নীল শূন্যতা,পর্ব:২

‘নীল শূন্যতা’
লেখনীতে: মাহমুদা
|২|

পরদিন ভোর রাত থেকেই ঝুম বৃষ্টি শুরু হয়। বৃষ্টির বেগ এমন যেন জমিনে পরে থাকা সকল আবর্জনাকে আজ ধুয়ে নিয়ে যাবে। অন্যান্যদিন ভোরবেলা পাখির কিচিরমিচির শুনা গেলেও আজ তা শুনা যাচ্ছে না। সম্ভবত বৃষ্টির জন্য কেউ ঘর থেকেই বের হচ্ছে না। বেলা আটটার দিকে বৃষ্টি কিছুটা ছাড় দেয়। জনাব নাহিদের বাড়ি থেকে বিদ্যালয় প্রায় দেড় ঘণ্টার পথ। সকালের নাস্তা করে স্বামী-স্ত্রী বিদ্যালয়ের উদ্দেশ্যে রওনা হয়। অনিচ্ছা সত্ত্বেও তুষার তার পিতামাতার সাথে বিদ্যালয়ের উদ্দেশ্যে যায়। পথিমধ্যে জনাব নাহিদ তুষারক্র বিভিন্ন কথা বুঝাচ্ছেন। বুঝাচ্ছেন বললেও ভুল হবে। কারণ তার বলার ধরন আদেশ করার সুর টানছে। জনাব নাহিদ একা নয়, বরং জনাবা তাহমিনাও সাথে আছেন। কিন্তু তাদের কথা তুষার কর্ণপাত করছে কি-না তা কেবল তুষার’ই জানে। সে দিব্যি তার মোবাইল চালচ্ছে এবং একটু পরপর হু হু করে সায় দিয়ে বুঝাচ্ছে যে সে তাদের কথা শুনছে।
পথিমধ্যে তুষার থেমে যায়। তাকে থামতে দেখে জিজ্ঞাসুক দৃষ্টিতে জনাব নাহিদ তার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করেন,
‘ কী ব্যাপার, তুষার? তুমি থেমে গেলে কেন?’
‘বাবা, আমার এক ফ্রেন্ড তার ভাইকে নিয়ে আসছে। তোমরা যাও, আমি ওর সাথে দেখা করেই চলে আসছি।’
‘বন্ধুর সাথে পরেও সাক্ষাৎ করতে পারবে। এখন বাহানা না বানিয়ে চলো।’
‘বাবা, প্রমিস চলে আসব। এতদূর যখন এসেছি বাকিটুকুও যাবো। চিন্তা করো না।’
‘কথার খেলাফ যেন না হয়।’
জনাব নাহিদ চলে যায়। তুষার বিদ্যালয়ের মূল প্রবেশদ্বারে দাঁড়িয়ে তার বন্ধুর জন্য অপেক্ষা করে। অফিসরুমে যাওয়ার পথে স্বামী-স্ত্রীর অনেক ছাত্রছাত্রীদের সহিত সাক্ষাৎ হয়। সকলেই তাদের দুজনকে সালাম দিয়ে যার যার ক্লাসের দিকে চলে যায়। অফিস কক্ষে প্রবেশ করে প্রায় সব শিক্ষকদের দেখতে পায়। জনাবা বেলি বসেছিলেন। সকলের উদ্দেশ্যে সালাম দিয়ে স্বামী-স্ত্রী উভয়েই নিজেদের আসনে বসেন।
অন্যান্যদিন জনাবা বেলির সাথে মিমকে দেখতে পাওয়া যেতো। হয় সে কোন কিছুর অন্য বায়না ধরতো, নয়তো খাতায় কোন পড়া লিখে মা-কে দেখাতো। কিন্তু আজ তাকে দেখা যাচ্ছে না। একটু আগ্রহ নিয়েই জনাবা তাহমিনা প্রশ্ন করেন,
‘বেলি ম্যাম, আজ কী মিম আসেনি?’
‘না, আসেনি।’
‘সে কি আজ স্কুলে আসবে না? আজ তো আমার ক্লাসে তার একটি পরীক্ষা আছে।’
‘আসবে, ম্যাম। গতরাতে মিমের আব্বু বাসায় এসেছে। ওর আব্বু নিয়ে আসবে আজ।’

জনাবা বেলির উত্তরে আর কিছুই বললেন না জনাবা তাহমিনা। জনাব নাহিদ শিক্ষক হাজিরা খাতাটি তার স্ত্রীর দিকে এগিয়ে দিলে তাতে স্বাক্ষর করে বিদ্যালয়ে উপস্থিতের সময়টিও উল্লেখ করেন।

~

বিদ্যালয়ে প্রবেশের রাস্তাটির মাথায় তুষার দাঁড়িয়ে কারো জন্য অপেক্ষা করছে। ইতোমধ্যে মিম ও তার বাবা বিদ্যালয়ের সেই রাস্তায় এসে উপস্থিত হয়। অথচ তুষার তাকে বিদ্যালয়ের একজন ছাত্রী হিসেবেই জানে। অপেক্ষারত তুষার মিম ও তার বাবার মাঝে হওয়া কথোপকথনের আংশিক শুনে ফেলে। মিম তার বাবাকে বলছে,
‘,,,,,, তাড়াতাড়ি চলো না, আব্বু। আম্মু তোমার থেকে তাড়াতাড়ি হাঁটতে পারে। ঘোড়ার মতো দৌঁড়ে আসতে হয় আমায়।’
‘তোমার আম্মুরও তো হাজিরা দিতে হয়। তো তাড়াতাড়ি আসবেই। আমাদের তো হাজিরা দিতে হবে না!’
‘উফ, আব্বু। তুমি এত পচা কেন? তুমি চাকরি পেলে কীভাবে?’
‘আমার এ-ই কথার সাথে চাকরির কী সম্পর্ক? ‘
‘অবশ্যই সম্পর্ক আছে। তুমি স্কুলে দেরি করে গিয়েছ, যার জন্য তুমি পেছনের বেঞ্চে বসেছ। তুমি ক্লাসে মনোযোগ দেওনি। দাদু বলে, তুমি পচা ছাত্র ছিলে। তুমি কাজেও এমন দেরি করে যাও। তোমার স্যার তোমায় বকা দেয় না?’
‘না, আম্মু। আমার স্যার তোমার মতো করে ভাবে না তো, তাই বকা দেয় না।’
ইতোমধ্যে তুষারের বন্ধু চলে এসেছে। কোন কিছু না বলেই তুষার সরাসরি তাকে প্রশ্ন করে,
‘এনেছিস?’
‘হুম, এ-ই নে,’ ছেলেটি তুষারের হাতে ছোট পলিথিনের একটি ব্যাগ দেয়।।
পলিথিনটি দেওয়ার সময় এবং তুষার নিজের প্যান্টের পকেটে তা রাখার সময় আশেপাশে তাকিয়ে দেখে কেউ দেখছে কি-না। কাজ শেষ হলে তুষার বিদ্যালয়ে প্রবেশ করে এবং ছেলেটি চলে যায়।
মিমের বাবা তাকে একটি দোকানে নিয়ে গিয়ে চকলেট কিনে দেয়। মিম তার বাবার পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তুষার ও ছেলেটির কর্মকাণ্ড দেখে। মিমকে বিদ্যালয়ের মূল প্রবেশদ্বারে নামিয়ে দিয়ে তার বাবা বলেন,
‘আগে তোমার আম্মুর সাথে দেখা করে নিবে, কেমন?’
‘আচ্ছা, আব্বু।’
মিম বিদ্যালয়ের ভেতর প্রবেশ করলে তার বাবা চলে যায়। বিদ্যালয় মাঠের একস্থানে বেশ কয়েকজন ছাত্রছাত্রী জমা হয়েছে। সকলেই হাসাহাসি করছে। কৌতূহলী মিম সেদিকটার ঘটনা বুঝবার জন্য সেদিকে যায়। ভীড় ঠেলে সামনে এগিয়ে দেখতে পায় তুষার মাঠে বসে আছে। তার শরীরের অনেকাংশে কাদামাটি লেগে আছে। তুষার বিরক্তি, লজ্জা ও রাগ মিশ্রিত দৃষ্টিতে সকলের দিকে তাকিয়ে আছে। মিম হাসছেও না, আবার কিছু বলছেও না। অথচ অন্যরা হাসছে। তুষার কপাল কুঁচকে মিমের দিকে তাকায়। মিম তার চকলেট ব্যাগে রেখে তুষারের দিকে এগিয়ে বলে,
‘ভাইয়া, আজ বৃষ্টি হওয়ায় রাস্তায় তো কাদা থাকবেই। আপনি একটু সাবধানে হাঁটবেন না, এতোবড় হয়েছেন? এখানে বসে না থেকে উঠুন। আমি আপনায় আম্মুর কাছে নিয়ে যাচ্ছি, সে আপনায় পরিষ্কার হতে সাহায্য করবে।’

বলতে বলতে ছোট মিম তুষারের এক হাত ধরে টেনে তুলার চেষ্টা করে। মিমের চেষ্টা দেখে তার দুজন সহপাঠী এবং একই সাথে ভালো বন্ধু শিশির ও নিহার এগিয়ে আসে তুষারকে সাহায্য করতে। ছোট মিমের এতটুকু কাজে তুষার মুগ্ধ হয়। নিহারের কাছে নিজের ব্যাগ দিয়ে মিম বলে,
‘প্রথম বেঞ্চে বসেছিস?’
‘হ্যাঁ, তোর জন্য জায়গাও রেখেছি।’
‘আচ্ছা, ব্যাগ নিয়ে রাখ। ব্যাগের কাছ থেকে সরবি না। নয়তো আবার পেন্সিল, কলম বা অন্য কিছু হারিয়ে যাবে।’
‘আচ্ছা।’

নিহার ও শিশির চলে যায়। তুষার তখনও সেখানে দাঁড়িয়ে আছে। মিম তুষারের এক হাত ধরে টেনে এগিয়ে যেতে যেতে বলে,
‘ভাইয়া, আপনার কেউ কি এ-ই স্কুলে পড়ে?’
‘না-তো। কেন?’
‘তবে আপনি স্কুলে কেন এলে?’
‘আব্বুর সাথে এসেছি।’
‘কে আপনার আব্বু?’
‘তোমাদের নাহিদ স্যার।’
‘ওহ, আচ্ছা।’

অফিসরুমের সামনে যেতেই জনাব নাহিদকে বের হতে দেখা যায়। মিম ও তুষারকে একত্রে দেখে সে খানিকটা অবাক হয়। তুষারের অবস্থা দেখেও খানিকটা ঘাবড়ে যায়। মিম তাকে সালাম দিয়ে বলে,
‘স্যার, ভাইয়া পড়ে গিয়েছিল। আমি তাকে অফিস পর্যন্ত নিয়ে এসেছি।’
‘খুব ভালো করেছ। এখন তুমি যাও,’ জনাব নাহিদ মিমের মাথায় একটু হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন।
‘আচ্ছা।’

মিম চলে যায়। তুষার মিমের চলে যাওয়ার দিকে তাকায়। জনাব নাহিদ বলেন,
‘চোখ কোথায় রেখে হাঁটিস?’
‘আব্বু, পা পিছলে গেলে এখানে আমার কী দোষ?’
‘চল আমার সাথে, এ-ই কাদামাটি পরিষ্কার করে নিবি।’

তুষার অতিরিক্ত কিছু না বলে তার বাবার সাথে চলে যায়। যেই মুহুর্তে তুষার পানির সাহায্যে তার পোশাক থেকে কাদামাটি পরিষ্কার করার চেষ্টা করছিল, ঠিক সে মুহুর্তে জনাব নাহিদ তার উদ্দেশ্যে প্রশ্ন করে বলেন,
‘মেয়েটিকে কেমন লাগল?’
‘অদ্ভুত, বাবা। যেখানে অন্য বাচ্চারা হাসাহাসি করছিল, সেখানে সে আমাকে সাহায্য করল। এক মুহুর্তে মনে হচ্ছিল ওটা এলিয়েন মেয়ে।’

তুষারের উত্তর শুনে জনাব নাহিদ তৃপ্তির হেসে উঠলেন। জনাব নাহিদের মুখে হাসি দেখে তুষার কপাল কুঁচকে তার পিতার দিকে তাকায়। জনাব নাহিদ হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ালে নাহিদ বেশ অবাক হয়। সে বিষ্মিত কন্ঠে প্রশ্ন করে,
‘সত্যি? তোমরা এ-ই মেয়েকে পছন্দ করেছ?’
‘মিথ্যা বলে আমার কী লাভ? আচ্ছা, তুই তোর মায়ের সাথে থাকবি। আমার ক্লাস আছে, আমি যাই,’ জনাব নাহিদের প্রস্থান ঘটলে নাহিদ খানিকটা চিন্তিত হয়ে পরে।
চলবে,,,,,

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here