নীল শূন্যতা,পর্ব:৪

#নীল_শূন্যতা
লেখনীতে: মাহমুদা
|৪|
দেখতে দেখতে দু’টি বছর কেটে যায়। মিম সমাপনী পরীক্ষায় গোল্ডেন প্লাস নিয়ে ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হয়। তুষার ও মিমের মাঝের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক আরো গভীর হয়ে উঠে। মিম তুষারকে একজন ভালো বন্ধু ও ভাই হিসেবে মানে।
দিনটি শুক্রবার,
শুক্রবার মানে মিমের জন্য ঘুমের একটি দিন। নাওয়া-খাওয়া বাদ দিয়ে সে এদিন জুম্মার আযান অব্দি ঘুমাবে। কিন্তু তার স্বাদের ঘুমের বারোটা বেজেছে আজ। সকাল আটটা বাজতে না বাজতে জনাবা বেলি মিমকে ডাকতে শুরু করেন এবং কক্ষ গুছাতে থাকেন। মাথায় একটি বালিশ চেপে মিম বিরক্ত হয়ে ঘুমন্ত কন্ঠে বলে,
‘আম্মু, আজ শুক্রবার। বিরক্ত করো না, ঘুমাতে দেও।’
‘আজ নয়, মিম। বাড়িতে মেহমান আসবে। উঠো, ঊঠে আমার কাজে সাহায্য করো তো।’
‘এই শুক্রবারে কে আসবে?’ মাথার উপর থেকে বালিশ সরিয়ে বন্ধ চোখে মিম প্রশ্ন করে।
‘তোমার নাহিদ স্যার ও তার পরিবার আসবেন।’
‘তুষার ভাইয়া কী ঘুমায় না? শুক্রবারে আমার ঘুম হারাম করতে হচ্ছে!’

খানিকটা রাগান্বিত হয়ে মিম চোখ ঢলতে ঢলতে ওয়াশরুমের দিকে চলে যায়। দাঁত ব্রাশ করে, হাত মুখ ধুয়ে জনাবা বেলির নিকটে এসে বলে,
‘আম্মু, তুমি যাও। ঘর গুছানোর ব্যাপারটা আমি দেখছি।’
‘আচ্ছা, যাই আমি। দেখে, আবার ব্যথা পেও না কিন্তু।’
‘আব্বু কোথায়?’
‘তোমার আব্বুর নিয়ম সকাল দশটা পর্যন্ত বাহিরে ঘুরাঘুরি করার, তা তো জানোই। কেন, কিছু দরকার?’
‘না, মোবাইল কোথায় রেখেছ?’
‘ওয়্যারড্রপের উপরে।’

জনাবা বেলি চলে যায় রান্নাঘরের দিকে। মিম ওয়্যারড্রপের উপর থেকে তার মায়ের মোবাইল হাতে নিয়ে তার বাবাকে কল করে। কল নয়, মিসডকল। এতে তার বাবা তাড়াতাড়ি কল ব্যাক করেন। মিমের বাবা কল ব্যাক করতেই মিম বলে উঠে,
‘আব্বু, তুমি কোথায়?’
‘এইতো, আশেপাশেই। কেন, আম্মু?’
‘বাসায় আসো এখন।’
‘কেন? কী হয়েছে?’
‘বাসায় এসে বাড়ির উঠোন ঝাড়ু দিয়ে যেখানে যাওয়ার যাও। আমি পারব না উঠোন ঝাড়ু দিতে। তোমায় পাঁচ মিনিট সময় দিলাম।’

আর কিছু না বলে এবং বলার সুযোগ না দিয়ে মিম কল কেটে দেয়। সে তার কাজ করতে থাকে। মিনিট দশেকের ভেতর তার বাবাও ফিরে আসেন এবং মিমের কথানুযায়ী উঠোন ঝাড়ু দিতে থাকেন। উঠোন ঝাড়ু দেওয়ার শব্দে জনাবা বেলি পেঁয়াজ কাটতে কাটতে হাক ছেড়ে বলেন,
‘মিম, তোমায় উঠোন ঝাড়ু দিতে হবে না। কোমড় ব্যথা করবে। রেখে দেও, আমিই করে দিব।’
কিন্তু না, সেই একই শব্দ ভেসে আসছে। রান্নাঘর থেকে উঠে আসেন জনাবা বেলি। আসতে আসতে বলেন,

‘আবার যদি বলিস না যে ব্যথা বেড়েছে, তো তোর—’ বাকিটুকু বললেন না। মিমের পরিবর্তে নিজের স্বামীকে ঝাড়ু দিতে দেখে জনাবা বেলি ভ্যাবাচেকা খেয়ে যায়। সে দ্রুত এগিয়ে এসে ঝাড়ু নিয়ে নেয়। সে বলেন,
‘তোমায় ঝাড়ই দিতে কে বলল?’
‘কেউ না, আমিই দিচ্ছি।’
‘মিম তোমায় কল করেছিল?’
‘হ্যাঁ।’
‘বুঝেছি, আর কিছু বলতে হবে না। যাও, গিয়ে চোখেমুখে পানি দিয়ে নেও। আমি ঝাড়ু দিয়ে দিচ্ছি।’

জনাবা বেলির কথা মান্য করে মিমের বাবা চলে যায়। ওদিকে মিম সম্পূর্ণ বাড়ির প্রতিটি কক্ষ সুন্দরমতো গুছিয়ে তা পরিষ্কারও করে নেয়। জুম্মার আযানের পরপর গোসল সেরে খাবার নিয়ে খেতে থাকে। জনাবা বেলি অবাক হয়ে যায় মেয়ের কান্ডে। সে বলেন,
‘সে-কী মিম? তোর স্যারদের সাথেই বসে খেতি। এক ঘণ্টারই তো ব্যবধান।’
‘আমি তাদের সামনে খেতে পারব না, এতোক্ষণ ক্ষুধার্তও থাকতে পারব না, আম্মু।’
জনাবা বেলি আর কিছু না বলে চলে যায়। কারণ এসময় বেলিকে কিছু বলেও লাভ হবে না।
জুম্মার নামায শেষ হবার ত্রিশ মিনিট পরপর তুষার ও তার পরিবার মিমদের বাড়ি এসে উপস্থিত হয়। মেহমানদের সাথে খানিকক্ষণ কথা বলে মিম তার কক্ষে চলে যায়। সেখান থেকে মোহাম্মদ জাফর ইকবাল স্যারের ‘দলের নাম ব্লাক ড্রাগন’ গল্পের বই নিয়ে বারান্দায় গিয়ে বসে বসে পড়তে থাকে।
খাওয়া দাওয়ার পর যখন বড় চারজন কথা বলা শুরু করেন, তখন এক পর্যায়ে জনাবা তাহমিনা তুষারকে বলেন,
‘তুষার, দেখো তো মিম কোথায়?’
‘সম্ভবত তার কক্ষে বসে গল্পের বই পড়ছে। যাও, গিয়ে দেখ,’ জনাবা বেলি বলেন।

তুষার বাধ্য ছেলের মতো সেখান থেকে উঠে চলে যায়। তুষার চলে যাওয়ার পরপর মিমের বাবা জনাব নাহিদের উদ্দেশ্যে বলেন,
‘ভাই, আরেকটু ভেবে দেখা দরকার। মিম এখনও অনেকটা ছোট।’
‘এখনই কী উঠিয়ে নিব না-কি? সবটা পাকাপোক্ত করে রাখতে চাচ্ছি,’ উত্তরে জনাব নাহিদ বললেন।
‘তুষারকে তো আমি নিজেই পড়িয়েছি, তাকে ভালোমতো জানি। কিন্তু, বেকার ছেলের সাথে—’ জনাবা বেলি বলে উঠলেন।
‘তুষার বেকার? হ্যাঁ, তা সত্য। কিন্তু সে কয়েকদিনের ভেতর নৌ বাহিনীতে যুক্ত হবে। তাই ছেলে যাওয়ার আগে সবটা ঠিক করে রাখতে চাচ্ছিলাম,’ জনাব নাহিদ বললেন।
‘তুষার কী ইচ্ছাকৃতভাবে এ-ই পেশা বেছে নিয়েছে?’ বিস্মিত কন্ঠে প্রশ্ন করলেন মিমের পিতা।
‘হ্যাঁ, তুষার জেনেছে মিমের পছন্দের পেশা না-কি এটা!’ উত্তরে জনাবা তাহমিনা বলল।

তুষার মিমের কক্ষে না গিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে খোলা আকাশের নিচে নরম ঘাসের উপর বসে নীল আকাশের সৌনদর্য উপভোগ করতে থাকে। সে আজ চিন্তিত। যেই উদ্দেশ্যে আজ মিমদের বাসায় এসেছে, তা যদি সফল না হয়? নিজ কক্ষে বসে বই পড়তে থাকা মিমের দৃষ্টি হঠাৎ করেই তুষারের উপর পরে। কৌতূহলী হয়ে বই টেবিলে রেখে মিম নিজেও তুষারের কাছে যায়। তুষারকে খানিক চমকে দিয়ে সে প্রশ্ন করে,
‘তুষার ভাই, কী করছেন?’
‘কিছু না, আকাশ দেখছিলাম,’ পুনরায় আকাশের দিকে দৃষ্টি রেখে তুষার উত্তর দেয়।
‘প্রিয়, নীল আকাশের মাঝের সাদা মেঘের ভেলার সৌন্দর্য তো সবটুকু উপভোগ করো। কিন্তু, এই নীলের মাঝে লুকায়িত শূন্যতা কেন অনুভব করতে চাও না! বলতে পারো?’ সাহিত্যিকদের মতো কথা বলতে শুনে তুষার মিমের পানে ভ্রু কুঁচকে তাকায়। সে বলে,
‘তুমি এসব শিখেছ কোথায়?’
‘আমি নিজেও জানিনা। কিন্তু আমার আসমানের নীল ও সাদার খেলা নয়, বরং শূণ্যতা অনুভব করতে বেশি ভালো লাগে।’
‘ইদানীং কী পাঠ্যবই ছাড়া গল্প-টল্প বেশি পড়ছিস? আকাশের বুঝি শূণ্যতা আছে?’
‘আছে, সবকিছুর মাঝেই এক শূন্যতা আছে। সবাই অনুভব করতে পারে না।’
তুষার মিমের গাল টেনে ধরে বলে, ‘বেশি পেকেছ। এতো ভারী ভারো অর্থপূর্ণ কথা বলা শিখলে কীভাবে?’
‘আরে, আমি তো যা ইচ্ছা তাই বলে ফেলি!’ গালে হাত রেখে বলল মিম।
মিমের বাচ্চাদের মতো গালে হাত রাখা দেখে তুষার হেসে উঠে। সে ভারাক্রান্ত মনে মিমকে বলে,
‘আমি চলে যাব, মিম।’
‘এহ! কোথায় যাবেন?’ মিম তুষারের দিকে ঘুরে বসে প্রশ্ন করে।
‘চাকরিতে।’
‘আপনি চাকরি করেন কবে থেকে?’
‘যেদিন থেকে করব সেদিন থেকে।’

তুষার খানিক হাসে। ভাবান্তর মিম প্রশ্ন করে,
‘কথার মানে কী?’
‘না বুঝলেও চলে। শোন, তোমায় কিছু বলি। আমি চলে গেলে তো আর সমস্যার কথা আমায় জানালেও আমি সাথে সাথে একশন নিতে পারব না। তাই, তোমাকে বেশ সাবধানে থাকতে হবে—’

তুষার মিমকে বিভিন্ন বিষয়ে উপদেশ দিতে থাকে। অপরদিকে, দুই পরিবারের মাঝে নতুন এক সম্পর্ক স্থাপনের কথাবার্তা ঠিক হয়ে যায়। কিন্তু মিমের বাবা বেশ চিন্তিত হয়ে বলেন,
‘মিম কলেজ লেভেলে উঠার আগে এ বিষয়ে জানানো ঠিক হবে না।’
‘কেন?’ জনাবা তাহমিনার প্রশ্ন।
‘এতে মিমের পড়ালেখার ক্ষতি হবে৷ কারণ ছোট মানুষ, ভেবে বসবে সে আমাদের বুঝা হয়ে গিয়েছে। সেই মনমানসিকতা থেকে সে পড়ালেখায় দূর্বল হয়ে পড়বে। তাই আমি চাচ্ছি ব্যাপারটি গোপন থাক।’
‘মিমের বাবা ঠিক বলেছে। কলেজ লেভেলে মিম যথেষ্ট প্রস্তুত থাকবে। এখন বা দু- এক বছরে যতটা প্রেশার নিবে তখন ততোটাও নিবে না,’ জনাবা বেলি সম্মতি দিয়ে বলেন।

দুই পরিবারই সিদ্ধান্ত নেয় ব্যাপারটি গোপন রাখার। মিম ও তুষারকে ডাকা হলে আরো বেশ খানিকক্ষণ আড্ডা দেবার পর সন্ধ্যার দিকে বিদায় নিয়ে চলে যায়। তার কয়েকদিনের মাঝেই তুষার প্রশিক্ষণের জন্য চলে যায়। মিম তার পড়ালেখাসহ দৈনন্দিন জীবন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যায়। প্রায়ই মিম ও তুষারের পরিবার একে অপরের বাড়িতে বেড়াতে যায়।
এমনি করে দেখতে দেখতে তিনটি বছর পার হয়ে যায়। ইতোমধ্যে জেএসসিতেও মিম সকলকে সন্তুষ্ট করার মতোই ফলাফল উপহার দেয়। বিজ্ঞান বিভাগ নিয়ে বর্তমানে সে দশম শ্রেণিতে পড়ছে। বিভিন্ন ধরনের কুপ্রস্তাব বা অবৈধ-হারাম সম্পর্কে জড়ানোর প্রস্তাব আসলেও, মিম নিজেকে যথেষ্ট নিয়ন্ত্রণে রেখে সেসব এড়িয়ে চলে। এ-ই তিনবছরে মাঝে মাঝে তুষার ছুটিতে বাড়ি ফিরত। সকলের সাথে তখন বেশ হাসিখুশি সময় কাটাতো। মিম তো তুষারকে পেলে সেই ছোট মিমে পরিণত হতো। যতো জমানো কথা ছিল, সব তুষারের কাছে ব্যক্ত করত। তুষার নিজেও মনোযোগ দিয়ে সেসব শুনত। কখনও হাসত, কখনও বকাবকি তো কখনও উপদেশ দিত।

চলবে,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here