। হঠাৎ পেছন থেকে সামরানের মিষ্টি কন্ঠ ভেসে এল,
💞💞💞
তুমি চাঁদের জোছনা নও
তুমি ফুলের উপমা নও,
তুমি চাঁদের জোছনা নও
ফুলের উপমা নও,
নও কোনো পাহাড়ি ঝর্ণা
আয়না– তুমি হৃদয়ের আয়না…
মায়া পেছনে ফিরতেই দেখলো ছাদে অগণিত মোমবাতি জ্বলছে। মোমবাতির আবছা আলোয় কালো শার্ট পরিহিত সামরান এর মেঘবর্ণ মুখ স্পষ্ট দেখা গেল। মুখের সেই মৃদু হাসিটি দেখে মায়া চোখ বন্ধ করে নিলো। অস্ফুটস্বরে গেয়ে উঠলো,
তুমি সাগর নীলিমা নও
তুমি মেঘের বরষা নও,
তুমি সাগর নীলিমা নও
মেঘের বরষা নও,
তুমি শুধু আমারই গয়না
আয়না—আমি হৃদয়ের আয়না।
সামরানের মুখের হাসি প্রশস্ত হলো। আস্তে আস্তে ধীর পায়ে এগিয়ে এসে মায়ার সামনে দাড়াঁলো। মায়া এক হাত সামরানের গালের পাশে রেখে হালকা হেসে গেয়ে উঠলো,
কবির লেখা যত কবিতা
শিল্পীর আকাঁ যত ছবি,
তোমার তুমির কাছে হার মেনে
যায় যেন সবই,
সামরান দু হাতে মায়ার কোমর জড়িয়ে ধরে,
সাঝের বেলার রাঙা গোধুলি
বর্ষা কালের ভরা নদী,
তোমার রুপের কাছে হার মেনে
যায় যেন সবই।
মায়া দুই হাতে গলা জড়িয়ে ধরলো,
তুমি সাগর নীলিমা নও
মেঘের বরষা নও
তুমি শুধু আমারই গয়না
আয়না—আমি হৃদয়ের আয়না
কোমর ছেড়ে এক হাত উপরে তুলে সামরান মায়ার খোপা খুলে দিলো। লম্বা চুল গুলো পুরো পিঠে ছড়িয়ে গিয়ে কোমরে থাকা সামরানের হাত স্পর্শ করলো,
বাবুই পাখির সাজানো বাসা
ময়না পাখির কথা গুলো,
তোমার গুণের কাছে সব কিছু হার মেনে গেল,
ভালোবাসার রুপালি তারা
সূর্যের মাঝে যত আলো,
তোমার প্রেমের কাছে সব কিছু হার মেনে গেল। দুপাশে মাথা নাড়ালো মায়া।
তুমি চাঁদের জোছনা নও
ফুলের উপমা নও
নও কোনো পাহাড়ি ঝর্ণা
আয়না—আমি হৃদয়ের আয়না।
আয়না —তুমি হৃদয়ের আয়না।
গান শেষ হতেই ঝাপটে জড়িয়ে ধরে মায়া সামরান কে। এক হাতে কোমর জড়িয়ে রেখে অন্য হাত মায়ার মাথার পেছনে রাখে সামরান। মায়া ফুপিঁয়ে কেঁদে উঠে।
–কাদঁছেন কেন?
মায়া নিশ্চুপ। সামরান মায়াকে নিজের থেকে সরিয়ে মায়ার চোখের পানি মুছে দেয়। তারপর লালবর্ণ ধারণ করা নাকের ডগায় আলতোভাবে চুমু বসালো। মায়া নাক টেনে বলল,
–যেদিন প্রথম এটা গেয়েছিলেন, আমি সারারাত ঘুমাতে পারিনি।
–কে জানতো? আমাকে কেউ আমার চেয়েও বেশি ভালোবাসে.. কানের কাছে মুখ নিয়ে বলে সামরান।
মায়া ঝাপটে জড়িয়ে ধরে।
–আপনি আমার কাছে তেমন,
হাজার হাজার তারার ভিড়ে একটা চাঁদ যেমন।
মায়ার কথা শুনে সামরান ভ্রু কুঁচকে দূরে সরে আসে। সরস গলায় বলে,
–আমি তো অমাবস্যার রাতের মত ঘুটঘুটে অন্ধাকার। চাঁদ তো নই?
–মোটেও না। সত্যি কি জানেন?
-উহুম জানিনা। দুপাশে মাথা নাড়িয়ে বলে সামরান।
মায়া দু পায়ের তালুতে ভর দিয়ে সামরানের গলা জড়িয়ে কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলল,
–আপনার এই রঙ আমার অনেক পছন্দের। আপনি মানুষটাও আমার অনেক পছন্দের। শুধু পছন্দেরই না,আমার সব। আপনি আমার আলোয় ঝলমল করা সেই দিনের মত, দিনের শেষে ঘুটঘুটে অন্ধকার নেমে আসা মোহময়ী রাত আপনি আমার। আপনি আমার সব।
সামরান চোখ বন্ধ করে নিলো। হাতের বাধন শক্ত করে মায়াকে জড়িয়ে ধরলো। মায়া সামরানের ঘাড়ে চুমু দিয়ে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে।
রুমে প্রবেশ করতেই শেহেরজাদ ভ্রু কুঁচকে নিলো। সিমির পরনে শাড়ি। শাড়ির আঁচল কোমরে গুঁজে কি যেন এদিক ওদিক খুঁজে চলেছে মেয়েটি। শেহেরজাদ সেদিকে না তাকিয়ে রুমে ঢুকে ফ্রেশ হতে চলে গেল।
ফ্রেশ হয়ে বের হতেই দেখলো সিমি শাড়ির আঁচল ভাজ করছে। শেহেরজাদ চোখ সরিয়ে নিলো। কাউচে্ বসে পড়ে।
সিমি গিয়ে পাশে বসে।
–সরো আমি ঘুমাবো।
–আমিও তো ঘুমাবো।
–হ্যাঁ বুঝলাম। নিজের বিছানায় যাও।
–নিজের মানে?
–মানে ওখানে। বিছানা দেখিয়ে বলে শেহেরজাদ।
সিমি ভ্রু কুঁচকে নিলো। সিমিকে বসে থাকতে দেখে শেহেরজাদ উঠে সামনের দিকে পা বাড়ালো। সিমি হাত ধরে নেয়। শেহেরজাদ পেছনে ফিরতেই সিমি জড়িয়ে ধরে। আচমকা জড়িয়ে ধরায় শেহেরজাদ অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। সারা শরীর হিম হয়ে আসছে। হাতের মুঠো শক্ত করে নেয় শেহেরজাদ। হৃদস্পন্দন যেন মুহুর্তেই বিদ্যুৎ গতিতে বেড়ে গেল। নিঃশ্বাস এর গতি বেড়ে গেল। শ্বাস নিজের ইচ্ছায় আটকে নিলো শেহেরজাদ। দাতেঁদাতঁ চেপে সিমিকে বলল,
–সরো।
–আগে আমার ইচ্ছে পূরণ করে দিন।
–কিসের–কিসের ইচ্ছে?
সিমি হালকা সরে কানের কাছে মুখ ফিরিয়ে বলে,
—আমার একটা ছোট্ট শেহেরজাদ মালিক চাই,দিয়ে দিন।
সিমির কথা শুনে শেহেরজাদ চোখ বন্ধ করে নিলো। অস্ফুটস্বরে বলল,
–নাহ্!
–আমার লাগবেই। নাহলে আজ ছাড় নেই। কথাটি বলে শেহেরজাদকে আরাও শক্ত করে জড়িয়ে ধরে সিমি। বাধন যত শক্ত হচ্ছে ততই যেন শেহেরজাদের ভেতরে এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। কন্ঠনালীর পাশে থাকা রগ গুলো বার বার ফুলে উঠছে।
–আমি কিন্তুহ্…
—আই লাভ ইউ!! এইবার আর শেহেরজাদ নিজেকে আটকে রাখতে পারলো না। দুহাতে সিমিকে জড়িয়ে ধরতেই সিমি হেসে দিলো……..
চলবে???
(