যখন নীরবে দূরে,পর্ব:২

যখন নীরবে দূরে (দ্বিতীয় পর্ব)
ঈপ্সিতা মিত্র
<৩>
সেইদিনের রাত কাটিয়ে পরের দিন সকাল দশটার পর রূপকথার ফোনটা বেজে উঠলো | স্ক্রিনে চোখ রাখতেই সেই চেনা নামটা | যাক , এতক্ষন বাদে তাহলে রূপকথার কথা মনে পড়েছে | এই ভেবে ফোনটা ধরতেই ওপারে বেশ রাগি রাগি একটা গলা ,
” কাল ঐভাবে কাউকে কিছু না বলে চলে এলি কেন ? ”
রূপকথা একটু নির্বিকার ভাবেই বললো , ” কাকে কি বলবো ! তুই তো ব্যস্ত ছিলিস , তাই আমি আর ডিস্টার্ব করিনি |”
এতে ঋকের পারদ আরোও চড়লো , ” ডিস্টার্ব ! এক রাতের মধ্যে এতো কথা শিখলি কোথা থেকে ? আর তোর বরং আমাকে সকাল সকাল ফোন করে কংগ্র্যাচুলেশনস বলা উচিত ছিল | কাল অতো বড়ো একটা বিজনেস অফার পেলাম | আর তার বদলে এইসব কথা !”
না | আর বেশি কথা বাড়ায়নি রূপকথা | সত্যি আজ ঋকের জন্য দিনটা খুব খুশির | আর ওর এই সময় রূপকথার জন্য মুড্ অফ হোক সেটা ঠিক না | তাই মেক আপ দেয়ার জন্য কিছু কথা সাজিয়ে বললো , ” আরে বাবা , আমার কাল মাথা ধরেছিলো | তাই চলে এসেছিলাম | আর তোকে কিছু বলিনি কারণ তুই মিস্টার আগারওয়াল , স্নেহার সাথে বিজি ছিলিস | আর আমি তো সামনাসামনি কংগ্র্যাচুলেশনস বলবো ভেবেছিলাম , তাই আর ফোন করিনি | বুঝলি | এবার রাগটাকে সাইডে রেখে হ্যাপি হয়ে যা | আর এবার তো দুটো ব্ল্যাকফরেস্ট কেক বানিয়ে খাওয়াতে হবে | একটাতে আর মানবো না |”
রূপকথার এতো কথা শুনে এবার ফাইনালি ঋকের মুখে হাসি | আসলে এই মেয়েটার সাথে একটু কথা কম হলেই দিনটা যেন কেমন খালি খালি লাগে | আর সেটা আজ থেকে না | সেই ছোটবেলা থেকেই | যাই হোক , এবার ঋক আর রাগের আড়ালে নিজের একসাইটমেন্টটাকে লুকিয়ে রাখতে পারলো না | বেশ উত্তেজিত হয়েই বললো , ” জানিস কাল কি হয়েছে ? মিস্টার আগারওয়াল বলেছে কলকাতায় আরো দুটো ব্রাঞ্চ খুলতে চায় ওরা ‘কলকাতা কলিং’ এর | আমি তো জাস্ট ভাবতেই পারছি না | বাট অল ক্রেডিট গোস টু স্নেহা | ও না কি আমাদের রেস্টুরেন্টে এসেছে দু বার বন্ধুদের সাথে | এখানকার কাস্টমার সার্ভিস, রান্নার কোয়ালিটি ওর ভীষণ পছন্ধ হয়েছে | তাই আমাদের বিজনেসে ইনভেস্ট করার আইডিয়াটা স্নেহাই ওর বাবাকে দিয়েছে | আই মিন সি ইস জাস্ট গ্রেট ..আর কাল কথা বলেও এতো ভালো লাগলো | মানে খুবই ডাউন টু আর্থ … অতো বড়ো বিজনেস ম্যানেজ করে , কিন্তু কথাবার্তা একদম সিম্পল …. ”
” ওহ , বাহ্ | সত্যি দারুন ব্যাপার | আই এম রিয়ালি হ্যাপি ফর ইউ ..”….. কথাগুলো যেন জোর করেই বললো রূপকথা | এই প্রথম ঋকের মুখে অন্য কোনো মেয়ের ব্যাপারে এতো সুনাম শুনে ওর মনটা যেন কেমন থমকে যাচ্ছে | কলকাতা কলিং এর আরোও দুটো ব্রাঞ্চ হবে শুনে তো ওর খুশি হওয়ার কথা ছিল | কিন্তু তার বদলে মনে হচ্ছে কেউ যেন অনেক দূরে চলে যাচ্ছে , যে এতদিন খুব কাছের , খুব নিজের ছিল | হয়তো কিছু সময় বাদে আর তাকে ধরা ছোঁয়া যাবে না !
সেদিন যেটা আনমনে মনে হয়েছিল রূপকথার , কিছুর দিনের মধ্যে যেন চোখের পলকে সেই ভাবনাটা সত্যি হয়ে গেলো | আসলে কাছের মানুষের দূরে সরে যেতে বেশি সময় লাগে না | ঋক আর রূপকথার গল্পটাও ঠিক সেই রকম | আর এই দূরত্ব বাড়ার শুরু হয়েছিল সেই শুক্রবার সকালবেলা , যখন রূপকথা রোজকার অভ্যাস মতন সকাল দশটার মধ্যে রেস্টুরেন্টে গিয়েছিলো | ও বেশ অনেকদিন ধরেই কাউন্টারটা সামলায় | আসলে আলাদা করে একাউন্টেন্ট রাখলে তো ভালোই খরচ , তাই ঋকই কাউন্টার সামলানোর দায়িত্ব পার্মানেন্টলি রূপকথাকে দিয়েছিলো প্রথম থেকে | কিন্তু সেইদিন রেস্টুরেন্টের দরজা খুলে রূপকথার পা টা হঠাৎ থমকে গেলো | কাউন্টারে কম্পিউটারের সামনে অন্য একটা মেয়ে বসে , ওর জায়গায় | খুব অবাক লাগলো এই দৃশ্য দেখে | ঋক তখন কিচেনে ছিল | রূপকথা এক মিনিটও সময় নষ্ট না করে অনেক প্রশ্ন মনে নিয়ে সেদিন ঋকের কাছে গিয়েছিলো | তবে ওকে দেখে ঋক ওর কিছু জিজ্ঞাসা করার আগেই উত্তরটা দিয়ে দিলো , ———
“আসলে রূপকথা , এখন যেহেতু আমাদের রেস্টুরেন্টটা চাইনিজ শেফ এর সাথে এসোসিয়েটেড , তাই অনেক নতুন নতুন চেঞ্জেস করতে হচ্ছে কলকাতা কলিং এ | মানে স্নেহা সব কিছুতেই প্রফেশনাল চায় | ওদের তো একটা ব্র্যান্ড ভ্যালু আছে | তাই একাউন্ট সামলানোর জন্যও একজন ইকোনোমিস্ট কে ই
এপয়েন্ট করেছে | কাল রাতেই আমাকে কল করে ওর এই ডিসিশনের ব্যাপারে জানালো | আমি তখন মুখের ওপর কি বলবো বুঝতে পারছিলাম না | কিন্তু তুই চিন্তা করিস না | আমাকে দু দিন সময় দে, আমি ওদের সাথে কথা বলবো | তুই তো প্রথম থেকে এই রেস্টুরেন্টটার সঙ্গে ছিলিস | তোকে বাদ দিয়ে আমি কিছু করবো না |” আসলে শেষের কথাগুলো বলে ঋক রূপকথাকে বোঝাতে চেয়েছিলো | ওর থমথমে মুখটা দেখে ঋক খুব ভালো করে বুঝতে পারছিলো যে হঠাৎ নিজের জায়গায় অন্য কাউকে দেখে রূপকথার কতটা খারাপ লেগেছে | তবে আর দু দিনের সময় দেয়নি রূপকথা | কিছু দরকার হয়তো এইভাবে সময়ের সাথে সাথে শেষ হয়ে যায় | তখন সেখানে জোর করে পরে থাকার মানে নিজেকে অপমান করা | তাই অন্য কারোর সরিয়ে দেয়ার আগে রূপকথা নিজেই সরে এসেছিলো কলকাতা কলিং থেকে | সেইদিন শান্ত গলায় তাই ঋককে বলেছিলো , ” কারোর সঙ্গে আমার জন্য কথা বলার দরকার নেই তোর | আর স্নেহা যেটা করেছে একদম ঠিক করেছে | আমি আর্টস এর স্টুডেন্ট | একজন প্রফেশনাল যেইভাবে তোর রেস্টুরেন্ট এর একাউন্টটা সামলাবে , সেইভাবে আমি কখনোই কাজ করতে পারবো না | আর আমি প্রথমে কলকাতা কলিং এর সঙ্গে ছিলাম কারণ লোক কম ছিল | আজ তো আর সেটা না | আর সত্যি আজ আমি নিশ্চিন্ত হলাম | অনেক দায়িত্ব ছিল আমার ওপর , আজ তাই ফ্রি হয়ে খুব হালকা লাগছে | যাই হোক , অল দ্যা বেস্ট | আমি আসি এখন |” ..
সেইদিন কথাগুলো শেষ করে রূপকথা আর ঋকের কোনো উত্তরের অপেক্ষা করেনি | জোরে পা চালিয়ে রেস্টুরেন্টের দরজা খুলে বেরিয়ে এসেছিলো |তারপর সামনের দাঁড়িয়ে থাকা বাসটায় কিছু না ভেবেই উঠে পড়েছিল | বাসটা কোথায় যাবে ও জানতো না , শুধু জানতো এই ‘কলকাতা কলিং’ থেকে ওকে অনেকটা দূরে চলে যেতে হবে | আসলে যখন প্রথমে এই রেস্টুরেন্টটা শুরু করেছিল তখন রূপকথা সব কিছুতে এতটা জড়িয়ে গিয়েছিলো ! মেনু ডিসাইড করা থেকে দেয়ালের কি রং হবে , প্রত্যেকটা জিনিস রূপকথার সাজেশন নিয়ে ঋক ঠিক করেছিল | তাই হয়তো নিজের অজান্তেই এই রেস্টুরেন্টটাকে ও নিজের মনে করতো | সেই জন্য কখনো ভাবতে পারেনি যে কারোর ডিসিশনের ওপর ওর এই রেস্টুরেন্ট এ কাজ করা না করাটা ডিপেন্ড করবে | আসলে এই বদলটাই হয়তো পৃথিবীর নিয়ম | আজ যে খুব ইম্পরট্যান্ট , খুব দামি , সময় বদলালে সে মূল্যহীন হয়েও যেতে পারে | না , ওর রাগ হচ্ছে না আজকের এই বদলের জন্য | শুধু খুব কষ্ট হচ্ছে | ভেতরে জমাট বাঁধা একটা কষ্ট | এইসব ভাবনার ভিড়েই সেই মুহূর্তে জানলার ধারের সিটটায় বসে চলন্ত বাস থেকে দৌড়ে চলা রাস্তা ঘাট , মানুষগুলোকে দেখছিলো রূপকথা | আকাশটা এখন খুব মেঘলা করে এসেছে | বৃষ্টি নামবে কিছুক্ষন পর | রূপকথা সেদিন সেই বৃষ্টিটার জন্যই অপেক্ষা করছিলো | বৃষ্টির জলের সঙ্গে নিজের চোখের জলটাকে মিশিয়ে দেয়ার অপেক্ষা | আসলে কান্নাটা তো লুকোনো , খুব নিজের | কারোর সামনে দেখানো যাবে না | তাই বৃষ্টিটাকে এখন খুব দরকার | একদম নিজের করে দরকার |
<৪>
এরপর সময় যেন খুব তাড়াতাড়ি এগিয়ে যেতে থাকলো | ঋকের বিজনেস যত বাড়লো , কলকাতার কলিং এর যতগুলো নতুন নতুন ব্রাঞ্চ ওপেন হতে থাকলো , ততই ওর সঙ্গে কাজের সম্পর্কটা গভীর হতে থাকলো | আসলে বিজনেস একটা নেশা অনেকের কাছে | আর সাকসেস সেই নেশাটা আরোও বাড়িয়ে দেয় | তখন মনে হয় দিনের চব্বিশটা ঘন্টাও কম | দিনটা যদি আর একটু বাড়ানো যেত , কাজটাকে যদি আরো বেশিক্ষন ধরে করা যেত , তাহলে হয়তো লাভের হিসেবটা আর একটু বেশি মেলানো যেত | তাই এই সময়ের পুরোটা জুড়েই ছিল ঋকের কাছে ওর বিজনেস আর রেস্টুরেন্টস | ‘কলকাতা কলিং’ এখন একটা ব্র্যান্ড নেম হয়ে গেছে ফুড ইন্ডাস্ট্রিতে | অনেক ফুড ম্যাগাজিনস থেকে টি.ভি শোস , সব জায়গায় ঋকের রেস্টুরেন্টের নাম , রিসিপির নাম | এর মধ্যে ঋক তিন খানা কুকিং ক্লাসেস শুরু করেছে ইন্ডিয়াতে | ওর স্বপ্নগুলো যে এইভাবে একের পর এক ওর কাছে এসে ধরা দেবে এতো কম সময়ে , ও এটা একদম কখনো ভাবতে পারেনি | তাই সব কিছু ভুলে , সবাইকে ভুলে ও শুধু এই স্বপ্নগুলোকে আঁকড়ে ধরেই বাঁচছিলো | রোজ সকালে উঠে একটাই কথা ওর এখন মনে হয় , আরো একটা স্টেপ ওপরে উঠতে হবে | সাকসেসের সিঁড়িটা অনেক লম্বা | ওকে সব কটা সিঁড়ি পার করে একদম টপ ফ্লোরে পৌঁছে যেতে হবে |
এই সময়ের মধ্যে রূপকথার জীবনে এমন কিছু বদল ঘটেনি শুধু ঋকের রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে আসার পর একটা স্কুলে চাকরি পাওয়া ছাড়া | এখন সময়টা বাচ্চাদের সাথে ভালোভাবেই কেটে যায় | তবে পুরোনো সময়ের কথা মাঝে মাঝেই কারণে অকারণে মনে পরে | ঋকের কথা মনে পরে | কখনো কখনোও আনমনে সেই চেনা নাম্বারটা ডায়েলও করে ফেলে | কিন্তু অনেক সময়ই দু মিনিট কথা হওয়ার পর ঋক ফোনটা কেটে দেয় | আবার কখনো রিং হয়ে যায় , কিন্তু ঋকের আর ফোনটা ধরা হয় না | আসলে এখন তো ওর জীবনে সময়ের খুব অভাব | সারাদিন ঘিরে শুধু ব্যস্ততা আর কাজ | তার মাঝে পুরোনো বন্ধুর সাথে বেশিক্ষন গল্প করা মানে টাইম ওয়েস্ট | আর টাইম ইস মনি , একটা কথাই আছে | ঋকের লাইফে এটাই এখন মূলমন্ত্র | এর মধ্যে ঋক নিজের পুরোনো বাড়ি ছেড়ে নতুন এপার্টমেন্টে শিফ্ট করেছে | তবে সেই এপার্টমেন্টটা প্রথম রূপকথাকেই দেখতে নিয়ে গিয়েছিলো | এই অভ্যেস অবশ্য ঋকের এখনো যায়নি | ওই দেয়ালের রং , থেকে ঘর সাজানো , সেই সবের জন্য রূপকথার সাজেশনটা খুব দরকার ওর | সেইদিন স্পেশালি তাই নিজের সব এপয়েন্টমেন্টস , ইন্টারভিউ , রেস্টুরেন্টের কাজ বন্ধ রেখে রূপকথাদের বাড়ি গিয়েছিলো , তারপর ওকে নিয়ে ঘুরেছিল কখনো পর্দার দোকান , তো কখনো শো পিস্ এর দোকানে | ইন্টেরিয়র ডিজাইনার থাকলেও ঋকের নিউ এপার্টমেন্ট এর প্রত্যেকটা কোনা রূপকথার পছন্দ মতন সাজানো | তবে সেইদিন রূপকথার মুখে হাসি থাকলেও মনটা অন্ধকার ছিল | এই ফ্ল্যাটে শিফ্ট করার পর ঋক আরোও দূরে চলে যাবে | পুরোনো বাড়ি , পুরোনো পাড়া , পুরোনো রাস্তা ছেড়ে অনেক দূরে | আর এখনই ঋকের সময় হয় না একবার ফোন ধরার , এরপর ঠিকানা বদলে গেলে হয়তো মাসে একবারও দেখা টুকুও হবে না | সেইদিন সারাক্ষন শুধু এইসব কথাই মনে হচ্ছিলো রূপকথার | কিন্তু এইসব কথা ওর , একদম নিজের | এগুলো ঋককে বলা যাবে না | আর ঋক তো নিজেও পুরোনো জায়গায় আটকে থাকতে চায় না | নতুন এই এপার্টমেন্টটা ওর ড্রিম হাউস | আর এখন ঋকের যা ইনকাম সেখানে ওকে এই লাইফস্টাইলটাই মানায় | পুরোনো রং ওঠা বাড়ি , চিলেকোঠায় সেই স্যাঁতস্যাঁতে ঘর , আর বৃষ্টিভেজা রোদে পোড়া এক টুকরো ছাদ , এইসব এখন ওর জন্য না | সেইদিন মাঝেই মাঝেই রূপকথা এই কথাগুলো মনে মনে নিজেকে বলছিলো , নিজেকে বোঝাতে চাইছিলো , যে আজ সারাদিন যে ওর পাশে আছে , সে আসলে এখন আর আগের মতন নেই | সে বদলে গেছে | অচেনা নতুন একটা মানুষ হয়ে গেছে | একদম ধরা ছোঁয়ার বাইরে |
এরপর আরোও কয়েকটা মাস কেটে গেছে | এখন ঋকের নতুন ঠিকানা সল্টলেক | তবে রূপকথা আজও বেহালাবাসী | এখন সেই পুরোনো গলি ধরেই হাঁটে | যাই হোক , আজ সেপ্টেম্বরের পাঁচ তারিখ | আজকের দিনটা একটু স্পেশাল | ঋকের জন্মদিন | তবে ঋক এখন কলকাতায় নেই যদিও | কুকিং ক্লাসেস নেয়ার জন্য দিল্লিতে | কিন্তু তাতে কি | রূপকথা আজকের দিনটা ওর সঙ্গে না থাকুক , ১২টার সময় প্রথম উইশটা ও ই করবে | এই ভেবেই সেইদিন হাসি মুখে ঋকের নাম্বারটাতে কল করেছিল | দু চারবার রিং হওয়ার পরই ঋকের গলা ,
” প্রত্যেকবারের মতন এবারও ফার্স্ট উইশটা তোর কাছ থেকেই পাবো , এটা আমি জানতাম | নে, এবার তাড়াতাড়ি হ্যাপি বার্থডে বলে ফেল |”
রূপকথা এটা শুনে একটু হতাশ হয়েই বললো , ” আজও তোর তাড়া ! এই রাত বারোটার সময় কি রাজকার্য করবি শুনি ? এনিওয়ে হ্যাপি বার্থডে , মেনি মেনি হ্যাপি রিটার্নস অফ দ্যা ডে ….. ”
রূপকথার উইশটা পেয়ে ঋকের মুখে এখন চওড়া হাসি , —- ” থ্যাংক ইউ সো মাচ … তোর উইশটা প্রথমে না পেলে দিনটা সত্যি ইনকমপ্লিটই লাগতো | সেই ছোটবেলার অভ্যেস তো | আর এখন আমি কোনো রাজকার্য করবো না | একটা পার্টিতে যাবো | স্নেহা দিল্লিতে এসেছে হঠাৎ | ও ই আমার বার্থডের জন্য পার্টিটা এরেঞ্জ করেছে | এন্ড আই ডোন্ট ওয়ান্ট টু বি লেট্ … বুঝলি এবার | ”
এইসব শুনে রূপকথার আর কিছুই বলার ছিল না | আর সত্যি এর বেশি কথা বাড়িয়ে ঋকের দেরী করিয়ে লাভ নেই | স্নেহা হয়তো অনেক বড়ো পার্টি এরেঞ্জ করেছে , কোনো ফাইভস্টার হোটেলে | সেখানে ওর একটা কলের কি ই বা ইম্পর্টেন্স থাকতে পারে | এই ভেবেই বললো , ” আচ্ছা , রাখছি এখন .. এনজয় দ্যা পার্টি .. ” ,, তবে কথাটা শেষ করে তখনই ফোনটা কাটতে পারেনি | ওর গলা শুনে হয়তো ঋক বুঝেছিলো যে ওর খারাপ লেগেছে , তাই কিছু কথা সাজিয়ে বলেছিলো , —- ” তুই রেগে গেলি না তো ? আসলে পার্টিতে বেশ কিছু ক্লাইন্টও আসবে আমাদের রেস্টুরেন্টের | এই জন্য ঠিকঠাক টাইমে পৌঁছনোটা দরকার | কিন্তু নেক্সট মন্থ তো কলকাতা যাচ্ছি , তখন একদিন তোকে ট্রিট দেব | আর গিফ্টটা কিন্তু মনে করে কিনে রাখিস | ওটা ছাড়ছি
না |”……রূপকথা জোর করে হেসেই এর উত্তরটা দিলো , ” আমার দেয়া গিফ্ট এখন তোর স্ট্যান্ডার্ডের হবে না | যাই হোক , রাখছি | যা পার্টিতে, আর দেরী করিস না |” ,.. এরপর আর কোনো কথার অপেক্ষা না করেই রূপকথা ফোনটা কেটে দিয়েছিলো | এই মুহূর্তে ওর অজান্তেই ওর চোখটা ভিজে | আজও যে ঋকের এতো তাড়া থাকবে ভাবতে পারেনি | মনে হচ্ছিলো এখন ঋককে ফোন করার মানে যেন ওকে ডিস্টার্ব করা |
(৫)
সেদিনের পর কেটে গেছে ছটা মাস | ঋকের কুকিং ক্লাস এর এখন খুব নাম | আর রিসেন্টলি ও ‘সাউথ ইন্ডিয়ান কুইজিন’ নিয়ে একটা বইও লিখেছে | আর এই বই এর হাত ধরেই চেন্নাইয়ে ওর প্রথম রেস্টুরেন্টটা ওপেন হয়ে গেলো আজকে | তাই সারাদিন জুড়েই ছিল ব্যস্ততা | বেশ কিছু লোকাল পেপার , ম্যাগাজিন থেকে জার্নালিস্টরা এসেছিলো এই ওপেনিং সেরিমনিতে | সঙ্গে একটা ছোট্ট স্টেজ শো ও অর্গানাইজ করা হয়েছিল | এইসবের মধ্যে ঋকের আজ শ্বাস নেয়ারও টাইম নেই যেন | এতো এতো লোককে এটেন্ড করা ! আর সব কিছু আজ পারফেক্ট হতে হবে | অনেক টাকার ইনভেস্টমেন্ট আছে এই রেস্টুরেন্ট এ | তাই আজ শুরুর দিনে কোনো গন্ডগোল হলে চলবে না | এইসব চিন্তাই সারাক্ষন ঘুরছিলো মাথায় | কিন্তু এইসবের মধ্যে রূপকথার নাম্বার থেকে বার বার ফোন আসছে আজ | সেই দুপুর বারোটা থেকে | প্রথম তিন চার বার কেটে দিয়েছিলো | আসলে তখন ওকে কিছু ইন্টারভিউ দিতে হচ্ছিলো , এই রেস্টুরেন্টের মেনু , রেসিপি এইসবের ব্যাপারে | তার মাঝে বার বার ফোনটা বেজে উঠছে , জার্নালিস্টরাও বিরক্ত হচ্ছে | তাই ভেবেছিলো তিন চার বার ফোন কেটে দিলে রূপকথা নিশ্চই বুঝবে যে ও এখন ব্যস্ত আছে | কিন্তু না | তার তো বোঝার নামই নেই | এতবার ফোন কেটে দেয়ার পরও আবার কল করছে | তাই পাঁচ বারের বার ঋক অনিচ্ছা সত্ত্বেও ফোনটা তুললো , তবে রূপকথাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই বললো , ——- ” উফফ , কেন বার বার ফোন করছিস | আমি এখন কথা বলতে পারবো না , বিজি আছি | তোকে রাতে কল করবো | রাখছি |” ……. কথাটা শেষ করেই ফোনটা কেটে দিয়ে আবার ইন্টারভিউতে মন দিলো | কিন্তু দু সেকেন্ডের মধ্যে আবার ফোনটা বেজে উঠলো | স্ক্রিনে সেই এক নাম্বার | রূপকথা | এবার ঋকের মাথাটা গরম হয়ে গেছে | এতবার ফোন কাটলো , তারপর এটাও বললো যে ও এখন ব্যস্ত আছে , তারপরেও বুঝছে না | আবার ফোন করছে | তাই এবার খুব বিরক্ত হয়েই ফোনটা ধরলো ,
” ঋক প্লিজ , তুই একবার আমার কথাটা শোন | আমার….. ” .. না , রূপকথার কথাকে শেষ হওয়ার সুযোগ না দিয়েই ঋক রেগে বলে উঠলো , ” তুই থামবি প্লিজ | তোর ফোনটা এতবার কাটলাম , বললামও যে ব্যস্ত আছি , তাও তোর মাথায় ঢুকলো না কথাটা | আর তোর মতন একটু বাচ্চাদের পড়িয়ে সারাদিন ফ্রি হয়ে তো আর ঘুরে বেড়াই না , অনেক টেনশনের কাজ থাকে আমার | এনিওয়ে প্লিজ এইভাবে যখন তখন আমাকে ফোন করবি না | তোর সাথে গল্প করার সময় নেই এখন আমার | রাখছি | ”
কথাটা শেষ করেই ঋক ফোনটা কেটে দিলো | তারপর আবার ব্যস্ত হয়ে গেলো ইন্টারভিউ দিতে | না , এরপর আর সারাদিন ঋকের ফোন রূপকথার নাম্বারটা ভেসে ওঠেনি | আর রূপকথা ওকে ফোন করেনি একবারও | সারাদিনের ব্যস্ততার শেষে হঠাৎ রাত্রিবেলা এই কথাটা মনে হলো ঋকের | তখন কি একটু বেশিই রুডলি কথা বলেছে ! আসলে আজ এই নতুন রেস্টুরেন্টের ওপেনিং এর জন্য ওর মাথায় এতো টেনশন ছিল , তাই একটুতেই মাথাটা গরম হয়ে গেলো | রূপকথার কি খুব খারাপ লেগেছে , তাই আর একবারও ফোন করেনি ! এই ভেবেই ঋক রূপকথার নাম্বারটায় কল করলো | একবার , দুবার , বার বার রিং হয়ে কেটে গেলে | ঋক আবার ফোন করলো , কিন্তু এবারও তাই | ওপাশ থেকে কেউ আর ফোনটা ধরলো না | এবার ঋকের চিন্তা হচ্ছে | তাহলে কি খুব রেগে গেছে ! সেই জন্য একবারও ওর কল রিসিভ করছে না | না , কলকাতায় ফিরেই রূপকথার বাড়িতে যেতে হবে | ও সামনে গিয়ে দাঁড়ালে আর রেগে থাকতে পারবে না | এইসবই ভাবছিলো , তখনই ফোনটা বেজে উঠলো | স্ক্রিনে ওর মায়ের নাম্বার | ফোনটা ধরতেই একটা কান্নাভেজা গলা , ———– ” তুই এইভাবে রূপকথার ফোনটা কেটে দিতে পারলি ঋক ? এতো কাজ তোর | একবারও একটা কথা শোনার মতন সময় নেই | তুই এতটা ইনসেন্সিটিভ কবে হোলি ? সত্যি , টাকা মানুষকে এতো বদলে দেয় !”
মায়ের মুখে হঠাৎ এতো কড়া কড়া কথা শুনে ঋক অবাক , —— ” তুমি এইভাবে কেন বলছো মা ? কি হয়েছে ? ”
” সকালে রূপকথার মায়ের একসিডেন্ট হয়েছিল ঋক | নার্সিং হোমের দরজায় দাঁড়িয়ে ও তোকে বার বার ফোন করছিলো | নার্সিং হোমের এডমিশন ফি ই ছিল আশি হাজার টাকা | ও পঞ্চাশ হাজার মতন জোগাড় করতে পারলেও বাকি টাকা কিছুতেই ম্যানেজ করতে পারেনি | তাই তোকে বার বার ফোন করছিলো , যদি তুই ত্রিশ হাজার টাকা ওর ব্যাংক একাউন্টে ট্রান্সফার করে দিতিস তাহলে এডমিশনটা হয়ে যেত | কিন্তু তুই কিছু শুনলিই না, কেটে দিলি ফোনটা ! এতো কাজ তোর ! ”
<চলবে>

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here