প্রেম প্রিয়জন পর্ব ১

–‘১৬ কিংবা ১৭ বছরের একটা বাচ্চা মেয়ে কে কোন মহা পুরুষ বিয়ে করতে রাজি হবে? যার জন্য একদম ভূত সেজে বসে আছিস?’

হাত পা বাঁধা অবস্থায় নিজেকে একটি অন্ধকার রুমে আবিষ্কার করে ভয়ে কুঁকড়ে গেলাম। যখনি বাঁধন খুলতে চেষ্টা করলাম ঠিক তখনি কোথা থেকে এক টুকরো শুভ্র আলো এসে পড়লো আমার চোখে। সেই আলো তে দেখতে পেলাম বডি বিল্ডারের মতো এক অবয়ব কে। ভয়ে প্রাণ যায় যায় অবস্থা। গলার পানি যেনো শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেলো। যখনি নিজেকে বাঁচানোর জন্য ছটফট করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম সিংহের গর্জনের ন্যায় ঝাঁজালো কন্ঠে ভেসে আসা কথা গুলোয় পুরো রুম শুদ্ধ যেনো ভয়ে থরথর করে কাঁপতে লাগলো। কন্ঠ শুনে চিনতে কষ্ট হয় নি।তার মানে পূর্ণ ভাই আমাকে এখানে বেঁধে রেখেছে? কিন্তু কেন? আমাকে চুপ থাকতে দেখে আবারো সেই ভয়ংকর কন্ঠ ভেসে আসলো,

–‘কথা বলছিস না কেন?’

ভয়ে এতোটাই জড়সড় হয়ে ছিলাম যে বেমালুম ভুলে গেলাম আমি বাকরুদ্ধ না বরং আমি কথা বলতে পারি। তাও তোতাপাখির মতো। দাদু বলতো ‘আমার বড় ছেলের ঘরে এক তোতার জন্ম হয়েছে। যার বকবকানি তে পুরো বাড়ি মুখরিত থাকে।’ আসলেই কি তাই? জানিনা কিন্তু আমি এতো বক বক করা মানুষ টাও কিভাবে এখন চুপচাপ আছি কে জানে! বয়স কিন্তু আমার মোটেও ১৬ বা ১৭ না। গুনে গুনে ১৮ বছর ৯ মাস। তাহলে পূর্ণ ভাই আমাকে বাচ্চা বললো কেন? উনার কি চোখে সমস্যা? আধো ধরা গলায় বললাম,

–‘পূর্ণ ভাই এসব কি হচ্ছে? আ-মি কো-থায়?’

আমার কথা উনার কান ওবধি পৌঁছালো কিনা কে জানে। ছায়ামূর্তি টা এবার এক জায়গায় ধম মেরে দাঁড়িয়ে থাকা ভুলে হাঁটতে শুরু করলো। আমার উদ্বিগ্ন চোখ দুটো সেটি ভালো করে দেখার আপ্রাণ চেষ্টা রত থাকলে ও ব্যর্থ হয়। কারণ রুমে আলো খুব ই কম। এই আলোয় কারো ছায়া শুধু সামনেই দেখা যায় পেছনে না। কোথায় গেলো পূর্ণ ভাই? ভয়ে গা ছমছম করছে! যাকে পূর্ণ ভাই ভাবলাম সে আবার ভূত টুত না তো? বাবারে তাহলে আজ ই কি আমার জীবনের শেষ দিন? পরী তুই তো গেলি পগাড় পাড়! হায় আল্লাহ এখনো বিয়েই হলো না তার আগেই ভূত এসে ঘাড় মটকে আমার সব স্বপ্ন আশা একেবারে বালি চাপা দিয়ে দিবে! এই ছিলো কপালে? হাত দিয়ে কপালে দুইটা বাড়ি মারার ইচ্ছা থাকলেও পারলাম না কারণ হাত তো বাঁধা। কি করবো বুঝতে পারছি না চিৎকার দিবো? দিলেও বা কে শুনবে? ভূত টা নিশ্চয়ই রুমে সাইলেন্সার লাগিয়ে রেখেছে। নাহলে ভূত টা যেভাবে পূর্ণ ভাইয়ের কন্ঠ নকল করে কথা বললো বাহিরের কেউ শুনলো না কেন? এ্যাঁহ? আমি আছি টা কোথায়? আমার বাসায় তো রাখবে না ভূত টা। তাহলে নিশ্চয় ভূতের আস্তানায় আছি।

–‘ভূত বাবা এবারের মতো ছেড়ে দে রে! আটা ময়দা একটু মেখেছি তাতেই তুই আমার প্রেমে পড়ে যাবি। আর তোর সঙ্গে করে নিজের আস্তানায় নিয়ে আসবি ভাবিনি রে।’

ভাই বলবো নাকি কাকা? মনে মনে এতো সব ভাবনা ভেবে কথা গুলো বাহিরে প্রকাশ করতেই যাচ্ছিলাম তখন কানের পাশে ফিসফিস করে কে যেনো বলে উঠলো,

–‘তোর সিক্স সেন্স খুব ভালো। কন্ঠ শুনে চিনে ফেললি বাহ!’

ভূতের বাচ্চা তোর আমাকে পছন্দ হয়েছে ভালো কথা সঙ্গে করে পূর্ণ ভাইয়ের কন্ঠ টাও নিয়ে এলি কেন? নাহ আর চুপ থাকা যাবে না বলে যেই চিৎকার দিতে যাবো ওমনি লাইট জ্বলে উঠলো। সেই লাইটের আলোয় পুরো রুম আলোকিত। চোখ টা কিছু সময়ের জন্য ধাঁধিয়ে দিলো যেনো। তবে এবার সত্যিই নিজের চোখের সামনে পূর্ণ ভাই কে দেখে বললাম আরে এতো ভূত না সদ্য জলজ্যান্ত একটা মানুষ। শুনেছি ভূতদের আয়নায় দেখা যায় না কিন্তু যাকে ভূত ভেবেছিলাম তাকে তো আয়নায় স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। তার মানে ভূত টুত কিছু নাই। কিন্তু পূর্ণ ভাই?

–‘কি বিড় বিড় করছিস?’

–‘আ-মি কোথায়?’

–‘তোর শশুড় বাড়ি!’

–‘ম-মানে কি পূর্ণ ভাই?’

–‘বিয়ে ছাড়াই তোকে তোর শশুড় বাড়ি নিয়ে এসেছি। এখানে আবার মানে কিসের?’

মনে পড়ে গেলো সব কিছু। আমাকে তো আজ ছেলেপক্ষ দেখতে আসার কথা। তার জন্য সুন্দর একটা জামদানি শাড়ি পড়ে রেডি হয়ে আয়নায় নিজেকে একবার দেখছিলাম। তারপর কি হয়েছিলো? এটা মনে পড়ছে না কেন? আশ্চর্য! রুম টা দেখে তো মনে হচ্ছিলো নিজের বাসা তেই আছি! হাত পা বেঁধে রাখা। খুলতে চেষ্টা করেছিলাম বলে এখন রিতিমত ব্যথা শুরু হয়ে গেছে! ব্যথায় কুঁকড়ে যাচ্ছি দেখে সইতে না পেরে পূর্ণ ভাই কে বললাম,

–‘পূর্ণ ভাই আমাকে বেঁধে রেখেছেন কেন? হাতে খুব জ্বালা করছে! কি করেছি আমি?’

–‘কি করিস নি সেটা বল!’

ভাবতে থাকলাম কি করেছি? কিন্তু এতো ভেবেও যথোপযুক্ত কারণ খুঁজে পেতে সক্ষম হলাম না।

–‘আমি কিছু করিনি!’

–‘তাই নাকি?’

–‘হ্যাঁ!’

–‘আজ তোকে দেখতে আসবে সেটা আমায় জানিয়েছিলি?’

পূর্ণ ভাইয়ের কথা শুনে জেঠিমার কথা টা মনে পড়লো। উনি আমাকে কড়া কন্ঠে বলে গিয়েছিলেন,

–‘তোকে যে দেখতে আসবে এটা যাতে আর কেউ না জানে! পূর্ণ ও না! নাহলে আমার থেকে খারাপ আর কেউ হবে না!’

আমাকে চুপ থাকতে দেখে পূর্ণ ভাই রেগে গর্জে উঠে বললেন,

–‘নিরবতা পালন করতে বলিনি আমি!’

–‘আমার বিয়ে আমি বুঝবো আপনাকে কেন জানাতে হবে? আপনি কে আমার?’

কথাটা বলার পর ঠাস করে গালে একটা পড়বে ভাবতে পারিনি। এতো খারাপ লাগলো যে চোখের পানি ও বাঁধ মানলো না। গাল বেয়ে অশ্রু ফোঁটা আপন গতিতে গড়িয়ে পড়তে লাগলো।

–‘থামলেন কেন মেরেই ফেলুন না। আপনাদের কাছেই বড় হয়েছি মারবেন কাটবেন সব তো আপনাদের ই ইচ্ছা। আমার তো কোনো ইচ্ছা নেই! আমি রো মানুষ ও না রোবট একটা। বড্ড অভাগী আমি যার বাবা মা নাই। যাকে নিজের আপন বাবা মা ই ফেলে চলে যায় তাকে তো অন্য রা মানুষ আঘাত ই করবে তাই না? ভালোবাসা তো আমার মতো মেয়েদের কপালে নাই!’

কেন যেনো এতোটা খারাপ লাগছিলো যে মনের কোণে চেপে রাখা কথা গুলো একনাগাড়ে বলেই দিলাম। মানুষ টার দিকে তাকানোর দুঃসাহস পেলাম না। নিচের দিকে তাকিয়েই কথা টা বললাম। পূর্ণ ভাই আর কোনো কথা বললেন না। হাত আর পায়ের বাঁধন গুলো খুলে হনহন করে কোথায় যেনো চলে গেলেন। ছাড়া পেয়ে কষ্ট যেনো আরো কয়েক গুন বেড়ে গেলো।

দাদুর মুখে শুনেছি বাবা মা আমাকে ছেড়ে চলে গেছেন। ফেলে গিয়েছিলেন জেঠা আর জেঠি মার কাছে। উনারাই লালন পালন করে বড় করেছেন। ছোট বেলায় কোনো অযত্ন করেন নি। কিন্তু যখন থেকে পুরোপুরি বুঝতে শিখলাম তখন থেকে উনাদের অবহেলা ছাড়া কিছু পাই নি মনে হয়। পরিবার থেকে বিতাড়িত করা হয় এক প্রকার। গিয়ে উঠলাম হোস্টেলে। দাদুর জন্য আমার লেখা পড়া বন্ধ হয় নি। হোস্টেলে থেকে লেখাপড়া করতাম। এখন পড়ি ইন্টার সেকেন্ড ইয়ারে। আজ সকালের জেঠা আমাকে হোস্টেল থেকে বাসায় নিয়ে আসেন। বাসায় আসলেই দাদুর কাছে জানতে পারি আমার বিয়ের কথাবার্তা চলছে। প্রথমেই না করে দিই। পরে জেঠিমা বলেন,

–‘যার বাবা মা নাই তার আবার কিসের কথা? চোরের মায়ের বড় গলা। এতোদিনে বহুত করেছি আর না। এবার বিয়ে দিয়ে তোকে বিদায় করতে পারলেই শান্তি!’

ঐ যে কথায় বলে না ছুরির আঘাত থেকে মানুষের কথার আঘাত বেশি অতিব গুরুতর। ঠিক তাই।

উনার কথার আঘাত এতোটাই প্রখর যে ভেতরে ভেতরে মরে গেছি। রাজি হয়ে যাই বিয়ের জন্য।পূর্ণ ভাই কে কেন জানাতে নিষেধ করেছিলেন আমার জানা নেই। আমি ও জানাই নি। পুষ্পা ও জেঠিমার মতোই। কেন জানিনা আমাকে দেখতে পারে না। এটা আমি বুঝি। সব সময় আমাকে এড়িয়ে চলে। তাই নিজের মতোই থাকছিলাম। কিন্তু পূর্ণ ভাই তো বিজনেসের কাজে শহরে ছিলো তাহলে এখানে কিভাবে এলো? আর কেনই বা আমার সাথে এমন করলেন? জান নাই!

সকল কষ্ট যেনো এই মুহূর্তে দলা পাকিয়ে আসতে থাকলো। মনে হতে থাকলো মন খুলে কাঁদতে পারলেই শান্তি লাগলো। গলা ফাটিয়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। ছন্নছাড়া পা নিয়ে দৌড়ে ছাঁদে চলে যাই। রেলিং ধরে কান্না করতে থাকলাম। শুনেছি বাবা মা সন্তানের আদর্শ। প্রিয়জন! সবচেয়ে প্রিয় মানুষ! তারা আমার সাথে এমন করলো কেন? কেন ছুঁড়ে ফেলে দিলো আমাকে অনাদর অবহেলার স্থুপে? আমি কি এতোই পঁচে গেছিলাম? সন্তানের লালন পালন করতে না পারলে আমাকে জন্মই বা দিলেন কেন? চিৎকার করতে করতে বলতে ইচ্ছে করছে। সন্তান জন্ম দিকেই লোকে তাদের বাবা মা কেন বলে? কেন এতো সুন্দর মর্যাদাপূর্ণ শব্দ দুটির সাথে মিলায়? মানুষ কি জানে না শুধু জন্ম দিলেই বাবা মা হওয়া যায় না!

অশ্রুসিক্ত চোখে আকাশের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে গলা ফাটিয়ে চিৎকার দিয়ে বলতে লাগলাম,

–‘আই হেট ইউ বাবা! আই হেট ইউ মা। আই হেট ইউ এ লট!’

(চলবে)

#প্রেম_প্রিয়জন🌸
#Writer_Sumaiya_karim

~সূচনা পর্ব~

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here