প্রেম সায়রের ছন্দপাত পর্ব ২

#প্রেম_সায়রের_ছন্দপাত

#সাদিয়া_নওরিন

পর্ব—২

—— চাদরের তলায় লুকিয়ে রাত পার করার ইচ্ছে থাকলে তারা কাশ্মীর কেন যাবে? নিজের ঘরেই তো পা দুইটা দুদিকে দিয়ে, উল্টা লটকে, যেমনে মন চায় তেমনে ঘুমাইতে পারে।
লাস্টের লাইনগুলো টানতে টানতে বলে উঠলো সাগর। ইরশাদ সেদিকে তাঁকিয়ে, ব্রু বাঁকিয়ে কিছু বলার আগেই চেঁচিয়ে বলে উঠলো বন্যা,
—– ঐ খ্যাত? এইসব কি ভাষা রে?
আর ইরশ তুই তো জানিস ও শুধু কাবাবে না, রিয়েল লাইফেও আস্ত বড় একটা হাড্ডি। ভেজাল কোম্পানির সর্দার একটা।

মুখ বাঁকালো বন্যা। আর সাগর, মন খারাপ করে তাকালো বন্যার দিকে। বন্যা সেদিকে তাকিয়ে বেবি ফেইস করে, এক কান ধরে ইশারায় সরি বলে নিল তাকে! বন্যা কেবল চায় যেকোন ভাবে ইরশাদের সুদৃষ্টি পেতে! কিন্তু সাগর, তার মন প্রাণ জুড়ে তো শুধু বন্যার ই অস্তিত্ব!

“খ্যাক” করে গলা পরিষ্কার করে গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠলো ইরশাদ,
—– পায়েল, নিঝুম তোরা কি যাবি আমাদের সাথে?
—- আমি কন্সিভ করেছি বেশী দিন হয় নি ইয়ার। আর এতো বড় জার্নি, তবুও..
—– তোর যাওয়ার মোটেও দরকার নেই। ইনফেক্ট তুই যেতে চায়লেও, নিয়ে যাব না তোকে আমি।
পায়েলের মুখের কথা কেঁড়ে নিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বলে উঠলো ইরশাদ।

পায়েল মিস্টি হেঁসে তাকালো তার দিকে। মানুষের কেয়ার করাটা যেন বিশেষ গুন তার এই বন্ধুর।যে কারো সমস্যায়, সবার আগে এগিয়ে আসার প্রবণতা অতিরিক্তই তার মাঝে!
মাঝে মাঝে তার অতিতের কথা মনে পড়লে বড্ড মন খারাপ হয় পায়েলের। দীর্ঘ নয় বছরের বান্ধবী সে ইরশাদের। আর এই নয়বছরে ইরশাদের একটু একটু করে পাল্টে যাওয়াকে, একদম কাছ থেকে অনুভব করেছে সে। পুরাতন ইরশাদ আর এই ইরশাদের মাঝে যেন আকাশ-পাতাল তফাৎ! এইসব কথা মনে পড়লে, মেয়েটির ওপর খুব রাগ উঠে পায়েলের। খুব করে ইচ্ছে হয় তার, মেয়েটিকে সামনে পেলে কষিয়ে দুটো চড় লাগাবে সে তাকে! আর জিজ্ঞেস করবে, তার দেওয়া ধোঁকার কারন। আজ যে শুধু তার জন্যই ইরশাদ এতোটাই অনুভূতিশূণ্য!

বন্যার ডাকে কল্পনার জগৎ থেকে ফিরে আসে পায়েল। আলতো নাক টেনে নিজের চোখের অশ্রুটুকু সামলে নেয় সে। বন্যা সেদিকে খেয়াল নেই,সে নাক ফুলিয়েই বলতে থাকে, নিঝুম তাদের সাথে না যাওয়ার খবর। তারপর দুপাশের আলতো মাথা ঝাঁকিয়ে বলে,
—- যাস না তুই। বৌয়ের আঁচলের তলে লুকিয়ে থাক
—– আরে ইয়ার
—- দূরে গিয়া মর, হারামি।
তার কথায় খিলখিলিয়ে হেঁসে দেয় সবাই, আর সাথে ইরশাদ ও। বন্যা পূলকিত ভাবে কিছুসময় সেই হাসির দিকে তাকিয়ে, লাজুক দৃষ্টিতে মাথা নুইয়ে ফেলে। তারপর পায়েলের দিকে তাকিয়ে সহাস্যে বলল,
—- ছোট একটা খালামনি গিফট করবি আমাকে। ঠিক আছে? একদম কিউট, যাতে দুপাশে দুইটি ঝুঁটি করে পুরো রাজ্যে ঘুরাতে পারি আমি !

—– মেয়ে কেন? ছেলে হবে। পায়েল আমার একটা লক্ষ্মী মামা চায় । আর তাছাড়া মেয়ে মানেই মরিচিকা!
নাক ফুলিয়ে তার দিকে তাকায় বন্যা। এই ছেলেটা এতো মেয়ে বিদ্বেষী কেন! আনমনে ভাবে সে তারপর শব্দ করেই বলে
—–কোন মেয়ে তোর পাকা ধানে হাগু দিয়েছে রে, যে তোর এতো মেয়েতে এলার্জি ?

সবাই ঠোঁট চেপে হাসে বন্যার কথায়। আর সাগর, সে তো অপলকেই তাকিয়ে আছে বন্যার সেই রাগী মুখটির দিকে! কুঁকড়ো চুলে মেয়েটিকে দারুণ লাগে তার। একদম চিপ চিপে শরীর তার, মেদের যেন ছিটেফোঁটাও নেই সেই শরীরে! আর হলদেটে গায়ের রঙে অপূর্ব মনে হয় তাকে সাগরের!

ইরশাদ আঁড়চোখে সাগরের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে তারপর বলে উঠে ,
—- তো যাব কখন আমরা?
—- দুদিন পর। কেনাকাটা ও তো করবো ইয়ার।
—- কেন তোর বিয়ে?

এবার আরেকদফা হাসে সবাই৷ বন্ধুত্ব যেন এমনই একজনকে খুঁচিয়ে অন্যজনের দুষ্টুমিভরা হাসি. এ যেন শ্বাসত নিয়ম
সবার দিকে আঁড়চোখে তাকিয়ে সাগর হালকা নাক ফুলিয়ে বলল,
—– দুদিন পর গেলে কি হয়।
—– আমরা একমাস পর যাব৷ কারন বিমানের টিকেট একমাস আগে কাটলে, ইজিলি চলে যাওয়া যাবে। আর তাছাড়া তখন পুজোর ছুটিও থাকবে।
—– আমরা যাব কিভাবে। আই মিন প্রসেসটা।

বন্যার প্রশ্নে সবাই আঁড়চোখে একজন অন্যজনের দিকে তাকালো। শেষে সবার দৃষ্টি তিশা আর তিতাসের উপর গিয়েই আঁটকে পড়লো। তিশা এতে ইতস্ততভাবে বলে উঠলো,
—- আরে আমি কি জানি। আমাকে তো ও নিয়ে যাবে।
—- আমাকে তো গাড়ি নিয়ে যাবে আমি তো চিনি না কিছু।
তিশার কথায় পরপর ঢোক গিলে কাচুমাচু করে বলল তিতাস। বন্যা তেড়েফুঁড়ে এগিয়ে গেল তার দিকে! তারপর নাক ফুলিয়ে বলল,
—– তো গাধা গাড়ি যে তোকে নিবে এড্রেসটাতো বলতে হবে নাকি! নাকি এই ভাবনায় আছিস চট্টগ্রাম থেকে গাড়িতে উঠে ঘুমুবি তারপর সোজা কাশ্মীর গিয়ে উঠবি। তোর তো আবার গাড়িতে ঘুমানোর অভ্যেস। পরে উঠে দেখবি বৌ হাওয়া! কাশ্মীরের শীতল হাওয়া উড়িয়ে নিয়ে ভেগেছে তোর বৌরে।
তিতাস অপরাধী দৃষ্টিতে ইরশাদের দিকে তাকাতেই মুচকি হাসলো ইরশাদ তারপর বলল,

—– আমরা চট্টগ্রাম থেকে বাসে ঢাকা যাব।ঢাকা থেকে আন্তর্জাতিক বিমানে প্রথম যেতে হবে দিল্লি ইন্ধিরা গান্ধী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে। অথবা ঢাকা থেকে কলকাতা। পরে সেখান থেকে ডোমেস্টিক বিমানে জম্মু অথবা শ্রীনগর বিমানবন্দরে যাওয়া যাবে। কলকাতা থেকে সরাসরি শ্রীনগরে কোনো ফ্লাইট নেই। তাই, দিল্লি হয়ে যেতে হয়। তবে, ঢাকা-কলকাতা-দিল্লি-শ্রীনগর এই ভাবে ভেঙে ভেঙে গেলে খরচ কম হয় তুলনামূলকভাবে। এ ছাড়া অন্তত এক মাস আগে টিকেট বরাদ্দ করে রাখতে পারলে কম খরচেই বিমানে সফর করা সম্ভব। আর আমাদের দশ দিন সময় নিয়ে যেতে হবে। রাস্তায় তিন চারদিন চলে যাবে বাকি দিনগুলো ঘুরাঘুরি। আর চায়লে গাইড ও নিতে পারি

—– তুই গিয়েছিলি?
—– হুম তিন বছর আগে।
—- তাহলে তো আর কথায় নেই। তুই হবি আমাদের গাইড।
খুশিতে হাত নাড়িয়ে নাড়িয়ে বলল বন্যা। আর এতে মৃদুমুচকি হেঁসে বলল ইরশাদ,
—- দেখা যাক
তারপর উঠে দাঁড়ালো ইরশাদ।সবাইকে নিজের সাথে নিয়ে আসা খাবারগুলো দিয়ে দিল সে।আর খাওয়া শেষ করে, খরচ নিয়ে আরো কিছুখন আলোচনা করে বেরিয়ে এলো সেখান থেকে।

————
রাত বারোটায় ফোনের বিকট শব্দে ঘুম ভাঙ্গলো ইরশাদের। রাজ্যের বিরক্তি তার চোখে মুখে, কিন্তু ফোনের স্কিনে বন্যার নামটি দেখে দুলাফে উঠে বসলো সে! মেয়েটি একা ফ্ল্যাটে থাকে কোন বিপদ হলো ভেবে তাড়াতাড়ি রিসিভ করতেই ওপাশের কথাগুলো শুনে মেজাজ বিগড়ে গেল তার! নাক ফুলিয়ে রাগীস্বরে বলে উঠলো সে,
—– এই কারনে এতো রাতে কল দিলি তুই আমাকে?
—– আসলে ইয়ার।আমার কাজিনটার ও অনেকদিন ধরেই যাওয়ার শখ ছিল তাই আর কি ওর হাসবেন্ড চায় আমরা একসাথে যায়।
—– তো ওরা একা ও তো যেতে পারে। কাপল মানুষের সিঙ্গেলদের সাথে গিয়ে কাজ কি? হুদাই আমাদের জেলাস ফিল করানো।
—–তুই জেলাস ফিল করিস! আহা!
টেনে বলল বন্যা।
ইরশাদ মুখ বাঁকালো তারপর কিছু বলার আগেই আবার বলে উঠলো বন্যা,
——আরে বিয়ে হয় নি। জাস্ট এনগেজমেন্ট। আর তাই তো একা ছাড়বে না তাদের। আমি ওর আম্মুকে বলবো আমার আরো বান্ধবীরা যাবে। আর তখন ওর আম্মু ছাড়বে ওকে। মামী অনেক বেশী এস্ট্রিক্ট তো তাই। প্লিজ ইয়ার।
—– ওকে ওকে। কয়জন ওরা, বয়স কি বেশী কম? কি নাম?
—- আরে প্রশ্নের গুলিতে মারছিস কেন৷ দম নে না আগে!
ছেলেটাকে তো তুই চিনিস। তোর তিন বেইজ সিনিয়র। তোর স্কুলেই পড়তো। ইরহাম ভাইয়া। আর মেয়ে আমার ছোট বোন। অনার্সে পড়ে এবার। আরশী।
—- কিহ্!
—– আরশী, আরশী মেহবুব।

—– ওহ তোর বোন মানে আমারও বোন। আচ্ছা ওদের টিকেট ও কাটবো। ওকে এখন রাখি ঘুমের চৌদ্দটা বাজিয়েছিস তুই আমার। এবার ঘুৃম না আসলে তোর বাসায় এসে মাথায় চটকানা দিব তোরে দেখিস।

ইরশাদ ফোন রাখতে মুচকি হেঁসে ফোনটি বুকের সাথে মিশিয়ে নেই বন্যা। তারপর আকুল কন্ঠে বলে উঠে,
—– এই দশটি দিন স্বপ্নের মতো আমার জন্য। তোকে নিজের করে চায় আমি ইরশাদ। আর দেখবি এই ক’দিনে তুইও আমাকে ভালোবাসবি।তারপর ইচ্ছে মতো আমাকে তুই চটকানা দিলেও কিছুটি বলবো না তোকে আমি!

ছলছল চোখে মুখভর্তি হাসি নিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দেয় বন্যা। আর রোজকার মতোই ইরশাদের স্বপ্নে বিভোর হয়ে পড়ে সে

চলবে

( গঠনমূলক মন্তব্য করবেন আশা করি আর গল্পটি কেমন হলো জানাবেন☺)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here