#প্রেমের_খেয়া
#লেখিকা_জান্নাতুল_মীর
#পর্ব_৩৫_শেষ_পর্ব
(অর্ধেক পড়েই কেউ মোচড় দিবেন না। পুরোটা পড়ার অনুরোধ রইলো। আর অবশ্যই, অবশ্যই বিঃদ্রঃ টা পড়বেন। সবার গঠনমূলক মন্তব্যের আশায় রইলাম। যা ভুল ছিলো তা শুধরে দিয়েছি।)
ছলছল নয়নে কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে থাকা হ্যান্ডকাফ পরা সামরানের দিকে তাকিয়ে রইল মায়া। এজলাসে বিচারকের আসনে বসে থাকা বিচারকের দিকে একবার তাকিয়ে পাশেই কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে থাকা তার প্রাণপ্রিয় শ্যাম পুরুষ এর দিকে তাকিয়ে থম মেরে দাঁড়িয়ে রইলো। চোখ জোড়া সামরানের দিকে স্থির। সামরান দৃষ্টি নত করে দাঁড়িয়ে আছে। মায়ার দিকে একবারও তাকাচ্ছে না। যার হাতে লাল গোলাপের তোড়া দেখার আশায় বসে ছিলো সেই হাতেই হ্যান্ডকাফ দেখে মায়ার ভেতরটা ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যাচ্ছে। যেই চোখে এত বছরের জমিয়ে রাখা ভালোবাসার সাজানো শব্দ দেখবে ভেবেছিলো সেই চোখই এখনো মায়া দেখলো না। প্রাণপ্রিয় স্বামীকে সারপ্রাইজ দিতে গিয়ে মায়া নিজেই সারপ্রাইজড হয়ে গেল। গলা ধরে আসছে মায়ার। যাকে সে ফেরেশতা ভেবেছিলো তার এ কি দশা? যাকে দেখে মায়া মানুষ কে বিশ্বাস করতে শিখেছিলো সেই মানুষই এতবড় ধোকাটা কি করে দিলো? আজকেই প্রথম সামরানকে কোর্টে তুলেছে। আর এই কেসের ভারই মায়ার কাছে এসে পড়েছে। যাকে আজীবন ফেরেশতা ভেবে এসেছে তাকে কি করে অপরাধী ভেবে ফাসির দড়িতে ঝুলানোর ব্যবস্থা করবে মায়া? কাদঁতে চেয়েও কাদঁতে পারছে না মায়া। শুধু সামরানের দিকে তাকিয়ে রইলো। নিজেকে কোনো মতেই সামাল দিতে পারছে না মেয়েটি। শেষমেষ বিচারকের কাছ থেকে একটা দিন সময় প্রার্থনা করে। বিচারক প্রার্থনা মঞ্জুর করতেই কোর্ট রুম থেকে বেরিয়ে এলো মায়া । নিজের পার্সোনাল চেম্বারে এসে দরজা বন্ধ করে দিলো মায়া। গা থেকে কোর্ট খুলে ছুড়ে মারে। চিৎকার করে কেঁদে মাটিতে বসে পড়ে। দু’হাতে নিজের মুখ চেপে ধরে শক্ত করে।
–ইয়া আল্লাহ! এটা তুমি কি করলে? আমি কিভাবে পা-পারব-পারবো? ন-না আম-আমি পারবো না। আমি এই কেসের বিরুদ্ধে লড়তে পারবো না।। আমি পারবো না ওনার অপরাধ এইভাবে সবার সামনে তুলে ধরতে, ইয়া আল্লাহহহ্। আপনি কেন এমন করলেন? আমি কিভাবে আপনার বিরুদ্ধে লড়াই করবো? কিভাবে? যেই কালো কোট আমি আপনার জন্য পড়েছি, সেই কালো কোট পড়ে আপনারই বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে লড়াই আমি করতে পারবো না। একবারও নিজের অলকানন্দার কথা ভাবলেন না? একবারও না? আমি যদি জানতাম আমার কর্মজীবনের অপরাধীদের তালিকায় প্রথমে আপনার নাম হবে,তাহলে কোনোদিনও আমি ফিরে আসতাম না। কোনো দিন ও না। দুই হাটু ভাজ করে মুখ গুঁজে কাদঁতে থাকে মায়া। হঠাৎ দরজায় কড়া নাড়ার শব্দে চমকে উঠে মায়া। উঠে দাঁড়িয়ে চোখ মুছে নিলো। দরজা খুলতেই দেখলো সিমি আর শেহেরজাদ দাঁড়িয়ে। তাদের সাথে একটি বাচ্চা মেয়ে। সিমি ভেতরে ঢুকে মায়াকে জড়িয়ে ধরে। মায়া সিমিকে ধরে আবারও কেঁদে দিলো। সিমি সরে আসে,
–দেখ এটা কে? বাচ্চা মেয়েটির দিকে ইশারা দিয়ে বলে সিমি।
মায়া বাচ্চা মেয়েটির সামনে হাটু গেড়ে বসে পড়ে। কান্না মিশ্রিত স্নিগ্ধ স্বরে বলে,
–নাম কি তোমার?
–মায়রা।
মায়া ভ্রু কুঁচকে সিমির দিকে তাকালো। তারপর বাচ্চা মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করে,
–কে রেখেছে এই নাম তোমার?
–আমার বাব্বা।
–বা–বাব–বাব্বাহ্.. বলে সিমির দিকে তাকাতেই সিমি বলে,
–ভাইয়া রেখেছে। তোর নামের সাথে মিলিয়ে। সিমির কথা শেষ হতেই মায়া মায়রা কে ঝাপটে জড়িয়ে ধরে। নিঃশব্দে কাদঁছে মেয়েটি। শেহেরজাদ মায়ার এমন অবস্থা দেখে সিমিকে ইশারা দিলো। সিমি কাধ স্পর্শ করতেই মায়া উঠে দাঁড়ালো। মায়া উঠে দাঁড়াতেই মায়রা আঁচল টেনে ধরে। মায়া মায়রার দিকে তাকালো,
–তুমি কি আমার বাব্বা কে ফাসি দিয়ে দেবে?
মায়রার এমন কথা শুনে মায়া দু’হাতে মুখ চেপে ধরে পিছিয়ে গেল অনেকটা। শেহেরজাদ মেয়েকে আটকালো,
–মায়রা এসব কি বলছো? কিচ্ছু হবে না বাব্বার। সিমি মায়ার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো।
–তুই একবারও বলিস নি যে তুই আসবি। অনেক জানানোর চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু, তোকে ফোনে পাইনি।
সিমির কথা শুনে মায়া চুপ করে রইলো। পাথরের ন্যায় শক্ত হয়ে রয়েছে মেয়েটা।
সিমি মায়ার বিমর্ষ মুখের দিকে তাকিয়ে কাধে রেখে বলল,
–বাড়ি যাবি না?
মায়া তাচ্ছিল্যের হাসি হাসে।
–বাড়ি? যাবো তো, যাবো না কেন? যাবো।
–চল।
–তোরা যা। আমি আসছি। মায়ার কথা শুনে সিমি আর জোর করলো না। শেহেরজাদের ইশারা দেখে চলে এল।
চেয়ারে বসে মাথা এলিয়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করে নিলো।
সেলের দেওয়ালে মাথা ঠেকিয়ে বসে আছে সামরান। চোখ মুখ শুকিয়ে আছে। শূন্যে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে কি যেন আনমনে ভাবছে সে। কোর্ট রুম ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার সময় আড়চোখে মায়াকে একবার দেখেছিলো সে। সাদা কালো শাড়ির উপর কালো লম্বা কোর্টে এত মায়াবী লাগছিলো যা প্রকাশ করার ভাষা সামরানের নেই। তার ছোট্ট মানুষটি অনেক বড় হয়ে গেছে আজ। ভাবতেই সামরান ঠোঁট কামড়ে হেসে দিলো।
–আপনি কি আমাকে ঘৃণা করবেন অলকানন্দা? আমি কি আপনাকে চিরতরে হারিয়ে ফেললাম? যাওয়ার আগে কি একবারও আমি আপনার মুখের সেই স্নিগ্ধ হাসি দেখতে পাবো না? নিয়তি আমাকে এই কোন মোড়ে এনে দাঁড় করালো? চোখ বন্ধ করে নেয় সামরান।
ধপ করে চেয়ার ছেড়ে সোজা হয়ে বসে মায়া। চোখ জোড়া এতক্ষণ বন্ধ ছিলো। একটু আগে কোর্ট রুমে যা যা হলো তা বন্ধ চোখের সামনে ভেসে উঠলো। ঝরঝর করে ঘামতে শুরু করলো। তাড়াতাড়ি পানির গ্লাস তুলে মুখে চুমুক দিলো মায়া। ঢকঢক করে পুরো পানি শেষ করলো। বার বার চোখের সামনে ভেসে উঠছে সামরানের অপরাধের সব প্রমাণ। যা মায়া নিজের মুখে বলেছে,
”আজ থেকে ৬বছর আগে নিজের দোষ ঢাকার জন্য সামরান মালিক ১২জন মানুষ কে নশৃসংশভাবে হত্যা করেছিল। শুধু তাই না প্রমাণ লোপাট করতে ব্লাস্ট করিয়েছেন। নারী পাচার,বে-আইনি অস্ত্র,প্রানঘাতী ড্রাগস থেকে শুরু করে আরও নানান অনৈতিক কাজের সাথে যুক্ত ছিল সামরান মালিক। শুধু তাই নয়, নিজের চাচা কেও হত্যা করতে দুইবার ভাবেন নি তিনি। ‘ দু’হাতে কান চেপে ধরে মায়া। দম আটকে আসছে মেয়েটির। শ্বাস টেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে অনেক। নিজেরই মুখে সামরানের অপরাধ গুলো উচ্চারণ করার সময় বার বার গলা ধরে আসছিলো। না চাইতেও নিজের দায়িত্ব পালন করতে হয়েছে। উঠে দাঁড়িয়ে চোখ মুছে নিলো। পরনের শাড়ি ঠিক আছে নাকি দেখে বেরিয়ে গেল কেবিন ছেড়ে।
সেলের দরজা খোলার শব্দ শুনে মাথা তুলে তাকালো সামরান। মায়াকে প্রবেশ করতে দেখে উঠে দাঁড়িয়ে গেল। মায়া ইশারা দিতেই কারারক্ষী চলে গেল। ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে সামরানের সামনে দাঁড়ালো। কাজল কালো চক্ষুদ্বয় পানিতে ভরে আছে। সামরানের চেহারার দিকে তাকিয়ে হাতের দিকে তাকালো। হাতে হ্যান্ডকাফ দেখে মায়া আস্তে আস্তে হাত এগিয়ে সামরানের হাত স্পর্শ করলো। হ্যান্ডকাফ হালকা সরাতেই দেখলো হাতে দাগ বসে গেছে। সেই দাগ দেখে মায়া ডুকরে কেঁদে উঠলো। সামরানের দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালো,
–কষ্ট হচ্ছে?
–কেমন আছেন? সামরানের শান্ত চাহনী, উদাসীন কন্ঠস্বর যেন মায়ার ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে ভেঙে দিলো।
–আমি ভালো নেই। আমি একটুও ভালো নেই। কিছু করুন। আমার অনেক কষ্ট হচ্ছে। আপনি না আমার কষ্ট সইতে পারেন না? দেখুন না, আমি সকাল থেকে কিছু মুখে দিই নি। আমার গলা দিয়ে খাবার নামছে না। আমার এখানে(বুকে হাত রেখে) শুকিয়ে আছে। খালি খালি লাগছে। আমি এসব মেনে নিতে পারছি না। বিশ্বাস করুন। আপনি বুঝতে পারছেন আমার কতটা কষ্ট হচ্ছে? সামরানের শার্ট খামচে ধরে মায়া কাদঁতে থাকে। সামরান শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। কাদঁতে কাদঁফে সামরানের বুকে মাথা ঠেকিয়ে দিলো মায়া । সামরানের হাত বাধা তাই মায়াকে স্পর্শ করতে পারছে না। শান্ত কন্ঠে বলে উঠল,
–শক্ত হোন! ভেঙে পড়লে চলবে? এখনই যদি ভেঙে পড়েন আমার বিরুদ্ধে লড়াই কিভাবে করবেন?
মায়া মাথা তুলে ভ্রু কুঁচকে তাকালো সামরানের দিকে।
–আপনি জানেন আপনি কি বলছেন?
–নিজের অপরাধ স্বীকার করে নিচ্ছি।
–একবার বলে দিন ওরা যা বলছে সব মিথ্যে। বলে দিন সব মিথ্যে আমি বাকিটা দেখে নেবো। একটি বার বলে দিন। জানেন,জীবনে বার বার সাপোর্ট পাওয়া যায় না।
ভালোবাসার চেয়ে প্রিয় কাওকে বার বার পাওয়া যায় না।
কাছে আছি আগলে নিন আমায়।
কারণ হারিয়ে গেলে আর পাবেন না আমায়। একটি বার আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বলে দিন।
–নাহ্! অনেক বলেছি মিথ্যে আর না। সময় এসে গেছে সব ছেড়ে মুক্ত হওয়ার।
সামরানের এমন শক্ত কথা শুনে মায়া দু কদম পিছিয়ে গেল। সামনে থাকা মানুষটিকে অচেনা মনে হচ্ছে।
–ওরা যা বলেছে সব সত্যি?
–হ্যাঁ!
–যদি তাই হবে,তাহলে কেন আমাকে আপনি বাহিরে পাঠালেন? কেন আমাকে ব্যারিস্টার বানালেন? আপনার বিপক্ষে দাঁড়িয়ে লড়াই আমি করতে পারবো না, এটা জানার পরও কেন আপনি আমাকেই…কাদঁতে কাদঁতে হাটু গেড়ে বসে পড়ে মায়া। সামরান তাকিয়ে রইলো মেয়েটির দিকে।
–কারণ,রায় দেওয়ার ব্যবস্থা যদি স্বয়ং আপনি করে থাকেন তাহলে আমি হাসতে হাসতে ফাসির দড়ি গলায় হার হিসেবে পড়ে নেব অলকানন্দা। হালকা হেসে বলল সামরান। মায়া মাথা তুলে তাকালো। চোখ মুছে উঠে দাঁড়ালো।
–তাই? বেশ তবে তাই হোক। শাস্তি তো আমি আপনাকে দিবোই। বিশ্বাস করুন, কষ্ট হবে আমার অনেক তারপরও আপনাকে ফাসির দড়িতে ঝুলিয়ে তবেই আমি স্বস্তির শ্বাস নেব। আপনি বলেছিলেন না, অপরাধীদের শাস্তি দিতে হবে আমায়। আপনাকে দিয়েই না হয় শুরু করি।
মায়ার কথা শুনে মাথা উঁচু করে হাসলো সামরান। একটু এগিয়ে এসে মায়ার সামনে দাঁড়িয়ে বলে,
–বিচারকের আসনে যদি আপনি থাকেন তাহলে আমি সমস্ত হওয়া না হওয়া গুনাহ মাথা পেতে নেবো অলকানন্দা!!!
শর্ত শুধু একটাই আমার, আপনি আমার মৃত্যু ক্ষণে আমার সামনে উপস্থিত থাকবেন। আর বিচারকের আসনে আপনি থাকবেন। নাহলে আমার শাস্তি কেউ নির্ধারণ করতে পারবে না।
বিশ্বাস করুন, আমি প্রচন্ড তৃপ্তির সাথে মৃত্যু কে সাদরে গ্রহণ করে নেবো যদি, ওই চেয়ারটাই আপনি থাকেন।সামরান মালিক পারে না এমন কিছুই নেই। আপনি শুধু শর্ত মেনে নিন। কি পারবেন তো শর্ত মেনে নিতে?
মায়ার চোখ দিয়ে অনবরত পানি ঝরছে। আটকে আসা দম কিছুতেই টেনে নিতে পারছে না।
–আমার ভালোবাসার এই প্রতিদান কেন দিলেন আপনি?
–আমি নিষ্ঠুর। এসব হওয়ারই ছিলো।
–ফেরেশতা ছিলেন তো! ছলছল নয়নে তাকিয়ে বলল মায়া
–ওটা মুখোশ ছিলো।
–এমন গাড় অভিনয় না করলেও পারতেন।
–হারানোর ভয়ে।ভালো বেসেছিলাম তো,
–সত্যি বেসেছিলেন? চোখ থেকে দুফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়লো মায়ার
–মিথ্যে কেন মনে হলো? মায়ার চোখে চোখ রেখে বলে সামরান
— শেষ ইচ্ছে কি? শ্বাস টেনে ঢোক গিলে বলল মায়া।
–ইচ্ছে নেই। তবে চাওয়ার অনেক কিছু আছে।
–কিছু চাইবেন না। কারণ আপনার কোনো চাওয়া আমি পূরণ করতে পারবো না। আপনি নিজেই তার রাস্তা বন্ধ করে দিয়েছেন।
— এতোটা ঘৃণা?
— বাধ্য করেছেন! বলেই মায়া পিছিয়ে গেল। সেল ছেড়ে বেরিয়ে যেতে নিলেই সামরান ডাক দিলো,
–অলকানন্দা?
মায়া অসহায় দৃষ্টিতে তাকালো,
–সাদা কালো শাড়িতে আবেদনময়ী লাগে। আমার ঘুম হবে না আজ আর।
মায়া আর দাঁড়ালো না। ছুটে বেরিয়ে গেল। মায়া চলে যেতেই সামরান আবার বসে পড়ে। দেওয়ালে মাথা ঠেকিয়ে শূন্যে তাকালো,
–জানি চাওয়ার সুযোগ নেই তবে,আপনার কাছে যদি আরেকবার কিছু চাওয়ার সুযোগ পেতাম
তাহলে আমি আপনাকেই চাইতাম অলকানন্দা। বলেই ঠোঁট কামড়ে হাসলো সামরান।
বাড়ি ফিরে আসে মায়া। বাড়িতে প্রবেশ করতেই পুরো বাড়ি একবার দেখে নিলো। চুপচাপ,শান্ত বাড়িটির দিকে তাকিয়ে মায়ার পুরনো অনেক কথায় মনে পড়ে গেল। আনমনে ভেজা দৃষ্টি নিয়ে হেসে দিলো মায়া। সিমি মায়াকে নিয়ে সোফায় বসালো। মায়া নির্লিপ্ত চাহনী নিয়ে প্রশ্ন করলো,
–আম্মা, আব্বা,ছোট আব্বু,ছোট মা কোথায়?
সিমি মায়ার কথা শুনে মাথা নিচু করে ফেলল,
–আজ ২৮ দিন তারা নেই। চিরতরে ছেড়ে চলে গেছে চারজনই একসাথে। সিমির কথা শুনে মায়া আরো বড় একটি ধাক্কা খেল।
–এ –এসব ক-কি বলছিস?
–হ্যাঁ, আফফান মালিক আব্বার ছোট ভাই। আর তার ছেলে ইবাদ মালিক,এরা দুজনের ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছিলো ভাইয়া। শুধু তাই না, এই পরিবারের কম ক্ষতি করেনি। আব্বা আম্মা বাড়ি গিয়েছিলো ফেরার সময় মা বাবাকে নিয়েই ফিরছিলো আর তখনই তাদের গাড়ি ব্লাস্ট হয়। ভাইয়া পাগলের মত হয়ে গেছিলো। যার ফলস্বরূপ ওদের মেরেই দিলো। আম্মা আব্বার এমন অবস্থা মেনে নিতে ভাইয়ার অনেক কষ্ট হচ্ছিলো,শুধু তাই না তুই আসলে তোকে কি বলবে সেই চিন্তায় উনি পাগলের চেয়েও বেশি খারাপ হয়েছিলো যার কারণে….
–বুঝেছি। মায়া উঠে চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই সিমি ডেকে উঠে,
–কোথায় যাচ্ছিস?
–ফ্রেশ হবো।
–কিছু বলার নেই?
–আছে তো। কাল রায় দেওয়ার পর দেখি।
–রায় কি হবে?
— অপরাধ যখন করেছে শাস্তি তো পেতেই হবে। কথাটা বলেই মায়া চলে গেল। সিমি নিরবে চোখের জল ফেলে সোফায় বসে পড়লো। সব কিছু কি এভাবেই এলোমেলো হয়ে যাবে?
সামরানের ফাসি নিশ্চিত করে বিচারক। মায়া আর সামরানের সাথে দেখা করেনি। করতেও চায় না। ইতিহাসে এই প্রথম হয়তো কোনো স্ত্রী তার স্বামীর বিপক্ষে কেস লড়ে তাকে ফাসিতে ঝুলিয়েছে। ফাসি শেষে পুলিশরা লাশ নিয়ে বাড়ি চলে আসে। লাশ রেখে দিয়ে পুলিশরা চলে গেল। সিমি সামরানের লাশ দেখে পাথরের ন্যায় শক্ত হয়ে রইলো। মায়রা হাউমাউ করে কাদঁছে। শেহেরজাদ ভাইয়ের লাশের পাশে বসে রয়েছে। ভাইয়ের মায়ায়ভরা চেহারা থেকে দৃষ্টি যেন সরছেই না। আর মায়া? সে দূরে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে আছে লাশের দিকে। মৃত্যু যেন শুধু সামরানের না মায়ারও হয়েছে। সামরানের পাশে গিয়ে তাকে একটু ছোঁয়ার ইচ্ছে বা শক্তি কোনোটাই মায়ার নেই। নিজের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে নিজের ভালোবাসা বিসর্জন দিয়ে দিলো মায়া। এটা হয়তো ইতিহাসে প্রথম যে, একজন ব্যারিস্টারের প্রথম অপরাধী তারই স্বামী। মারাত্মকভাবে ভালোবাসার পরও এই প্রথম কোনো ব্যারিস্টার স্বামীর মৃত্যু ঘোষণা করাতে বাধ্য হয়েছে । যাকে সে প্রাণের চেয়েও বেশি ভালোবাসতো।
৩মাস পর..……….…
দেখতে দেখতে তিন মাস কেটে গেল। সারাদিন মায়রাকে নিয়েই ব্যস্ত থাকে মায়া। কোর্টে আর যায় না। আজ সিমিরা বাহিরে গেছে। কয়েকদিন ঘুরে তবেই ফিরে আসবে। মায়ার শরীর ভালো ছিলো না, তাই মায়া যায় নি। ছাদে এসে বসেছে সেই অনেক্ষণ। চারপাশে হালকা বাতাস বইছে। মায়া উঠে গিয়ে রেলিংয়ের পাশে দাঁড়ালো। হঠাৎ কাধে কারো নরম ওষ্ঠদ্বয়ের উষ্ণ পরশ অনুভব করলো। মায়া আবেশে চোখ বন্ধ করে নিলো। শাড়ির নিচে উন্মুক্ত পেটে হাত রাখতেই মায়া পেছনে ফিরে যায়। চোখ জোড়া এখনো বন্ধ। কানের কাছে কারো তপ্ত নিঃশ্বাস অনুভব করছে। মোহময়ী কন্ঠস্বরটি কানে পৌঁছাতেই মায়া মৃদু হাসলো।
–সামরান মালিক ইজ ব্যাক!বলেছিলাম না বিচারকের আসনে আপনি থাকলে একটা কথা ছিল। আপনি ছাড়া অন্য কেউ আমায় শাস্তি দেওয়ার ক্ষমতা রাখে না অলকানন্দা।
মৃদু হেসে মায়া চোখ খুলে নিলো। দুহাতে সামরানের গলা জড়িয়ে ধরলো।
–মাঝ নদীতে কেউ নৌকা ছেড়ে যেতে পারে?
–একদমই না। মায়ার নাকের ডগায় চুমু দিয়ে সরস গলায় বলল সামরান।
–আমার প্রেম সাগরের, প্রেমের খেয়ার সেই মাঝি আপনি। মাঝ দরিয়ায় ছেড়ে যাবেন তা হয় না। আমি হতেই দেব না।
খেয়া তীরে ভিড়তে অনেক দেরী।
–আমি তীরে ভিড়তেই দেব না। ভাসতে চাই আজীবন। কারণ মালকিন যে এত…..সামরান গালে স্লাইড করতে নিলেই মায়া হাতে চড় বসিয়ে দেয়।
–একদমই না।
–দিন দিন এত সুন্দর হয়ে যাচ্ছেন কেন আপনি?
— সুন্দর হয়ে যাচ্ছি নাকি? তাহলে তো ভালোই, আবারো বিয়ে দেওয়া যাবে।
–আমাকে রাগিয়ে দিতে চাইছেন?
–কি জানি?
–আমার রাগ আপনি হজম করতে পারবেন না অলকানন্দা।
–চাইও না। বলেই সামরানের গালে চুমু দিলো মায়া।
–আজ তো দফারফা করেই ছাড়বো। ঠোঁট কামড়ে হেসে কথাটি বলে মায়াকে কোলে তুলে নিলো সামরান। মায়া হেসে গলা জড়িয়ে ধরলো সামরানের……
———————————-সমাপ্ত—————————-