প্রেম পায়রা ২ পর্ব ১৬

#প্রেম_পায়রা (২)
#অজান্তা_অহি (ছদ্মনাম)
#পর্ব_____১৬

খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে তিথির রুমের দিকে পা বাড়ালো সম্পদ। দরজার ছিটকিনি লাগানো ছিল না। ভেতরে ঢুকে দেখলো তিথি গভীর ঘুমে। ধীরপায়ে খোলা জানালার সামনে এগিয়ে গেল। পরখ করলো এদিক থেকে তিথির বিছানা দেখা যায় কি না! দেখা যায় না। তবুও স্বস্তি মিলল না তার। তিথি রুমে হাঁটাচলা করলে নিশ্চয়ই অপজিটের বিল্ডিংয়ের ওই ভুড়িওয়ালা লোকটা খেয়াল করে। লোকটার চাহনি দেখেই সে সব বুঝতে পেরেছে। ভেতরে ভেতরে অগ্নিকুন্ডের মতো জ্বলে উঠলো। হাত মুঠ করে জানালার সামনে থেকে সরে এলো। এক নজর তিথির দিকে চেয়ে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল। তিথিকে এই রুমে থাকতে দিবে না সে। কোনোভাবেই না!

ওয়ারড্রবের কাছে গিয়ে একে একে তিথির সব কাপড়চোপড় বের করলো। দু হাতের ভাঁজে সেগুলো নিয়ে নিজের রুমে ঢুকলো। আলমারির অর্ধেক জায়গা খালি করলো সে। ভাঁজ করে রাখা নিজের শার্টগুলোর পাশে তিথির ড্রেসগুলো রাখলো। কয়েক সেকেন্ড সেদিকে চেয়ে রইলো। কি অদ্ভুত সংসার জীবন! ঠোঁটে হাসি ফুটে উঠলো তার।

মিনিট বিশেকের মধ্যে সে একে একে তিথির ব্যবহার্য সমস্ত জিনিস নিয়ে নিজের রুমে রেখে আসলো। ক্লান্ত হয়ে তিথির বিছানার পাশে এসে দাঁড়ালো। লম্বা করে শ্বাস টেনে নিল। সবকিছু নেওয়া শেষ। এখন তিথিকে নিলেই হবে৷ সম্পদ বুঝতে পারছে না ঘুমের মধ্যে কোলে করে নিয়ে যাবে নাকি ঘুম ভাঙার অপেক্ষা করবে। আবার তিথি বিষয়টাকে কিভাবে নিবে সেটা ধারণা করতে পারছে না। সহজ ও স্বাভাবিক ভাবে যে নিবে না সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না।

রুমে কিছুক্ষণ পায়চারি করে অবশেষে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল সে। তিথিকে ছোটখাটো সারপ্রাইজ দিতে চাইলো। ঘুমন্ত অবস্থায় তিথিকে নিজের রুমে নিয়ে যাবে। ঘুম ভেঙে তিথি নিজেকে তার বিছানায় আবিষ্কার করে কেমন প্রতিক্রিয়া করবে তা দেখার লোভ সামলাতে পারলো না। হাসি হাসি মুখ করে বিছানার কাছে এগিয়ে গেল। হুট করে তার ভাঙা পায়ের কথা খেয়ালে এলো। পা টা এখনো সুস্থ হয়নি। এই অবস্থায় তিথিকে কোলে তুলে ও রুমে নিয়ে যেতে পারবে তো? মনের মাঝে উদয় হওয়া প্রশ্নকে পাত্তা দিল না সে। অন্তত চেষ্টা করে দেখতে বারণ কোথায়!

এক হাঁটুতে বিছানায় ভর দিয়ে শরীর বাঁকিয়ে দাঁড়ালো সে। তিথির পিঠের নিচ দিয়ে বাম হাতটা গলিয়ে দিতে ধপ করে চোখ খুলল তিথি। থমকে গেল সম্পদ। ঘন ঘন চোখের পাতা ফেলতে লাগলো। মুখের উজ্জ্বলতা নিভে গিয়ে একটা চোরাভাব এসে ভর করলো। তিথির ভয় পাওয়া দৃষ্টি দেখে সম্পদ ঝটপট বলল,

‘ঘুম ভাঙলো তোমার? কেমন আছো?’

তিথি নড়চড় করতে সম্পদ পিঠের নিচের হাতটা দ্রুত সরিয়ে আনলো। বিছানা ছেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়ালো। ঘন ঘন মাথার চুল নেড়ে বলল,

‘ওভাবে তাকিয়ে থাকার মানে কি? আমি তো কিছু করছিলাম না।’

তিথি উঠে বসলো। কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে বসে রইলো। তিথির এত নিশ্চুপতা দেখে সম্পদের ভেতরে অপসাদের গাঢ় ছায়া ছড়িয়ে পড়লো। সে যতই চেষ্টা করছে তিথির পুরনো দুঃখ ভেদ করে ভেতরে প্রবেশ করতে ততই সব এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। তালগোল পাকিয়ে যাচ্ছে সব।

কিছুক্ষণ পর তিথি বিছানা ছেড়ে নামলো। ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়াতে খোলা ওয়ারড্রব নজরে এলো। এতক্ষণে কপালে সন্দেহের রেখা ফুটে উঠলো। সম্পূর্ণ রুমে নজর বুলিয়ে সম্পদের দিকে পেছন ফিরে তাকালো। জিগ্যেস করলো,

‘আমার জিনিসপত্র কোথায়?’

‘আমার রুমে।’

‘আপনার রুমে? আপনার রুমে গেল কিভাবে?’

‘আমি নিয়েছি।’

‘কেন?’

তিথির দৃষ্টির তীক্ষ্ণতা সহ্য করতে পারলো না সম্পদ। চোখ সরিয়ে নিল। কয়েক সেকেন্ড পর বলল,

‘তিথি একটা সমস্যা হয়েছে। তুমি বিষয়টাকে কিভাবে নিবে বুঝতে পারছি না। একটু আগে বাবা ফোন দিয়েছিল। কোনো একটা প্রয়োজনে দুদিনের জন্য ঢাকা আসছে। ঢাকা আসলে আমাদের এখানে যে ঘুরতে আসবে তাতে সন্দেহ নেই। দু-একদিন থাকতেও পারে।’

‘বাবা আসলে আসবে। তার সাথে আমার জিনিসপত্রের সম্পর্ক কি?’

‘তোমাকে চালাক ভেবেছিলাম। কিন্তু তুমি আমার ভুলটা ভেঙে দিলে তিথি। এত বোকা কেন তুমি?’

‘হেয়ালিপনা বাদ দিন। আমি যা জিগ্যেস করেছি তার উত্তর দিন।’

‘আরে বাবা এসে আমাদের দুজনকে দু রুমে দেখলে সন্দেহ করবে না? বাবা অত্যন্ত বিচক্ষণ মানুষ। ঠিক বুঝে যাবে যে আমাদের মধ্যে সত্যিকার কোনো সম্পর্ক নেই। সবই লোক দেখানো।’

তিথি আর কিছু বললো না। মাথার ভেতর কেমন শূন্য শূন্য লাগছে। ওয়াশরুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল সে। ট্যাপ ছেড়ে চোখে মুখে পানির ঝাপটা দিল। বেসিনের আয়নায় ধূলো জমে গেছে। কতদিন হলো ঠিকমতো নিজের মুখ দেখা হয় না। পানি দিয়ে পরিষ্কার করে আয়নায় সৃষ্ট প্রতিবিম্বের দিকে তাকালো। নিজেকে দেখে কিছুক্ষণের জন্য থমকে গেল। ত্বকের উজ্জ্বলতা আগের থেকে বেড়ে গেছে মনে হচ্ছে। খোপা সরিয়ে গলা, ঘাড় পরখ করলো। দুই বাহু এপিঠ ওপিঠ করে দেখলো। দেহে কোনো ক্ষত নেই। সব আগের মতো আছে। বলতে গেলে আগের থেকে আরো উজ্জ্বল হয়েছে। সবুজের দেওয়া স্পর্শ গুলো মুছে গেছে। কিন্তু তার স্মৃতি থেকে মুছছে না কেন? বুকে জমা ক্ষতে কেন এখনো দগদগে ঘা? এই ঘা সারাতে চায় সে। চিরদিনের জন্য সবুজের যন্ত্রণাময় স্মৃতি মুছে ফেলতে চায়। কবে এই দূর্বিষহ স্মৃতির যন্ত্রণা থেকে মুক্তি মিলবে? কবে?

ঝরঝর করে চোখ দিয়ে তার পানি গড়িয়ে পড়লো।

১৯.

রাতের বেলা একসাথে খেতে বসেছে দুজন। খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে সম্পদের দৃষ্টি তিথির উপর ঘোরাফেরা করছে। নিজের প্লেটে ছোট মাছের তরকারি নিয়ে সে তিথির প্লেটের দিকে তাকালো। অল্প একটু ভাত অনেক ক্ষণ ধরে নেড়েচেড়ে যাচ্ছে। সে বাটি থেকে এক চামচ তরকারি তার প্লেটে উঠিয়ে দিল। সঙ্গে সঙ্গে তিথি চোখ উল্টে তাকালো। রাশভারী গলায় বলল,

‘সমস্যা কি?’

‘কোনো সমস্যা নেই। সমস্যা থাকতেই পারে না।’

‘নিজের যা লাগে তাই নিয়ে নিন। অন্যের প্লেটে ছোঁড়াছুড়ি করছেন কেন?’

সম্পদ মুচকি হাসলো। মজার ছলে বলল,

‘আমার যা লাগে তাই নিয়ে নিবো? বাঁধা দিবে না তো?’

ভাতের প্লেটে তিথির হাত থেমে গেল। চোখের মণি এদিক ওদিক ঘুরপাক খেতে লাগলো। কোনো কথা না বলে প্লেটটা হাতে নিয়ে রান্নাঘরে ঢুকে গেল সে। সম্পদ পেছন থেকে গলা উঁচিয়ে বলল,

‘খাবার ফেলে কোথায় যাচ্ছো? এত খাবার কে খাবে? তিথি?’

তিথি রান্নাঘরে রাখা টুলটার উপর বসে পুনরায় খাওয়া শুরু করলো। প্লেটের অবশিষ্ট খাবার টুকু শেষ করতে অনেক বেগ পেতে হলো। কোনো রকমে শেষ করে বেসিনে ধুয়ে ফেলল। প্লেটটা সরিয়ে রেখে আবার টুলে গিয়ে বসলো। সঙ্গে সঙ্গে সম্পদ এঁটো প্লেট হাতে নিয়ে রান্নাঘরে ঢুকলো। নিজের প্লেট নিজেই ধুয়ে ফেলল। কোনো অস্বস্তিকর পরিবেশের সৃষ্টি করলো না। চুপচাপ হাত ধুয়ে রান্নাঘর থেকে বের হয়ে গেল। সে যেতে তিথি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল।

রান্নাঘর থেকে তিথি বের হলো আধ ঘন্টা পরে। খাওয়া শেষে দশ মিনিটের মতো সম্পদ টিভি দেখে। রেগুলার না, তবে মাঝে মধ্যে দেখে। সেই সূত্র ধরে সে এতক্ষণ রান্নাঘর থেকে বের হচ্ছিল না। ড্রয়িং রুমে উঁকি দিল। দেখলো কেউ নেই! স্বস্তি পেল সে। ডাইনিং টেবিলের কাছে গিয়ে দেখলো একদম পরিষ্কার। তার মানে অবশিষ্ট খাবার সম্পদ ফ্রিজে ঢুকিয়ে রেখেছে। কিছুটা কাজ কমলো ভাবতে তার ঠোঁটের কোণে অস্পষ্ট একটা হাসির রেখা ফুটে উঠলো। ভীষণ ক্লান্ত লাগছে। নিজের রুমের দিকে এগিয়ে গেল। দীর্ঘ সময়ের একটা ঘুম দরকার।

আনমনে দরজা ঠেলতে চমকে গেল সে। দরজা খুলছে না। খুলবে কি করে? দরজার উপর বিশালাকৃতির একটা চাইনিজ তালা ঝুলছে। বিস্ময় নিয়ে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলো সে। সন্ধ্যার পরও রুমের দরজায় তালা ছিল না। এটা সম্পদের কাজ বৈকি কিছুই নয়। মুহূর্তে ভেতরটা রাগে ফুঁসে উঠলো। মেজাজ তরতর করে আঁকাশ স্পর্শ করলো। গটগট পায়ে সে সম্পদের রুমের দিকে এগোল।

এক ধাক্কায় দরজা খুলে ভেতরে ঢুকল। সম্পদ ল্যাপটপে কিছু করছিল। দরজা খোলার শব্দে মাথা তুলে তাকালো। তিথি তার দিকে জ্বলন্ত দৃষ্টি নিক্ষেপ করে বলল,

‘পাশের রুমে তালা কেন?’

‘এত দামী একটা তালা৷ অবহেলায় পড়ে ছিল। ব্যবহার না করলে মরিচা ধরে যাবে। কিন্তু ব্যবহার করার মতো কিছু খুঁজে পাচ্ছিলাম না। তাই……’

‘কেন? আপনার মুখে ব্যবহার করতে পারলেন না? তাহলে এতো ভিত্তিহীন, অযৌক্তিক কথাগুলো শুনতে হতো না। আমি এখন কোথায় ঘুমাব?’

‘এখানে ঘুমাবে। আমার বিছানায়।’

তিথি ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়লো। হতাশ সুরে বলল,

‘দেখুন, আমি ভীষণ ক্লান্ত। লম্বা সময়ের একটা ঘুম প্রয়োজন। আপনার সাথে তর্কাতর্কি করার মুড নেই। চাবিটা দিয়ে দিন।’

সম্পদ কয়েক সেকেন্ড চিন্তা করে মেনে নিল। তিথির চেহারায় সত্যি সত্যি ক্লান্তির ছাপ ফুটে উঠেছে। বসা থেকে উঠে সে ট্রাউজারের পকেট হাতড়ালো। টিশার্টের পকেট খুঁজলো। আস্তে আস্তে কপাল কুঁচকে যেতে লাগলো। তিথির দিকে এক পলক চেয়ে সম্পূর্ণ বিছানা হাতড়ালো। কয়েক মিনিট সময় নিয়ে সে সমস্ত রুম তন্নতন্ন করে চাবি খুঁজলো। কাচের টেবিল, ড্রয়ার, ড্রেসিং টেবিল, আলমারি, বিছানাপত্র কিছুই বাদ রাখলো না। এক পর্যায়ে তিথির সম্মুখে এসে চিন্তিত মুখে দাঁড়ালো। অপরাধী সুরে বলল,

‘তিথি, তুমি বিশ্বাস করবে কি না জানি না। চাবিটা বোধ হয় সত্যি সত্যি হারিয়ে গেছে। কোথায় রেখেছিলাম মনে নেই। এখন খুঁজে পাচ্ছি না।’

(চলবে)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here