বর্ষার_এক_রাতে পর্ব ১৩

#বর্ষার_এক_রাতে
#সাদিয়া

১৩
তূবার জ্ঞান ফিরে অনেক পরে। তার পাশে বসে আহফিন শক্ত হাতে তার হাত ধরে রেখেছিল। তূবা চোখ খুলতেই আহফিন তার মাথায় হাত রাখে। আলতো হাতে মাথায় হাত বুলাতে লাগল আহফিন। তূবা একবার আহফিনের দিকে তাকিয়ে মুখ ফিরিয়ে নিল। বড্ড কষ্ট লাগছে তার। লোকটার প্রতি পিনপিনে রাগ টা বাড়তে লাগল তূবার।

আহফিন তূবার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে শান্ত স্বরে বলল
“আগের কথাটাই শুনলে এর পরেরটা শুনবে না? আগের টা যেহেতু শুনতে পেরেছো পরের কথাও শুনতে হবে তোমার।”
“…
তূবার চোখ মুখ ফেটে কান্না আসছিল। নাক টেনে কান্না আড়াল করার চেষ্টা করল সে।
“আমি শুনতে চাই না।”
তার কথায় কান না দিয়ে আহফিন নিজের মতো বলতে লাগল।

“লুবনার প্রতি আমার ফিলিংস টা শুধু ভালো লাগার ছিল। ভালোবাসার মানে তো আমি তোমার সংস্পর্শে বুঝতে পেরেছি। হ্যাঁ এটা স্বীকার করতে কোনো অসুবিধা নেই যে প্রথম রাতে আমি শুধু রাগের বশে তোমার সাথে মিলিত হয়েছি। সে রাতে আমার রাগের মাত্রা এত যেন প্রতিটা মুহূর্তে আমি তোমাকে লুবনা মনে করে মারতে চেয়েছিলাম। কষ্ট দিতে চেয়েছিলাম। ভেতরের রাগ টা সবটা ঝেড়ে ফেলতে চেয়েছিলাম আমি। কিন্তু যখন তোমার মুখের দিকে তাকাতাম তখন কষ্ট দিতে পারতাম না। প্রথম দিন রাতে ঘুমের মাঝে স্বপ্ন দেখে জেগে উঠি। লুবনার উপর রাগে আমি তোমার গলা চেঁপে ধরতে যাই কিন্তু তখন তুমি ঘুমে ছিলে তোমার ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে আমার হাত আর চলল না। স্নিগ্ধ একটা বাতাস পাই বুকে। পাশ ফিরে শুয়ে পরেছিলাম তখন। সকালে যখন তোমাকে পাই নি কেমন অধৈর্য হয়ে গিয়েছিলাম। মনে হচ্ছিল কিছু চলে গেছে নিজের থেকে। সেদিন সারাটা দিন আমি তোমার কথা ভেবেছি। তোমার মুখশ্রী আমার চোখের নাগালে ছিল। ভাবছিলাম কখন রাত হবে তোমায় চোখের সামনে পাবো। মায়াবী মুখের আঁচে বুকটা খানিক শীতল হবে। এরপর থেকে আমি তোমার কাছে যাই শুধু নিজের জন্যে। আমার ছুঁয়ায় আমি হিংস্রতার বদলে কোমলতা দিতে চাইতাম। দিনদিন তোমার প্রতি আমার একটা আকর্ষণ বেড়েই উঠছিল। একটা টান, একটা মায়া, সেই ঝড় সৃষ্টি করা অনুভূতি। তোমাকে দেখার তৃষ্ণা বাড়তেই লাগল আমার। আমি বুকে তোমার প্রতি অনুভূতি অনুভব করতে শুরু করেছিলাম। তোমার স্পর্শ পেলে আমার শরীরে অদ্ভুত শিহরণ লাগে। তোমার প্রতি আমার যে অন্যরকম অনুভূতি তার নাম আমি জানি না। কবিরা বলে গেছে এমন অনুভূতির নামই নাকি ভালোবাসা। তবে বলব আমি তোমার জন্যে আমার বুকে বাসা বেঁধেছি। ভালোবাসার একটা বাসা।”

তূবা আহফিনের দিকে মুখ ফিরিয়ে কেঁদে ফেলল। আহফিন কান্না ভরা চোখে তূবার পানি মুছে দিল।
“তূবার চোখের পানি বুকে ছুরিকাঘাত করে যে। কাঁদবে না কোনোদিন আমার সামনে। ভেতরে খুব জ্বালা হয়।”
“…
তূবা কেঁদেই যাচ্ছে।
আহফিন হাত দিয়ে তার চোখের পানি গুলি মুছে দিচ্ছিল।
“তোমাকে ভালোবেসে বুকে ভালোবাসার ঘর বেঁধেছি। সেখানে থাকবে তূবা?”
সে উঠেই আহফিন কে জড়িয়ে ধরল কেঁদে। আহফিন চোখ বন্ধ করে তূবা কে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। দুই ফোটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল তার। এ কিসের অশ্রু তা জানা নেই। তূবার মাথা টা নিজের সাথে চেঁপে রেখেছে যেন কখনো ছাড়বে না। আহফিন চোখের পানি ছেড়ে তূবার মাথায় চুমু দিল।

তূবার কপালে গভীর চুম্বন করল আহফিন। তূবা কেঁদে আবার জড়িয়ে ধরল আহফিন কে।
“আমাকে ছেড়ে চলে গিয়ে একা করে দিবে না তো তূবা?”
“আমি যেন শেষ নিশ্বাস আপনার বুকের মাঝেই ছাড়তে পারি আহফিন।”

“তূবা।”
“হুম?”
“জানো কেন তোমাকে আমি এসব কথা আজ বলেছি?”
“না জানি না।”
আহফিন তূবা কে বুক থেকে তুলে মুখামুখি হয়ে বসল।
“লুবনা কাল আমায় কল করেছে।”
তূবার হাসি আনন্দ আবার মিলিয়ে গেল। আহফিনের দিকে অসহায় দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে রইল।
“ওই পাগলি তুমি মন খারাপ করেছো কেন? আল্লাহ কখনো কাউকে ছেড়ে দেয় না। কিছু পাপের শাস্তি তিনি দুনিয়াতেই দিয়ে দেন।”
“….
“লুবনা আমার সাথে যা করেছে ঠিক তার সাথে ইয়োক তা করেছে। ইয়োক তাকে ব্যবহার করে ছেড়ে দিয়েছে। সে এখন দেশে এসে আমার সাথে দেখা করতে চায়। আমার কাছে ফিরে আসতে চায়।”
“…
“পাগলি তোমার কি মনে হয় আমি রাজি হবো? আমি আমার তূবা কে ছাড়া আর কিছু বুঝি না। বুঝতে চাইও না। তূবা আমার একটা পৃথিবী।”
তূবা বজ্রের গতিতে আহফিন কে আবার জড়িয়ে ধরল।

তূবা সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে দেখতে পেল এক জোড়া চোখ তার উপর নিবদ্ধ। চমকে উঠেছে তূবা। ভীত স্বরে জিজ্ঞেস করল।
“তাকিয়ে আছেন যে?”
“…
“মাথা নাড়াচ্ছেন কেন?”
আহফিন মুচকি হাসল তার দিকে তাকিয়ে।
“ঘুম থেকে উঠলেন কখন?”
“ঘুমালে তো ঘুম থেকে উঠব।”
“মানে কি আহফিন?”
“রাত জেগে আমি আমার জীবনের জ্যোৎস্না কে দেখেছি।”
তূবা কি বলবে জানে না। কিন্তু মানুষটা বদ্ধ পাগল বৈ আর কিছু না। এমন পাগলামি গুলি তার বুকে আনন্দের ঝড় তুলে দেয়।

—-
সেদিন তূবা রাতে একাই আহফিনের বাসায় এলো। কিন্তু বাড়ি টা একদম নীরব। এমনিতে নীরবই থাকে। তবে আজ যেন আরো থমথমে লাগছে। কারণ সারা বাড়িতে একটুও আলো নেই। তূবার ভেতরে খানিক ভয় হচ্ছে। এমন কুচকুচে অন্ধকারে একা একটা মেয়ে ভয় পাওয়াটা এত অস্বাভাবিক নয়। সে শুকনো ঢোক গিলে ডাকল “আহফিন?” “আহফিন আপনি কোথায়?” “আহফিন আপনি কি বাসায় নেই?”
কোনো সাড়াশব্দ আসে না। এবার তূবা খানিক জোরালো ভাবে ভয় পেতে শুরু করেছে। কিন্তু তেমন পাত্তা না দিয়ে সে ব্যাগ থেকে নিজের ফোন বের করে ফ্লাশলাইট অন করল।

কিছুদিন আগে আহফিনই তূবার জন্যে ফোন টা নিয়ে এসেছে। তূবা একবার ইচ্ছা হয়েছিল একটা স্মার্টফোন চালানোর। কিন্তু টাকার অভাবে কিনতে পারেনি। ইচ্ছা কে অবশেষে মাটি চাঁপাই দিতে হয়েছে।
“এই পৃথিবী তে কত হাজার হাজার মানুষ প্রতিদিন নিজের ইচ্ছা কে নিরিহ ভাবে মাটি চাঁপা দেয় তা আয়ত্তের বাহিরে। এটাই জীবন। এই তো মধ্যবিত্ত নিম্নবিত্তের সংগ্রাম।”
তূবা কে ফোন টা দেওয়ার পর সে স্তব্ধ হয়ে ছিল। আহফিন বিষয় টা বুঝেও হাল্কা ভাবে নিল। নিজ হাতে সারারাত তূবা কে একটা স্মার্টফোনের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল। সেদিন তূবা মুখ ফুটে আহফিন কে কিছু না বললেও সে মনে মনে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছিল। লোকটার দিকে ছলছল নয়নে তাকিয়ে ছিলো স্লান হেসে।


তূবা লাইট এদিক ওদিক ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠছিল আর আহফিন কে ডাকছিল। তূবার এই ডাক কেউ শুনতে পাচ্ছিল না।

তূবা আহফিনের ঘরের সামনে গিয়ে দেখতে পেল দরজা লাগানো। তূবার ভয়ে এবার শরীর কাটা দিতে শুরু করেছে। কি হচ্ছে আজ? আসার সময় তার আম্মা দুই তিনবার না করেছে এই দিনে কাজে যেতে। তবুও আজ এলো। না জানি কি হয়। তূবা ঢোক গিলে দরজা ঠেলে দিল। কাঁপা পায়ে ভেতরে গেল সে। আহফিন কে ডাকলও বার কয়েক। লাইটের সুইচ অন করল। কিন্তু আলো এলো না। তূবার ভেতরে ভয়ে ধরাক ধরাক শব্দ হচ্ছে। এবার সে আহফিনের নাম্বারে কল দিল। কিন্তু ফোন বন্ধ। তূবার আর মন সাই দিল না ভয়ে। সে পিছন ফিরে ঘুরার আগেই একটা শক্ত হাত তার মুখ চেঁপে ধরেছে। সঙ্গে মাগায় বোধহয় ছুরিও ঠেকিয়েছে। তূবার হাত থেকে ফোন টা ধপাস করে উল্টো হয়ে নিচে পড়ে গেল। চোখ বড়বড় হয়ে এসেছে তার। ভেতরটা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গিয়েছে ভয়ে। নিজেকে ছাড়ানোর জন্যে ছটফট করতে লাগল সে। বিনিময়ে গলায় রাখা ছুরি শক্ত চাঁপ অনুভব করল। তূবা সঙ্গেসঙ্গে নীরব হয়ে যায়। ভয়ে মাথায় কিছুই আসছে না তার। সব কিছু লোপ পেয়েছে। কান্না পাচ্ছে খুব। তার সুখের দিন গুলি খুব অল্পই হয়। এবার আবার কোন কালবৈশাখী ঝড় চলে এলো হঠাৎ? জীবন কে আবার এলোমেলো করে দিয়ে যাবে না তো? কেন যেন রনির কথা মনে আসছে। রনি আবার..!
তূবার চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ল।

চলবে♥

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here