নীল শূন্যতা,পর্ব:১

১|
‘নেশা করি আমি, অথচ তার প্রতিক্রিয়া তোমরা দেখাচ্ছ!’ হতভম্ব তুষার তার পিতা-মাতার উদ্দেশ্যে বললেন।
ছেলের এমন কথা শুনে পিতা নাহিদ এবং মাতা তাহমিনা পরস্পরের সহিত দৃষ্টি পরিবর্তন করেন। জনাবা তাহমিনা তুষারের নিকটে গিয়ে বসেন। ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে তিনি তাকে বুঝাতে ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। জনাবা তাহমিনা বললেন,
‘জীবনে ছোটখাটো কিছু ঘটনা ঘটে যায়, যা সমস্ত আত্মাকে বিষন্নতায় ছেয়ে যায়। এসব ছোটখাটো ঘটনা একজনের জন্য কতবড় বুঝা তা অবশ্যই আমরা জানি। কিন্তু, সেই একই ঘটনাকে ধরে রেখে তুই কেন নিজেকে কষ্ট দিচ্ছিস, বাবা? এভাবেই তো জীবন কাটাতে এবং নষ্ট করতে পারবি না।’
‘খামখা জ্ঞান দিও না-তো, মা। কী বলবে সরাসরি বলো,’ তুষারের ব্যক্ত বাক্যে বিরক্ত স্পষ্ট।
‘ তুষার, তুমি যার জন্য নিজের জীবনটাকে শেষ করছ, সে কিন্তু ইচ্ছাকৃতভাবে তোমায় ছেড়ে অন্যের হাত ধরে চলে গিয়েছে। তুমি কী করছ? তোমায় বলব অতীত ভুলে সামনে এগিয়ে যেতে,’ গম্ভীর কন্ঠে জনাব নাহিদ বললেন।
‘বাবা, এতো সহজে ভুলতে বললে! পাঁচটা বছর ভুলা কী এতোটাই সহজ?’ তুষার ব্যথিত দৃষ্টিতে জিজ্ঞাসা করল।
‘মায়া বাড়ানোর তুলনায় কাটিয়ে উঠাটাই শ্রেয়, তুষার।’
‘আর সেটা কীভাবে? তোমাদের পছন্দ করা ক্লাস ফরের একটা মেয়েকে বিয়ের জন্য রাজি হয়ে? এখন তো নেশা করছি, তখন চৌদ্দ গোষ্ঠী জেলের ভেতর যাব।’

তুষারের তাচ্ছিল্য শুনে জনাব নাহিদ বেশ ক্ষিপ্ত হয়ে যায়। সে তুষারের হাত থেকে ফোনটা কেড়ে নিয়ে তাকে ধমকের সুরে বলতে লাগল,
‘তুমি কাল আমার বিদ্যালয়ে গিয়ে সেই মেয়েটির সাথে সাক্ষাৎ করবে। এটাই আমার শেষ কথা।’
জনাব নাহিদের প্রস্থান ঘটে। জনাবা তাহমিনা বললেন,
‘তুই বদ্ধ পাগল হয়েছিস! আরে, তোকে এখন কে বিয়ে করতে বলছে? তুই কী চাকরি করিস? লেখাপড়া শেষ হয়েছে তোর?’
‘তাহলে কী?’ তুষার বুঝার চেষ্টায় প্রশ্ন করল।
‘মেয়েটি এখন ছোট। সে বিয়ের উপযুক্ত হতে হতে তোরও জীবন সেট হয়ে যাবে। বাকি থাকবে শুধুমাত্র বিয়ের। বিয়েটা পরবর্তীতে হবে। তোকে শুধুমাত্র মেয়েটির সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়তে হবে, যেন পরবর্তীতে না বলার আগে ভাবে।’
‘তোমাদের কোন কথাই না আমার মাথায় ঢুকছে না। মেয়েটার সাথে দেখা করতে হবে তো? যাও করব আগামীকাল। কিন্তু, অতটুকু মেয়ে দেখা করার মানে কী বুঝবে?’
‘তুই নিজেই বুঝতে পারবি, কীভাবে কী বলতে হবে।’
জনাবা তাহমিনা মুচকি হেসে তুষারের কক্ষ ত্যাগ করেন। বেশ ভালো ও শিক্ষিত পরিবারের বড় ছেলে তুষার। হাই স্কুল জীবন থেকে এক মেয়ের সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে যায়, তুষার। একবছর কাটার পর বন্ধুসুলভ বাবা-মায়ের সাথে মেয়েটির ব্যাপারে আলোচনা করলে, তারা তেমন কিছু বলেনি। না সম্মতি দিয়েছিল, আর না অসম্মতি। তুষারের মতে মেয়েটি তাকে ধোকা দিয়ে অন্য কাউকে বিয়ে করেছে। লোকজনের সামনে তাকে বেশ অপমান করেছিল মেয়েটি এবং তাদের মাঝের সকল সম্পর্ক এক মুহুর্তে শেষ করেছিল। সেই থেকে এক মাস যাবত তুষার সব বাদ দিয়ে নেশা ও বদ্ধ জীবন নিয়ে পরে আছে। জনাব নাহিদ ছেলের এমন অবস্থায় বেশ চিন্তিত ছিলেন। কী করে ছেলেকে ফেরাবেন তার একটিমাত্র উপায়, একটিমাত্র পথের সন্ধান চেয়ে রোজ নামাজে কান্নাকাটি করতেন। স্বামী-স্ত্রী উভয়েই একই বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। এই শিক্ষকতার মাধ্যমেই যে তিনি আসার আলো খুঁজে পাবেন, তা তিনি ভাবেননি। কথায় আছে, ‘কাঁটা দিয়ে কাঁটা তুলতে হয়’। ঠিক এই প্রচলিত কথাটিই তিনি নিজ পূত্রের ক্ষেত্রে কাজে লাগাবেন।
কিছুক্ষণ পূর্বে যেই মেয়েকে নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল, তার মা জনাব নাহিদের সহকর্মী ; অর্থাৎ তিনিও একই বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। এর ফলে, ছোট মেয়েটিকে আরো কাছ থেকে দেখার সুযোগ পান জনাব নাহিদ।
~
পরদিন সকালে জনাবা তাহমিনা তুষারের কক্ষে যায়। ছেলেকে ঘুম থেকে জাগ্রত করে কড়াভাবে আদেশ দেন, যেন সে বিদ্যালয়ে যাওয়ার ব্যাপারটি সম্পর্কে না ভুলে। বিরক্তি নিয়ে অপরপাশে ঘুরে ঘুমাতে থাকে তুষার। স্বামী-স্ত্রী দুজনে বিদ্যালয়ের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়।
যথারীতি ক্লাস শুরু হয়। মাঝখানে বিরতি পর্ব অর্থাৎ টিফিন পিরিয়ড৷ সেই সময়টাতে অফিস রুমে জনাবা তাহমিনা, জনাব নাহিদ ও জনাবা বেলি অর্থাৎ আলোচিত মেয়েটির মা ব্যতীত কেউ থাকেন না। একেকজন একেক দিকে গিয়ে এই সময়টুকু অতিবাহিত করেন৷ সেই সুযোগ নিয়ে জনাব নাহিদ জনাবা বেলিকে কিছু ইঙ্গিত দেওয়ার চেষ্টা করেন। তিনি বলেন,

‘ম্যাডাম, আপনি মিমকে এতো ভদ্র কীভাবে বানালেন? কীভাবে এতো সুন্দর শিক্ষা দিয়েছেন?’
‘আমি তেমন কিছুই করিনি। মেয়েটা আমার এখনই ভালোমন্দ বেশ বুঝে। তাই ভালোটা নিজের মাঝে নিয়ে মন্দটা ত্যাগ করার চেষ্টা করে। আপনি তো তার শিক্ষক। আপনার তো কিছু ধারণা থাকার কথা,’ জনাবা বেলি হেসে বললেন।
‘এই বয়সে মাশা-আল্লাহ এতো ভদ্র মেয়ে! আমি এবং আমার ওয়াইফ তো বেশ সন্তুষ্ট। প্রতিদিন মিমকে নিয়ে ক্ষনিকের জন্য হলেও আলোচনা করি।’
‘ম্যাডাম, আমার খুব ইচ্ছে মিমের মতো একটা মিষ্টি ভদ্র মেয়েকে আমার তুষারের বউ করার,’ জনাবা তাহমিনা বললেন।
‘ইনশা-আল্লাহ, আল্লাহ আপনাদের নেক ইচ্ছা পূরণ করবেন,’ জনাবা বেলি হেসে উত্তর দেয়।
‘আসসালামু আলাইকুম। আমি কি আসতে পারি?’ ছোট মেয়ের কন্ঠস্বরে সকলে প্রবেশ দরজার দিকে তাকায়।
মেয়েটিকে দেখামাত্র জনাব নাহিদের ঠোঁটজোড়ায় এক তৃপ্তিময় হাসির রেখা দেখা যায়। সে বলে,
‘এসো, মিম।’
দশ বছর বয়সী এক মেয়ে সুন্দরভাবে হেঁটে প্রবেশ করে। অন্য কোথাও না গিয়ে সে তার মায়ের কাছে যায়। জনাবা বেলি তাকে কাছে টেনে জিজ্ঞাসা করে,
‘কী ব্যাপার, মিম। তুমি এসময় অফিসে?’
‘আম্মু, আমার পেন্সিল হারিয়েছে,’ মাথা নীচু করে মিম উত্তরে বলল।
‘হারিয়েছে না-কি কেউ চুরি করেছে?’
‘আম্মু, তুমিই তো বলেছ, না জেনে কাউকে কিছু না বলতে। যেহেতু আমি দেখিনি, জানিনা তাই পেন্সিল হারিয়েছে।’
‘আচ্ছা, চলো। নতুন পেন্সিল কিনে দিচ্ছি।’

জনাবা বেলি মিমের এক হাত ধরে নিয়ে অফিস রুম থেকে বের হয়ে যায়। জনাব নাহিদ বলে উঠেন,
‘মাশা-আল্লাহ!’
‘টিফিন টাইম তো প্রায় শেষের দিকে। ছেলেটা এখনও আসছে না কেন বলোতো?’ জনাবা তাহমিনা চিন্তিত হয়ে প্রশ্ন করলেন।
‘আমিও তাই ভাবছি।’

অন্যদিকে নিজ কক্ষে একাকী বসে ফোনের দিকে তাকিয়ে আছে তুষার। ফোনের স্ক্রিনে তার এবং তার প্রাক্তনের কথোপকথন ভেসে আছে। একে অপরের মাঝে হওয়া মেসেজগুলো পড়ছে এবং অঝোরে অশ্রুজল বিসর্জন দিচ্ছে। ইতোমধ্যে তার দৃষ্টি লালচে বর্ণ হয়ে আছে। কিছুক্ষণ পর তার ফোনের স্ক্রিনে তার পিতার নাম্বার ভেসে উঠে। জনাব নাহিদ তুষারের কোন দেখা না পেয়ে কল করেছেন। কিন্তু তুষার কল রিসিভ করল না। বরং সে কল কেটে দিয়ে মোবাইল সাইলেন্ট করে রাখল। টেবিল থেকে একটি ঘুমের ঔষুধ হাতে নিয়ে তা পানির সাহায্যে খেয়ে নিল। অতঃপর বিছানায় শুয়ে চোখ বন্ধ করে নিল।
~
প্রতিদিন টিফিনের পরবর্তী একটি ক্লাস করে জনাবা তাহমিনা বাড়ি ফিরে আসেন। তার অন্যতম কারণ তাহমিদ, অর্থাৎ তার দেড় বছরের ছোট ছেলে। বিদ্যালয়ে যাওয়ার আগে খাইয়ে দিয়ে তার শ্বাশুড়ির কাছে রেখে যায়। আজ তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। কিন্তু বাসায় ফিরে শ্বাশুড়ির কক্ষে না গিয়ে আজ সে তুষারের কক্ষে যায়। তুষার ইতোমধ্যে ঘুমিয়েছে। তা দেখে জনাবা তাহমিনা দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। জনাব নাহিদকে কল করে তুষারের ব্যাপারে জানালে সে বেশ ক্ষিপ্ত হয়। জনাবা তাহমিনা তার অন্যান্য কাজে লেগে যায়। বিকালের দিকে জনাব নাহিদ বাড়ি ফিরে আসতেই তুষারকে ডাকডাকি শুরু করেন। তুষার তখনও ঘুমে।
কিন্তু রাতের বেলা তুষার ছাড় পায় না। বেশ অনেকক্ষণ রাগারাগি করার পর জনাব নাহিদ স্পষ্টভাবে জানিয়ে বলেন,
‘আগামীকাল সকালে আমার সাথে বিদ্যালয়ে যাচ্ছ, তুষার। নয়তো, যেভাবে পারবে এসব শোক পালন করা একদিনের ভেতর ছাড়তে হবে। সিদ্ধান্ত তোমার হাতে। প্রতিদিন তোমার একই অবস্থা, তোমার দ্বারা ঘটিত একই ঘটনায় অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছি। পিতামাতা হিসেবে আমাদের জন্যও কিছু ভাবো।’

আজ আর জনাবা তাহমিনা তুষারকে কিছুই বুঝানোর চেষ্টা করেন না। রাগান্বিত দৃষ্টিতে তুষারের পানে তাকিয়ে তিনি চলে যায়। দীর্ঘশ্বাস ফেলে তুষার জানালা খুলে এক দৃষ্টিতে রাতের আকাশ উপভোগ করতে থাকে। এসময় তার সঙ্গ দেয় মুঠোফোনের বিষাদময় গান ও তিমিরাচ্ছন্ন পরিবেশ।

চলবে,,,
‘নীল শূন্যতা’
লেখনীতে: মাহমুদা

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here