#বর্ষনের_শেষে
পর্বঃ৯(শেষ পর্ব)
#সাদিয়া_চৌধুরী_তাহমিনা
বিয়ের পর মেয়েরা সবাই নিজের সংসারে মন দেয়।অরিন তার ব্যাতিক্রম নয়।বাবার বাড়িতে কাজ না করলেও এখানে এসে নিজ ইচ্ছায় যা পারে তা করে।তবে বলতেই হয় কপাল গুনে সে একজন শাশুড়ি পেয়েছে।এমন পরিবার পেতে মেয়েদের কপাল লাগে।সকাল ১০ টা বেজে গেছে।৯ টার দিকে অফিসে চলে গিয়েছে তারেক।আজ তাদের বিয়ের এক মাস হতে চললো।কোমরে শাড়ির আচল গুজে কাজ করছে সে।তখনি বাসার কলিংবেল বেজে উঠলো।দরজা খুলে দেখলো একজন লোক দাঁড়িয়ে।তাকে দেখেই সালাম দিয়ে বললো
” অরিন আহমেদ আছেন?”
“জ্বি আমি অরিন”
“ম্যাম আপনার নামে একটা পার্সেল এসেছে”
অরিন বিচলিত হলো।তার আবার ভয় করছে।নিজেকে স্বাভাবিক করে পার্সেলটা নিয়ে বিছানায় রেখে তারেককে কল দিলো।যদিও সে জানে তারেক আজ অনেক ব্যাস্ত থাকবে।ভয় আর বিচলিত মন নিয়ে কল দিচ্ছে সে।দুবারের মাথায় কল ধরে তারেক বললো
“কী ব্যাপার এখন কল কেন?”
“আজ আবারও পার্সেল এসেছে”
“তো”
“সে কী আবার শুরু করলো।কী করবো”
“উফ এই একটা বিষয় নিয়ে কল দেয়া লাগে? পার্সেল এসেছে খুলে দেখো।নাম লেখা থাকলে তো চিনবে আর না চিনিলে ফেলে রাখো।অযথা কল দিও না”
তারেকের এমন আচরণে বিষম খেলো অরিন।তারেক কখনো তার সাথে এমন খারাপ আচরণ করে নি।বেশ কষ্ট পেলো সে।পার্সেল টা আর না দেখে বিছানার পাশে রেখে নিচে পা বাড়ালো।তৎক্ষনাত মনে হলো তারিনকে ব্যাপারটা জানানো উচিত।আবারও রুমে ফিরে গিয়ে তারিনকে কল দিলো।কিন্তু তারিনের ফোন বন্ধ দেখাচ্ছে।মনে মনে রাগ লাগলো অরিনের।সারাদিন তারিন ফোন হাতে নিয়ে ঘুরে আর আজ তার দরকারের সময় ফোন বন্ধ।তাই এসব মাথা থেকে ঝেরে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়ালো।আজ সে স্পেশাল কিছু রান্না করবে।একমাস তেমন কিছু না হলেও তার কাছে স্পেশাল।এই এক মাসে তারেকের কেয়ার আর ভালোবাসা পেয়ে সে খুশি।সাথে এমন পরিবারে বিয়ে হওয়ায় নিজেকে ভাগ্যবতী মনে করে ।অরিনের শাশুড়ি অরিনের পাশে এসে বললেন
“কিরে মা কী করছিস”
“না মা তেমন কিছু না।পায়েশ রান্না করতে চাইছিলাম”
“তুই কেন রান্না করতে যাবি।বাসায় মানুষ আছে তো আর তাছাড়া আমিই রান্না করবো”
“উহু হবে না আমি আজ রান্না করবই”
“না মা দরকার নেই।তুই পারবি না”
“আমি আজ রান্না করবো বলেছি ব্যাস।আমি আর কোন কথা শুনবো না।”
অরিনের জেদের কাছে হেরে গিয়ে অরিনের শাশুড়ি হাসলেন।এমন সময় আবারো কলিংবেল বেজে উঠলো।অরিন যেতে চাইলে তাকে থামিয়ে অরিনের শাশুড়ি গেলেন দরজা খুলতে।কিছুক্ষণ পর হুড়মুর করে রান্না ঘরে ঢুকলো তারিন।অরিন তো প্রায় ভয় পেয়ে গেছে।তারিনকে দেখেই তার মুখে হাসি ফুটে উঠলো।মুচকি হেসে বললো
“কিরে এভাবে না বলে চলে আসলি যে?”
“কেন বোনের বাসায় আসতে কী পারমিশন নেয়া লাগবে নাকি?”
“আরে তা কেন হবে।এসেছিস ভালোই হয়েছে”
“আমি আজ সারাদিন তোর বাসায় থাকবো আপু”
“বেশ তো”
দু বোন গল্প করতে করতেই অরিনের পায়েশ হয়ে গেছে।সেই সাথে দুপুরের রান্নাটাও আস্তে আস্তে সেরে ফেলেছে অরিন।কাজ শেষে উপরে গিয়ে নিজের বিছানায় গা এলিয়ে দিলো সে।তারিন বললো
“আপু এই উপহার কে দিলো রে”
অরিন তাকিয়ে দেখলো উপহার বক্সটি হাতে নিয়ে কথাটি বলেছে তারিন।মুহূর্তেই আবারও ভয় এসে মনে বাসা বাধলো অরিনের।দ্রুত উঠে বসে তারিনকে বললো
“তারিন আজ আবার পার্সেল এসেছে।আমি ভয়ে খুলেই দেখিনি”
কপালে চিন্তার ছাপ ফুটিয়ে তারিন বললো
“নাম লিখা নাই”
“না”
“দুলাভাইকে জানিয়েছিস”
“হ্যাঁ বলেছি।সে তো পাত্তাই দিলো না”
অরিনের কথা শেষ হতেই রেপিং পেপার খুলা শুরু করলো তারিন।অরিন বাধা দিলে বলে
“আরে আজিব যেই দিক না কেন খুলে দেখবি তো নাকি।সর আমি খুলবই”
তারিন খুলতেই অরিন ভিতরে কী আছে তা দেখার জন্য উঁকি দিলো।তারিন বিছানায় রেখে বললো
“ওয়াও দেখ কী সুন্দর সব কিছু”
অরিন তাকিয়ে দেখলো একটা কালো জামদানী,কালো চুড়ি,বেলী ফুলের মালা সহ বিভিন্ন কিছু।অরিন ভয় নিয়ে তারিনের দিকে তাকাতেই তারিন বললো
“উফ আপু তুই এসব পরে সাজলে তোকে যা লাগবে না”
“কী বলিস আমি এসব পরবো কেন।কে দিয়েছে তা না জেনে আমি পরবো না”
“সে দেখা যাবে”
তারিনের কথায় আর তেমন পাত্তা দিলো না অরিন।দুপুরের আযান হয়ে গেছে। তারেক দুপুরের খাবার এসে বাসায় খেয়ে যায়।তাই দ্রুত শাওয়ার নিতে চলে গেলো অরিন।দুপুর ২ টা পেরিয়ে ৩ টা বাজতে চললো।কিন্তু তারেক আসার খবর নেই।তাই তারেককে ফোন লাগালো অরিন।তারেক ফোন ধরছে না।দুপুর ঘনিয়ে বিকেল হয়ে গেছে।তারিনকে চিন্তিত মুখ নিয়ে তারেকের কথা বললে তারিন কিছুই বলে নি।বিকেল ৪ টা বাজতেই তারিন বললো
“আপু আয় তোকে এই শাড়ি পরিয়ে সাজাই”
“না আমি এগুলো পরবো না”
“উফ আপু সে তো আর জানবে না তুই যে পরেছিস প্লিজ”
“দেখ তারিন জোর করিস না প্লিজ।এমনিতেই তোর দুলাভাই ফোন ধরছে না এ নিয়ে চিন্তায় আছি”
“শুন আপু হয়তো দুলাভাই বিজি থাকায় ফোন ধরছে না।শাড়ি পরে ছবি তুলবি এটা সেটা করবি দেখবি সময় চলে গেছে আর এর ভিতরে দুলাভাই ও চলে আসবে”
তারিনকে মানাতে না পেরে অগত্যা তৈরি হতে হচ্ছে অরিনকে।যদিও সে কিছুই করছে না সব তারিনই করছে।সাজগুজ সব কমপ্লিট হতেই তারিন ভালোভাবে অরিনের দিকে তাকিয়ে বললো
“বাহ আমার বোনকে বেশ মিষ্টি লাগছে দেখতে”
তখনি অরিনের ফোন বেজে উঠলো।তাকিয়ে দেখে তারেক ফোন দিয়েছে।দ্রুত ফোন ধরতেই ওপাশ থেকে তারেক কাঁপা কাঁপা গলায় বললো
“অ,,রিন”
“কী হয়েছে এভাবে কথা বলছ কেন?”
“অরিন প্লিজ দ্রুত শীব বাড়ির কাছে যে মাঠ সেখানের শেষ দিকে চলে এসো”
“কী হয়েছে তোমার, হ্যালো কথা বলো প্লিজ।হ্যালো”
তারেক ফোন কেটে দিয়েছে।তারিনকে সব বলতেই তারিন বললো চল যাই।অরিন আর জামা না পাল্টিয়ে ঠিক এভাবেই রওয়ানা হলো।
শীব বাড়ি পৌঁছে মাঠের শেষের দিকে দৌড়ে যাচ্ছে অরিন।পাশে তারিন আছে কিনা সে দিকে তার খেয়াল নেই।শেষ মাথায় এসে দেখলো কাশফুলে ভরা এখানটায়।কিন্তু কোথাও তারেক নেই।ক্লান্ত হয়ে গেছে সে।দম ফেলে পাশে তাকাতেই দেখলো তারিন নেই।সে অবাক আর বেশ ভয় পেলো।তারপর ভাবলো হয়তো তারিন গাড়িতেই থেকে গেছে। ফোন হাতে নিয়ে তারেককে কল দিতেই তারেক বললো
“এসে গেছ”
“হ্যাঁ কোথায় তুমি”
“কাশ বাগানের শেষের দিকে আসো”
তারেকের কথা মতো অরিন সেখানে গিয়ে দাঁড়িয়ে এদিক সেদিক তারেককে খুঁজছে।তার ভয় করছে তারেকের কিছু হলো না তো।তখনি পিছন থেকে কেউ অরিনের দু বাহু আলতো হাতে ধরলো।ঘুরে তাকিয়ে দেখলো তারেক।উত্তেজনা নিয়ে অরিন বললো
“কী হয়েছে তোমার,এভাবে কথা বলেছিলে কেন”?
” হ্যাপি ওয়ান মান্থ এনিভার্সারি”
তারেকের কথা শুনে ভেবাচেকা খেয়ে গেলো অরিন।তারপর তারেকের দিকে ভালোভাবে তাকিয়ে দেখলো তারেক কালো পাঞ্জাবি পরেছে।অরিন কাঁদু কাঁদু মুখ বানিয়ে বললো
“কিসের উইশ।আমাকে চিন্তায় ফেলে উইশ করছ?”
“আরে একটু অভিনয় না করলে কী আর এভাবে সারপ্রাইজ দিতে পারতাম”
“এটা কোন কথা হলো আমি কতোটা ভয় পেয়েছি।”
“আচ্ছা বাবা এই কারনে সরি”
হঠাৎ তারিনের কথা মনে হতেই অরিন বললো
“তারিন মনে হয় গাড়িতেই রয়ে গেছে। সে একা একা বসে থাকবে নাকি কল দিয়ে বলো এখানে আসতে ”
“তারিন চলে গেছে”
তারেকের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে অরিন বললো
“তার মানে সব প্ল্যান ছিলো তোমাদের”
“হ্যাঁ প্ল্যান না করে কী এভাবে সারপ্রাইজ দিতে পারতাম নাকি”
অভিমান নিয়ে মন খারাপ করে অরিন বললো
“কিন্তু সকালে এভাবে কেন কথা বলেছিলে আমার সাথে”
“এইটাও প্ল্যানের অংশ মিসেস।নাহলে কী এভাবে সারপ্রাইজড হতে।আর উপহার তো আমিই পাঠিয়েছি আজ তাই হাইপার হওয়ার প্রশ্নই আসে না”
তারেকের কথা শুনে অবাক হয় অরিন।এখন বুঝেছে কেন এমন করেছে তারেক।কিন্তু তবুও ওর অভিমান ভাঙ্গে নি।মুচকি হেসে অরিনের হাত ধরে কাশ বাগানের কাছে গিয়ে অরিনের হাত দুটো ধরে তারেক বললো
“আকাশ পানে তাকাও প্রিয়া,দেখো শরতের আকাশে কেমন শুভ্র সাদা মেঘ উড়ে বেড়াচ্ছে ঠিক তোমার মতন।আমার মনের মনি কোঠায় তুমি এভাবেই উড়ে বেড়াও।আর আমি এই শুভ্র সাদা সৌন্দর্যের মাঝেও তোমার মাধুর্যতায় নিজেকে খুঁজে বেড়াই”
তারেকের এমন কথায় মুচকি হাসলো অরিন।তারেক অরিনের মুচকি হাসি দেখে বললো
“মন খারাপের লেস কাটিয়ে যেভাবে আজ হাসলে ঠিক এমনি এক বর্ষনমুখর দিনেই তোমায় দেখেছিলাম।সেদিন বৃষ্টি শেষে রোদ উঠেছিলো।পুরো শহর বর্ষনের শেষে রোদের ছায়ায় হেসে ছিলো, ঠিক আজ যেমন তুমি মন খারাপের লেস কাটিয়ে হেসেছ।”
তারেকের হাত আরেকটু শক্ত করে ধরে অরিন।এভাবে উপহার পেয়ে যদি ভয় ঢুকার পর জানতে পারে সেটা নিজের প্রিয় ব্যক্তির দেয়া।তাহলে এভাবে উপহার পেতে সে রাজি।তারেক যেভাবে বর্ষনের শেষে তাকে দেখে হৃদয়ে গেথে প্রস্তাব দিয়ে একেবারে নিজের করে নিয়েছে ঠিক সে ভাবেই সে ভালোবাসায় আগলে রেখে অরিনের হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছে।
———-সমাপ্ত———-
(ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।পাশে থাকার জন্য সবাইকে ধন্যবাদ।)