যখন নীরবে দূরে,পর্ব:১

যখন নীরবে দূরে (প্রথম পর্ব )
ঈপ্সিতা মিত্র
<১>
আজ ঋকের জন্য দিনটা খুব ইম্পরট্যান্ট | আজ ওর রেস্টুরেন্টের এক বছর কমপ্লিট হলো | সাকসেসফুল একটা বছর | অনেকদিনের অপেক্ষা , স্ট্রাগেল , আর চেষ্টার পর শুরু করেছিল ‘কলকাতা কলিং’ কে | আসলে ছোটবেলা থেকেই রান্নার প্রতি যেন একটা নেশা কাজ করতো ঋকের | মা রান্নাঘরে গেলেই তাই ও ও ছুটতো পেছনে পেছনে | এক্সপেরিমেন্টাল রান্না থেকে রোজকার ডাল ভাত , সব কিছুই যেন ওকে টানতো | আর সময়ের সঙ্গে রান্না করাটা যে কখন একটা প্যাশনের মতন হয়ে গেলো ওর কাছে আর কিচেনটা ওর বেস্ট ফ্রেন্ড, বুঝতেই পারেনি ! তাই সব সময়ই কেরিয়ারের কথা মাথায় এলেই ভাবতো যা করবে জিভে প্রেম এর জন্যই করবে | সেইমতোন গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট করে হোটেল ম্যানেজমেন্টটাও পড়লো | তারপর তিন বছর দিল্লির একটা ফাইভস্টার হোটেলে চাকরিও করলো | ভেবেছিলো তখন এই তিন বছরের স্যালারির জমানো সব টাকা দিয়েই শুরু করবে নিজের প্রথম রেস্টুরেন্ট | তবে জীবনটা তো আর আমাদের প্ল্যান করা স্ক্রিপ্ট এর মতন চলে না | ওপরওলা অনেক সময়ই একটা আলাদা স্ক্রিপ্ট রেডি করে রাখে ! আর সেই ওপরওলার স্ক্রিপ্টের লেখা অনুযায়ী হঠাৎ ঋকের সুস্থ বাবার হার্টে প্রব্লেম দেখা দিলো | আর কিছু টেস্ট করার পর জানা গেলো কিডনিও ড্যামেজ ! এদিকে প্রাইভেট ফার্মে চাকরি করে যা টাকা জমিয়েছিল সেটা ছেলের হোটেল ম্যানেজমেন্টের ফিজ দিতেই শেষ | তাই হাত পুরোই ফাঁকা | তখন ঋকের কাছে নিজের রেস্টুরেন্টের স্বপ্নর থেকে অনেক বেশি দামি মনে হয়েছিল বাবার জীবন | সেই জন্য ব্যাংকের সব সেভিংস কয়েক মাসে শেষ করে দিয়েছিলো বাবার চিকিৎসায় | প্রায় ছ মাস , কলকাতা , ভেলোর , চেন্নাই এর নামি নামি হসপিটাল , ডাক্তারদের দ্বারে ঘুরে ঘুরেও শেষ রক্ষা হলো না | একদিন বাবা সব ছেড়ে সেই চলেই গেলো | আর গেলো ওর হোটেলের চাকরিটাও | সেই সময় বাবার সঙ্গে থাকার জন্য আসলে অনেক ছুটি নিতে হচ্ছিলো ঋককে | বার বার হোটেল থেকে ওকে ওয়ার্নিং দিচ্ছিলো , কিন্তু ঋকের পক্ষে তখন বাবাকে হসপিটালে রেখে , আর মায়ের ওপর একা সব কিছু ছেড়ে দিয়ে দিল্লিতে চলে আসা সম্ভব ছিল না | তাই আর চাকরিটা রাখতে পারলো না | ওই সময় মনে হয়েছিল জীবনে সব কিছু বোধ হয় শেষই হয়ে গেলো ! ওর ফ্যামিলি , ওর কেরিয়ার , ওর স্বপ্ন , সব | তবে এই সব শেষ হয়ে যাওয়ার সময়ে একজন ছিল, যে সারাক্ষন ওর হাতটা শক্ত করে ধরে রেখেছিলো | ঋক ভাঙতে চাইলেও সে ভাঙতে দেয়নি | জোর করে ওকে আবার স্বপ্ন দেখতে বাধ্য করিয়েছিলো | আর সে হলো ওর ছোটবেলাকার বন্ধু রূপকথা | পাশের বাড়ির এই মেয়েটা সেই ক্লাস ওয়ান থেকে ওর ভালো , মন্দ ,সময়ে, অসময়ে ওর সঙ্গে থেকেছে | সে ঋকের স্কুল প্রজেক্ট ঠিক সময়ে রেডি করে দেয়া হোক , কি ওর বানানো এক্সপেরিমেন্টাল ডিশ কে প্রথম চেখে দেখা , সবেতেই রূপকথা | এমন কি যখন ঋকের বাবা ওর হোটেল ম্যানেজমেন্ট পড়াটাকে একেবারেই সাপোর্ট করছিলো না, চাইছিলো ঋক মাস্টার্স কমপ্লিট করে অফিসে চাকরির জন্য ইন্টারভিউ দিক , তখনও হোটেল ম্যানেজমেন্ট এর গুরুত্ব থেকে শেফ হলে ঠিক কি কি রাজ্য জয় করা যায় , টাটা বিড়লা আম্বানি না হোক , সঞ্জীব কাপুর হয়ে ঠিক কত সম্পত্তির মালিক হওয়া যায় তার একটা লিস্ট বানিয়ে রূপকথা এসেছিলো ঋকদের বাড়িতে , ওর বাবাকে বোঝাতে | আর তিন ঘন্টার লেকচারে কাজও হয়েছিল | ঋকের বাবা রূপকথার যুক্তিগুলোকে অস্বীকার করতে পারেনি , আর ঋককে হোটেল ম্যানেজমেন্ট পড়ার পারমিশনটা হাসি মুখে দিয়ে দিয়েছিলো | এইসবের পর সময় যখন ঋকের জীবনে দুঃসময় ডেকে এনেছিল তখন রূপকথাই প্রথম বলেছিলো সময় পাল্টানোর কথা | ‘কলকাতা কলিং’ কে শুরু করার কথা | তারপর বাড়িটাকে মর্গেজ রেখে ঋক ওদের পুরোনো নিউটাউনের কাছে দাদুর বাড়িটাকে রিনোভেট করে শুরু করেছিল এই রেস্টুরেন্টটা |আর রূপকথা হয়েছিল ওর এসিস্টেন্ট শেফ কাম ওয়েটার , কাম একাউন্টেন্ট | আসলে দরকার অনুযায়ী রূপকথার কাজগুলো বদলে যেত | আর প্রথমে তো অতো টাকাও ছিল না যে অনেকজনকে এপয়েন্ট করে রেস্টুরেন্ট চালাবে ! তাই রূপকথাকেই অনেকটা সামলাতে হতো | তবে দিন পাল্টাতে বেশি সময় লাগেনি | ঋকের রান্নার জন্য ভোজনরসিক বাঙালি বেশি দিন ‘কলকাতা কলিং’ কে ইগনোর করে থাকতে পারেনি ! ওর বানানো চিকেন রেজালা থেকে সেজোয়ান রাইজ , সবটাই কিছুদিনের মধ্যে ওই এলাকায় বেশ ফেমাস হয়ে গেছে | কাস্টমারের সংখ্যা যেমন বাড়তে থেকেছে , সেই রকম ‘কলকাতা কলিং’ এর ওয়েটারের সংখ্যাও |
এইসবই ভাবছিলো আনমনে রেস্টুরেন্ট এর ডেকোরেশন করতে করতে | আজ এক বছর কমপ্লিট হওয়ার জন্য সন্ধ্যেবেলা একটা পার্টি আছে এখানে | তাই খুব সকাল সকালই রেস্টুরেন্টে হাজির হয়েছে ও | এতো সাকসেসফুল একটা বছর যে এইভাবে দেখতে দেখতে চোখের পলকে কেটে গেলো সেটা যেন এখনো বিশ্বাসই হচ্ছে না ! তখনি রূপকথার গলার আওয়াজ কানে এলো ,
” কিরে ? এতো কি ভাবছিস তখন থেকে ? আমি এলাম আর তুই খেয়ালও করলি না ?”
” তোর কথাই ভাবছিলাম এতক্ষন | আজকের দিনটা তো তোর জন্যই পসিবল হয়েছে | নইলে তো আমি ট্র্যাজিডি কিং হয়ে বাড়ি বসেছিলাম |”— ঋক হেসে এক নিঃশাসে কথাগুলো বলে গেলো |
রূপকথা এবার নিজের ভ্রুটাকে দু ইঞ্চি না তুলে পারলো না !—- , ” বাবা ! এতো ক্রেডিট আমি রাখবো কোথায় ! সত্যি ! তবে শুধু ক্রেডিড এ কাজ হবে না | নিজের হাতে ব্ল্যাকফরেস্ট কেক বানিয়ে খাওয়াতে হবে | তাহলেই মানবো | বুঝেছিস |”
ঋক এটা শুনে জোরে হেসে ফেললো ,—” হ্যাঁ , সেই | তারপর গোটা একটা ব্ল্যাকফরেস্ট কেক খেয়ে মোটা হয়ে যাবি | তখন কে বিয়ে করবে তোকে ? তারপর তো সারা জীবন আমার ঘাড়ে বসেই নাচবি |” …
” কেন , তুই তো আছিস | বিয়ে করার জন্য |” .. উত্তরটা রূপকথার মনে এসেও মিলিয়ে গেলো | আসলে কিছু কথা সব সময় মনেই থাকে , আড়ালে | মুখে বলা যায় না | তাই একটু হেসে একটা সাজানো কথাই বলতে হলো রূপকথাকে , ” বেশ করবো নাচবো | তোর ঘাড়টা আছে তো সেই জন্যই , যাতে আমি সেখানে উঠে ভরতনাট্যম , মনিপুরী , ব্রেক ডান্স , এইসব করতে পারি |”
<২>
সেইদিন সন্ধ্যেবেলা ‘কলকাতা কলিং’ এর পার্টিতে একটা দারুন ঘটনা ঘটলো , যেটা ঋক স্বপ্নেও ভাবতে পারেনি | ওদের উল্টো দিকের নামি ‘চাইনিজ শেফ’ রেস্টুরেন্ট ঋকের বিজনেস এ ইনভেস্ট করতে ইন্টারেস্টেড | এই রেস্টুরেন্ট এর অনেকগুলো ব্রাঞ্চ সারা দেশে | তারা যে ওর দিকে বিজনেসের হাত এইভাবে এগিয়ে দেবে নিজে থেকে , সেইসব ঋক কল্পনাও করেনি | যখন ‘চাইনিজ শেফ’ এর ওনার মিস্টার আগারওয়াল ওকে পার্টিতে এসে নিজের মুখে কথাটা বললো , তখন মনে হয়েছিল যেন স্বপ্ন দেখছে | আসলে এই মাত্র এক বছরেই ঋকের রেস্টুরেন্ট আর শেফ হিসেবে ওর নাম কলকাতায় বেশ ছড়িয়েছে রান্নার গুনেই | তাই ‘কলকাতা কলিং’ এ ইনভেস্ট করাটাকে বেশ লাভেরই মনে হয়েছে মিস্টার আগারওয়ালের | সেইদিন সেই মুহূর্তে এই অফারের ব্যাপারে শুনে ঋকের সঙ্গে অবশ্য আরোও একজনের মুখে একটা হাসি চলে এসেছিলো | রূপকথা আসলে ভাবতে পারেনি যে এতো তাড়াতাড়ি এতো কিছু সম্ভব | মিস্টার আগারওয়ালের কথাগুলো শেষ হতেই সেইদিন তাই রূপকথা ঋকের হাতটা শক্ত করে ধরে নিয়েছিল , ঠিক সেইদিনের মতন , যখন ঋকের বাবা মারা গিয়েছিলো , ওর চারিদিকটা অন্ধকার ছিল ! তবে আজ হাত ধরার কারণটা অন্য | আজ একটা আলোর দিন , নতুন শুরুর দিন | এইসবই ভাবছিলো রূপকথা পার্টিতে সবার মধ্যে ঋকের পাশে দাঁড়িয়ে , তখনই হঠাৎ ওর চোখের পলকে রেস্টুরেন্টের দরজা খুলে একজন ঢুকলো , আর পার্টিতে দাঁড়িয়ে থাকা সবার চোখ তার দিকেই যেন আটকে গেলো ! এতো সুন্দরী কেউ হতে পারে ! আর রূপকথা খেয়াল করলো এই প্রথম ঋকের চোখও কাউকে দেখে থমকে গেছে , একটা স্থির দৃষ্টি ছিল ওই মেয়েটার দিকে ওর , যেটা রূপকথা নিজের জন্য কখনো দেখেনি | তখনই মিস্টার আগারওয়াল পরিচয় করিয়ে দিলো সেই চোখ থমকে যাওয়া সুন্দরীর সঙ্গে , ” ঋক , মিট মাই ডটার , স্নেহা | সি লুকস আফটার মাই বিজনেস…” আর কথাটা শুনেই ঋক এক সেকেন্ডে রূপকথার থেকে হাতটা ছাড়িয়ে স্নেহার দিকে বাড়িয়ে দিলো , তারপর হাসি মুখে বললো , ” রিয়ালি নাইস টু মিট ইউ স্নেহা .. এন্ড উই ক্যান বি ফ্রেন্ডস , রাইট ,ইনস্টেড অফ বিং বিজনেস পার্টনারস ..” … কথাটা শুনে স্নেহা হাসিমুখে বললো , “ইয়েস , অফকোর্স শেফ .. উই ক্যান বি ফ্রেন্ডস..”
তারপর সেইদিনের পুরো পার্টি জুড়েই স্নেহা ছিল , ওর মুগ্ধ করা হাসি , হীরের নেকলেসের ঝলকানি , ডিজাইনার ড্রেসের মোড়কে ঢাকা গ্ল্যামার , সবটা মিলিয়ে পার্টিতে সবাই যেন এই সুন্দরীর সঙ্গে দু সেকেন্ড সময় কাটিয়ে নিতে চাইছিলো , একটা সেলফি তুলে নিজের কাছে রেখে দিতে চাইছিলো সযত্নে | আর ঋক , সে তো তার নতুন বন্ধুর সঙ্গে কখনো বিজনেস তো কখনো হবিস এইসব নিয়ে আলোচনায়ই খুব ব্যস্ত ছিল | তার আর অন্য দিকে বিশেষ খেয়াল ছিল না | তার সব খেয়াল জুড়েই ছিল সেদিনের চিফ গেস্ট , মিস্টার আগারওয়াল , আর স্নেহা |
তবে রূপকথা সবটাই দেখছিলো একটা কোনায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে | আর মাঝে মাঝে খেয়াল করছিলো নিজেকে | সেই গ্ল্যামারাস ড্রেসের সামনে ওর নিউ মার্কেট থেকে কেনা সস্তার একটা কুর্তি , হীরের নেকলেসের বদলে একটা সরু পুরোনো মায়ের দেয়া সোনার চেন , আর একটা সাধারণ হাসি | সত্যি , এই রকম দামি কেউ সামনে না এলে হয়তো নিজের সাধারনত্বটা ঠিকভাবে ফিলই করা যায় না ! হঠাৎ কেমন যেন বেমানান লাগছিলো ওর এই পার্টিটাতে | এতো লোকের ভিড়ে যেন মনে হচ্ছিলো নিজেকে হারিয়ে ফেলেছে | তাই আর বেশিক্ষন একটা কোনায় দাঁড়িয়ে থাকেনি | কাউকে না বলেই বেরিয়ে এসেছিলো ‘কলকাতা কলিং’ থেকে | তারপর জ্যামে ভরা রাস্তায় , একা একা হেঁটেছিলো অনেক্ষন | এই সাধারণের ভিড়ে যেন নিজেকে খুঁজতে চাইছিলো রূপকথা | ও তো এদেরই মতন | এই পথ চলা , ক্লান্ত , ঘামে ভেজা , টাকার চিন্তায় মাথায় ভাঁজ পড়া সাধারণদের মতন , যেখানে একটুও গ্ল্যামার নেই , চোখ ধাঁধানো রূপ নেই | শুধু আছে সাধারণত্ব | তাই হয়তো কেউ থমকে ওর দিকে তাকায় না ! ওর মধ্যে হারিয়ে যায় না ।
<চলবে >

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here