বর্ষণের সেই রাতে- ২ পর্ব ৪২

#বর্ষণের সেই রাতে- ২
#লেখিকা: অনিমা কোতয়াল

৪২.

আদ্রিয়ানের দৃষ্টি বেশ শান্ত। ওকে দেখে বোঝা যাচ্ছে না কিছু শুনেছে কি-না। অনিমা অনেকটা ভীত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আদ্রিয়ান কিছু শোনেনিতো? ভুল ভাবেনিতো কিছু? ও তো বলতেই চেয়েছিল সব আদ্রিয়ানকে। আদ্রিয়ানই কিছু শুনতে চায়নি। উল্টে রেগে গেছিল। কী করতো ও? এদিকে রিক ভয় না পেলেও আদ্রিয়ানের উপস্থিতিতে অস্বস্তিতে পরেছে। ও চায়না আদ্রিয়ানকে কষ্ট দিতে। আবার অনিকেও ওর সাথে সহ্য করতে পারছেনা। প্রচন্ড টানাপোড়েনের মধ্যে অাছে। ইতস্তত করে একবার অনিমা আরেকবার আদ্রিয়ানের দিকে তাকাচ্ছে। আদ্রিয়ান ভ্রু কুচকে বলল,

” কী হল? দুজনেই মিউট হয়ে গেলি কেন?”

রিক মুখে জোরপূর্বক একটু হাসি ফুটিয়ে বলল,

” আসলে অনিমা জাবিনের রুমে শুতে যাচ্ছিল, আমিও আমার রুমে যাচ্ছিলাম। এখানে দেখা হল দুজনের তাই একটু কথা বলছিলাম।”

কথাটা শুনে আদ্রিয়ান অনিমার দিকে তাকাল। অনিমা চোখ নামিয়ে নিল। আদ্রিয়ান রিকের দিকে তাকিয়ে বলল,

” কথা বলা হয়ে গেছে নিশ্চয়ই? আর এখন রাতও হয়েছে অনেক। অনি আমার রুমে এসো একটু।”

কথাটা বলে অনিমার হাত ধরে রিকের দিকে তাকিয়ে আদ্রিয়ান মুচকি হেসে বলল,

” গুড নাইট।”

রিক মুখে হাসি ধরে রেখেই বলল,

” গুড নাইট।”

আদ্রিয়ান আর কিছু না বলে অনিমার হাত ধরে ওর রুমে নিয়ে গেল। রিক শুধু শক্ত চোখে ওদের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইল। আদ্রিয়ান অনিমাকে রুমে এনে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে, এরপর গিয়ে দরজাটা লাগিয়ে দিল। অনিমা একটু অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। দরজা লাগাচ্ছে কেন? আর ওকেই বা কেন আনল? দরজা লাগিয়ে আদ্রিয়ান তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকাল অনিমার দিকে। অনিমা বেশ ভয় পাচ্ছে। একটু আগের ঘটনাটা নিয়ে আদ্রিয়ান ওকে কিছু বলবে না তো। আদ্রিয়ান দৃষ্টি দেখে অনিমা মাথা নিচু করে ফেলল। আদ্রিয়ান যত এগিয়ে আসছে অনিমা তত শক্ত করে বিছানার চাদর খামচে ধরছে। ওর খুব ভয় লাগছে যে আদ্রিয়ান কী না কী করে বসে। এই ছেলেকে বিশ্বাস নেই। কিন্তু অনিমাকে অবাক করে দিয়ে আদ্রিয়ান ঝট করে অনিমার কোলে মাথা রেখে শুয়ে পরল। অনিমা হকচকিয়ে গেল। কিছুক্ষণ বোকার মত তাকিয়ে থেকে বলল,

” এটা কী হল?”

আদ্রিয়ান মাথা ঘুরিয়ে অনিমার দিকে ঘুরে বলল,

” কিছু হয়নি তবে হবে, ঘুম। একটা সাউন্ড স্লিপ চাই জানপাখি। মাথায় হাত বুলিয়ে দাও তো।”

” আপনি এইজন্য আমাকে নিয়ে এসছেন?”

” হ্যাঁ, তুমি মাথায় হাত বুলিয়ে দিলে ঘুম ভালো হবে। আর কথা বলোনা, এবার মাথায় হাত বুলিয়ে দাও প্লিজ!”

অনিমা দরজার দিকে একবার তাকিয়ে বলল,

” কিন্তু জাবিন রুমের দরজা খুলে আমার জন্যে ওয়েট করছে তো!”

আদ্রিয়ান চোখ বন্ধ রেখ বলল,

“আমি ঘুমিয়ে পরলে তুমি জাবিনের রুমে চলে যেও।”

” আচ্ছা নাহিদ ভাইয়া কোথায়? এখানে তো এলোনা?”

” ও একটু কাজে আটকে আছে। এদিকে আসতে পারবেনা।”

অনিমা আর কিছু না বলে আদ্রিয়ানের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে শুরু করল। আদ্রিয়ানও ভদ্র ছেলের মত চোখ বন্ধ করে রইল। আজ আর কোন দুষ্টুমি করল না। অনিমার রিকের বলা কথাগুলো মনে পরছে শুধু। রিক কী বলল তখন? রিক ওকে ভালোবাসে? কিন্তু কীভাবে সম্ভব এটা? সব এরকম এলোমেলো লাগছে কেন? এসব ভাবতে ভাবতে হঠাৎ আদ্রিয়ানের মুখের দিকে চোখ পরল ওর। চোখ বন্ধ করে রাখা অবস্থায় বেশ ইনোসেন্ট লাগছে আদ্রিয়ানকে। অনিমা বেশ অনেকক্ষণ আদ্রিয়ানের মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে মুচকি হাসল।

____________

রঞ্জিত চৌধুরী নিজের ক্যাবিনে বসে সামনে রাখা গ্লোবটা ঘোরাচ্ছে আর গভীর মনোযোগ দিয়ে ভাবছে কিছু একটা। বেশ কিছুক্ষণ পর দরজা খুলে কবির শেখ ঢুকতে ঢুকতে বলল,

” কী ব্যাপার! আজ এতো সকাল সকাল তলফ করলেন যে? কোন দরকার ছিল?”

কথাটা বলে চেয়ার টেনে বসলেন উনি। রঞ্জিত চৌধুরী গ্লোব থেকে চোখ সরিয়ে নিয়ে বলল,

” হ্যাঁ! রিক মানিকের বাড়িতে গেছে জানো তো?”

” হ্যাঁ শুনেছি!”

” তোমার কী মনে হয়? কী করবে ও?”

” কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না। ছেলেটা যদি আদ্রিয়ান না হয়ে অন্যকেউ হতো। তাহলে রিককে আমি আমার মত চালাতে পারতাম। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে এটাই যে ওটা আদ্রিয়ান। তাই আমি এবিষয়ে ওকে বেশি উস্কাতে গেলে আমায় সন্দেহ করত। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হতো না। তাই আমি ওকে যেটুকু যা উস্কেছি কাজ হলে তাতেই হবে। আর যদি কাজ না হয় তাহলে এবিষয়ে আমাদের আর কিছু করার নেই।”

রঞ্জিত চৌধুরী হতাশ নিশ্বাস ত্যাগ করে বলল,

” এতো ঝামেলা আর ভালো লাগছেনা। একেতো এই ঝামেলা, তারওপর অনেক খোঁজ লাগিয়েও এখনও বুঝে উঠতে পারছিনা আমাদের অজান্তেই এভাবে আমাদের সব প্লান ভেস্তে কে দিচ্ছে?”

” হ্যাঁ! অনিমাকে যখন পাচার করা হচ্ছিল সেই মুহূর্তেই গ্যাংটা ধরা পরা, তখনই পুলিশ চলে আসা, ঐ বুড়ি মাদারের এভাবে ভ্যানিস হয়ে যাওয়া, আর এর আগে যেসব বাঁশ দিয়েছে সেসব বাদই দিলাম। আচ্ছা! অনিমা আদ্রিয়ানের কাছে আছে। আদ্রিয়ানই বিয়ে করল ওকে। কোনভাবে আদ্রিয়ান এসব করছে না তো?”

রঞ্জিত চৌধুরী তাচ্ছিল্যভরা হাসি দিয়ে বললেন,

” আরে দূর! আর মানুষ পেলেনা? দু-বেলা গিটার নিয়ে টুংটাং করে বেড়ায়। গান গেয়ে একটু নাম ডাক করেছে। ওর দ্বারা এতো জটিল কাজ সম্ভব না-কি? আর তাছাড়াও এদেরতো অনেক ব্যস্ততা থাকে এতো জটিল কাজে যুক্ত হওয়ার সময় কোথায়? এটা কী সিনেমা না-কি?”

কবির শেখ দুই হাত একত্রিত করে তারওপর থুতনি রেখে বলল,

” সবকিছু এতো হালকাভাবে নেওয়া ঠিক নয়। যে গিটারে টুংটাং করতে পারে সে বন্দুকের ট্রিগারও টানতে পারে। আর ওতো কেবল রকস্টার। বাস্তবেও আরও বড় বড় প্রফেশনে থাকা মানুষও এসবে যুক্ত থাকে। শুধু সাধারণ চোখে পরেনা। টাকার জোরে নিজেদের আড়ালে রাখে। পৃথিবী এতোটাও সহজ নয়। সেটা আপনার চেয়ে ভালো কে জানে?”

” হ্যাঁ ভুলকিছু বলোনি। কিন্তু পরবর্তী পদক্ষেপ কী হবে? অনিমা যদি আদ্রিয়ানকে আমাদের ব্যাপারে বলে দেয় তখন?”

” চিন্তা করোনা। বলবেনা। কারণ ও নিজেও নিশ্চিতভাবে কিছুই জানেনা। যেটুকু জানে অনুমান মাত্র। আর যেটুকু নিশ্চিতভাবে জানে সেটুকুতে আমাদের বড় কয়েকটা মাথা ফেঁসে গেলেও আমরা ফাঁসব না। তাই আপাতত বাবাই যা করছে করতে দাও। এখন এটা জানা বেশি জরুরি যে হঠাৎ আমাদের পেছনে লাগলোটা কে? বা কারা? আর কেন?”

____________

বেশ অনেকটা জায়গা জুড়ে করা ফুলের বাগানটা বেশ সুন্দর লাগে দেখতে। বিভিন্ন রকমের ফুল ফুটে বাগান জুড়ে। বোঝাই যায় খুব সুন্দরভাবে পরিচর্যা করা হয় এই বাগানের। এই আবরার মেনশনের মানুষগুলো সবাই যে কত শৌখিন তার পরিচয় এই বাড়ির প্রতিটা গাছ, মাটি, প্রতিটা ইট বহন করে চলেছে। আজ জাবিন নিজেই গাছগুলোতে পানি দিচ্ছে। ও বাড়িতে থাকলে মাঝেমাঝেই এটা করে। ওর খুব ভালোলাগে বাগানের যত্ন নিতে। কেমন একটা ‘আমার বাগান’ ‘আমার বাগান’ ফিল আসে। এই নিয়ে আদ্রিয়ানকের সাথে ছোটবেলায় ঝগড়াও করত অনেক। আদ্রিয়ান বলত বাগানটা ওর, আর জাবিন বলত ওর। শুরু হয়ে যেত দুই ভাই-বোনের ঝগড়া। সে কী ঝগড়া! গাছে পানি দিতে দিতে এসব ভেবে আনমনেই হাসল জাবিন। হঠাৎ ওর চোখ পরল অভ্রর দিকে। অভ্র হেডফোন কানে লাগিয়ে গান শুনতে শুনতে এদিকেই আসছে। ও একটু গলা ঝেড়ে চুল-টুল সেট করে গাছে পানি দেওয়ায় মন দিল। ওর মনে হল অভ্র হয়ত ‘গুড মর্নিং’ বা কিছু একটা বলবে। কিন্তু ওকে অবাক করে দিয়ে অভ্র পাশ কাটিয়ে চলে গেল। জাবিন অবাক হয়ে তাকিয়ে রইল। এটা কোন ব্যবহার হল? প্রচন্ড রাগ লাগছে ওর। না, ব্যাপারটা আর সহ্য করা জায়না। ও এবার চেচিয়ে বলল,

” ও হ্যালো?”

হয়তো গান স্লো বাজছিল তাই অভ্র শুনতে পেল। পেছন ঘুরে তাকিয়ে হেডফোন নামিয়ে নিয়ে বলল,

” কিছু বলবে?”

জাবিন রেগে এগিয়ে গিয়ে বলল,

” নিজেকে কী মনে করেন অাপনি? প্রেসিডেন্ট টাইপ কিছু? এতো ভাব কীসের হ্যাঁ?”

অভ্র অবাক হয়ে তাকিয়ে থেকে বলল,

” সরি?”

” সরি মাই ফুট! সবসময় আশেপাশ দিয়ে গেলে এমন ভাব করেন যেন চেনেনই না। এতো মুড কীসের? নিজেকে খুব স্পেশাল কিছু ভাবেন? একটু কথা বললে কী হয়?”

জাবিনের এসব কথায় বোকা বনে গেল অভ্র। বোকার মতই কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বলল,

” আমি কিছুই বুঝলাম না।”

জাবিনের মাথায় এবার আগুন জ্বলছে। ও পানির পাইপটা সোজা অভ্রর দিকে দিয়ে ওকে পুরো ভিজিয়ে দিল। তারপর পাইপটা ছুড়ে ফেলে বলল,

” বুঝবেনও না, ডাফার।”

বলে হনহনে পায়ে চলে গেল। অভ্র অবাক হয়ে একবার নিজের ভেজা শরীরের দিকে একবার জাবিনের যাওয়ার দিকে তাকাল। কী হলো কিছুই বুঝলোনা। গোটা ব্যাপারটাই ওর মাথার ওপর দিয়ে গেল ওর।

___________

আবরার মেনশনে ওরা এসছে দুদিন হয়ে গেল। এরমধ্যে অনিমা আর আদ্রিয়ানের কাছেও যেতে পারেনি। আসলে সারাদিনই ব্যস্ত থাকে। মিসেস রিমার সাথে পুরোটা সময়ই রান্নাঘরে থাকে, আবার কখনও মানিক আবরারের সাথে গল্প করে, জাবিনের সাথে আড্ডা দেওয়া। বাকি সময়টা পারিবারিক আড্ডা। তবে রিকের কাজ থেকে বেশ দূরত্ব বজায় রেখেই চলেছে ও। যদিও রিক আবার একবার ওরকম ব্যবহার করেছিল ওর সাথে কিন্তু অনিমা চলে এসছে নিজেকে সামলে। এতকিছুর মধ্যে আর আদ্রিয়ান পাচ্ছেনা ওকে। বেশ মেজাজ খারাপ হয়ে আছে ওর এইজন্য। সবার সামনে অনিমাকে ডাকতেও পারেনা। কিন্তু অনিমাও সবসময় কারো না কারো সাথেই আছে। তাই অনিমার ওপরও বেশ রাগ হচ্ছে ওর।

রাতে খাওয়া-দাওয়া সব কিছুর পর বাকি কাজ সেড়ে অনিমা শোয়ার জন্যে জাবিনের রুমের দরজার কাছেই এসছে সবে। হঠাৎ কেউ ওকে কোলে তুলে নিল। অনিমা হকচকিয়ে তাকিয়ে দেখে আদ্রিয়ান। ও কিছু বলতে যাবে তার আগেই আদ্রিয়ান ধমক দিয়ে বলে উঠল,

” একদম চুপ! আর একটা কথাও বলবেনা। অনেক জ্বালিয়েছ এবার চুপচাপ থাকো।”

বলে ওকে কোলে নিয়েই হাটা শুরু করল। অনিমা অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে আদ্রিয়ানের। আজব তো! ও আবার কী করল? এভাবে রেগে আছে কেন? এই লোকটাকে মাঝেমাঝে ও মজা করে পাগল বলে। কিন্তু ওর এখন মনে হচ্ছে সত্যিই এই লোকের মাথার কয়েকটা ছেড়া। নইলে হুটহাট এমন অদ্ভুত আচরণ করে কেউ?

#চলবে….

[ আজ দুটো গল্পই দিয়েছি তাই একটু ছোট হয়ে পর্বটা। একটু এডজাস্ট করে নিন।]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here