#প্রেম_সায়রের_ছন্দপাত
#সাদিয়া_নওরিন
পর্ব—১
“তোমার ওষ্ঠের মাদকতায় ডুবতে দিবে কি আমায়? আমি যে তোমার প্রেম সায়রের ছন্দপাত হতে চাই! তোমারী নেশায় সিক্ত হবো, এমন এক তুমি চাই!”
ধপ করে বিছানা ছেড়ে উঠে বসে ইরশাদ। বিন্দু বিন্দু ঘাম জমেছে তার নাকের ডগায় ও কপালে। কক্ষজুড়ে চোখ বুলাল সে,চারপাশটা অদ্ভুত লাল হয়ে আছে!
মূলত সূর্যের আবছা আলোক রশ্মি সাদা টাইলসের ওপর পড়ে পুরো রুম জুড়ে ছড়িয়ে দিয়েছে লাল রক্তিম আভা। ফুল এসিতেও দরদরিয়ে ঘামছে ইরশাদ। চোখেমুখে অস্তিরতা ছড়িয়ে পড়েছে, যার প্রমান সরুপ দৃশ্যমান কানের গোড়ায় ছুঁইয়ে পড়া ঘামের লহর! সাদা সেন্ডুগেন্জিটা পুরো শরীরে লেপ্টে, আঁকাবাঁকা পেশীগুলো ও দৃশ্যমান হচ্ছে এখন ।
আনমনে কিছু ভেবে, লাফিয়ে বিছানা ছেড়ে নেমে এলো ইরশাদ। কয়েকদিন পরপরই একই স্বপ্ন দেখে সে, আর ঠিক তখনই বুকটা বড্ড ফাঁকা ফাঁকা লাগে তার। মনে হয় বুকের বা পাশটা কেউ খুব যত্নে ফালা ফালা করে কাটছে আর তারপর তা কর্নফুলী নদীতে ফেলার প্লানিং করছে সে!
দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে ফ্রেস হয়ে নিল সে। আর তারপর তোয়ালেতে মুখ মোছে ফ্রি হেন্ড এক্সারসাইজ করতে নেমে গেল। এ যেন মনের অশান্তিকে শরীরের ওপর প্রদান করা! ঘন্টাখানেক পুশআপও অন্য এক্সারসাইজ শেষ করে, পানির বোতলটি হাতে নিতেই হাতের ওপর লিখা ” AR” চিহ্নটির দিকে চোখ পড়লো ইরশাদের। আর সাথে সাথেই অতীতের স্মৃতি নাড়া দিয়ে উঠলো তার মনের মাঝে!
তার সেই হুট করে চলে যাওয়া, তার সাথে কাটানো প্রতিটি মুহূর্ত! ইরশাদের আজো মনে অাছে তার সাথে দেখা হওয়া শেষ দিনটির কথা,
ছন্দ হুট করেই চলে গিয়েছিল তাকে ছেড়ে,আর তারপর পরইসবজায়গা থেকে ব্লক! যেভাবে ঝড়ের গতিতে এসেছিল সে তার জিবনে,ঠিক সেইভাবে হাওয়ার গতিতেই হারিয়ে গিয়েছিল সে আবারও! আর তারপর, ইরশাদের সেই নয়মাস! পুরো পাগলের মতো হন্য হয়ে খুজেছিল সে তাকে প্রতিটি স্কুলে স্কুলে! আর সেই নয়মাস পর, এসএসসি পরীক্ষার সেন্টারের সামনে আবার দেখেছিল সে ছন্দকে! বুকের ওপর নেইম প্লেটের নামটি দূর থেকে পুরোটা পড়তে পারে নি সে। কেবল দুইটি শব্দ পড়েছিল “এ আর”!
ছন্দ ছন্দ নামে পেছন থেকে ডাক দিতেই দৌড়ে চলন্ত বাসে চড়ে হাওয়া হয়ে গিয়েছিল সেদিন ছন্দ”!
চোখ বেয়ে পড়া নোনাজলগুলো কানিআঙ্গুলে মুছে গোসল করে চলে যায় ইরশাদ। ঝরনার পানি তার সাদা পিঠ ছুঁইয়ে ঠুপঠুপ করে ফ্লোরের পানির সাথে মিশছে, সাথে মিশে একাকার হচ্ছে ইরশাদের চোখের অশ্রু ও!
ফজরের নামাজ শেষ করে পড়ার টেবিলে বসে পড়লো সে। পড়তে বসে ইরশাদ আনমনে কিঞ্চিৎ কিছু ভাবলো । তারপর টেবিলের সিক্রেট ড্রয়ার থেকে বের করে আনলো সে তার বহু পুরাতন ডাইরীটি।
“অস্তিত্ব ভালোবাসা স্বর্গীয় অনুভূতি,
হয় সে কখনো কারো দেওয়া প্রতিশ্রুতি,
অপেক্ষার দুর্নিবাণ অন্তরের সেই রাগিনী,
কে তুমি প্রিয়তমা,
তুমিই কি আমার প্রেমানুরাগিনী”!
মুখের তাচ্ছিল্যের হাসি ঝুলিয়ে বাকি পৃষ্ঠাগুলো উল্টিয়ে চলল ইরশাদ! তারই লিখা কবিতা। সাতবছর হয়ে গিয়েছে এইসব লিখালিখি ছেড়ে দিয়েছে সে। আজকাল তো এইসব তার কাছে কৈশোরের হেয়ালীপনাই মনে হয়!
” প্রেম বলতে কিছুই নেই, সবকিছুই হলো হরমোনের কারিশমা। আর ফেইসবুকের প্রেম এ তো দুনিয়ার নিকৃষ্ট জিনিস!”
ডাইরিটা বইয়ের স্তুপে ছুঁড়ে দিতে দিতে আনমনে এইসব বলে উঠে, বিসিএসের বইটি খুলে তাতেই মুখে গুঁজে দেয় ইরশাদ!
আঙ্গুর ফল টকে মতো ইরশাদের কাছে নারীসঙ্গ ও বিরক্তিকর! “ইরশাদ মেহতাব,” বাবা মায়ের একমাত্র আদরের ছেলে। যদিও আরো দুইটি বোন আছে তার, কিন্তু বোনদের ধারনা ইরশাদের তুলনা কারো সাথেই দেয় না তাদের বাবা মা। বর্তমানে ব্যাংকে জব করছে সে। বেসরকারি ব্যাংক, তবে হুট হাট ছুটি কাটানোর খারাপ ব্যামো আছে তার। হুট করেই কাজ ছেড়ে হাওয়া হয়ে যাওয়া ইরশাদ, কম্পিউটারের চেয়ে দ্রুত কাজ সামলাতে পারে! আর তাই হয়তো তার জবটা যেতে যেতে রয়ে গেছে আজো।তবে তার এবারের ইচ্ছে সে বিসিএস দিবে।
পড়ার প্রতি সে অতিমাত্রায় উৎসাহিত, তা কিন্তু মোটেও নয়। পড়াটা তার কাছে ক্ষোভের কারণ। ঠিক যেন জানি দুশমন! পড়ার দফারফা করার স্বপ্নে মাঝে মাঝে এতোটাই বিভোর হয়ে পড়ে সে, মনে হয় একে প্রতিহত না করতে পারলে তার জিবনই বৃথা!
ফোনের রিংটোনে ব্রু কুঁচকে তাকায় ইরশাদ। জোড়ব্রু তার কিন্তু গাড় নই, আবছা। মাঝখানের ব্রুগুলো তো আবার ধূসর! তবে তার মায়ের কাছে সেইটাই যেন দুনিয়ার শেষ্ঠ সৌন্দর্য।
নাকমুখ কুঁচকে কিছুসময় গালাগালি দেয় সে, এই মুহুর্তে ফোনের ওপ্রান্তে থাকা মানুষটিকে! তারপর ফোনটি রিসিভ করেই ঝাঁঝের সাথে বলে,
—-ব্যাটা,জানিস না এই সময় পড়ি আমি। ঘুমের ঘোরে চোর কি তোর লুঙ্গিটা নিয়ে গিয়েছে, যে সকাল আটটায় কল দিলি।
—— লুঙ্গি নিলে তোকে কল ক্যান দিতাম? পুলিশরে দিতাম। তোর কি মনে হয় আমি এখন লুঙ্গির জন্য লুঙ্গি বিমা করতে কল দিয়েছি তোকে?
—– তো বমি করি দাও, কোন শুভকাজের লক্ষ্যে কলটি দিয়েছেন আপনি আমায়!
ইরশাদের খোঁচা গায়ে মাখালো না সাগর। সে সাবলীলভাবেই বলে চলল,
—–আমরা সবাই গেটটুগেদার পার্টি করবো আজ। আর তাছাড়া আজ তো ফ্রাইডে। তো তাই নয়টায় আমার বাসায় আসবি তুই।
—- তোরটা কি লিটনের ফ্লাট যে সকাল সকাল আসবো?
—- কাটা কাটা গা জ্বালানো কথা ছাড়া ভালো কথা বলতে পারিস না তুই?
খিলখিলিয়ে হেঁসে দেয় ইরশাদ । মুহূর্তেই দৃশ্যমান হয় তার চিকন চিকন দাঁতগুলো, আর সাথে ঠোটের দুপাশটাও কুঁচকে যায় সেই হাসিতে। আরো কিছুখন দুষ্টুমি করে ফোনটি কেটে দেয় সে। তারপর আরো কিছুখন পড়ে, রেডি হয়ে বেরিয়ে যায়।
সাতজনের গ্রুপ তাদের। তার মধ্যে চারজন ছেলে আর তিনজন মেয়ে। পায়েল, তিশা, বন্যা। এ তিনজনের মধ্যে সিংগেল আছে শুধুই বন্যা। তবে তা বন্যার ভাষায়,
“আমি সিংগেল তার মানে এই নয় আমি অসুন্দর, তার মানে এই আমাকে অনেকে প্রপোজ করে আর আমি কারো মন ভাঙ্গতে চায় না। আর তাই একজনকে চুজ না করে সবাইকে ওয়েটিং লিস্টে বসিয়ে রাখি”
বন্যার একথা মিটিমিটি হাসে পায়েল। সুশ্রী, লক্ষ্মী সে। ম্যারিড কিন্তু ফ্রেন্ডদের আড্ডা মিস দিতে চায় না সে। তিশার আবার সেইম এইজ রিলেশন তাও আবার তাদেরই সার্কেলের তিতাসের সাথে। আর নিঝুম সে যেন বিয়ের পর নিঝুম দ্বিপ বনে বসে আছে। আর সেই হিসেবে সিংগেলের খাতায় এখন নাম আছে কেবল সাগর আর ইরশাদের।
আজকের গেটটুগেদার পার্টিটা মূলত তিশা আর তিতাসের বিয়ে উপলক্ষে। তারা প্রি-হানিমুনে যাবে কাশ্মীর। আর সেইটা শুনার পর থেকেই যেন দুচোখে ঘুম নেই সাগরের! সে ইরশাদের ডানহাতটাই আলতো টোকা দিয়ে উৎসুক হয়ে বলে উঠলো,
—— ইয়ার, ওরা নাকি কাশ্মীর যাবে চলনা আমরাও যায়।
—- ক্যান, কাবাবে হাড্ডি হতে মন চায় কেন এতো তোর? ওরা একটু সেখানে গিয়ে কম্বলের তলে রোমান্স করবে, আর তোর দেখতে মন চায়বে সানরাইজ। বল এটা কিভাবে সম্ভব?
ঘাড়ত্যাড়া ভাবেই উত্তর দেয় ইরশাদ। আর তার কথায় সাথে সাথেই চুপসে যায় সাগর।
তবে সে জানে তাদের এবার যাওয়া হবেই।কারন যতই কাট কাট কথা বলুক ইরশাদ, কিন্তু তার মতো কোমল মন হয়তো আর কারোই নেই!
তবে ইরশাদের এ সকল কঠিন কথা খুব করে টানে বন্যাকে! ইরশাদ নামক ঘোরে যেন সে সবসময় ডুবে থাকতে ভালোবাসে। ইরশাদের সবকিছুই তার অতিমাত্রায় প্রছন্দ। এই যে ইরশাদ চিবিয়ে চিবিয়ে কথা বলে, হাসলে হালকা গোলাপি ঠোঁটের মাঝে চিকন দাঁতগুলো দৃষ্যমান হয়,। বন্যার যেন মন চায় সেই দাঁতগুলোকেই সে সু-কেসে যত্নে তুলে সাজিয়ে রাখে! সাদা দুধের মাঝে এক চিমটি লাল মরিচ দিলে যেই রংয়ের সৃষ্টি হয় ইরশাদের গায়ের রঙটা তদ্রুপ! আর তাই তো বন্যা এমন দুধ বানিয়ে রোজই খায়! অদ্ভুত ভালো লাগে এতে তার! তার মনে হয় সে ইরশাদকেই চেটেপুটে খাচ্ছে,
ইশ, ঝালের সাথে মিষ্টি!
তার ওপর আবার ইরশাদের ছ’ফুট উচ্চতার সুনিপুণ বডিটা, এ যেন বন্যার হৃদয়ে ধুকপুকানির সৃষ্টি করে যা মাঝে মাঝে সিডরে রুপান্তরিত হয়! বিগত দুবছর ধরেই সে ইরশাদের নেশায় মজেছে! কিন্তু ইরশাদ সে যেন দেখেও দেখে না তাকে!
চলবে?
( কেমন হয়েছে জানালে খুশি হবো আর কন্টিনিউ করবো কি না বলবেন। ধন্যবাদ☺)