প্রেমোবর্ষণ পর্ব -০১

প্রেমোবর্ষণ

১.
‘বিয়ে পড়ানো হয়ে গেছে মোনাজাত ধরবে এখন।’

পিয়াল ভাই দরজায় দাঁড়িয়ে কথাটা বলে খেজুরের প্যাকেট নিয়ে বেরিয়ে গেলেন।

‘তুমি কি এখানেই বসে থাকবে?’ ত্রয়ী প্রশ্ন করলো কলিকে।

‘হু’

‘মন খারাপ?’

কলি খাটের হেডবোর্ডে হেলান দিয়ে বসা ছিল এবার পা গুছিয়ে সোজা হয়ে বসল।

‘নাতো।’

‘তবে কি আমার মত ক্রাউডে অস্বস্তি হয়!’

কলি অপাঙ্গে তাকালো পাশে থাকা ত্রয়ীর দিকে। বড় মামার বড় ছেলে পরশের বাগদত্তা ত্রয়ী আপু। কলির বলতে ইচ্ছে করলো, ‘না ক্রাউডে নয় বরং আপনাকে দেখে অস্বস্তি হচ্ছে।’ কিন্তু না এ কথা বলা যায় না। তার দিকে নজর পড়লেই কেঁদে ওঠে কলির অন্তর। গত রাত থেকে কলির মানসিক অবস্থা বিধ্বস্ত সে খবর কেউ জানে না। রাতটা কেটেছে নির্ঘুম ভোরে উঠেই সে এ ঘরে ঘাপটি মেরেছিল। এখন দিন পেরিয়ে সন্ধ্যেলগ্ন এখনো বসে আছে এ ঘরে। তবে মাঝে দু বার এ ঘর থেকে বেরিয়েছিল সে। একবার আম্মুর ব্যাগ থেকে জামা আনতে দ্বিতীয়বার বড় মামীর কথা শুনে পিয়াকে গহনা পরাতে। পার্লার থেকে কনে সাজিয়ে আনার পর ঘরে বসেই সোনাদানার বাকি সাজ সারতে হয়েছে। এরই মাঝে বরযাত্রী এলে ত্রয়ী আপু বাইরে থাকতে অস্বস্তি বোধ করায় পরশ ভাই নিজে তাকে এ ঘরে বসিয়ে গেল। অনিচ্ছুক চোখে একবার কলিকেও দেখে গেল মানুষটা৷ বাগদত্তার সামনে বড় অবহেলার দৃষ্টি ফেলেছিল তখন কলির ওপর। সেই থেকেই গায়ের ভেতর বিষকাঁটা ফুটছে কলির। কখন ফুরাবে এই বিয়ের তামঝাম! তার বড় বিতৃষ্ণা এ শহরে, এই বাড়িতে, পরশ ভাইয়ের চোখের ত্রিসীমানায় থাকতে। তার ভীড়বাট্টার ঢাকা শহর এর চেয়ে ঢের ভাল। সেখানকার রাস্তা, বায়পাস, অলিগলি সবটা জুড়ে কোলাহল কোথাও নিস্তব্ধ দহন নেই। অথচ এই শান্ত, শীতল রাজশাহীর বাতাসটাতেও কলির মন পুড়ে ছাই হচ্ছে প্রতিনিয়ত। বেশ তো ছিল দুটো বছর নিষ্ঠুর মানুষটার সাথে দূরত্ব রেখে। কাছে এসেই জ্বলে যাচ্ছে ভেতরটা। কলির জবাব দেওয়া হলো না ত্রয়ী আপুকে। সে চুপচাপ ঘর ছেড়ে বের হলো।

নিচতলায় হুল্লোড় বেড়েছে কনে বিদায় হবে বলে। বড় মামী জ্ঞানের হারিয়েছেন মেয়েকে জামাতা হস্তে সপর্দ করার মুহূর্তে। মামাও অশ্রুসিক্ত চোখ নিয়েই পিয়ার হাত তার বরের হাতে দিল। একে একে মেজো মামা, মামী, কলির মা আর অন্যান্য মুরুব্বীরাও সমাদরের সাথে পিয়াকে গাড়িতে তুলে দিল। মূল দরজায় দাঁড়িয়ে কলি খুঁজতে লাগল নিষ্ঠুর মানুষটা কোথায়! পিয়াল ভাই, রায়ান ভাই বাকিরাও আছে তবে সে কোথায় গেল? পরক্ষণেই ভাবল থাকুক যেখানে খুশি তার কি? পাষাণ লোককে আজকের পর সে চোখের দেখাটাও দেখতে চায় না। কথা সত্যি হলো। কাউকে কিছু না জানিয়ে রাতের বাসে রওনা হলো ঢাকার উদ্দেশ্যে। ততক্ষণে বিচারসভা বসেছে বড় মামার শোবার ঘরে। অপরাধী হিসেবে নিচু মস্তকে দাঁড়িয়ে আছে পরশ ভাই। প্রথম প্রশ্ন পরশ ভাইয়ের উদ্দেশ্যেই, ‘চেইন ছিঁড়েছো কেন?’ এই প্রশ্নের উত্তর না দিলেও পরশ ভাই ঘোষণা দিয়েছিলেন তিনি ত্রয়ীকে বিয়েটা করছেন না। ব্যস, তারপরের সময়গুলো এক প্রকার ঝড়ো হাওয়ার মত কাটছে কলির মামা বাড়ির সকলের।
__________________

‘ফোন ধরছিস না কেন?’

‘সম্ভব ছিল না।’

‘বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে না!’

‘এ কথা বলতে কল দিয়েছো?’

‘কেন এমন করছিস বল তো! আর তো মাত্র কয়েকটা দিন।’

‘ভণিতা রেখে স্পষ্ট করে বলো কি বলছো?’

‘তুই বুঝিস না কি বলছি?’

‘বুঝলে নিশ্চয়ই প্রশ্ন করতাম না।’

কপালের সামনের ছোট চুলগুলো বেয়ে টপাটপ ঝরছে বৃষ্টির জল।
ফোনটা সেই কখন থেকেই তারস্বরে বেজে যাচ্ছিলো। কলির কানে শব্দ এলেও বৃষ্টিধোয়া রিকশায় বসে তা চেক করা সম্ভব হয়নি৷ আষাঢ়ের আজ তৃতীয় দিন। ঢাকা শহরের ব্যস্ত কিছু রাস্তা আজকের বর্ষনে কোমর অবধি ডুবে গেছে। কলি মাত্রই রিকশা থেকে নেমে হোস্টেলে ঢোকে। ভাড়া মিটিয়ে দ্রুত পায়ে গেট পেরিয়ে হোস্টেল বিল্ডিংয়ের লম্বা করিডোরে পা রেখেই ফোনটা ধরেছিল সে। কিন্তু পরশের এই অল্পতেই রেগে যাওয়া আচরণটা বিরক্ত লাগল কলির। যে মানুষটা সপ্তাহ খানেক আগেও ছিল তার প্রতি উদাসীন আজ সে প্রতি মুহূর্তে তাকে রাগ, ক্রোধ আর প্রেমময় আচরণ দিচ্ছে! বিরক্তিটা ঠিক এখান থেকেই শুরু কলির। সময় গুণে যাচ্ছে সে কবে মানুষটা দেশ ত্যাগ করবে। একটুখানি স্পেস দরকার অতি প্রিয় এই মন পুরুষটার কাছ থেকে। একটা সপ্তাহ আগেও যে ছিল বুকের ভেতর ধকধকানির কারণ আজ সে মানুষটা অসহ্যকর ভালোবাসায় পরিণত হয়েছে। এর কারণ কি! উত্তর খুঁজে পায় না কলি। রিমঝিম ছন্দ তোলা বর্ষণে সিক্ত কলি ফোন কানে নিরুত্তর। পরশের সহ্য হলো না এই নিশ্ছিদ্র নিরবতা সে এবার ফোনটাই ছুঁড়ে মারলো কোথাও। এপাশে থাকা কলি শুধু টের পেল যান্ত্রিক সংযোগের সমাপ্তিটুকু অথচ একটুও আঁচ করতে পারলো না ওপাশে কি ঘটছে। মামা বাড়ির সাথে তাদের সুসম্পর্ক হুট করেই এখন দুঃসম্পর্কের হয়ে উঠেছে। সকাল বিকাল মায়ের মুখে এখন অভিশাপ বর্ষিত হয় কলির জন্য। কি এক কালো দৃষ্টি পড়েছে যেন সম্পর্কগুলোতে নাকি কলি নিজেই সেই ত্রুটি যা দিয়ে সম্পর্ক ধ্বংস হয়! ভেজা চোখ, মুখ ভেজা হাতে মুছতে মুছতে কলি উঠে গেল দোতলায় নিজ কক্ষে। ভাবতে লাগল পরশ ভাইয়ের পিএইচডির এই প্রস্তুতিটা কি হঠাৎ করে নেওয়া নাকি আগে থেকেই নিচ্ছিলো! সে তো জানতো এক সপ্তাহে কখনো বিদেশে যাওয়ার প্রসেসিং সম্ভব নয় তার ওপর সোজা পিএইচডি সুযোগ! নাহ ওই পাষাণ লোক বড় ধূর্ত নইলে সুন্দরী এক কন্যার সাথে ঘটা করে বাগদান সেরে এখন কেন দেশ ছাড়ছে? ছাড়ছে তো ছাড়ছে তবে এনগেজমেন্ট ভাঙলো কেন?বিয়ে করে বউ রেখে কি পিএইচডি করা যায় না! কলির মাথা ধরেছে খুব৷ ভেজা কাপড় বদলে চটপট ইলেকট্রিক পটে চা বানিয়ে বসলো বিছানায়। এক চুমুক চা মুখে দিতেই মনে হলো এত বিস্বাদ চা সে এ জীবনে কখনো বানায়নি আগে। মন অস্থির নিজেই কি এবার কল করবে পরশ ভাইকে? বেহায়া মন যতই বলুক সে মানুষটাকে ঘৃণা করে মন তো জানে সে ঘৃণা শুধুই মুখোশ।

-রূবাইবা মেহউইশ

(‘বরষায় ভেজা মন’ থেকেই এ গল্পের উৎপত্তি তবুও আমার চেষ্টা থাকবে এমন ভাবে লেখার যেন সে গল্প না পড়া পাঠকও অনায়েসে এ গল্পটা উপভোগ করতে পারেন। আর হ্যাঁ ভুল ত্রুটি গুলো বরাবরের মতই এবারও ক্ষমার চোখে দেখার অনুরোধ রইলো। সম্ভব হলে কিছু মিসিং থাকলে কমেন্টে জানিয়ে দিবেন। আশা করছি সকলেরই ঈদ আনন্দময় কেটেছে।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here