প্রেম পিয়াসী পর্ব -১১+১২

#প্রেম_পিয়াসী ❤️
#লেখা_মুহতারিযাহ্_মৌমিতা
#পর্ব_________১১.

রাদ তার চাচী রাজিয়ার ডাকের কোনো রূপ উত্তর দিলোনা। মলিন মুখে প্রস্থান করলো। ইলহাম দেখছিলো রাদের হালচাল। কিছু ঠিক মনে হলোনা তার। মান্নাত বেগম রাদের যাওয়ার পানে তাকিয়ে ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো। সেও কিছু না বলে প্রস্থান করলো। রাজিয়া চললো তার পিছু পিছু। অবশেষে দাঁড়িয়ে ছিলো অন্তু, ইলহাম এবং অনন্যা। ইলহাম অনন্যার পানে একবার তাকালো। ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ত্যাগ করে বলল,

—-“আমার রুম টা দেখিয়ে দিবে প্লিজ? অনেক টায়ার্ড লাগছে।”

অনন্যা ব্যস্ত হয়ে উঠলো।

—-“ হ্যাঁ, ভাবি। এসো আমার সঙ্গে।”

ইলহাম চললো অনন্যার পিছু পিছু। অন্তু ইলহামের দিকে কুটিল দৃষ্টিতে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত কামড়ে আপন মনে বলল,

—-“ভাবি মাই ফুট।”

____________

প্রভাতে ঘুম ভাঙতে ধড়ফড়িয়ে উঠে বসলো ইলহাম। রাদের পাশের রুমটাই দেওয়া হয়েছিল তাকে। অবশ্য রাতে অতো ভাবার সময় ছিলো না। ক্লান্ত শরীর বিছানায় এলিয়ে দিতেই ঘুম জড়িয়ে এলো দু’চোখ জুড়ে। রাতে ঘুম ভাঙেনি একবারও। একদম টানা ঘুমিয়ে সবেই ঘুম ভাঙলো তার। কিন্তু ঘুম ভাঙতেই এমন ঘটনার সাক্ষী হবে ভাবতে পারেনি। রাদ তার বিছানার পাশে ফ্লোরে বসে খাটে মাথা হেলিয়ে ঘুমচ্ছে।

উনি কখন এলেন? ভাবতে পারলোনা ইলহাম। শুধু একটা কথা মনে হলো, রাতে তাকে এঘরে আসতে কেউ দেখেনিতো?

—-“রাদ? রাদ! আপনি এখানে কি করছেন?”

রাদ ঘুম জড়ানো চোখ মেলে তাকালো। ইলহামের এক ডাকেই ঘুম ভেঙেছে তার। ইলহাম উৎসুক নয়নে তাকিয়ে আছে তার পানে। রাদ চমৎকার হাসলো। ঘুম জড়ানো চোখে প্রায় দীর্ঘসময় নিয়ে তাকিয়ে রইলো ইলহামের পানে। অতঃপর কিছু না বলে উঠে বসলো বিছানায়। ইলহামের দৃষ্টি ক্রমশ বিস্ময়ে রূপ নিচ্ছে। কি করছে পা-গল ছেলে? রাদ আচমকাই সটান হয়ে শুয়ে পড়লো। ইলহাম লাফ মে//রে উঠে যেতে নিলে রাদ তার ওড়নাটা পেঁচিয়ে নিলো হাতের মাঝে। অতঃপর, চোখ বুঁজে ঘুম জড়ানো কন্ঠে বলল,

—-“এখানে চুপটি করো বসো। আমি ঘুমাবো।”

—-“ছাড়ুন! কি করছেন? ঘুমাবেন তো ঘুমোন না? আমায় কেন যেতে দিচ্ছেন না?”

—-“তোমায় ছাড়া আমার ঘুম আসবেনা সুইটহার্ট। প্লিজ, যেওনা।”

ইলহামের বুকের ভেতরটা ধক করে ওঠে। রাদের চোখ বুঁজে থাকা ঘুমন্ত মুখ খানার পানে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে তেতে ওঠা গলায় বলে,

—-“কি-সব যা-তা কথা বলছেন। রাদ.. পা/গ/লামি করে না। কেউ দেখে নিলে খারাপ…”

ইলহামের ভাঙা রেকর্ডার শোনার বিন্দু মাত্র ইচ্ছে হলো না রাদের। ওড়নার তোয়াক্কা না করে এক টানে ফেলে তাকে দিলো নিজের উপর। ইলহাম হকচকিয়ে গেলো ক্রমাগত। বোবা প্রানীর ন্যায় ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকলে রাদ আচমকা তাকে নিজের নীচে ফেলে দেয়। অতঃপর বিছানাতেই শক্ত করে চেপে ধরে তাকে। রা/গী গলায় বলে,

—-“সকাল সকাল কেন রাগাচ্ছো আমায়? সুন্দর সাবলীল ভাষা ভালো লাগছেনা বুঝি?”

ইলহাম ভয়ে শক্ত হয়ে গেলো। বারংবার ঢোক গিলে চলেছে নিজের অবস্থা দেখে। লোকটা সত্যি সত্যি পা/গ/ল হয়ে গেছে। মাথা ন/ষ্ট হয়ে গেছে। নয়তো একরকম কান্ড… উমম…”

রাদের পাগলামি দিগুণ বাড়লো। আকস্মিক ঠোঁট ডুবিয়ে দিলো ইলহামের ঠোঁটে। আজ রাদের প্রতিটা ছোঁয়াই খুব বেশি অদ্ভুত এবং ভ/য়া/ন/ক মনে হলো ইলহামের। ভ/য়ে, তা/ড়নায় অতিষ্ট হলো তার মন। কেঁপে উঠল ভেতরটা। রাদের মাথায় কোনো উল্টোপাল্টা ভূত চাপলো না তো?

না; ইলহামের মনে আশার আলো রেখে ছেড়ে দিলো রাদ। এমনকি ওভাবেই ঘুমিয়ে পড়লো সে। ইলহাম তাকে পাশে ঠেলে উঠে পড়লো চটজলদি। বড় বড় দম ফেলে নিঃশ্বাস নিলো। অতঃপর পেছন মুড়ে তাকে দেখলো একবার। এলোমেলো হয়ে শুয়ে আছে। ইলহাম আর কিছু না ভেবে তাকে সোজা করে শুয়ে দিলো। তার হাত থেকে ওড়টানা ছাড়িয়ে নিয়ে চলে গেলো ওয়াশরুমে। ফ্রেশ হয়ে একেবারে সাওয়ার নিয়ে বের হলো। নেভি ব্লু রঙের একটা চুরিদার পড়েছে। ভেজা চুল গুলো দু’বার তোয়ালে দিয়ে মুছে ওমন করেই রাখলো। এখন ইচ্ছে করছেনা শুঁকাতে। প্রভাতের এই স্নিগ্ধ শীতল পরিবেশটা উপভোগ করতে চায় সে। তাই নিজের রুমে আর এক মুহুর্তও দেরী না করে চলে গেলো ছাঁদে। ভোরের ৬টা বাজে, এখন প্রায় প্রত্যেকেই ঘুমে ডুবে আছে। বিশেষ করে অন্তু।

ছাঁদে উঠতে মনটা আরও ফ্রেশ হয়ে গেলো ইলহামের। চারপাশে প্রভাতের স্নিগ্ধ কোমল হাওয়া। যা একত্রে শরীর মন দুই-ই ছুঁয়ে যায়। ভেজা চুল গুলো থেকে টপটপ করে পানি ঝড়ছে এখনও। যার দরুন পেছনের দিকে জামাটা পুরোটাই ভিজে গেলো আবার। তাই হাতে দিয়ে চুল গুলো সব নিয়ে এলো সামনে। হাতের সাহায্যেই চুল চিপে পানি ফেলতে লাগলো। এমন কাজে নিয়োজিত হয়েই ধীরপায়ে এগিয়ে গেলো ছাঁদের এক কোনে। চারপাশের সুন্দর পরিবেশটা উপভোগ করছে মন প্রাণ দিয়ে। ঠিক এমন মুহুর্তে ভেসে এলো কারোর কান্না জড়ানো গলা,

—-“আমি কি করে থাকবো বলুন? বাবা, মা, ভাইয়া কেউ বুঝবেনা আমার কথা! প্রনয় ভাই, আমি মাকে অনেকবার বলার চেষ্টা করেছি আপনার কথা! কিন্তু মা.. মা আমার একটা কথাও শুনলো না! (কাঁদতে কাঁদতে) আমি ম//রে যাবো প্রনয় ভাই। আমায় প্লিজ নিয়ে যান আপনার কাছে! আমি ম//রে যাবো! এভাবে বাঁচা যায়না প্রনয় ভাই। এভাবে মানুষ বাঁচতে পারেনা। আপনিও যদি আমার থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন তবে মনে রাখবেন, আমি নির্ঘাত আ/ত্ম/হ//ত্যা করবো।”

—-“অনন্যা?”

অনন্যার পেছনে এসে দাঁড়ালো ইলহাম। তার চোখেমুখে লেপ্টে আছে একরাশ বিস্ময়। এসব সে কি শুনছে!

পেছন থেকে কারোর ডাক পড়তেই চমকে উঠলো অনন্যা। চটজলদি কান থেকে ফোনটা নামিয়ে নিয়ে সুইচডঅফ করে দিলো কৌশলে। অতঃপর দ্রুত চোখ মুছে নিলো। মুখের ভাব স্বাভাবিক করে তারপরেই পেছন মুড়ে তাকালো সে। অনন্যা দেখতে ভীষণ মিষ্টি। মুখের গড়ন বেশ মায়াবী। ফর্সা চোখ জোড়া ফুলে এক রকম লাল হয়ে উঠেছে। ইলহাম এবার সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকালো। কিছু বলবে তার পূর্বেই অনন্যা হাস্যজ্বল মুখে বলে উঠলো,

—-“ভাবি? এতো ভোরে উঠে পড়লে!”

অনন্যার স্বাভাবিক ভঙ্গিমা ইলহামের সন্দেহ দিগুন করে দিলো। তবুও মুখে প্রকাশ করলো না সে। অনন্যার ন্যায় স্বাভাবিক ভঙ্গিতে নরম হাসলো। বলল,

—-“হ্যাঁ, ঘুম ভেঙে গেলো। তা তুমি এতো ভোরে? সব সময় কি এমন সময়েই উঠো নাকি আজ কোনো স্পেশাল।”

অনন্যার মুখটা ক্রমশ মলিন হয়ে যাচ্ছিলো। অর্থাৎ তার ইলহামের দিকে মনোযোগ নেই। মনোযোগ আঁটকে আছে হাতের ফোনটার দিকে। ইলহাম খেয়াল করছিলো সবই। হঠাৎ অনন্যার কোনো জবাব না পেয়ে বলল,

—-“কারোর কলের অপেক্ষা করছো অনন্যা?”

অনন্যা চমকে উঠলো। ধরা পড়া চোরের ন্যায় ঘাবড়ানো গলায় বলল,

—-“ন্ না ভাবি! ক্ কারোর কলের অপেক্ষা করছিলাম না।”

ইলহাম চাইলো না অনন্যাকে কোনো অপ্রীতিকর পরিস্থিতিতে ফেলতে। তাই কথা ঘুরিয়ে ফেললো। অন্য টপিকেই দু’জনে পুরোটা সময় গল্প করে কাটিয়ে দিলো। অনন্যা ইলহামের এতো লম্বা চুলের রহস্য জানতে চাইলো। ইলহাম কেবল হাসছিলো তার কথা শুনে। অনন্যা দেখতে যেমন মিষ্টি, তেমন ভীষণ আন্তরিকও বটে। কোনো দিক থেকেই অন্তুর সাথে ওর ম্যাচ হয়না। ইলহাম বুঝে উঠতে পারেনা, অন্তুটার এমন বিগড়ে যাওয়ার কারন কি?

____________________________________________

নাস্তার টেবিলে সবাই এসে হাজির হলো। কিন্তু রাদ এলোনা। মান্নাত বেগম ইলহামকে বলল, “রাদের খাবারটা ঘরে দিয়ে আসতে।” ইলহাম বাধ্য মেয়ের মতো রাদের খাবারটা নিয়ে চলে এলো রাদের ঘরে। রাদ তখনও বেঘোরে ঘুম। অবশ্য মাঝে একবার উঠে নিজের রুমে এসে ঘুমিয়েছে। ইলহাম খাবারটা বিছানার পাশে রাখতে রাখতে রাদের ঘুমন্ত মুখপানে তাকালো একবার। কি নিষ্পাপ মুখ। মনে হচ্ছে, একটা বাচ্চা ছেলে ঘুমোচ্ছে। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছিলো রাদকে। রাদ দেখতে কোনো হিরোর চেয়ে কম নয়। জিমড বডি, চাপ দাঁড়ি,ডার্ক রেড ঠোঁট, ঘন পল্লব বিশিষ্ট চোখ। সবই পার্ফেক্ট। শুধু একটু মাথায় গন্ডগোল। কথাটা ভাবতেই হাসি পেয়ে গেলো ইলহামের। হাসতে হাসতে বসলো রাদের পাশে। মাথার সিল্ক চুলগুলো এলোমেলো হয়ে লেপ্টে আছে কপালে। ইলহামের ইচ্ছে হলো, হাত দিয়ে নেড়ে দিতে। কিন্তু সাহস হলো না। সকালের ঘটনাটা মনে পড়তে সটান হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো। গলা খাঁকারি দিয়ে ডাকতে লাগলো তাকে।

—-“রাদ? রাদ! আপনার জন্য ব্রেকফাস্ট এনেছি। রাদ?”

রাদের কানে পৌঁছালো ইলহামের ডাক। তবে উঠলো না। নড়েচড়ে আবারও ঘুমিয়ে পড়লো। ইলহাম একটু এগোলো তার নিকট। হাত বাড়িয়ে রাদের হাতের উপর রাখতেই আচমকা ফট করে তার হাত ধরে নিলো রাদ। ইলহাম আঁতকে উঠল। অসহায় দৃষ্টি মেলে রাদের দিকে তাকাতেই রাদ ঘুম জড়ানো কন্ঠে বলে উঠলো,

—-“একটু আদর করে ডাকতে পারছোনা? অদ্ভুত রমনী।”

—-“ন্ না পারছিনা। উঠুন তো। অনেক ঘুমিয়েছেন।”

—-“সারারাত ঘুমোয়নি। আমার আরও ঘুমাতে হবে। বসো না একটু।”

ইলহাম সকালের কান্ডটি নিয়ে ভ/য় পাচ্ছে। সে চায়না তা আবারও রিপিট হোক। তাই ঢোক গিলে অসহায় কন্ঠে বলল,

—-“প্লিজ উঠুন না।”

রাদ জবাব দিলো না। হেঁচকা টানে নিজের পাশে বসিয়ে দিলো ইলহামকে। ইলহাম টাল সামলাতে না পেরে বসে পড়লো ধপ করে। তার হার্টবিট অতি দ্রুত ছুটছে। রাদ আকস্মিক তার কোমর জড়িয়ে লম্বা নিঃশ্বাস টেনে পূণরায় ঘুমের তোড়জোড় করছে। ইলহাম স্তব্ধ হয়ে রইলো রীতিমতো। বাকরূদ্ধ চাহনিতে রাদের পানে তাকাতেই রাদ কেমন করা কন্ঠে বলে উঠলো,

—-“তুমি কি আমায় একটুও ভালোবাসোনা, সুইটহার্ট?”

—-“উফফ! এখন এসব কথা বলার সময় নয়। প্লিজ উঠুন। আমার কেমন অস্থির লাগছে।”

রাদ এক চোখ মেলে তাকালো। এক ভ্রু উঁচিয়ে বলল,

—-“কেন? ফিল হচ্ছে আমায়?”

ইলহাম লজ্জায় ভাজ হয়ে পড়লো যেন। শ্বাসরুদ্ধ কন্ঠে বলল,

—-“আমার আপনাকে ফিল হয়না। উল্টে রাগ হয়। ছাড়ুন তো!”

রাদের ধাতে লাগলো ইলহামের কথাটা। সে আরও শক্ত করে চেপে ধরলো ইলহামের কোমর। ইলহাম শক্ত হয়ে জমে গেলো পূণরায়। দু’হাতে খামচে ধরলো বিছানার চাদর। খিঁচে চোখ জোড়া বন্ধ করে নিলে অনুভব হয় রাদ ক্রমশ ডুবে যাচ্ছে তার কোমরে। অদ্ভুত সব কান্ড করছে। ইলহাম সহ্য করতে পারলোনা। ছিটকে সরে পড়লো ওখান থেকে। দূরে সরে এসে বড় বড় নিঃশ্বাস ফেললে পেছন থেকে ভেসে এলো রাদের শীতল কন্ঠ,

—-“ফিল হলো আমায়? নাকি আরও ডেমো দেখাবো!”

ইলহাম দম বন্ধ করে ফেললো রাদের কথায়। এ ঘরে দাঁড়িয়ে থাকা আর সম্ভব হলো না তার। এক ছুট্টে দৌড়ে পালালো।

#চলবে______#প্রেম_পিয়াসী❤️
#লেখা_মুহতারিযাহ্_মৌমিতা
#পর্ব__________১২.

গুটি কয়েক নিকটাত্মীয়রা ইতিমধ্যে আসতে শুরু করে দিয়েছে। বাকি আত্মীয়দের দাওয়াত দিতে হবে হবে কার্ড ছাপিয়ে। বারো’শ কার্ডের অর্ডারের হুকুম নিয়ে বের হলো অন্তু আর রাদ। অন্তুর সাথে রাদ দোকানে গিয়ে কার্ডের অর্ডার গুলো দিয়ে চলে যাবে নিজের অফিসে। অনেক কাজ জমে আছে। অনেক অর্ডারস জমে আছে। সব গুলো ফুলফিল করতে হবে খুব অল্প সময়ের মধ্যেই। নয়তো বিরাট ঝামেলা হতে বেশি সময় লাগবেনা।

কার্ডের অর্ডার দিয়ে রাদ আর এক মুহুর্তও দেরী করলো না। চলে গেলো। অন্তু একটা মোক্ষম সুযোগ পেলো ইলহামকে একা পাওয়ার। কত ক্ষো/ভ যে জমে আছে মনে গুনে শেষ করতে পারবেনা সে। ইলহাম তাকে কম ঘোরায়নি। যাকে বলে নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরানো। সে তো তার চেয়েও অধিক করেছে তার সঙ্গে। আর এখন তো পাখি তার নিজের খাচাতেই এসে বন্দী হয়েছে। এবার চাইলেও সে সহজে উড়ে যেতে পারবেনা। কথাটা ভাবতেই পৈ/শা/চি/ক আনন্দে ফাল পেড়ে উঠলো মনটা। ব্যস্ত ভঙ্গিতে একটা সিএনজি ডেকে রওনা হলো বাড়ির উদ্দেশ্যে। কিন্তু যেয়ে শুনতে হলো, ইলহাম বাসায় নেই। তারা বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেও চলে গেছে ভার্সিটি। আসবে সেই ২টায়। রাদ বাসায় আসার পথে নিয়ে আসবে তাকে।

অন্তুর সমস্ত প্ল্যানে জল ঢেলে পড়লো। কি ভেবে এসেছিলো বাড়িতে আর কি হলো? ড্যাম। অন্তু রে-গে-মে-গে আবার বেরিয়ে গেলো।

গ্রীষ্মের সবচেয়ে ভ/য়া/ন/ক এবং বী/ভ/ৎস রূপের সাথে সাক্ষাৎ হয়ে চলেছে বেশ ক’টাদিন যাবত। তীব্র রোদের ফাটা আক্রোশ পাশাপাশি গা পোড়ানো ভ্যাপসা গরম। ইলহাম সাফোকেশনে ভোগে খুব। মাঝেমধ্যেই তার শরীর এমন ভাবে হাঁপিয়ে ওঠে, যেন সে হাঁপানির রু/গী। কিন্তু আজ অন্তরীক্ষ অন্য কিছুর ইঙ্গিত দিচ্ছে। জানান দিচ্ছে, সব গরমের অন্ত হয়ে আসছি আমি সিন্ধু বয়ে।

ক্লাস শেষ করে বের হয়ে এলো ইলহাম। পরনে সকালের সেই নেভি ব্লু রঙের চুরিদারটা। এই রঙে, এবং এই ড্রেসে ভীষণ ফুটেছে তার মুখ-খানা। যেন, এক নীলপরি। রাদের একটা ম্যাসেজ এসেছিল বটে, “প্রিয়দর্শনী? সাবধানে থেকো। আজ কিন্তু একটু বেশি মনোরম লাগছো তুমি।”

ইলহাম রাদের এহেম ম্যাসেজে পাত্তা না দিয়ে নিজের মনে করে গেছে সব। জীবনটা পরাধীনতায় কাটানো একদম পছন্দ নয় তার। অথচ দেখো, ঐ পরাধীনতাই আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রেখেছে তাকে।

তার মনে আছে স্কুলের সেই দিনটির কথা। যে দিনে মিশমিশের সাথে প্রথম দেখা হয়। ইলহাম বরাবরই শান্ত প্রকৃতির মেয়ে। কারোর সাথে তাকে কথা বলতে দেখা তো দূর বসতেও দেখা যেতোনা কোনোদিন। অথচ মিশমিশ প্রথম দিনেই তাকে নিজের পাশে বসিয়েছে। পাশাপাশি এতো সব গল্প করেছে যা ইলহাম গোটা জীবনে কখনোও করেনি। মিশমিশ ছিলো ইলহামের বিপরীত। খুবই চঞ্চল এবং দুষ্ট প্রকৃতির মেয়ে। ইলহামকে মাত্র অল্প দিনেই স্বাভাবিক করে তোলে। তারপর থেকেই তারা বেস্ট ফ্রেন্ড। মিশমিশ ছিলো মফস্বলের মেয়ে। বাবার চাকরির ট্রান্সফার হয়ে এসেছে এখানে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, এখানেও স্থায়ী ভাবে থাকতে পারবে কি না জানেনা সে।

মিশমিশ এবং তার দিন বেশ ভালোই যাচ্ছিলো। এর মাঝের প্রায় অনেক ঘটনাই মনে নেই ইলহামের। তার ছোট্ট একটা রোগ আছে। শর্ট টাইম মেমোরি লস। মুলত এর জন্যই ইলহাম সর্বদা নিঃসঙ্গ ছিলো। মিশমিশ ইলহামের এই রোগের কথা অবশ্য জানতো না। কিন্তু যখন থেকে জানতে পারলো, তখন থেকে সে ইলহামকে আরও আগলে আগলে রাখতে শুরু করলো। ইলহাম নিজের জীবন বলতে মিশমিশকেই বুঝতো। তার সবটা জুড়ে ছিলো তার বেস্ট ফ্রেন্ড মিশমিশ। কেননা, তখন তার আপন বলতে কেউই ছিলো না। মামা-মামি ছোট থেকেই বড় অনাদর অবহেলায় বড় করেছে তাকে। তাই নিঃসঙ্গ জীবন তাকে আরও পিষ্ট করে মা/র/তো।

কিন্তু মিশমিশও বেশিদিন টিকলো না তার জীবনে। তার মনে আছে, যখন তারা মেট্রিক দিলো, তখন একটা রোড এ/ক্সি/ডে/ন্টে মিশমিশ মা//রা যায়। মিশমিশের মৃ//ত্যু//তে ইলহাম পুরোপুরি একা হয়ে যায়। মায়ের মৃ//ত্যু//র পর থেকে তার মনে পড়েনা এরকম কোনো বড় আ/ঘা/ত আর কোনোদিন পেয়েছে কিনা? ধীরেধীরে তার নিঃসঙ্গ জীবনটা তলিয়ে যায় ঘোর অন্ধ/কারে। পূর্বের চেয়েও আরও অধিক একা হয়ে পড়ে সে। আর কোনোদিন মিশমিশের খালি জায়গাটা কাউকে দেওয়ার দুঃসাহস করতে পারেনা ইলহাম। কেননা, তার প্রথম বেস্ট ফ্রেন্ড ছিলো তার মা। যে তাকে খুবই অল্প সময়ের মাঝে একা ফেলে হারিয়ে যায়। অতঃপর আসে মিশমিশ। যাকে আঁকড়ে ধরে তার জীবনটা চলছিলো একটা স্বাভাবিক গতিতে, সেটাও সইলো না ভাগ্যে। কেঁড়ে নিলো তাকেও।

ইলহাম প্রায় মাঝেমধ্যেই ভুলে যেতো মিশমিশের কথা। আবার মাঝে মাঝে মনে হতো মিশমিশ তো বেঁচে আছে। আবার মাঝে মাঝে যখন মনে পড়তো মিশমিশ বেঁচে নেই, তখন তার জীবনটা থমকে যায় একদম। জীবন থেকে হারিয়ে যায় সকল আনন্দ, উৎসাহ, খুশিগুলো। একদম হারিয়ে যায়।

—-“এই ইলু?”

ইলহাম ক্লাস থেকে বের হয়ে অন্যমনস্ক হয়ে হাঁটছিলো। এমন সময় সামনে থেকে হাত উঁচিয়ে ডাকলো আলভি। ইলহাম ডাক পেয়ে সামনে তাকাতেই দেখলো আলভি আর উপমা দাঁড়িয়ে আছে। ইলহাম স্মিত হেসে হাত নেড়ে চলে গেলো ওদের কাছে।

—-“কি ব্যাপার ম্যাডাম? দুলাভাইয়ের কাছে গিয়ে তো আমাদের একদম ভুলেই গেলেন?”

উপমা ইলহামের হাত ধরে বলল কথাটা। ইলহাম বিরস মুখে তাকালো উপমার পানে। আলভি উপমার কথার রেশ টেনে বলল,

—-“তা আর বলতে? দেখছিস না, আজকাল ভার্সিটি এসে আমাদের দু’জনকে একবার খুঁজছেও না! আসছে আর যাচ্ছে।”

ইলহাম চোখ জোড়া সরু করে তাকালো আলভির পানে। কাঁধের উপর দু-চার ঘা দিয়ে বলল,

—-“তুই না চুপই থাকবি বুঝলি। জানিস, সেদিন দেখলাম তানহার সাথে কিসব ফ্লার্ট-স্লার্ট হচ্ছিলো। আমি এতো করে ডাকলাম, আমায় দেখলোই না বেয়াদবটা।”

আলভি ধরা পড়া চোরের ন্যায় পালাতে চাইলো। উপমা ক্ষপ করে ওর হাতটা চেপে ধরে বলল,

—-“কি রে হ্যাঁ? তুই নাকি তানহাকে দেখিসই না? তাহলে এসব কি?”

আলভি কেশে উঠলো। কথা পালটানোর মতলবে মাথা চুলকে বলল,

—-“না না! শুন না, আমার খুব ক্ষিদে পেয়েছে চলনা কিছু খেয়ে আসি?”

—-“আচ্ছা? এখন খুব ক্ষিদে পেয়ে গেলো তাইনা? তা এতক্ষণ যে আমি বলছিলাম খেতে যাওয়ার কথা, তখন তো খুব বললি ক্ষিদে নেই।”

আলভি উপমার দিকে অসহায় চোখে তাকালো। উপমা আর ইলহাম হেসে উঠলো ওর অসহায় মুখটা দেখে। অতঃপর দু’জনেই দু-চারটে কিল-ঘুষি দিয়ে বলল,

—-“আজ যদি তানহার কেস টা না বলিস তাহলে কিন্তু তোকে আস্ত রাখবোনা।”

আলভি দু’জনের হাত থেকে নিজেকে বাঁচাতে বাঁচাতে মৃদুস্বরে চেঁচিয়ে বলল,

—-“বলবো বলবো! প্রমিজ। আর মা/রিস না ভাই। তানহা দেখলি প্রেস্টিজের দফারফা।”

—-“এই এক সেকেন্ড আমার ফোন..”

সবাইকে চুপ করিয়ে দিয়ে ইলহাম ফোনটা বের করলো। রাদ কল করেছে। ইলহাম দু’জনের দিকে তাকিয়ে অনুনয়ী সুরে বলল,

—-“সরি গাইজ। আজ আমি চলি। অন্যদিন না হয়, একসাথে লাঞ্চ করা যাবে। মিস্টার ডেভিল এসে পড়েছেন।”

—-“হ্যাঁ যাও যাও। তোমাদেরই তো সময়। আজ আমার একটা ডেভলি নেই বলে।”

আলভির মুখে ডেভলি শুনে হেঁসে উঠলো দু’জনে। ইলহাম উপমার দিকে তাকিয়ে কড়া হুকুমে বলল,

—-“তুই ওকে একদম ছাড়বিনা কিন্তু। আজ তানহার ব্যাপারে সবটা একদম পেট থেকে টেনে বের করবি বলে দিলাম। ভার্সিটির ক্লাস তো আজ থেকেই অফ। নেক্সট উইকে আমি সব জিজ্ঞেস করবো।”

বলতে বলতে চলে গেলো ইলহাম। ইলহাম চলে গেলে উপমা আলভির কান ধরে নিয়ে যায় ক্যান্টিনে। আজ আলভি ট্রিট দিবে সেই সাথে তানহার ব্যাপারে সবটা খুলে বলবে, বলে উপমার কঠিন জারি।

__________________________________

ইলহাম মেইন রোডে এসে দাঁড়াতেই ঝপাৎ করে বৃষ্টি নামলো। রাদের গাড়িটা দাঁড়িয়ে আছে দূরে। রাদ পথ চেয়ে বসে ছিলো। হঠাৎ ইলহামকে আসতে দেখে ঠোঁটের কোনে মিষ্টি হাসির রেখা ফুটে উঠলো। ততক্ষণে খেয়াল হলো মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। ইলহামের খুব ইচ্ছে হলো বৃষ্টিতে ভিজতে। কিন্তু কি মনে হতে আবার ভিজলো না। ওড়না টেনে মাথা ঢেকে এক দৌড়ে এসে হাজির হলো গাড়ির কাছে। ইলহাম গাড়ির কাছে আসতেই রাদ চটজলদি খুলে দিলো গাড়ির দরজাটা। ইলহাম ভেতরে বসতে বসতে ওড়নাটা ভালো করে ঝেড়ে নিলো। রাদ দেখছিলো ওকে। ভাবুক মনে বলল,

—-“আজ ক্লাস কেমন হলো?”

ইলহাম অন্যমনস্ক হয়ে জবাব দিলো,

—-“হু, ভালো।”

—-“গুড। ক্ষিদে পেয়েছে? কিছু খাবার নিয়ে আসবো?”

—-“না। বাসায় চলুন। বাসায় গিয়ে খাবো।”

ইলহাম একবার দেখলো রাদকে। তারপর বলল কথাটা। রাদ গাড়ির স্টিয়ারিং এর উপর হাত রেখে কাচুমাচু করছে। ইলহাম আরও একবার দেখলো তাকে। রাদ হয়তো তাকে কিছু বলতে চাইছে। সে কি জানতে চাইবে? না; থাক। নিজের ইচ্ছে হলে ঠিকই বলবে।

—-“সুইটহার্ট, তোমায় একটা কথা জিজ্ঞেস করবো?”

ইলহামের ভাবনার পৃষ্ঠে আচমকাই প্রশ্ন করে উঠলো রাদ। ইলহাম ফের পাশ ফিরে দেখলো তাকে। সাত-পাঁচ ভাবনায় একবার ডুব দিয়ে বলল,

—-“হ্যাঁ! বলুন?”

রাদ হঠাৎ শক্ত করে চেপে ধরলো গাড়ির স্টিয়ারিং। অতঃপর বুক ফুলিয়ে বড় করে নিঃশ্বাস ছাড়লো। অবশেষে স্থীর হয়ে ফিরে তাকালো ইলহামের পানে। হাত বাড়িয়ে ইলহামের ভেজা হাত দু’টো নিজের হাতের মুঠোয় পুরে নিয়ে বলল,

—-“আমার একটা ইনফরমেশন চাই।”

ইলহাম প্রাথমিক পর্যায়ে চমকায় রাদের আচরণে। পরমুহূর্তে বেশ অবাক হয়। অবাক কন্ঠেই জানতে চায়,

—-“ইনফরমেশন! কিসের ইনফরমেশন?”

—-“আজ থেকে প্রায় সাত বছর পূর্বে তুমি তোমার মাকে একটা রোড এ//ক্সি//ডে//ন্টে হারাও। সেই দিনটির কথা মনে আছে তোমার?”

রাদের কথায় আকস্মাৎ ইলহামের মুখটা র/ক্তশূণ্য হয়ে উঠে। বুকের ভেতরটা কেমন মোচড় দিতে থাকে পর্যায়ক্রমে। একই সঙ্গে শতাধিক প্রশ্ন মন পুকুরে এসে জমা হতে দম বন্ধ লাগে তার। রাদ কি করে জানলো তার মায়ের মৃ//ত্যু সাত বছর পূর্বে একটা রোড এ//ক্সি//ডে//ন্টে হয়েছিলো? সর্বপ্রথম এই প্রশ্নটাই মাথায় আসে তার। পরমুহূর্তেই সে ভাবে, মামার মুখে শুনেছিলো তার মা নাকি একজন নামকরা সিঙ্গার ছিলেন। তার প্যাশন ছিলো একদিন বড় গায়িকা হবেন। এক সময়কার কঠোর পরিশ্রমে তিনি সত্যি একজন নামকরা গায়িকা হয়েছিলেন। কিন্তু, ভাগ্য তাকে বেশিদিন টিকে থাকতে দিলোনা। হঠাৎ রোড এ//ক্সি//ডে//ন্টে গুরুতর আ/হ/ত,অতঃপর মৃ//ত্যু।

সেই খাতিরে রাদ হয়তো জানবে তার মায়ের মৃ//ত্যু সম্পর্কে। কিন্তু তার যে মনে নেই ঐ দিনটির কথা। তখন তো সে অনেক ছোট!

—-“না। ম্ মনে নেই। তখন তো আমি খুব ছোট। স্বাভাবিক ভাবেই আমার মনে থাকার কথা নয়।”

ইলহাম না সূচক মাথা নেড়ে জবাব দেয় রাদকে। ইলহামের গলার স্বর কেমন মিইয়ে আসে। রাদ বুঝতে পারে। যার দরুন সে তড়িঘড়ি কথা পাল্টাতে স্মিত হেসে ইলহামের গালে হাত রাখে। চোখ ঝাপটে বলে,

—-“হ্যাঁ, ঠিকই বলেছো। তখন তুমি সত্যিই খুব ছোট। আর স্বাভাবিক ভাবেই তোমার ওসব কথা মনে না থাকারই কথা। ইট’স ওকে, সুইটহার্ট। ডোন্ট টেইক প্রেশার…”

—-“কিন্তু আপনি যে বললেন, ইনফরমেশন চাই! কিসের ইনফরমেশন চাই? আর আমার মায়ের মৃ//ত্যু//র ব্যাপারে আপনার ইনফরমেশন কেন চাই?”

—-“উনি তো অনেক বড় সিঙ্গার ছিলেন। তাই উনার হঠাৎ মৃ//ত্যু//টা কেউ স্বাভাবিক ভাবে নেয়নি। অথচ কেউ এটা নিয়ে কখনও মুখ অব্দি খোলেনি। তাই কিউরিওসিটি থেকে জানতে চাইলাম। নাথিং এট অল।”

ইলহামের অস্থির মনটা শান্ত হলোনা। তবুও আর কথা বাড়ালো না। মলিন হেসে মাথা নাড়লো। রাদও ঠিক তার ন্যায় হাসলো। ফের,আবার ঘুরে বসলো পূর্বের জায়গায়। অতঃর গাড়ি স্টার্ট দিতে দিতে ভাবলো,

—-“এতো বড় সিঙ্গারের হঠাৎ মৃ//ত্যু//তে গোটা মিডিয়া পাড়া একদম নিরব থেকেছে! ব্যাপারটা কি মোটেও কৌতুহল জাগায় না? আমায় এর রহস্য ঘাটতে হলে তোমার থেকেই সকল ইনফরমেশন নিতে হবে, সুইটহার্ট। কেননা, তুমি যা জানো তা আর কেউ জানেনা। কেবল সময়ের অপেক্ষা।”

রাদ কথাগুলো মনে মনে আওড়ালো। বড় করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে রওনা হলো বাড়ির উদ্দেশ্যে।

#চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here