নীল শূন্যতা,পর্ব:৫

#নীল_শূন্যতা
লেখনিতে: মাহমুদা
|৫|

দশম শ্রেণিতে উঠার পরপর হয় মেয়েরা ভুল করে, নয়তো কোন ঝড় তাদের জীবনে হানা করে। কম বেশি সব মেয়েরাই এধরনের পরিস্থিতির শিকার হয়। একই ঘটনা মিমের ক্ষেত্রেও ঘটেছে।
তুষার তার চাকরির ছুটি পেয়ে বাড়ি এসেছিল। বাড়ি ফেরার পর সেদিন আর মিমের সাথে সে সাক্ষাৎ করেনি। ভেবেছিল পরদিন সকালে সাক্ষাৎ করবে। অনেকদিন যাবত বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেওয়া হয় না ভেবে সেদিন রাতে বন্ধুদের সাথে সাক্ষাৎ করার সিদ্ধান্ত নেয়। যেমন ভাবনা তেমন কাজ। কল করে বন্ধুদেরকে একত্রিত করে তুষার। বেশ হাসি তামশার মধ্য দিয়ে সময় অতিবাহিত হতে লাগল। তুষারের বন্ধুরা মিম ও তুষারের মাঝের প্রকৃত সম্পর্ক জানত না। জানবেই বা কীভাবে? মিম নিজেই যে সে সম্পর্কে অবগত নয়। তার এক বন্ধু রাকিব হঠাৎ করে তুষারকে বলে,
‘তুষার, তোর আন্টির যে মিম নামের এক মেয়ে আছে না?’
‘হুম, কি হয়েছে?’ চিন্তিত তুষার আগ্রহ নিয়ে কপাল কুঁচকে প্রশ্ন করে।
‘মেয়েটা মনে হয় ভালো চরিত্রের না।’
‘কী বলতে চাচ্ছিস? পরিষ্কার করে বল।’
তুষারের ইতোমধ্যে রাগ চড়ে বসে। কিন্তু সে রাগ প্রদর্শন না করে সম্পূর্ণ ঘটনা জানার জন্য প্রশ্ন করে। রাকিব তাকে অতিরিক্ত ভাব দেখিয়ে বলে,
‘মেয়েটা সেদিন আমায় স্কুল গেটের সামনে সরাসরি প্রপোজ করেছে।’
‘তোকে প্রপোজ করেছে?’ তুষার পরোয়া না করার মতো করেই বলল।
‘আমিও তো সেদিন রাকিবের সাথে ছিলাম। কী মেয়েরে ভাই! সরাসরি এসে রাকিবকে বলে দিল সে তাকে পছন্দ করে। একটুও ঘাবড়ায়নি,’ পাশ থেকে তুষারের অন্য এক বন্ধু বলে উঠল।

কথাগুলো জানার পর তুষারের কেমন সূক্ষ্ম অস্বস্তি অনুভব হতে লাগল। সে বন্ধুদের আসর থেকে উঠে দাঁড়ায় এবং বলে,
‘আচ্ছা, আমি আজ যাই। বাবা হয়তো অপেক্ষা করছে।’
‘কী তুষার? কলেজ লাইফ থেকে দেখছি শুধু বাবা বাবা করিস। মেয়ে হয়ে গেলি না-কি?’ তুষারের এক বন্ধু তাকে প্রশ্ন করে।
‘বাবা পাগল হতে হলে মেয়ে হতে হবে? ছেলেরা কী বাবাকে ভালোবাসতে পারে না?’
তুষার তার বন্ধুর উত্তর শোনার অপেক্ষা করেনি। বাসায় ফিরে সে রাতের খাবারও খায় না। জনাবা তাহমিনা তুষারকে খাবারের জন্য ডাকতে আসলে তুষারকে অন্যমনস্ক দেখতে পায়। সে তার ছেলেকে উদ্দেশ্য করে প্রশ্ন করে,
‘কোন সমস্যা হয়েছে, তুষার? তোকে কেমন অন্যমনস্ক লাগছে?’
‘না, মা। তেমন কিছু না। এমনি মাথাটা একটু ধরেছে।’
‘আচ্ছা, চল। খেয়ে ঔষুধ খাবি।’
‘না, মা। তোমরা খেয়ে নাও। আমি একটু ঘুমাব।’
‘না খেয়ে কেন,,’ জনাবা তাহমিনার বাক্যকে অসম্পূর্ণ রেখে তুষার অন্য একটি বালিশ দিয়ে চোখজোড়া বন্ধ করে নিয়ে বলে,
‘লাইট বন্ধ করে দিয়ে যেও।’
‘তুই আর পাল্টাবি না, তুষার!’
দীর্ঘশ্বাস ফেলে বাতি নিভিয়ে দিয়ে জনাবা তাহমিনা চলে যায়।
নিরবতা ও অন্ধকার সম্পূর্ণ ঘরে চুপচাপ একাকী শুয়ে আছে তুষার। সে ভাবছে তার বন্ধুর বলা প্রতিটি কথা, সে ভাবছে মিমের কথা। সে ভাবছে, রাকিবের ব্যক্ত প্রতিটি বাক্যে সত্য শব্দের সংখ্যা কতো হতে পারে। সে ভাবছে, তার মিমকে সে সন্দেহ করে রাগারাগি করবে! সে ভাবছে, মিম তো তার কথার অমান্য করার ও বিশ্বাস ভঙ্গ করার মেয়ে নয়। তবে? তার হিসাব যে মিলছে না।
অন্ধকারকে আড়াল করতে যেমন একটুখানি আলোর সূচনা যথেষ্ঠ, তেমনি করে তুষারের মোবাইলে টুং শব্দ করে আলো জ্বলে উঠে। চোখের সামনে থেকে বালিশ সরিয়ে মোবাইল হাতে নিয়ে মেসেজ চেক করে দেখতে পায় তা মিমের মেসেজ। সে লিখেছে,
“ভাইয়া, আপনি আজ আমাদের বাসায় আসলেন না কেন? আমি যে কয়েকদিন যাবত একটি বিষয় নিয়ে বেশ চিন্তিত। ভেবেছিলাম আপনার সাথে শেয়ার করব। কিন্তু আপনিই এলেন না। আগামীকাল প্লিজ একটু আসবেন!”

তুষার হয়তো কিছুটা আন্দাজ করতে পেরেছে। সে উত্তরে মিমকে ‘ঠিকাছে’ মেসেজ প্রেরণ করে।

পরদিন সকাল হতে না হতে তুষার মিমদের বাড়ির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পরে। ইতোমধ্যে মিমের স্কুলের জন্য প্রস্তুত হবার কথা। কিন্তু মিম তখনও নিত্যদিনের পোশাক পরিহিত অবস্থায় বসে পড়ছে। কক্ষের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে মিমকে তার নাম ধরে ডাকলে মিম বই থেকে মাথা তুলে তুষারের দিকে তাকায়। মলিন একটু হেসে মিম তুষারকে ইশারায় ভেতরে ডাকে। মিমকে দেখে তুষারের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠে। কারণ মিম যেমন শুকিয়েছে, তেমন তার চোখের নিচে কালো দাগ জমেছে ও গায়ের রংও কিছুটা কালো হয়েছে। তুষার বেশ বুঝতে পারছে মিম কোন বিষয় নিয়ে একটু বেশি চিন্তিত। মিমের পাশে একটি চেয়ার টেনে বসে তুষার তাকে প্রশ্ন করে,

‘স্কুলে যাবে না?’
‘না।’
‘কেন?’
‘এমনি, ভালো লাগছে না। কেমন আছেন, ভাইয়া?’
‘আমি তো ভালো, কিন্তু তুমি কেন ভালো নেই?’
‘কে বলল আমি ভালো নেই?’
‘নিজেকে আয়নায় দেখেছ? এ-ই হাল কেন?’
মিম উত্তরে চুপ করে মাথা নীচু করে থাকে। তার দৃষ্টি অশ্রুতে ভরে আসছে। তুষার মিমের মাথায় হাত বুলিতে দিয়ে আবারও প্রশ্ন করে,
‘ মিম, কী হয়েছে? আমায় বল।’
মিম ঢুকরে কেঁদে উঠলে তুষার বেশ ভীত হয়। মিম কান্নারত অবস্থায় বলে,
‘আমার স্কুলে যেতে ভয় করে, ভাইয়া।’

কিছুদিন আগের ঘটনা,

ছুটির পর মিম ও নিহার একত্রে প্রাইভেট পড়ে বাসায় ফিরে। আজও তার ব্যতিক্রম হচ্ছে না। গল্প করতে করতে দু বান্ধুবী একত্রে স্কুল গেট থেকে বের হয়। প্রতিদিন এসময় স্কুল গেটের সামনে কিছু সংখ্যক ছেলেরা দাঁড়িয়ে থাকে। মিম ও নিহার তাদের এড়িয়ে চলে। আজ হঠাৎ করে একজন ছেলে মিমের সামনে দাঁড়িয়ে তার পথে বাধার সৃষ্টি করে। ছেলেটি তুষারের বন্ধু রাকিব নিজেই। সে মিমের দিকে তাকিয়ে বলে,
‘কতোদিন ধরে তোমার জন্য স্কুল গেটে অপেক্ষা করছি। অথচ তুমি একবারও আমার দিকে চোখ তুলেও তাকাও না? বুঝতে পারো না, আমি তোমায় পছন্দ করি?’
মিম উত্তরে কিছু বলে না। চোখেমুখে বিরক্তির ছাপ ফুটিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে বলে,
‘সামনে থেকে সরে দাঁড়ান, ভাইয়া। আপনার সাথে কথা বলতে অনিচ্ছুক আমি।’
‘ভাইয়া? আমি তো জান ডাক শুনতে চাই। শোন মেয়ে, এতো ভদ্র সাজতে হবে না। তোমাদের মেয়েকে আমি ভালোমতো জানি। ভদ্র সেজে ছেলেদের আরো ইমপ্রেস করার চেষ্টা করো। তোমায় তিনদিন সময় দিচ্ছি। ভেবে আমায় উত্তর জানাবে। আর অবশ্যই উত্তর হ্যাঁ হতে হবে। নয়তো খবর খারাপ হবে।’

রাকিব কথাগুলো বেশ বাজেভাবে বলে। এতে মিম ভয় পায়। রাকিব পথ থেকে সরে দাঁড়ালে মিম ও নিহার দ্রুত সেখান থেকে চলে যায়। বাড়ি ফিরে জনাবা বেলির নিকট সব বলে মিম কান্না করে দেয়। সেদিন থেকে কয়েকদিন পর্যন্ত জনাবা বেলি মিমকে স্কুলে পৌঁছে দেয় এবং নিয়ে আসেন। সেই ছেলেটির আর দেখা মিলে না। কিন্তু তার ক্লাসমেটদের ভয় দেখিয়ে রাকিব মিমের কাছে প্রতিদিই চিঠি পাঠায়। চিঠি পাঠাতো না, হয়তো মোবাইলে বিরক্ত করতো। কিন্তু মিমের কোন মোবাইল নেই।
একদিন স্কুলের কাজের জন্য জনাবা বেলি মিমকে স্কুলে পৌছে দিতে পারেন না। তাই মিমকে নিহারের সাথেই স্কুলে যেতে হয়। নিহার যথাসম্ভব মিমকে সাহস দিচ্ছে। বিভিন্ন কথা বলে মিমের সাথে স্কুলে যাচ্ছে। কিন্তু মিমের যে ঠিক ভয় করছে। আর যে ভয় তার মনে কাজ করছিল, তাই হলো। রাকিব আজ আবারও মিমের সামনে উদয় হলো। সে হেসে বলে উঠে,
‘কী, জানপাখি! কি অবস্থা তোমার? এতদিন তো তোমার মা-কে সাথে আসতে দেখেছি। তা আমার উত্তর কি? আজ নবম দিন।’
মিম সেদিনের মতো আজও চুপ থাকে। কিন্তু ভয়ে সে কাঁপছে। রাকিব তাকে রাগান্বিত কন্ঠে বলে,
‘আমি কী তবে উত্তর না বুঝে নিব? ফুলটুসি, উত্তর না হলে খবর খারাপ হবে।’ আচমকা রাকিব মিমের ডান হাত ধরে বলে, ‘এ-ই হাত দিয়ে লেখাপড়া করে বড় হওয়ার স্বপ্ন না, মুহুর্তে ভেঙে গুড়িয়ে দিব।’

মিম তার হাত মোচড়ামুচড়ি করে ছাড়ানোর বৃথা চেষ্টা করে। রাকিব ও তার বন্ধুরা মিমের এই অবস্থা দেখে হুহু করে হেসে উঠে। মিমের হাত ছেড়ে দিয়ে বলে,
‘ছুটির সময় আমি উত্তর চাই।’

রাকিব ও তার বন্ধু চলে যায়। লাল হওয়া হাতের দিকে তাকিয়ে মিম নিঃশব্দে কান্না করে দেয়। সেদিন আর সে স্কুলে যায়নি। নিহারও যায়নি। মিমকে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে সেও বাড়ি ফিরে যায়। সেদিন থেকে মিম আর স্কুলে যায়নি।

বর্তমানে,

তুষারকে ঘটনাগুলো বলার সময় মিম ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠে। জনাবা বেলি তুষারের জন্য নাস্তা নিয়ে এসে জানায় এই ব্যাপারের জন্য চিন্তা করতে করতে মিমের এ-ই হাল। সে আরো বলে,
‘তোমার সমবয়সী ছেলেটি এতদূরই শান্ত নয়। বরং রোজ রাতে এসে বাড়ির সামনে হৈ চৈ সহ বাজে বাজে কথা শুনিয়ে যায়। এটা নিয়ে মিম বেশি ভয়ে আছে। জানোই তো, মিমের ভাই নেই, ওর বাবাও চাকরির সুবাদে দেশের বাহিরে আছে। তাই সে তোমার ফেরার অপেক্ষায় ছিল। তুমি প্লিজ ব্যাপারটা একটু দেখ।’
‘জ্বি আন্টি। চিন্তা করবেন না।’
জনাবা বেলি তুষারের দিকে তাকিয়ে মিমকে ইশারা করে কিছু বুঝায়। তুষার হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ালে জনাবা বেলি সেখান থেকে চলে যায়। তুষার মিমের দিকে তাকিয়ে দেখে তার গাল বেয়ে অনবরত পানি ঝরছেই, বারংবার মুছেও মিম থামাতে পারছে না। তুষারের ভীষণ খারাপ লাগছে। কিন্তু সে তার খারাপ লাগাকে এখন প্রকাশ করলে তো চলবে না। তুষার মিমের চোখের পানি মুছে দিয়ে বলে,
‘নিশ্চয়ই সকালে নাস্তা করোনি। এখন নাস্তা করে নেও।’
‘করব না। ক্ষিধে নেই,’ কান্নারত কন্ঠে মিম উত্তর দেয়।
‘ক্ষিধে নেই বললে চলবে না। খেতে হবে এখন,’ তুষার ধমক দিয়ে বলে উঠে।

তুষারকে মান্য করার কারণে মিম নাস্তা করে। নাস্তার পরপর মিমের কান্না থেমে যায়। তুষার মলিন হাসে। সে জিজ্ঞাসা করে,
‘টেস্ট কবে থেকে শুরু হবে?’
‘আগামী পরশু থেকে।’
‘প্রিপারেশন কেমন তোমার?’
‘আলহামদুলিল্লাহ ভালো৷ এখন বাকিটা খাতায় লেখার উপর ও আল্লাহ তায়ালার উপর নির্ভর করে।’
‘আচ্ছা৷ এখন পড়ো তবে৷ আমি বিকালে আবার আসব।’
‘এখন কোথায় যাবেন?’ মিম তুষারের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে।
‘একটু কাজ আছে। আচ্ছা, শোন। বিকালে রেডি থেকো, আমি নিতে আসব।’
‘আমি তো কোথাও যাব না!’
‘জানি তো, আমি নিয়ে যাব।’

মিম কথাটা শুনে বেশ খুশি হয়। সে মিষ্টি করে হেসে উঠে। অনেকদিন পর কোথাও যেতে পারবে তাই। মিমের হাসিতে তুষারের মনে প্রশান্তি আসে। সে মিমের মাথায় হাত বুলিয়ে বিদায় নিয়ে চলে যায়।

মিমদের বাড়ি থেকে বেশ খানিকটা পথ হেঁটে যাওয়ার পর সে তার প্যান্টের পকেট থেকে মোবাইল বের করে রাকিবকে কল করে। কয়েকবার রিং হওয়ার পর রাকিব রিসিভ করে ঘুম ঘুম কন্ঠে বলে,
‘কিরে, বন্ধু। এতো সকালে কল কেন করলি?’
‘কোথায় আছিস, তুই?’ গম্ভীর কন্ঠে তুষার প্রশ্ন করে।
‘বাসায় আছি। কেন?’
‘বিশ মিনিটের ভেতর আমার সাথে দেখা কর। আমি গতকালের স্থানে অপেক্ষা করছি।’
রাকিবকে বেশি কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে তুষার কল কেটে দেয়। সে হাঁটছে, রাগান্বিত মুখমন্ডল নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ সে বাকা হেসে নিজের চুলে হাত দিয়ে ঠিক করতে থাকে।

চলবে,,,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here