প্রেম_প্রাঙ্গণ পর্ব ১৮

‘প্রেম প্রাঙ্গণ’🍂
|পর্ব-১৮|
~সুনেহরা শামস
.
.
২০৪ নাম্বার কেবিনের সামনে ব্যস্ত পায়ে পায়চারী করছেন রুবিনা।মাথায় তার বিন্দু বিন্দু ঘামেদের উপস্থিতি,,চোখ-মুখ অস্বাভাবিক!!কিছুই ভালোলাগছে না তার।সকাল বেলায় হসপিটাল থেকে খবর এসেছে যে,রেহনেওয়াজের অবস্থা ভীষণ খারাপ,,প্যারালাইসিস অবস্থায় থাকার বয়সকাল এখন তার প্রায় দেড় বছর।তবে এর মধ্যে কখনো এমন খবর আসে নি,,তবে কখনো তার অবস্থার উন্নতিও ঘটেনি।কিন্তু হুট করে তার অবস্থার অবনতি কেন হলো তা বুঝতে পারছে না রুবিনা।

রেহনেওয়াজ সম্পর্কে প্রাঙ্গণের বাবা হন,,আদেও সে তাকে বাবা মানে কী না তার মধ্যেও সন্দেহ আছে।আইজার মৃত্যুর প্রায় চারমাস পর হুট করেই একদিন অস্বাভাবিক হয়ে পড়েন তিনি,,অবস্থা বেগতিক দেখে হসপিটাল নিয়ে গেলে ডাক্তাররা জানায় যে,,তার দেহের বাম পাশের অংশ একদম অকেজ হয়ে গেছে যাকে ডাক্তারি ভাষায় প্যারালাইজড বা প্যারালাইসিস বলা হয়।এই দেড় বছর যাবত রেহনেওয়াজ এই হসপিটালের এই নির্দিষ্ট কক্ষে অকেজ অবস্থায় পড়ে আছেন,,একদমই নিশ্চলভাবে।কিন্তু সবই তিনি শুনতে এবং বুঝতে পারেন।হুঠাৎ করে কি এমন হলো যে রকম রেহনেওয়াজ এর অবস্থা খারাপ হয়ে গেল,,রুবিনা ভাবনায় পড়ে যায়!!

ডাক্তারের গলার স্বরে ভাবনার সুতোগুলো ছিড়ে যায় রুবিনার(প্রাঙ্গণে মা)।ডাক্তারকে ভালোভাবে লক্ষ্য করে তিনি,,তাকে দেখে বেশী একটা সুবিধার মনে হচ্ছে না।রুবিনা এবার ঘাবড়ে যায়,,ভুল কিছু হয়ে গেল না তো?

“রেহনেওয়াজ কেমন আছে এখন?”

ডাক্তার নাসিরউদ্দিন কিছুক্ষন চেয়ে থাকেন নিচের দিকে।অতঃপর একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে রুবিনার দিকে চেয়ে বলে উঠেন,,

“গতকাল রাতে কোনোকিছুর প্রভাবে তিনি ভীষণ রকমের উত্তেজিত হয়ে পড়েন।উত্তেজনায় নিউরনগুলোও অতি স্বল্প মাত্রায় ড্যামেজ হয়ে গেছে।সরি টু সে,,বাট এখন তিনি আর জীবনেও চলাচল করতে পারবেন না।হি ইজ ফুল্লি প্যারালাইজড!”

রুবিনার দম আটকে আসে,,কয়েক কদম পিছিয়ে যায়।ভাবনাগুলো এখন শূন্যের কোটায়!ঘামগুলো এবার সারি সারি ভাবে কপাল বেয়ে পড়ে চলেছে,,চোখগুলো টলমলে হয়ে উঠছে,,ব্যস্তপায়ে কেবিনের দিকে রওনা দেন।
.
কেবিনের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে যায় রুবিনা,,কতদিন বাদে রেহনেওয়াজকে দেখছে সে।এই লোকটার সকল কাজ,তা সৎ হোক বা অসৎ হোক না কেন,রুবিনা সবসময় পাশে ছিল।তারপর যখন রেহনেওয়াজ অসুস্থ হয়ে পড়েন তখন তিনিই রেহনেওয়াজের গোপনে করা স্মাগলিং এর কাজ নিজের হাতে সামলাতেন।যদিও এখন সব কিছুই প্রাঙ্গণের আন্ডারে,,তবে এই কাজে প্রাঙ্গণকে জড়ানো অতটা সহজ ছিল না।এর জন্য অনেক কাঠখড় পুড়াতে হয়েছে রুবিনাকে।আজকে নিজেকে এমন মুহূর্তে এসে ভীষণ একা লাগছে রুবিনার,,না আছে এখন স্বামীর সঙ্গ আর না পাশে আছে ছেলে।এসব ভাবনার মাঝেই চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ে রুবিনার।

রেহনেওয়াজের বেডের সামনে গিয়ে দাঁড়ায় রুবিনা,,কিছুক্ষন বাদেই তার হাতের সাথে মাথা ঠেকিয়ে হু হু করে কেদে উঠে।ডাক্তারের ওয়ার্নিং এ মাথা তুলে চোখ মুছে,,রেহনেওয়াজের মুখের দিকে তাকায়,,চেয়ে আছে সে!মুখ হালকা বেকে গেছে,,হাত-পা একদম সোজা করে রাখা।ভেতরটা পুড়ে যাচ্ছে রুবিনার,,কীভাবে কি করবে এবার?এবারতো রেহনেওয়াজের পেছনেও অনেক টাকা খরচ করতে হবে,,তাহলে বাকী থাকবে কি?রুবিনা রেহনেওয়াজের বাহু ঝাকিয়ে উত্তেজিত স্বরে বলে উঠে,,

“এই উঠো,,উঠো বলছি!আর কত জ্বালাবে এভাবে?বিরক্ত হয়ে উঠেছি আমি।রোজ রোজ তোমার পেছনে এত টাকা খরচ করবো কেন?তুমি কি টাকার খনি বের করে রেখে গেছ নাকি?এভাবে কুলাঙ্গারের মতো আর কতদিন এই বিছানায় পড়ে থাকবে?উঠো রেহনেওয়াজ উঠো!”

রুবিনার মুখে যা আসছে তাই বলে যাচ্ছে,,এদিকে ডাক্তাররাও কোনোভাবেই কিছু করতে পারছেন না।হুট করে পঞ্চাশ বয়সী এই নারীর এত জোর কিভাবে এলো?
একসময় এভাবে ঝাকাতে ঝাকাতে হাতের ক্যানোলা ছুটে যায়,,গড়গড়িয়ে সেখান থেকে রক্ত বেরুতে থাকে।রুবিনার অবস্থাও নাজেহাল,,চুল উস্কোখুস্কো হয়ে গেছে,,চেহারাও অস্বাভাবিক হয়ে আছে।
এদিকে রেহনেওয়াজও এত লোড সহ্য করতে পারছেন না,,হাত-পা অকেজো থাকায় সেই হাত-পা এতবার নাড়ানোতে তার পেশীগুলো আর ভার বহন করতে পারছে না।এবার তিনি একদম নিস্তেজ হয়ে যান।দুর্বল মস্তিষ্ক এত ধাক্কা সহ্য করতে না পেরে নিজের কাজ করা বন্ধ করে দেয়।অতঃপর রেহনেওয়াজের মৃত্যু ঘটে!একদম অপ্রত্যাশিত ভাবে তিনি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন।রুবিনা হয়রান হয়ে গেলে রেহনেওয়াজকে ছেড়ে ফ্লোরেই বসে পড়েন,,নিজের চুলগুলো আকড়ে ধরেন।কেন যেন পুরো পৃথিবীই ঘুরছে তার,,আস্তে আস্তে ঢলে পড়েন ফ্লোরেই,,জ্ঞান হারান রুবিনা!

~~~
“চিকিৎসা চলাকালীন অবস্থায় মৃত্যবরণ করেন বিশিষ্ট শিল্পপতি রেহনেওয়াজ করিম।ইন্না-লিল্লাহি ওয়াইন্না লিল্লাহি রওজিউন।আমরা তার আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি।”

খবরটুকু শুনা মাত্রই সাহিল-সুহা উভয়ই অবাক হয়ে যায়,,এদিকে প্রেম বুঝে উঠতে পারে না এদের এমন প্রতিক্রিয়ার কারন কি।প্রেম চোখ ঘুরিয়ে প্রাঙ্গণের দিকে তাকায়,,তার চোখগুলো লাল হয়ে আছে,,কিন্তু চেহারা একদম স্বাভাবিক।এরই মাঝে সাহিল হন্তদন্ত হয়ে প্রাঙ্গণের কাছে যায়,,তাকে ঝাকিয়ে বলে উঠে,,

“প্রাঙ্গণ আর ইউ অলরাইট?”

প্রাঙ্গণ টিভির দিকে নজর রেখেই শান্তসুরে বলে উঠে,,

“আমার কি হবে??”

“এসব কিভাবে হল প্রাঙ্গণ?আংকেল তো স্বাভাবিকই ছিল।তাহলে?”

“আমি কিভাবে জানবো?”

প্রাঙ্গণ এই ত্যাড়া ত্যাড়া জবাবে সাহিল বিরক্তবোধ করে।তবুও নিজেকে যথেষ্ট শান্ত রেখে বলে উঠে,,

“বাবা হয় তোর প্রাঙ্গণ,,তিনি আর নেই এই পৃথিবীতে।এখনো এমন পাষানের মতো ব্যবহার করবি?”

প্রাঙ্গণ কিছু বলে না।সে আগের মতোই চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে।কিছুক্ষন বাদে সাহিলের হাত ছাড়িয়ে সে নিজের ঘরের দিকে রওনা হয়।এদিকে প্রেম অবাক হয়ে একবার প্রাঙ্গণ আর একবার টিভির দিকে তাকায়।প্রাঙ্গণের ব্যপারগুলো সে আগে থেকেই কখনো বুঝত না কিন্থ আজকে যেন পুরো ব্যপারটাই মাথার উপর দিয়ে গেল।নিজের জন্মদাতা বাবার প্রতি কিসের এত রাগ প্রাঙ্গণের যে তার মৃত্যুতেও কিছুই যায় আসে না?

~~~
নিস্তব্ধ ও অন্ধকার ছাদের মাঝে একা দাঁড়িয়ে আছে প্রাঙ্গণ।ভাবনা আকাশ সমান,,পরবর্তীতে কি করবে তার ভাবনাগুলোও দলা পেকে আছে।কি করা উচিত?হাতে থাকা সিগারেট নিচে ফেলে পা দিয়ে পিষে নিভিয়ে ফেলে।

সাহিল এখন সুহা জ্বালাতনে ঘরে বা বরান্দায় বসে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়তে পারে না,,তার উপর বাচ্চার যদি ক্ষতি হয় এই ভেবে সাহিলও আর সেখানে বসে সিগারেট খায় না।কিন্তু বারান্দা নেই তো কি হয়েছে,,এত বড় ফাকা ছাদটা কি কাজে আসবে?এই ভেবে ছাদেই চলে এসেছে সে,,সুহা এখন গভীর ঘুমে,,,,

ছাদে এসে একদম কর্ণারে প্রাঙ্গণকে দেখতে পেয়ে ভ্রুকুচকে ফেলে সাহিল।এই ব্যাটা তো ছাদেই আসে না,,ধরে বেধে আড্ডা দেওয়ার জন্য নিয়ে আসা যায় না,,আর সে নাকি আজকে ছাদে?সাহিল কৌতূহলবশত এগিয়ে যায় প্রাঙ্গণের দিকে……

“প্রাঙ্গণ!”

সাহিলের ডাকে পিছনে ফিরে তাকায় প্রাঙ্গণ,,অতঃপর ছোট একটা শুকনো হাসি দেয়।সাহিলও একটা নির্জীব হাসি দিয়ে বলে উঠে,,

“কষ্ট লাগছে তোর প্রাঙ্গণ?”

“কেন?”

“আঙ্কেল এর মৃত্যুতে তোর একটুও খারাপ লাগছে না?”

প্রাঙ্গণ ভ্রকুচকে একবার সাহিলের দিকে তাকায়,,তারপর আবার স্বাভাবিকভাবে তাকায়।সাহিলের গলায় হাত রেখে আকাশে দিকে চেয়ে বলে উঠে,,

“একটা কথা উত্তর দে তো সাহিল”

“কি?”

প্রাঙ্গণ আকাশের দিকে চেয়ে বাকা হেসে বলে উঠে,,

“যে মৃত্যুর জন্য দায়ী থাকে সে কেন আবার আফসোস করবে??”

সাহিল অবাক হয়ে বলে উঠে,,

“মানে!?”

প্রাঙ্গণ একহাত পকেটে ঢুকিয়ে হাসিটা আরো প্রশস্ত করে বলে উঠে,,

“আয় তোকে বুঝিয়ে বলি,,,”

চলবে…

[ভুল-ত্রুটি আল্লাহর প্রদত্ত ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।আজকের পর্ব সম্পর্কে একলাইনের একটি মন্তব্য ছেড়ে যাবেন।ধন্যবাদ।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here