প্রেয়সীর হৃদয় ব্যাকুল পর্ব –৪২+৪৩

প্রেয়সীর হৃদয় ব্যাকুল

৪৪.
অরু ওড়না দুলিয়ে ড্রয়িংরুমে আসলো। সাজগোছ করে পরিপাটি সে। হাঁটার তালে নুপুরের শব্দে রাঙিয়ে উঠছে চারিপাশ। তন্ময় তখন ড্রয়িংরুমের সোফায় বসে। অরুকে দেখেই বলে, ‘বিছানার উপর আমার শার্ট-প্যান্ট রেখে এসেছি। বিকেলেই লাগবে। ধুয়ে শুকাতে দে!’

অরুর মাথায় বাজ পড়লো যেমন। চমকে তাকিয়ে রইলো। নিজের কাপড়চোপড় সে ধুয়ে পড়ে না। আর তন্ময়ের কাপড়চোপড় ধুবে। অরু মন ক্ষীণ করে ফেললো। চোখ জোড়া বড়বড় করে আশেপাশে তাকাল। সকলেই উপস্থিত। অথচ কেউই কিছু বলছে না! অরু নাক ফুলিয়ে রাখল। নড়ল না এক’পা। তন্ময় পুনরায় বলল, ‘যাচ্ছিস না কেন?’
‘আপনি বুয়াকে দেন নাই কেন ধুতে!’
‘তুই কী যাবি?’

অরু হাসফাস করে সিঁড়ির দিকে হাঁটা দিল। তন্ময় আজকাল যথাসম্ভব হুকুম করে অরুকে। এটাসেটা সবকিছু নিয়েই তার হুকুম, আদেশ লেগেই থাকে। যেমন সেদিন অফিস থেকে এসে অরুর হাতে একটা ফাইল ধরিয়ে দিল। হুকুম করল গুঁছিয়ে রাখতে। তোতাপাখির মতো অরু বলেছিল,’নিজের জিনিস নিজে কেন রাখছেন না!’

তন্ময় ভোঁতা চোখে তাকিয়ে অরুকে ভয় পাইয়ে দৌড় দেওয়াল। আজ সন্ধ্যায় সেই ফাইল তন্ময় আনতে বলেছে। অরু কই যেনো রেখেছে মনে নেই। সেই ফাইল খুঁজতে খুঁজতে ঘন্টা লেগে গেল। সাতটা ত্রিশে তন্ময়ের রুমে গেল ফাইল হাতে। তন্ময় তখন মহা ব্যস্ত। এই ল্যাপটপ ঘাটছে নাহলে একের পর এক ফাইল। অরু শব্দহীন ভঙ্গিতে ফাইল রাখল পাশে। তন্ময় ল্যাপটপে নজর রেখেই বলল, ‘ধুয়েছিলি?’

অরু ওড়নার কোণা মুঠো করে ধরে। হাত-পা রীতিমতো কাঁপছে তার। মুলত তন্ময়ের প্রশ্নেই এই অবস্থা তার। কাপড়চোপড় সে ধুয়েছে। এর পূর্বে তন্ময়ের প্যান্টের পকেটে সে লাল রঙের ছোট বক্স পেয়েছে। সেটার ভেতর চকচকে আংটি দেখেছে। একদম তার আঙুলের মাপের। অরু আংটি খানা পরেছেও। তন্ময় কী তার জন্য কিনেছে? অরু বিষয়টি সকাল থেকে বলতে যেয়েও পারছে না। এখন যখন তন্ময় যেচে জিজ্ঞেস করছে, সে লজ্জার সম্মুখীন হয়ে পড়লো। অস্পষ্ট স্বরে বলল,’হু।’
‘আংটি পেয়েছিস?’
‘হু।’
‘আঙুলে ফিট হয়েছে?’
‘হু।’
‘কই দেখি।’
‘আমি পড়িনি।’
‘সঙ্গে আছে?’
‘হু।’
‘এদিকে আয়।’

অরু ঠাঁই দাঁড়িয়ে। এগিয়ে গেল না কথামতো। তন্ময় উঠে দাঁড়ালো। নিজেই এগিয়ে আসলো। অরু আংটির বক্স ওড়নায় বেঁধে রেখেছিল। সেখান থেকে ছোটাল। বক্স তন্ময় হাতে নিল। ছটফট হাতে আংটি বের করে অরুর আঙুলে পরিয়ে দিল। ঠিক এনগেজমেন্ট আঙুলে। অরু লক্ষ্য করলো তন্ময়ের হাত। তার আঙুলেও আংটি। অরু আগে কখনো তন্ময়কে আংটি পরতে দেখেনি। এই প্রথম। তাও হুবুহু একই ধরনের আংটি। অরুর ঠোঁট জুড়ে মিষ্টি হাসি ফুটে উঠতে চাইছে। সে খুব প্রচেষ্টায় হাসি লোকাল। তন্ময় আবারো ব্যস্ত পায়ে চলে গেল। কাজে ভীষণ ব্যস্ত সে। অরু লাজুক নয়নে তাকিয়ে রইলো। হাতটা সমানে দেখছে সে। কি সুন্দর মানিয়েছে আংটি খানা। অরু সঙ্গে সঙ্গে গেল না। চেয়ার পেতে বসলো। মন দিয়ে তন্ময়কে দেখতে লাগলো। খুটিয়ে খুটিয়ে! তার ইচ্ছে করলো জিজ্ঞেস করতে, ‘আপনার জন্য কফি আনি? মাথাটা টিপে দেই?’

তন্ময় হুট করে ফাইল বন্ধ করে ফেললো। কপালে আঙুল চেপে ধরলো। মাথা ব্যথা করছে খুব। কপাল সহ চোখজোড়া কুঁচকে রাখল। অরু ব্যস্ত ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়ালো। কিছুটা গিয়ে প্রশ্ন করলো, ‘খুব মাথা ব্যথা করছে? কফি করে আনব?’

তন্ময় পুনরায় দানব আদেশের শুরু বলল,’মাথাটা টিপে দে।’

এই ইচ্ছে মনে তখন পোষণ করলেও, আপাতত করতে দ্বিধাবোধ এবং লজ্জাবোধ ঘিরে ধরছে অরুকে। তবে পরক্ষণেই তন্ময়ের অতিরিক্ত কুঁচকানো কপাল দেখে, দ্রুত পায়ে এগোল। খুঁজে আনলো মুভ ক্রিম। তন্ময় মাথা এলিয়ে চেয়ারে বসে। অরু পেছনে গিয়ে দাঁড়ালো। আঙুলে ক্রিম নিয়ে তন্ময়ের কপাল স্পর্শ করলো। নরম তুলতুলে হাত তার। একেকটি স্পর্শ যেমন স্বর্গে নিয়ে যাচ্ছে তন্ময়কে। সে গম্ভীর স্বরে ছোট করে গোঙ্গাল। অরুর হাত থেমে গেল। তন্ময় চোখ বন্ধ অবস্থায় বলল, ‘থামিস না।’
______________
মোস্তফা সাহেবের কানে এসে পৌছেছে, লতা বেগম শাবিহাকে নিয়ে অসন্তুষ্ট। বিয়েটা তিনি মেনে নিতে চাচ্ছেন না। শাবিহার বয়স বেশি, বিন্দুমাত্র মানানসই নেই দুজনের মধ্যে, এমন আক্ষেপ পুষে রেখেছেন মনে। সঙ্গে বলাবলি, আলোচনা করেছেন কিছু কটূ কথা। সেসব আলোচনা ছড়িয়ে পড়েছে মহল্লায়। মোস্তফা সাহেব মেয়ের জন্য হলেও রাজি হবেন বলে ভেবে রেখেছিলেন। তবে এখন আর তা সম্ভব নয়। তিনি স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিয়েছেন, এই সম্পর্ক মেনে নিবেন না। কিছুতেই না। মেয়েকে এমন কোনো পরিবারের কাছে তুলে দিবেন না, যারা তার মেয়ের কদর করতে জানেনা। শাবিহাকে পরদিনই ড্রয়িংরুমে ডাকা হলো। বাড়ির সকলের সামনে মোস্তফা সাহেব বলেছেন, অয়নের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে না। কোনোপ্রকার কথাবার্তা, দেখাসাক্ষাৎ করা যাবেনা। অয়নকে ভুলে যেতে হবে।

আশ্চর্যজনক ভাবে শাবিহা মাথা পেতে মেনে নিয়েছে বাবার আদেশ। তাও খুবই স্বাভাবিক ভাবে। কোনো হেলদোল দেখায়নি। বরং সেদিনই রুমে ঢুকে সেলফোন থেকে সিম বের করে, ভেঙে ফেলেছে। কাজ থেকেও লিভ নিয়ে নিয়েছে স্বেচ্ছায়। একপ্রকার সে ঘরবন্দী করে নিল নিজেকে। বাবার সব কথা মুখ বুজে মেনে নেবার কারণ রয়েছে শাবিহার কাছে। সেও জানতে পেরেছে লতা বেগমের নারাজি। তার বলা একেকটি কথা কানে এসেছে শাবিহার। চারপাশে আলোচনায় এখন শুধু শাবিহা! সবার ধারণা এখানকার অপ্রয়োজনীয় ব্যক্তি শাবিহা। অয়ন ছোটো, কতটুকু বা বুঝে সে! শাবিহা তো বড়ো। ঠিক সময় বিয়েসাদী হয়ে গেলে তার একটা বাচ্চা থাকতো। এমন হাজারো আলোচনার কথা শুনেছে শাবিহা। তৎক্ষণাৎ হৃদয় তার কেমন মরে গেল। বাবার যুক্তির সাথে মিল পেল৷ যোগাযোগ করার সকল রাস্তা বন্ধ করে দিল, নিজ হাতে। কিন্তু হৃদয়? এই ব্যাকুল হৃদয় যে মানতে নারাজ। বিচলিত হয়ে ছটফট করে চলেছে প্রতিমুহূর্তে। এক দন্ড শান্তি দিচ্ছে না। তোলপাড় করে তুলছে বুকের ভেতরে। দম বন্ধ হয়ে আসছে। যন্ত্রণায় গলা দিয়ে পানি পর্যন্ত গিলতে পারছেনা। চারপাশের কিছুতেই আনন্দ মিলছে না। রঙিন পৃথিবী আঁধারে তলিয়ে গেল। অন্ধকারে রুপান্তরিত হলো প্রত্যেকটি কোণা। শাবিহার পরিবর্তন গুলো পরিবারের চোখে নিউজপেপারে হেডলাইনের মতো, ছেঁয়ে গেল।

বুধবার বিকেলে জ্ঞান হারিয়ে ফেললো শাবিহা। অজ্ঞান শাবিহাকে প্রথমে দেখতে পেয়েছে অরু। সেই চিৎকার চেঁচামেচি করে সবাইকে জড়ো করেছে। ডাক্তার ডাকা হলো। দুর্বল হয়ে পড়েছে শাবিহার শরীর। মানসিক ক্লান্তিতে ভুগছে সে। ডিপ্রেশনের দিক চলে যাচ্ছে ক্রমাগত। তার অবস্থা ভালো নয়।

ডাক্তারের একেকটি কথা ধারালো তীরের ন্যায় মোস্তফা সাহেবের বুকে চুবেছে। তিনি মাস খানেক ধরে মেয়ের পরিবর্তন লক্ষ্য করেছেন। স্ত্রীও তাকে বারংবার বলেছে। মোস্তফা সাহেব অগ্রাহ্য করেছিলেন। সময়ের সাথে পরিবর্তন হয়ে যাবে তার মেয়ে, অনিমেষ ভঙ্গিতে বলেছিলেনন। তবে আজ যা হলো সেটা মেনে নিতে পারছেন না। চোখের সামনে মেয়ের এমন করুণ অবস্থা সহ্য হচ্ছেনা। কি করবেন, কোথায় যাবেন, বুঝতে পারছেন না!

জবেদা বেগম রুম ট্রান্সফার করলেন। আজ থেকে তিনি মেয়ের সঙ্গে থাকবেন৷ যতটুকু সম্ভব মুখের উপর রাখবেন মেয়েকে। কথা বলতেই থাকবেন মেয়ের সঙ্গে। তারপর দেখবেন কীভাবে মেয়েটা ডিপ্রেশনে থাকে! এসব ডিপ্রেশন টিপ্রেশন সব দূর করে দিবেন।

আঁধার রাত। ঘড়ির কাঁটা নয়টায় ঘুরছে। এমন সময়, শাহজাহান বাড়ির সদরদরজায় হাঙ্গামা শুরু হয়েছে। চেঁচামেচির তুমুল শব্দ। বিকট শব্দের কারণে, সকলেই বেরিয়ে আসতে বাধ্য হলেন। এমনকি শাবিহাও। সে নিচে নামেনি। দোতলার বারান্দায় এসে দাঁড়ালো। সদরদরজায় অয়ন দাঁড়িয়ে। খুব অগোছালো অবস্থা তার। ক্ষিপ্ত মুখশ্রী। শরীরের সর্বচ্চ শক্তি ব্যবহার করে, কেচি গেটে আঘাত করে চলেছে। মুখ দিয়ে উচ্চস্বরে চেঁচিয়ে ডাকছে, ‘শাবিহা!’

প্রতিবেশীদের উপস্থিতি ঘটেছে। চারপাশে মানুষ জড়ো হয়েছে। মোস্তফা সাহেব ক্রুদ্ধ হয়ে আছেন। বেসামাল গতিতে ছুটে এসেছেন। অয়ন চেঁচাল, ‘আমার শাবিহা কোথায়? কী করেছেন ওর সাথে?’

মোস্তফা সাহেব চোয়াল শক্ত করে ফেললেন। ওহী সাহেব ক্ষিপ্ত গলায় শাসালেন, ‘চেনাজানা বিদায় চুপ আছি। নাহলে এতক্ষণে হাজতে থাকতে।’
‘অয়ন ভয় পায়না। পুলিশ ডাকুন। আপনার বাড়ির মেয়ের জন্য মা’র খেতেও রাজি। আগে শাবিহাকে ডাকুন।’

ওহী সাহেব রেগে এগোলেনন। ক্রুদ্ধ নয়নে তাকিয়ে রইলেন। তেজে ছটফট করছেন। সেই মুহুর্তে তন্ময় বেরিয়ে আসলো। তার সঙ্গে আকাশ ও রয়েছে।তন্ময় বাসার কাপড়চোপড় পরে। কিছুক্ষণ আগেই অফিস থেকে এসেছে। খুব শান্ত ভঙ্গিতে মোস্তফা সাহেবের পাশে দাঁড়ালো। আকাশ সদরদরজা খুলে দিলো। উচ্চস্বরে চেঁচিয়ে প্রতিবেশীদের উদ্দেশ্যে বলল, ‘ট্রেলার বিনামূল্যে দেখতে দিলাম। বাকিটা মুভি চলবে, সেই মুভি দেখতে হলে টিকিট কাটতে হবে। না কাটলে সকলেই নিজ নিজ গর্তে চলে যান।’

হুড়মুড়িয়ে সকলকে হাতের ইশারায় সরিয়ে দিল। লাজলজ্জা ভুলে অনেকেই তবুও ঠাঁই দাঁড়িয়ে। যেমন মুভি তারা দেখবেই দেখবে। অয়ন হন্তদন্ত ভঙ্গিতে বাড়ির ভেতর ঢুকতে চাইল। উচ্চস্বরে আবারো ‘শাবিহা!’ ডেকে উঠলো। তন্ময় তার চাচ্চুকে সরিয়ে অয়নের সামনে দাঁড়ালো। দুজন লম্বায় উঁচু নিচু। হাইটে অয়ন সামান্য শর্ট। প্রাপ্তবয়স্ক হলে হয়তো অতটুকুও ঘুচিয়ে নিবে। অয়নের কাঁধে হাত রাখল তন্ময়। সেখানে প্রবল শক্তিতে দুটো থাপ্পড় বসালো। যেমন কাঁধের ময়লা ঝাড়ছে। কন্ঠে কঠিন্যতা নিয়ে বলল, ‘স্বপরিবার মানিয়ে, সকলের প্রশ্নের সহি জবাব দিয়ে, প্রাপ্ত মর্যাদা সহ বিয়ের প্রস্তাব নিয়েই, এই বাড়ির দরজায় পা রাখবে। কেমন? বাসায় যাও এখন।’

অয়নের ছটফট পা জোড়া থমকে গেল। শ্বাসপ্রশ্বাসের বেসামাল অবস্থা। ঘনঘন নিশ্বাস ফেলছে এবং নিচ্ছে। দ্রুততম গতিতে উঠানামা করছে বুক। হাসফাস করছে সে। দৃঢ় দৃষ্টিতে চাইল তন্ময়ের চোখে। লালিত চোখজোড়ার অবস্থা। মনির চারিপাশে লালচে দাগ ফুটে আছে। কন্ঠের স্বর নিচুস্তর এবং অনিমেষ, ‘শাবিহা কেমন আছে?’

তন্ময় নির্দ্ধিধায় বলে দিল, ‘কি মনে হয় তোমার? কেমন থাকতে পারে!’
‘একদম ভালো না!’
‘ভালো থাকার ব্যবস্থা করো তাহলে।’

অয়ন মাথা দোলাল। নিষ্প্রাণ চোখে ভেতরে তাকাল। পরপর উপরে নজর রাখল। ততক্ষণে শাবিহা মুখ চেপে সরে গিয়েছে। ফুঁপিয়ে চাপাস্বরে কেঁদে উঠেছে। বুক ভাঙা যন্ত্রনায় শব্দ করে কাঁদতে লাগলো একসময়। চোখের তৃষ্ণা মেটাতে যাকে দেখতে হতো তাকে না দেখে, অসহায় মুখশ্রী নিয়ে অয়ন ঘুরে হাঁটা ধরলো। ধীর পায়ে বেরিয়ে গেল। মোস্তফা সাহেব এবার ছেলের দিক দৃষ্টিপাত করলেন। চোখ রাঙালেন। অবিশ্বাস্য সুরে বললেন, ‘তুমি এতকিছুর পরও চাচ্ছ শাবিহাকে এই পরিবারে দিতে?’
‘অয়ন খুব ভালো বাবা। শাবিহাকে সুখে রাখবে।’

ছেলের নরম স্বর শুনে, মোস্তফা সাহেব তপ্ত শ্বাস ফেললেন। ছেলের পানে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে ভেতরে চলে গেলেন। সবসময় তিনি আর তার ছেলে আগুন এবং পানির ন্যায়। খুব কম সময় তাদের মতের মিল ঘটে। তাও অফিসের সমস্যা গুলোতে। এভাবে দৈনন্দিন জীবনে দুজন টম অ্যান্ড জেরির মতো লেগে থাকে। কিছু না কিছু কারণে তাদের দন্ড ঘটেই। তার প্রথম সন্তান বলে কথা। খুব অল্প বয়সেই বাবা হয়েছিলেন। তাই ছেলে প্রাপ্তবয়স্ক হতেই, এক অদেখা বন্ধুতে পরিনত হয়েছে বলা যায়! মোস্তফা সাহেব প্রায়শই বিক্ষিপ্ত অনুভূতি শেয়ার করেন। সমস্যা, চিন্তাভাবনা খোলাখুলি বলেন। পরামর্শ করেন বৃদ্ধদের মতো। ছেলে নিজেও তাকে সবকিছুই বলে কয়ে করে। কোনোকিছুই গোপন নয়। ছোট থেকেই এমন ছেলেটা। মোস্তফা সাহেব অফিস থেকে ফিরতেই ছোট্ট তন্ময় দৌড়ে আসত। বসে বসে সকল ঘটে যাওয়া ঘটনা খুলে বলত। এতসব ছেলেটা নিজের মা’কেও বলত না। মোস্তফা সাহেবের মনে আছে, একটি বিশেষ ঘটনা। তন্ময় তখন ক্লাস টেন৷ তার সমবয়সী মেয়ে তাকে প্রপোজ করে। ফুল দেয়, লেটায় লেখে, ডায়রি গিফট করে। মোস্তফা সাহেবকে সেগুলো ছেলেটা দিয়ে বলেছিল, ‘এই বেয়াদব মেয়েটার বাবাকে গিয়ে নালিশ দিবে।’
_______________
পড়ন্ত বিকেল। স্নিগ্ধ পরিবেশ। অরু সেজেগুজে গাড়িতে উঠে বসেছে। তন্ময়ের সাথে সে ধানমন্ডি যাবে। সুপরিচিত ‘হাজিবলা মিষ্টান্ন’ হোটেলের উদ্দেশ্যে। খুব ভালো মিষ্টি পাওয়া যায় সেখানে। এমনকি সুস্বাদু রসমালাইও। মুলত তারা রসমালাই আনতে যাচ্ছে। পছন্দ হলে, মিষ্টিও আনা হবে। গাড়ি স্টার্ট করেছে তন্ময়। অরু গুনগুন করে কাঁচ নামিয়ে দিল৷ তন্ময়ের দেখাদেখি সানগ্লাস পড়লো। পরপর খুলে রেখে পরিবেশ উপভোগ করায় মনোযোগী হলো। এমন সময় তন্ময়ের ফোন বেজে উঠলো। সেলফোন অরুর সামনেই। স্টেয়ারিংয়ের পাশে। তন্ময় বলল, ‘দেখ কে!’

অরু ফোন হাতে নিল। স্ক্রিনে মাহিন লেখা। অরু দেখে বলল, ‘মাহিন ভাইয়া।’
‘ধর। লাউড স্পিকার দে।’

অরু সময় নিয়ে ধরলো। তার এখনো মাহিনের কথাগুলো মনে আছে। কীসব বলেছিল, সে স্পষ্ট শুনেছে। অবশ্য তাতে অরু রেগে নেই। বরং লজ্জায় মরে যাচ্ছিলো প্রায়।

মাহিনের গলার স্বর স্বতঃস্ফূর্ত, ‘মাম্মা!’

তন্ময় নিঃশব্দে হাসলো। জবাবে বলল,’হু।’
‘লালে লাল হয়ে আছ না! বন্ধুবান্ধব চেনো না।’
এইবারেই যদি না আসিস, তোর সাথে কোনো সম্পর্ক থাকব না। কইয়া দিলাম!’
‘কই যাচ্ছিস এবার?’
‘যাচ্ছি নারায়ণগঞ্জ মাম্মা। সবকিছু স্যাট! রিহানের বাবা লঞ্চ দিবে। সবাই মিলে। ধুমসে যামু। প্লিজ চল এবার। মজা হবে। ইয়াহু।’
‘ব্যাচের সবাই যাচ্ছে?’
‘হু। সব্বাই! এই চল না! অরুকে সঙ্গে নিবে কিন্তু।’

অরুর চোখজোড়া বোয়াল মাছের মতো বড়ো হয়ে আছে। তন্ময় তখনো পাকাপোক্ত স্বীকারোক্তি দেয়নি। ইনিয়েবিনিয়ে কল কেটেছে। কিন্তু অরুর মনে রয়েই গেল বিষয়টি। খোঁচ খোঁচ করছে ভেতরে। নারায়ণগঞ্জ সাথে লঞ্চ! অরু হাওয়ায় দুলতে লাগলো! যেতে পারলে মন্দ হতো না…

চলবে ~
‘নাবিলা ইষ্ক’
_______________
বিশেষ দ্রষ্টব্য, ‘ব্যস্ত ছিলাম। পারিবারিক কারণ। আপনাদের নিরাশ করতে চাইনি। সময় দিন, রেগুলার হবো, ইনশাআল্লাহ। গল্পটার সুন্দর সমাপ্তি দিতে, রেগুলার হতেই হবে।’প্রেয়সীর হৃদয় ব্যাকুল

৪৫.
তন্ময়ের বন্ধুবান্ধব ধানমন্ডির আশেপাশেই আছে। আজ শুক্রবার। ছুটির দিন। সবাই কাজ থেকে মুক্ত। সেই সুবাদে সকলে মিলে এক রেস্তোরাঁয় আড্ডা জমিয়েছে। আড্ডার মূল বিষয় হচ্ছে, নারায়ণগঞ্জ কীভাবে যাবে, কই যাবে, কী খাবে, কীসব করবে, তার একটি তালিকা তৈরি করছে। তন্ময়কে এখানেই আসতে বললো মাহিন। ছেলেটার মন তল্লাশি করবে আজ সে। মুখোমুখি জিজ্ঞেস করবে নারায়ণগঞ্জ যেতে চায় নাকি! কোনোমতে যদি চোখমুখ পড়ে বুঝতে পারে যে তন্ময় যেতে চায়! তাহলে সে আসমান জমিন এক করে ফেলবে তবুও তন্ময়ের প্রেয়সী সহ তন্ময়কে নিয়েই ছাড়বে এই ট্রিপে। রিহান নাকমুখ কুঁচকে মাহিনের ভাবনায় বিভোর মুখশ্রী পর্যবেক্ষণ করছে। দু আঙুলের সাহায্যে চুটকি বাজালো চোখের সামনে। ভরাট কন্ঠে ডাকল, ‘এইযে বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ছোটো মাহিন মজুমদার দাদু! তন্ময় চাচা কী আসছে?’

মাহিন হতাশ গলায় বলল, ‘বিশিষ্ট ডিজাইনার সর্বোচ্চ ছোট্ট রিহান শিকদার কাকাকে জানাচ্ছি, তন্ময় প্রায় চলে এসেছে। সঙ্গে তার প্রানপ্রিয় প্রেয়সী ও আছে। তাই মুখে দয়া করিয়া লাগাম মারিবেন।’
‘লাগাম ছাড়া কখন হলাম,আশ্চর্য! আমার মতো ভদ্র মুখের অধিকারী দ্বিতীয় কেউ নেই। এইযে তুই ‘স্টেমিনা একদম নেই’ রোগে ভুগিস কই আমিতো বলতে যাইনা!’

সৈয়দ মাহিনের পাশে। সে অতিষ্ঠ ভঙ্গিতে মাথা দোলাল। মাহিন তাকে ইশারা করে বলল, ‘ও কী আমার বিছানায় এসেছিল? মানে ড্রাংক অবস্থায় মেয়েমানুষ মনে করে ওর সাথেই কিছু করেছিলাম নাকি! নাহলে জানল কীভাবে আমার স্টেমিনা নেই! ভাবার বিষয়।’

শুহানি উচ্চস্বরে হেসে উঠলো। হাসতে হাসতে সে রিহানের বাহুতে পড়ে গেল৷ চোখের কোণ ভিজে উঠেছে। থেমে নেই বাকিরাও। রিহান বিরক্ত হলো। নাকমুখ কুঁচকে ফেলল, ‘ইয়াক! শালা তুই ডাক্তার দেখা।’

ঠিকানা অনুযায়ী রেস্তোরাঁয় মাত্রই পৌঁছেছে গাড়ি।রসমালাই এবং মিষ্টান্ন জাতীয় খাবার গুলো কিনে তবেই এসেছে। সেগুলো গাড়িতে রেখেই বেরোলো তন্ময়। অরুর ওড়না ফেঁসেছে সিটবেল্টে। খেয়াল করেনি। বেরোতে গিয়ে টান খেল। ফ্যাচ ফ্যাচ শব্দে ছিঁড়ে গেল অনেকখানি। বোকার মতো ছেঁড়া ওড়নায় নজর বোলালো। ইশ, কতখানি ছিঁড়েছে। ভাগ্যিস কোণঠাসা হয়ে ছিঁড়েছে। নাহলে তো বোঝা যেতো। ওড়না ধরে বেরোতে নিয়ে উঁচু জুতোর কারণে বা পা বেঁকিয়ে ফেললো। পড়তে নিয়েও গাড়ির দরজা ধরে নিজেকে সামলাল। পায়ের কোণা ছুলেছে কিছুটাও। তন্ময় সামনেই দাঁড়িয়ে। সে সাবলীল ভঙ্গিতে অগোছালো অরুকে দেখছে। এদিকে অরু কিছুটা বিরক্ত হলো বটে। নাকমুখ কুঁচকে বেরোলো। ওড়না পরিপাটি করলো। তন্ময়ের দু ভুরুর মাঝে ভাঁজ পড়েছে। সে প্রশ্ন করলো, ‘তোর থেকে তোর জুতো বড়ো। দেখি, জুতো খোল। এসব জুতা আর পড়বি না। আমি যেনো না দেখি।’

আতঙ্কে হাসফাস করে উঠলো অরু। মাথা দু’পাশে
দুলিয়ে তন্ময়ের অগোচরে হেঁটে সামনে অগ্রসর হলো। যার জন্য চুরি করে সে বলে চোর। এইযে এতো উঁচু জুতো ত তন্ময়ের জন্য পরে। মানানসই একটা ব্যাপার আছে না। লম্বা তন্ময়ের সামনে উঁচু জুতো না পরলে, একটুখানি দেখায় অরুকে। বলা যায়, দেখাই যায়না। এরজন্যই তো পরে সে।
অরুর বিভ্রান্ত চিন্তাভাবনা তন্ময় বুঝবে কীভাবে! সে অরুর কাঁধ চেপে ধরেছে। দুজন একসাথে এগোচ্ছে।

ভেতরে প্রবেশ করতেই সম্মুখীন হলো সকলের। হৈচৈ পড়ে গেল মুহুর্তেই। এটাসেটা নিয়ে কথাবার্তা শুরু হয়েছে তৎক্ষণাৎ। রিহান কথায় হেরে গিয়েছিল খানিক তবে সে পুনরায় শুরু হলো।এবার আর মাহিনের পিছু লাগেনি। তন্ময় আর সৈয়দের পিছু লেগেছে। হাস্যজ্বল পরিস্থিতি। অরুকে শুহানি এবং আশা’র মধ্যে বসিয়েছে তন্ময়। তারপর সে বসেছে মাহিনের পাশে। সাথে ইব্রাহিম আছে। রিহান ও পাশাপাশি। তাদের মধ্যে আলাদা আলোচনা। মাহিন কফিতে চুমুক বসিয়ে খুব স্বাভাবিক স্বরে শুধালো, ‘কি সমস্যা? যেতে কেন চাচ্ছিস না!’

তন্ময় নিশ্চুপ রইলো। দৃষ্টি কিছুটা দূরে বসা অরুর পানে। শুহানি কিছু একটা বলছে অরুকে। তাতে লজ্জায় চোখমুখ নুইয়ে রেখেছে অরু। তন্ময় বেশ কিছুক্ষন দেখল। চোখ সেখানে রেখেই বলল, ‘আজকাল আমি আর নিজের উপর কনফিডেন্ট নই।’
‘বিয়েটা তো হয়েছে। এখন কনফিডেন্ট না থাকলেও চলবে!’
‘তন্ময় চাচার যন্ত্রপাতি তাহলে ঠিকঠাক আছে।’

তন্ময় হাসলো। স্মিথ হাসি তার, ‘বাবা মানবে না। পারিবারিক ভাবে বিয়েটা হলে, তারপর নাহয়… ‘
‘এতকিছু বুঝি না। আমার বন্ধু যেতে চায় এটাই ইম্পর্ট্যান্ট। আর তুই যাবি সাথে তোর লেঞ্জাও।’

রিহান মুখ ভোঁতা করল, ‘তোর বাপের এতো মাথা ব্যথা কেলা?’
‘আমার বাবার কাছে সবকিছুর উর্ধ্বে পরিবার। খুব যত্নে আগলে রেখেছেন। কোনো কারণে পরিবার ভেঙে যাবে সেটা সে স্বপ্নেও ভাবতে পারেনা। তাই এতসব চিন্তা তার। আমাদের বিয়েটা ভবিষ্যতে হয়তো সমস্যা দাঁড় করাতে পারে, এটাই মুখ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। অরু যেহেতু ছোটো তাই বাবার চিন্তা বেশি। তার মনে হয় আমাদের মতামত মিলবে না। বা বিয়েটা টিকবে না৷ আর যদি তেমন হয় পরিবার ভেঙে যাবে।’

মাহিন বিরক্ত হলো, ‘তোর বাপের এসব চিন্তাভাবনা নদীতে ডুবে আছে। অযথা চিন্তা যত্তসব। সে কী জানে না তুই কে? তুই তো ভেজা বিড়াল। মাছ সামনে রেখে ছুঁয়েও দেখোস না, লাগলে কাতরে মরে পড়ে থাকবি। কতটা ভালোবাসোছ তা তো আমরা জানি। নিজের চোখে দেখছি। এইসব সমস্যা কোনোকালেই হবে না, আমার কথা মিলিয়ে রাখ। আর অরু এখন যথেষ্ট প্রাপ্তবয়স্ক। এমনতো নয় ও তোকে পছন্দ করেনা৷ খুব পছন্দ করে। এইযে আমি খেয়াল করলাম মিনিটে শতবার তাকিয়েছে। তোকেই তো দেখছে ঘুরেফিরে।’

গম্ভীরমুখের তন্ময় শব্দ করে হাসলো। নিরব হাসি। স্বচ্ছ প্রানবন্ত। মাহিন বলল, ‘দোস্ত আমার কাছে ছুঁতো আছে। তুই শুধু ওয়েট কর। আমরা এবার সবাই মিলেই যাবো।’
_________
রবিবার সন্ধ্যা সাতটা। মোস্তফা সাহেব লিভিং রুমে বসে আছেন। নিউজ দেখছেন সঙ্গে চা খাচ্ছেন। সাথে ওহী সাহেব, আনোয়ার সাহেবও রয়েছেন। এমতাবস্থায় বিনা আমন্ত্রণে হাজির তন্ময়ের বন্ধুবান্ধব। একসাথে ছয়জন। ছেলেমেয়ে মিলিয়ে এসেছে। হাতে নানান সরঞ্জাম। হাত ভর্তি খাবার এনেছে। সেগুলো উঠিয়ে দিয়েছে সামনে দাঁড়ানো জবেদা বেগমের হাতে। সেসময় তন্ময় বাসায় নেই। অফিসে সে। হন্তদন্ত ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়ালেন মোস্তফা সাহেব। ছেলের বন্ধুদের সে ভালোভাবেই চেনে। প্রায়শই কাজে অকাজে দেখা হয়েছে সকলের সাথেই। হঠাৎ তাদের আগমনে ভড়কে গেলেন কিছুটা। বসতে বললেন। মাহিন হাস্যজ্বল গলায় সালাম জানিয়েছে। চামড়া পাতলা রিহান ততক্ষণে ওহী এবং আনোয়ার সাহেবের মধ্যে চেপে বসেছে। গপ্পোবাজ সে এটাসেটা বলে আলোচনা শুরু করেছে। শান্ত বাড়িটি অশান্ত হয়ে উঠল মুহুর্তেই। চেঁচামেচির শব্দে বেরিয়ে এসেছে দীপ্ত, রুবি, শাবিহা এবং অরু। জবেদা বেগম অরু এবং রুবিকে কাজে লাগিয়ে দিয়েছে৷ ঝটপট খানাপিনা তৈরি করতে হবে। এভাবে শুকনো খাবার অলরেডি ট্রে করে নিয়ে এসেছেন।

সবাই আলোচনা করে এসেছে। আজ মুলত ট্রিপের কথা মাহিন বলবে। লজিক কথাবার্তায় সে এক্সপার্ট। বাকিগুলো ধাপ্পাবাজ একেকটা। তাই সময় পেয়েই মাহিন বলল, ‘চাচা পারমিশন নিতে এসেছি আপনার।’

মোস্তফা সাহেব হাসলেন, ‘কীসের জন্য? তোমাদের আবার পারমিশন লাগবে কীসে!’
‘নারায়ণগঞ্জ যাচ্ছি। বন্ধুবান্ধব সকলে মিলে।’
‘তা তো বেশ। সাহায্য লাগলে বলো নির্দ্ধিধায়।’
‘চাচা সবকিছু স্যাট। আগামী বৃহস্পতিবার রাতে বেরোবো। লঞ্চ করে যাবো। লঞ্চ রিহানের বাবা দিচ্ছে। আর নারায়ণগঞ্জ আমার নানাবাড়ি। তো খানাপিনা, থাকা নিয়ে কোনো চিন্তা নেই। তিনদিনের ট্রিপ। আমরা চাচ্ছিলাম আপনারা সকলে যদি সামিল হোন, খুশি হব।’

মোস্তফা সাহেব উৎসুকভাবে হাসলেন, ‘বাচ্চাদের ট্রিপ। সেখানে আমরা মুরব্বি যেয়ে কী করবো! না বাবা! সম্ভব নয়। এভাবেও কাজের চাপ আছে।’
‘তাহলে বাচ্চাদের পাঠিয়ে দিন। মিলেমিশে যাই। আপনজন থাকলে ট্রিপ মজার হবে।’
‘পাঠানোর কী আছে? তন্ময় যেতে চাইলে যাবে!’
‘তন্ময় তো যাবেই। সাথে শাবিহা, রুবি আর অরু যদি যায়… ‘

মোস্তফা সাহেব থমকে গেলেন। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন। কিছু বলবেন পূর্বেই মাহিন পুনরায় বলল, ‘আর শাবিহার জন্য এই ট্রিপ খুব ভালো হবে। মনমেজাজ সতেজ হবে। ডিপ্রেশন কেটে যাবে অনেকাংশে। এসময় ঘুরাফেরা খুব কাজে দেয়।’

আনোয়ার সাহেব সহমত হলেন। ওহী সাহেব ও ভাবুক ভাবে মোস্তফা সাহেবের দিক তাকাল। মোস্তফা সাহেবেরও মাহিনের কথাগুলো ভালো লাগলো। শাবিহার জন্য ঘুরাফেরা এখন খুব দরকার। মাইন্ড ফ্রেশ হবে। হয়তো অয়নকে ভুলেও যাবে। মায়া কাটবে। কিন্তু অরু….মোস্তফা সাহেব দোটানায় পড়লেন। ওহী সাহেব বলল, ‘রুবির সামনে পরিক্ষা। ও তো যেতে পারবেনা। তবে তন্ময় তো যাচ্ছেই। শাবিহাকে দেখে রাখতে সঙ্গে অরুও যাক। তিনজন মিলে ঘুরেফিরে আসবে।’

খুব সাবধানে সিচুয়েশন হাতের মুঠোয় নিয়ে নিল মাহিন। রিহান ও এদিকে সুরক্ষার বানি শোনাতে ব্যস্ত। মেয়েগুলো দিব্বি ভাব জমিয়েছে জবেদা বেগম, মুফতি বেগম এবং সুমিতা বেগমের সাথে। শাবিহাও ফাঁকে দু’এক কথা বলছে।

অবশেষে মোস্তফা সাহেব রাজি হলেন। বললেন, ‘যেতে চাইলে যাক। ঘুরে আসুক।’

ব্যস। অরু রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে লাফিয়ে উঠলো। জড়িয়ে ধরলো শাবিহাকে। জাপ্টে ধরে নিঃশব্দে চেঁচাচ্ছে। লাফালাফি থামাতে শাবিহা দু’হাতে অরুকে ধরে রেখেছে। মেয়েটা ব্যথা না পেয়ে বসে৷
________
অরুর কান্নার শব্দ ভেসে আসছে। ধীরে ধীরে স্বর বেড়ে চলেছে। একসময় উচ্চস্বরে কেঁদে উঠলো। তার কান্নার শব্দে উতলা হয়ে সবাই বেরিয়ে এসেছেন। আনোয়ার সাহেব ছুটেছেন জুতো ছাড়া। অরু তখন ফ্লোরে বসে সমানে কাঁদছে। চোখ ফুলে কলাগাছ। তার সামনে তন্ময় দাঁড়িয়ে গম্ভীরমুখে। হাতে কে’চি। পায়ের সামনে নানাজাতের উঁচু জুতোর সমাহার। সবগুলো জুতো আপাতত ছেঁড়া। এগুলো কেঁটে ফেলেছে তন্ময়। ফ্যাচ ফ্যাচ শব্দে সবগুলো কেঁটেছে। সেই জুতো জাপ্টে ধরেই কাঁদছে অরু। মোস্তফা সাহেব প্রশ্ন করলেন, ‘কি হয়েছে?’

আনোয়ার সাহেব ও চিন্তিত সুরে শুধালেন, ‘হয়েছে কী?’

অরু রেগেমেগে উঠে দাঁড়ালো। অস্থির গলায় বিচার দিল, ‘আমার সব জুতো কেঁটে ফেলেছে। আমার জুতা…’

অরুর এমন করুণ কান্নায় মোস্তফা সাহেব রেগে গেলেন। চোখ রাঙিয়ে তাকালেন ছেলের পানে। এদিকে আনোয়ার সাহেব হাসলেন। মেয়েকে নিজের সাথে রেখে বললেন, ‘আরও সুন্দর জুতো কিনে দিব মা। থাক কাঁদে না।’

বাবার এমন কথায় অরুর কান্না দ্বিগুণ হলো। আশ্চর্য! কিনে দিবে মানে! এই লোককে কিছু বলছে না কেন! অরুর মনের আশা পূরন করলো মোস্তফা সাহেব। ধমকে উঠলেন ছেলেকে, ‘কেন করলে এমন!’

তন্ময় তখনো গম্ভীর মুখশ্রী নিয়ে অরুর দিক তাকিয়ে। এদিকে রুবি সহমত পোষণ করল, ‘চাচ্চু তন্ময় ভাইয়া ঠিক করেছে। এই মেয়ে এক আনা, জুতো পরে দু আনার। পায়ে ফোসকা পড়ে আছে কতশত। দেখ, ওর পায়ের অবস্থা! আমি কতবার করে বললাম এমন প্যান্সিল হিল পরিস না। এগুলো অনেক উঁচু। না কথাই শোনে না।’

সুমিতা বেগম বিরক্ত ভঙ্গিতে চলে যাবার জন্য পা বাড়ালেন। যাবার আগে রাগান্বিত কন্ঠে বলে গেলেন, ‘একদম ঠিক হয়েছে।মেয়েটা কোনো কথাই শোনে না।’

জবেদা বেগমের ছেলের কাজ পছন্দ হলো না। তিনি অসন্তুষ্ট স্বরে বললেন, ‘এরজন্য এমন করবে। মেয়েটা কতো কষ্ট পেলো। বুঝিয়ে বললেও ত হতো।’

মোস্তফা সাহেবও বিরক্ত, ‘তুমি কীসের বুঝদার হলে বলো ত! ছেলেমানুষী করে বিদায় তো এমন। বুঝলে কী আর এগুলো পড়বে!’

তন্ময় জবাব দিলো না। কেঁ’চি ফেলে চলে গেল। অরু বিছানার এক কোণে বসে। কষ্টে বুকটা ফেটে যাচ্ছে। তার কতগুলো টাকার জুতো। সবগুলো এভাবে নষ্ট করে দিল। ইশ, দানব’টা মলম পট্টি করে যে এমন করবে কে জানত! এইযে কিছুক্ষণ আগেই নিজ হাতে পায়ের গোড়ালি’তে মলম লাগিয়ে পট্টি করে দিল। অরু তখন ভালোবাসার সমুদ্রে ভাসছিল। সেখান থেকে টেনে হিঁচড়ে পুকুরে ফেলে দিতে মানুষটার বুক কাঁপলো না। একটুও না।

জুতার বিষয় নিয়ে অরুর মন খারাপ রয়েই গেল। রাতের খাবার খেতে বসেও মনমরা হয়ে থাকল। মোস্তফা সাহেব বোঝালেন। জুতা নতুন অনেকগুলো কিনে দিবেন বললেন। তবুও কাজ হলো না। একসময় আলোচনা উঠলো ট্রিপের বিষয়টি নিয়ে। তন্ময় মাথা তুলে তাকালো। এই বিষয়ে সে একদম অজানা। তাকে না জানিয়েই এসেছে বান্দরগুলো তাহলে। তার বাবাকে মানিয়েও ফেলেছে। কীসব বলেছে কে জানে!

অরুর অভিমান রয়েই গেল। পরদিনও সে চুপচাপ বাড়ির চারপাশে ঘুরঘুর করছে। তন্ময়ের কাছে ভুলবসতও ভিড়ছে না। তন্ময় কতবার ডেকেছে হিসেব নেই। শুনেও না শোনার ভাণ করে থাকলো। অরু এই লোকের সাথে কথাই বলবে না।
___________
চলবে ~
‘নাবিলা ইষ্ক’

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here