যখন নীরবে দূরে,পর্ব:৩

যখন নীরবে দূরে (শেষ পর্ব)
ঈপ্সিতা মিত্র
(৬)
মায়ের মুখে এইসব কথা শুনে ঋক যেন আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলো না | হঠাৎ একটা ধাক্কা লেগেছে ওর | পাশের চেয়ারটা ধরে কোনো মতে নিজেকে সামলালো | কি করে এতো বড়ো একটা ভুল করলো ! কি করে ও ওই সময়ে ফোনটা কেটে দিলো ! নিজের ওপর এখন লজ্জা হচ্ছে , রাগ হচ্ছে | নিজেকে দেয়ার মতন আজ আর কোনো উত্তর নেই ওর কাছে | তখনই মা আবার বলে উঠলো , ——— ” আমি সেই সময়ে সিউড়িতে ছিলাম , একটা ঠাকুরের আশ্রমে | ফোনটা বাড়িতে ফেলে গিয়েছিলাম | সন্ধ্যেবেলা ফিরে সব কিছু জানতে পারি | রূপকথার বাবা সেই কোন ছোটবেলায় মারা গিয়েছিলো | তারপর থেকে তো ওরা মা মেয়ে একা | আর একটা সময় যখন আমাদের খারাপ সময় ছিল , তখন প্রত্যেকটা মিনিট , প্রত্যেকটা সেকেন্ড রূপকথা আমাদের সঙ্গে থেকেছে | সাপোর্ট করেছে | আর আজ যখন হসপিটালে গিয়ে ওর মুখে তোর এই ব্যবহারের কথা শুনলাম তখন নিজের লজ্জা হচ্ছিলো | চোখ মেলাতে পারছিলাম না আমি ওর সাথে , যে শুধুমাত্র একটা দিন ওই মেয়েটার দরকারে আমরা ওর পাশে থাকতে পারলাম না | যাই হোক , আর তোকে এইসব বলে কোনো লাভ নেই | শুধু একটাই কথা , জানি না এটা তুই আজ বুঝবি কি না , কিন্তু তুই খুব বড়ো একটা ভুল করলি | আর এই ভুলের খুব বড়ো একটা দাম তোকে দিতে হবে | আর সেদিনই হয়তো তুই বুঝবি বিজনেস , সাকসেস , টাকা পয়সা এইসবের থেকে অনেক বেশি ইম্পরট্যান্ট একটা কাছের মানুষ |” .. কথাটা শেষ করেই সেইদিন ঋকের মা ফোনটা কেটে দিয়েছিলো | কিন্তু সেই মুহূর্তে ঋকের চারিদিকটা যেন অন্ধকার হয়ে আসছিলো | সত্যি , এতটা হিসাবি ও কবে হয়ে গেলো ! একটা সেকেন্ড ও দিতে পারলো না রূপকথাকে ! রূপকথা কতবার ফোন করলো , রিকুয়েস্ট করলো একবার ওর কথা শোনার জন্য , আর ঋক তার বদলে অতো কথা শুনিয়ে ফোনটা কেটে দিলো মুখের ওপর | এতো খারাপ একটা সময়ে এইভাবে রূপকথাকে একা করে দিলো | ভাবনাগুলো আসতেই ঋক আবার রূপকথার নাম্বারে ফোন করলো | শুধু একবার ওর গলা শুনতে চায় এখন | একবার ওকে সরি বলতে চায় | রূপকথার হাতটা শক্ত করে ধরতে চায় | কিন্তু , এবারও ফোনটা রিং হয়ে হয়ে কেটে গেলো | এরপর ঋক যতবার ফোন করলো ততবারই ওপার থেকে এলো নিঃস্তব্ধতা | সেই চেনা গলার আওয়াজটা যেন হঠাৎ থেমে গেছে | শেষ হয়ে গেছে বলে মনে হলো ঋকের | তাহলে কি রূপকথার সাথে ওর সব কথা আজ শেষ ! এরপর কি আর কখনো এই নিঃস্তব্ধতা ভাঙবে না | ওই চেনা গলার আওয়াজটা , ওই পুরোনো কথাগুলো আর ফিরে আসবে না ! এইসব ভাবতেই ওর চারিদিকটা আবছা হয়ে এলো | চোখে হঠাৎ জল জমেছে | কাউকে হারিয়ে ফেলার জল |
পরের দিন সকালের ফার্স্ট ফ্লাইট ধরেই ঋক এসে পৌঁছেছিল কলকাতায় | তারপর এয়ারপোর্ট থেকে সোজা হসপিটাল এ গিয়েছিলো | রূপকথার সাথে দেখা হওয়াটা এখন খুব দরকার | একবার ওর মুখোমুখি হয়ে ওকে সরি বলতেই হবে | সেইদিন এইসব ভেবেই হসপিটালের জেনারেল ওয়ার্ডের দরজায় এসে দাঁড়িয়েছিল ঋক | দেখেছিলো সামনের বেঞ্চটায় থমথমে মুখে রূপকথা বসে | চোখ মুখে ক্লান্তির ছাপ স্পষ্ট | বোঝা যাচ্ছে যে অনেক বড়ো একটা ঝড় পেরিয়ে গেছে ওর ওপর দিয়ে | ঋকের রূপকথার এই চেহারা দেখে নিজের ওপর আরোও রাগ হচ্ছে | কাল কি পরিস্থিতিতে রূপকথা ওকে বার বার ফোন করেছিল ! আর ও এতো খারাপ ব্যবহার করলো | এইভাবে একা করে দিলো এতো বড়ো একটা ক্রাইসিসের সময়ে ! কথাটা ভেবে ওর চোখ দুটো মাটিতে নেমে যাচ্ছিলো , লজ্জায় | কিন্তু এখন আর রূপকথাকে একা থাকতে দেবে না | আজ ও এসেছে রূপকথার হাতটাকে শক্ত করে ধরার জন্য | এখনো হয়তো খুব দেরী হয়নি ! এইসব ভেবেই ঋক রূপকথার কাছে গেলো | হঠাৎ ঋককে সামনে দেখে রূপকথা অবাক ! তবে রূপকথার কিছু বলার আগেই ঋক বলে উঠলো ,
” আই এম রিয়ালি সরি রূপকথা ..রিয়ালি ভেরি সরি .. আমি আসলে ভাবতে পারিনি যে এই রকম কিছু হতে পারে ! কাল না বুঝে ফোনটা কেটে দিয়েছিলাম | প্লিজ এটাকে মনে রাখিস না | আমি এখন সব ব্যবস্থা করে দেব | কাকিমাকে এই সরকারি হসপিটালে থাকতে হবে না | আমি কলকাতার বেস্ট নার্সিং হোমে নিয়ে যাবো , বেস্ট ডাক্তার দিয়ে ট্রিটমেন্ট করাবো | দেখবি সব ঠিক হয়ে যাবে | কাকিমা একদম সুস্থ হয়ে যাবে | ” …….. কথাগুলো সেদিন এক নিঃশ্বাসে বলে গিয়েছিলো ঋক | তবে রূপকথা চুপ ছিল | খুব মন দিয়ে শুনছিলো এতক্ষন ধরে ওর কথা | কিন্তু এই ‘কাকিমা একদম সুস্থ হয়ে যাবে’ কথাটা শুনে আর চুপ থাকতে পারলো না | কারণ এরপর আর চুপ থাকা যায় না | তাই শান্ত গলায় ঋককে বলেছিলো , ” কাল আমার মা আমার সামনে যন্ত্রনায় ছটফট করছিলো | সারা শরীর থেকে মায়ের রক্ত পড়ছিলো , যখন আমি তোকে কল করেছিলাম | এক বার , দু বার , বার বার | তখন আমি লাইফ কেয়ার নার্সিং হোমে ছিলাম | এডমিশনের জন্য ত্রিশ হাজার টাকা কম পড়ছিলো | ফোনবুকে বেশ কিছু আত্মীয় স্বজনের নাম্বার ছিল | কিন্তু আমি ভেবেছিলাম তারা ফিরিয়ে দিলেও তুই ফেরাবি না | একচুয়ালি একটা বিশ্বাস ছিল | তোর ভুল না , আমার ভুল | প্রথম থেকে | এতো বিশ্বাস আসলে কখনো কাউকে করা উচিত না | যাই হোক , তোর শেষবার ফোন কেটে দেয়ার পর মা কে নিয়ে এক নার্সিং হোম থেকে আর এক নার্সিং হোম করেছি | লাস্ট এ এখানে , সরকারি হসপিটালে অনেক কষ্টে একটা বেড এরেঞ্জ করতে পারলাম | কিন্তু ততক্ষনে অনেক দেরী হয়ে গেছিলো | এতটা ব্লিডিং হয়েছিল যে মায়ের কোমরের নিচ থেকে পুরোটা প্যারালাইসিস হয়ে গেছে | কোনো সার নেই | ডাক্তার বলেছে হয়তো আমার মা কখনো আর উঠে দাঁড়াতে পারবে না | চলতে পারবে না | এতগুলো কথা বলতাম না | যদি না নিজের সময় খরচ করে তুই হসপিটাল অব্দি আসতিস ভদ্রতা করতে , সান্ত্বনা দিতে | যাই হোক ,এখানে আসার জন্য , এতো ভদ্রতা করার জন্য থ্যাংক ইউ সো মাচ .. এবার তুই আসতে পারিস | আসলে এটা তো সরকারি নার্সিং হোম , সাধারণদের জায়গা | তোর মতন অসাধারণ কাউকে এখানে ঠিক মানাচ্ছে না | ” …. কথাটা শেষ করে আর এক সেকেন্ডও রূপকথা ঋকের সামনে দাঁড়িয়ে থাকেনি | করিডোর থেকে নিচে রিসেপশনে নেমে এসেছিলো | কিছু সময় কিছু মানুষের সাথে দূরত্ব এতটাই বেড়ে যায় যে তাকে চোখের সামনে দেখতেও ইচ্ছে করে না | কিন্তু ঋক ওই লোকজনের ভিড়ে , করিডোরটায় দাঁড়িয়ে ছিল একা , অনেক্ষন | আজকে নিজের ভুলের হিসেবে মেলানোর চেষ্টা করছে ও | প্রথম থেকে যতবার ঋকের দরকার হয়েছে , রূপকথা কিছু না বলে , চুপচাপ , ঋকের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে | শক্ত করে ধরে রেখেছে ওকে | আর আজ , একবার , শুধুমাত্র একবার যখন রূপকথার ওকে দরকার ছিল , তখন ও কনেকশনটাই কেটে দিলো ! নিজের হাতে শেষ করে দিলো ওদের এতো বছরের বন্ধুত্বকে !
(৭)
রূপকথা ভেবেছিলো সেইদিনই ঋকের সাথে ওর শেষ দেখা হবে | আর এখন তো ঋক সময়ের খুব হিসেবি | তাই ওর আর কোনো দ্বায় নেই বার বার হসপিটালে এসে সময় নষ্ট করার | এইসব ভাবনাকে সঙ্গে করেই পরের দিন মায়ের জন্য দুপুরের খাবার নিয়ে গিয়েছিলো হসপিটালে , কিন্তু কেবিনের দরজার সামনে এসেই পা টা থমকে গেলো | ঋক ওর মায়ের পাশে বসে | এই দৃশ্য দেখার জন্য ও একদমই তৈরী ছিল না | আর এই মানুষটাকে দেখার ইচ্ছেও আর বিশেষ নেই | মনে হয় কালকের সান্ত্বনার কোটা কমপ্লিট হয়নি , তাই আজকে আবার এসেছে | ভেবেই রূপকথার মুখটা খুব কঠিন হয়ে গেলো | কিন্তু ওর কিছু বলার আগেই মা বলে উঠলো , ” রূপকথা আর না | ঋক কালও এসেছিলো | কিন্তু তুই না কি ওকে দেখা না করেই চলে যেতে বলেছিস ! দ্যাখ , যা হয়েছে সেটা তো ও ইচ্ছে করে করেনি | ও যদি জানতো যে আমার একসিডেন্ট হয়েছে তাহলে কি সাহায্য করতো না ! আর সব জেনে তো ও সেই চেন্নাই থেকে এসেছে | তুই রেগে থাকলেও এরপর আমি আর রেগে থাকতে পারবো না | সেই ছোট্ট থেকে দেখেছি ওকে | আমি জানি ও আমাকে কতটা ভালোবাসে |” .. এইসব শুনে রূপকথার রাগটা আরো বাড়লো ঋকের ওপর | আসলে ঋক জানে যে ওর মা কতটা নরম | তাই ভেবেছে মা বোঝালেই সব ঠিক হয়ে যাবে | কিন্তু রূপকথার জন্য যখন কিছু শেষ হয় , সেটা সারা জীবনের জন্যই শেষ হয় | তাই কিছু কথা সাজিয়ে ঋককে উদ্যেশ্য করে ওর মা কে বললো , ” তোমার যার সাথে কথা বলার ইচ্ছে হয় বলো | আমি একদম বারণ করবো না | কারণ আমি আর তুমি তো আলাদা মানুষ | আমার ঠিক ভুলগুলো তোমার সাথে এক না ই হতে পারে | কিন্তু আমার সাথে এই ব্যাপার নিয়ে প্লিজ কখনো কোনো কিছু বোঝাতে এস না | যেটা বোঝার দুদিন আগেই আমি বুঝে গিয়েছি | আর আমি বাইরে আছি করিডোরে | তোমার এই নামি দামি অতিথি চলে গেলে বোলো , আমি তখন আসবো |” … কথাটা শেষ করেই রূপকথা ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো | ঋকের চোখটা এখনো ঝাপসা হয়ে আসছে | জল না চাইতেও বার বার চোখে এসে ভিড় করছে | কোনোদিনও ভাবেনি যে রূপকথা কখনো ওকে এইভাবে এভয়েড করবে ! এইভাবে মুখ ফিরিয়ে নেবে | কিন্তু যা হয়েছে সেটা তো ওর ভুলের জন্যই হয়েছে | আর যে ভাবেই হোক , ওকে ওর এই ভুলটা ঠিক করতেই হবে |
এইসবের মাঝেই তিনটে সপ্তাহ চোখের পলকে কেটে গেলো | আজ রূপকথার মা হসপিটাল থেকে বাড়ি আসবে | ঋক আজ এই এক্সিডেন্টের পর প্রথম রূপকথাদের বাড়ি গেলো | এর মাঝে রোজ যখনি ও হসপিটালে গেছে , রূপকথা ওকে দেখেই ঘর থেকে বেরিয়ে গেছে | জানে না আজ বাড়ি গেলে কি হবে ! কিন্তু যা হবে , ও সেটা একসেপ্ট করবে | ওর এতো বড়ো ভুলের পর এই রাগ , এই ব্যবহারই পাওয়ার কথা | এইসব ভেবেই কলিংবেলটা বাজালো | কিছুক্ষনের মধ্যে রূপকথাই দরজা খুললো | অন্যদিন যেমন ঋক এলে রূপকথার হাসি মুখ থাকতো , আজ দৃশ্যটা পুরোই অন্য | রূপকথার মুখে আজ কোনো হাসি নেই | বরং খুব গম্ভীর | ঋক জানে যে ওর এখানে আসাটা রূপকথার একেবারেই ভালো লাগেনি | কিন্তু ঋক না এসে থাকতেও পারবে না | তবে সেইদিন দরজায় দাঁড়িয়ে ঋককে তিন সপ্তাহ বাদে প্রথম রূপকথা কিছু বলেছিলো , খুবই আস্তে আর দৃঢ় গলায় , ” দ্যাখ ঋক , আমি আর আমার মা কোনো চ্যারিটি কেস নোই | ভদ্রতা করছিস , সমবেদনা জানাচ্ছিস , ওই অব্দিই ঠিক আছে | কিন্তু ট্রাস্ট মি , তোর কোনো রকম হেল্প এর আর আমাদের দরকার নেই | আর আমি আমার মা কে কোনো ব্যাপারে দুঃখ দিতে চাই না | তাই তোর এই বাড়িতে আসা নিয়ে আমি কখনো কোনো আপত্তি করবো না | কিন্তু তোর মতন হাই প্রোফাইল লোকেদের তো আবার মাঝে মাঝে মহান সাজতে ইচ্ছে করে, তাই আগে থেকেই বলে রাখলাম প্লিজ , চ্যারিটি করার জন্য অন্তত এখানে আসবি না কখনো |”
… কথাগুলো শেষ করে রূপকথা আর এক সেকেন্ডও অপেক্ষা না করে নিজের ঘরে চলে গেলো | কিন্তু ঋকের পা টা যেন আজ আর এগোচ্ছে না | কবে এতো খারাপ , এতো হিসেবি ভেবে ফেললো রূপকথা ওকে ! একদিনের একটা ভুলের জন্য তো কারোর চোখে এতো নিচে নেমে যাওয়ার কথা না ! তাহলে কি ওই একদিনটা বাদেও আরও অনেকদিন আছে ,আরোও অনেক খারাপ লাগা আছে , যেগুলো মিলিয়েই রূপকথা আজ এতো দূরে চলে গেছে ! কথাটা ভেবে ঋক যেন আজ থমকে গেছে | এতদিন যেই কাজের নেশাটা ওকে সারাদিন ঘিরে থাকতো , আজ আর সেটা নেই | আজ আর ইচ্ছে করে না সকালে উঠে এটা ভাবতে , যে আর একটা সিঁড়ি ওপরে উঠতে হবে | আজ সকাল সন্ধ্যে শুধু থাকে একটা ফাঁক , একটা একাকিত্ব | লোকের ভিড়ে , কাজের ব্যস্ততায় , সবার মাঝে , সকাল , বিকেল , সন্ধ্যে , রাত জুড়ে থাকে সেই একাকিত্ব | মাঝে মাঝে মনে হয় যদি কোনো ভাবে আগের সময়ে ফিরে যেতে পারতো , সেই চিলেকোঠার ছাদে , সেই পুরোনো ভাঙাচোরা রাস্তাগুলোতে , তাহলে আর কখনো আগের ভুলগুলো করতো না , সেই সময়টাকে কোনোভাবেই আর যেতে দিতো না ! .
এখনো ও রোজ রূপকথাদের বাড়িতে যায় | বেশিরভাগই সকালে , এগারোটার পর | আসলে ওই সময়ে গেলে রূপকথা স্কুলে চলে যায় , বাড়িতে তখন শুধুই ওর মা | আসলে এখন রূপকথার মুখোমুখি হলে কিছুতেই চোখ দুটো তুলে রাখতে পারে না ঋক | সেটা মাটিতে নেমেই যায় | রূপকথাও ঋককে দেখলে যতটা সম্ভব দূরে থাকার চেষ্টা করে | কখনো কখনো সন্ধ্যেবেলা ঋক ওদের বাড়িতে এলে ও নিজের ঘরের দরজা বন্ধ করে থাকে | মাঝে মাঝে ঋকের থমথমে মুখটা দেখে খারাপ লাগে ! মনে হয় যে যা হয়েছে তারপর ঋক ভালো নেই | আগের মতন নেই | কিন্তু যখনই মা কে হুইলচেয়ারে বসে থাকতে দেখে , তখনই এই ভাবনাগুলো মন থেকে মিলিয়ে যায় রূপকথার | বার বার মনে হয় , মাত্র ত্রিশ হাজার টাকা সেদিন ঋক দিতে পারেনি | আর তার দাম আজ ওর মাকে দিতে হচ্ছে , সারাক্ষন এক জায়গায় বসে থেকে ,নিথর দুটো পা কে সঙ্গী করে | এরপর আর ঋকের সাথে ওর কথা বলা সম্ভব না কখনো | এই নিঃস্তব্ধতাটাই আজ ওদের মধ্যে সব থেকে বড়ো সত্যি | আসলে কিছু জিনিস কখনো চাইলেও ভোলা যায় না | দুজনের মাঝখানে খারাপ লাগা , যন্ত্রণার একটা মোটা কাঁচের দেয়াল তৈরী হয়ে যায় | যেই দেয়ালে দুপাশে দাঁড়িয়ে একে অপরকে পরিষ্কার দেখা গেলেও , আর ফিরে যাওয়া যায় না | চুপচাপ , নীরবে , দূরেই থাকতে হয় |
(৭)
এই দূরত্বের দেয়ালের দুপাশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে এখন একটা বছর কেটে গেছে , দেখতে দেখতেই | আজ সেকেন্ড নভেম্বর… রূপকথার জন্মদিন | দূর্গা পুজো শহর ছেড়ে কিছুদিন আগে চলে গেলেও , শরতের নীল আকাশ , সোনালী রোদেরা এখনো ঠিকানা বদলায়নি | তারা আজও এই শহরেরই বাসিন্দা | সকালের আকাশটা দেখতে দেখতে রূপকথার আজ এইসবই মনে হচ্ছিলো | স্রান করে রেডি হয়ে নিয়েছে এখন ও | এরপর পুজো দিতে যেতে হবে মন্দিরে | অন্যবার মা সঙ্গে যায় | কিন্তু এবার তো আর সেটা সম্ভব না | যাই হোক , ও নিজেই যাবে , মায়ের হয়ে নিজের নামে পুজো দেবে | এই ভেবেই ড্রইং রুমে এলো | কিন্তু হঠাৎ মা কে দেখে পা টা কেমন থেমে গেলো | প্রত্যেকবারের মতন এবারও মা স্রান করে ভিজে চুলে নতুন তাঁতের শাড়ি পরে ওর সামনে দাঁড়িয়ে ! হ্যাঁ দাঁড়িয়ে | হুইল চেয়ারটা আজ দূরে একটা কোনায় পরে আছে |মায়ের যেন তার সাথে আর কোনো সম্পর্কই নেই | রূপকথা যেন চোখকে বিশ্বাসই করতে পারছে না যে এটা সম্ভব | এর মধ্যে ওর চোখের পলকে মা হাসি মুখে ওর সামনে হেঁটে এসে সেই প্রত্যেক বছরের মতন বলে উঠলো , ” কিরে হা করে দাঁড়িয়ে দেখছিস কি ! যাবি না মন্দির ? আমি কিন্তু একদম রেডি ..” … রূপকথার এখনো যেন কিছু বিশ্বাস হচ্ছে না | ও কি স্বপ্ন দেখছে ! ওর মা ওর সামনে দাঁড়িয়ে , হেঁটে চলে বেড়াচ্ছে ! .. রূপকথার মুখের এক্সপ্রেশনটা দেখে ওর মা আবার বলে উঠলো ,
” না , তুই স্বপ্ন দেখছিস না | যা হচ্ছে একদম বাস্তবেই হচ্ছে | এবার তো হাস | এক বছর ধরে তোর ওই গোমড়া মুখ দেখতে দেখতে আমি ক্লান্ত |”
এইসব শুনে রূপকথার ঘোর কাটলো | নিজেকে সামলে কিছু কথা সাজিয়ে বললো , — ” কিন্তু এটা কি করে সম্ভব হলো ? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না |”
রূপকথার মা এবার হেসে ফেললো , ” তোর বোঝার কথাও না | তোকে সারপ্রাইজ দেয়ার জন্যই তো আমি ইচ্ছে করে কিছু বুঝতে দিইনি | তবে পুরো আইডিয়াটাই ঋকের ছিল | আর আজ যে আমি একদম ঠিক হয়ে গিয়েছি , সেটাও ওর জন্যই | তুই স্কুলে পড়াতে চলে যাওয়ার পর ঋক রোজ আমাদের বাড়ি আসতো | ও কলকাতার বেস্ট ডাক্তারদের ,বেস্ট ফিজিওথেরাপিস্ট কে এপয়ন্ট করেছিল আমার ট্রিটমেন্টের জন্য | তুই চলে গেলে ঋক আমাকে তাদের কাছে নিয়ে যেত , আবার কখনো তারা আমাদের বাড়ি এসেই আমাকে দেখতো | এই ভাবে রোজ একটু একটু চেষ্টা করতে করতে একদিন দেখলাম হাঁটতে পারছি | আর আমার চেনাটাই ঠিক ছিল কিন্তু | ঋক কখনোই একজন খারাপ মানুষ না | আর এরপর ওকে দেখে ঐরকম ব্যবহার করিস না | সেইদিন যেটা হয়েছিল সেটা তো ও ইচ্ছে করে করেনি | ও জানতো না আমার একসিডেন্ট হয়েছে | তাই না বুঝে ফোনটা কেটে দিয়েছিলো | আর এই এক বছরে ওই একটা ঘটনা ঋককে কতটা এফেক্ট করেছে , সেটা আমি দেখেছি | এতো চুপচাপ , ও আগে ছিল না | হ্যাঁ , মানছি ও না বুঝে একটা ভুল করেছিল | কিন্তু কজন পারে নিজের ভুলটাকে ঠিক করতে ! তাই বলছি , আর রেগে থাকিস না |”
এইসবের মধ্যে হঠাৎ রূপকথাদের বাড়ির কলিংবেলটা বেজে উঠলো | দরজা খুলতেই ঋকের মা , হাতে আবার দুটো প্যাকেট | রূপকথা ঠিক কিছু বুঝতে পারছিলো না | তখন ঋকের মা ই বলে উঠলো , ” এই প্যাকেট দুটো তোর জন্যই এনেছি | দুটো ব্ল্যাকফরেস্ট কেক আছে | স্পেশালি তোর জন্মদিনের জন্য|” .. কথাটা শুনে রূপকথার হঠাৎ সেই পুরোনো কথাটা মনে পড়লো | রূপকথা তো একদিন ঋকের কাছে দুটো ব্ল্যাকফরেস্ট কেকই চেয়েছিলো ! তাহলে কি ঋকই এগুলো পাঠিয়েছে ! না , এতো কিছুর পর একবার ঋকের সাথে দেখা করতেই হবে | অনেকদিন ও দরজা বন্ধ করে থেকেছে | আজ সেই দরজাটা খুলে ঋকের কাছে যেতেই হবে | এই ভেবেই জিজ্ঞেস করলো , ” কাকিমা , ঋক কোথায় ? আমি যাবো ওর কাছে | অনেকদিন কথা বলিনি | কিন্তু আজ আর না|” ….. কথাটা শুনে ঋকের মা আলতো হেসে বললো , – ” যাক , রাগ কমেছে তাহলে ! বাঁচা গেলো | আর ঋক কোথায়ই বা থাকবে | সেই পুরোনো চিলেকোঠার ঘরে , ছোটবেলায় ঝগড়া হলে যেখানে বসে থাকতো , আজও সেখানেই আছে |” ……..
এরপর আর রূপকথা এক মুহূর্তও দেরি করলো না | সেই ভাঙাচোরা রাস্তা , পুরোনো গলিটা পেরিয়ে এখন ও ওই রং ওঠা বাড়ির সামনে এসে হাজির | সেই পুরোনো চিলেকোঠার ঘরটা আজও ওকে ডাকছে , একদম পুরোনো দিনগুলোর মতন | রূপকথা সিঁড়ি দিয়ে উঠে , সেই চিলেকোঠার ঘরের দরজাটা এক ধাক্কায় খুলে দিলো | ভাঙা ফার্নিচার , পুরোনো দিনের ফটো ফ্রেম , শিক দেয়া ওই জানলাটার মাঝে সেই ছেলেটা দাঁড়িয়ে , আজও , একদম আগের মতন | মনে হলো , কত বছর যেন কেটে গেছে ওদের মাঝখান দিয়ে ! কত সময় পেরিয়ে গেছে এই চিলেকোঠার ঘরে পুরোনো দেয়ালগুলোকে সঙ্গী করে !আজ আবার একটা আলোকবর্ষ বাদে সেই কাঁচের দেয়াল ভেঙে ওরা এখন মুখোমুখি | আজ রূপকথাই নিঃস্তব্ধতা ভেঙে ভিজে গলায় প্রথম বললো ,
” মায়ের জন্য অতো কিছু করলি , আর আমাকে একবারও বললি না কেন ? ”
ঋকের চোখ দুটোও আজ জলে ঝাপসা | তা ও দুটো কথা সাজিয়ে বললো , ” বললে তো ভাবতিস চ্যারিটি করছি | তা ও যাক , এতদিন বাদে তোর গলার আওয়াজটা এট লিস্ট শুনতে পেলাম ! নইলে এতদিন তো পুরো সাইলেন্ট মোডে ছিলিস | যাই হোক , আরও যদি কিছু কথা শোনানোর থাকে , শুনিয়ে ফেল | মনে রাখিস না প্লিজ আর কিছু |”
এবার রূপকথার চোখের জলের সঙ্গে একটা রাগ ও এসে জমা হলো , ” থামবি তুই ! বেশ করেছি কথা বলিনি | আর তুই কি করেছিস তার আগে ? ফোন করলে দু মিনিট কথা বলেই নাইন্টি পার্সেন্ট টাইম রেখে দিতিস | সারাক্ষন কাজ আর কাজ | জন্মদিনে উইশ করলাম , তখনও তাড়া ! কে না কে বার্থডে পার্টি দিয়েছে , সেখানে যেতে হবে |”
রুপকথার একসঙ্গে এতগুলো কমপ্লেন শুনে ঋক আর চুপ থাকতে পারলো না … ” আচ্ছা ঠিক আছে সরি | পুরোনো সব কিছুর জন্য সরি | আর কখনো এই ভুল গুলো রিপিট করবো না প্রমিস | আর ‘কে না কে’ বার্থডে পার্টি দিলেও আমি বলবো আমি যেতে পারছি না | তোর থেকে বেশি পাত্তা আমি আর কাউকে দেব না, সত্যি | আজ আমি শপথ করলাম | ”
এইসব শুনে রূপকথা আর না হেসে থাকতে পারলো না | অনেকদিন বাদে সেই পুরোনো ঋক যেন এসে হাজির হয়েছে ওর কাছে | আর রূপকথার এই হাসি মুখ দেখে ঋকের কনফিডেন্সটাও এবার অনেকটা বেড়ে গেলো , তাই বেশ জোর গলায় বললো , ” আচ্ছা তুই রাজি তো ? বিয়ের ডেটটা তাহলে ফাইনাল করতে বলি ?”
হঠাৎ বিয়ের ডেটের কথা শুনে রূপকথা আকাশ থেকে পড়লো , এসব আবার কি বলছে ! .. ওর মুখ দেখে ঋক আবার বলে উঠলো , ” এই রকম এক্সপ্রেশন কেন দিচ্ছিস ! দুটো ব্ল্যাকফরেস্ট কেক দিলাম , তাতেও কিছু বুঝলি না ?”
রূপকথা এবার অবাক হয়ে প্রশ্ন করলো , ” ব্ল্যাকফরেস্ট কেকের সাথে বিয়ের কি সম্পর্ক ! কি বলছিস টা কি তুই ?”
ঋক এবার ধৈর্য হারালো , ” আরে বাবা , দুটো ব্ল্যাকফরেস্ট কেক খেয়ে তুই যতই মোটা হোস না কেন ! আমার কোনো প্রব্লেম নেই | আমি তোর বর হতে রাজি আছি বুঝলি | এই এক বছরে এতো চুপচাপ থেকে এটা অন্তত বুঝে গেছি , যে হাজারটা রেস্টুরেন্ট থাক , হাজারটা বিজনেসডিল , ক্লাইন্টস থাক , কিন্তু তুই না থাকলে সব কিছু ইনকমপ্লিট … আর এই এক বছরে তুই যখন সকালে বাড়ি থাকতিস না , তখন তো তোর বাড়ি যেতাম , তোর ঘরেও যেতাম | তখন তোর পার্সোনাল ডাইরি পড়ে পার্সোনাল ফিলিংস এর ব্যাপারে সব কিছু আমি জেনে গেছি | তাই বলছি , বিয়ের ডেটটা এবার ফাইনাল করা যাক|”
কথাটা শুনে রূপকথার পারদ চড়ে গেলো , —- ” তুই আমার বাড়ি গিয়ে বসে বসে আমার পার্সোনাল ডাইরি পড়তিস ? তোর লজ্জা করে না ! আর তুই তো স্নেহাকে লাইক করিস | সারাক্ষন তো আগে ওরই গুন্ গাইতিস কথায় কথায় | আমি তো কখনো সিনেই ছিলাম না |”
ঋক এবার হেসে ফেললো , —— ” তুই কি পাগল ! স্নেহা জাস্ট আমার বিজনেস পার্টনার | ওকে নিয়ে আমি কখনো ঐভাবে ভাবিনি..| হ্যাঁ, ওর পার্সোনালিটি , কথাবার্তা আমার ভালো লাগে | সে তো অনেকেরই লাগে | আর একটা ইনফরমেশনও দিয়ে দিই , আমার এক কলেজ ফ্রেন্ডের সাথে আমি দায়িত্ব নিয়ে স্নেহার আলাপ করিয়ে দিয়েছি , এন্ড নাও দে আর ইন এ রিলেশনশিপ .. বুঝলি | এবার তো বিশ্বাস হলো ! যদি ওকে লাইক করতাম তাহলে নিশ্চই এই ঘটকের কাজটা করতাম না | আর বেশ করেছি তোর ডাইরি পড়েছি | এই এক বছর তুই তো সাইলেন্ট মোডে ছিলিস , তাই তোর ডাইরিটা তোর অল্টারনেটিভ হিসেবে কাজ করেছে | এবার তো বিয়ে করবি আমাকে ?”
না , এতো কিছু শুনে আর বুঝে রূপকথার আর না বলার মতন কিছু ছিল না সেদিন | এবার তো বিয়ে করতেই হবে | তাই আজ ঋকের হাতটাকে শক্ত করে ধরলো , ঠিক আগের মতন | সত্যি , লাইফ যেন হঠাৎ করে কখনো কখনো সারপ্রাইজ দেয় | সব কিছুকে কেমন সহজ করে দেয় | পুরো হিসেবটাকেই বদলে দেয় | আর ওই না দেখা কাঁচের দেয়ালগুলো এক নিমিষে ভেঙে দূরত্ত্বগুলো শেষ হয়ে যায় | আর হঠাৎ বিনা নোটিশে বাস্তব আর রূপকথা মিলে মিশে এক হয়ে যায় |

< সমাপ্ত >

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here