বসন্তের অচেনা সুর পর্ব -০৩ ও শেষ

#বসন্তের_অচেনা_সুর
#শেষ_পর্ব
#লেখিকা_নূরজাহান_ফাতেমা

হটাৎ ফিক করে হেসে ফেলল প্রিয়া।

“মজা করছিলাম আমি।এমন কিছুই হয়নি।এই কয়দিনে কই ম’রতে গেছিলি তুই।লাইট দিয়ে খুঁজেও তোকে অনলাইন পাইনি।”

স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে মৌনতা।খুব ভয় পেয়েছিল সে।তার এতো সাধের আইডি অন্য কারো দখলে ভাবতেই শিউরে উঠেছিল।প্রিয়াকে এক এক করে এই কয়দিনের ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো বলে মৌনতা।কিভাবে বিয়ে ভেঙেছে সেসব বলে বিস্তর হাসে দুইজন।একটু পরেই রুমে প্রবেশ করে হিয়া।এসেই গম্ভীরমুখে বলে,

“আপুর কোন কাজই নেই।তোকে চাচার কবল থেকে বাঁচাতে এখানে নিয়ে এসেছে।আর বুদ্ধিটা নাকি পারভেজ ভাইয়ের ছিলো।তোকে কয়েক মাস এখানে রেখে দিবে।”

“বলিস কি বইন!ওই বেটা খাটাস আমাকে রক্ষা করতে এই বুদ্ধি দিয়েছে?কিন্তু এখানে থেকে আমি করব টা কি?আমার এডমিশন এর কি হবে!”

“সে জন্য তো পারভেজ ভাই আছেই।ইংলিশ ডিপার্টমেন্ট এর স্টুডেন্ট সে।হিউম্যানিটিস গ্রুপ এ ইংলিশটাই হার্ড হয়।এছাড়া অন্য বিষয় গুলোও সে তোকে পড়াবে।…”

“মাপ চাই বইন।ওই বেটা জাদরেল এর কাছে আমি পড়তে পারব না।কথায় কথায় অপমান করে।তাছাড়া যেই রাগ ওনার।আস্ত গিলে খাবে আমাকে।”

“কিন্তু এটা ছাড়া তোমার কোন উপায়ও নেই মেয়ে।তুমি যদি ওনার কাছে না পড় তো আমি বাড়িতে বলে দিব কিভাবে বিয়েটা ভেঙেছো।”

“তুই এত্তো খারাপ আপু।এটা নিয়ে আমাকে ব্লাকমেইল করতে পারলি?”

“হ করলাম।তোর ভালোর জন্যই করছি এটা।পারভেজ ভাইয়ের কাছে আজ থেকেই পড়বি তুই।আমি আজই রাজশাহী চলে যাব।কাল ইম্পর্ট্যান্ট ক্লাস আছে।”

নিজের বক্তব্য শেষ করে হনহন করে বেরিয়ে যায় হিয়া।এদিকে অসহায়ের দৃষ্টি মেলে রয় মৌনতা।এখন থেকে নিজের সবচেয়ে অপ্রিয় ব্যক্তিটির সান্নিধ্যেই কাটাতে হবে তার বেশিরভাগ সময়।
_______
কেটে গেছে কয়েক মাস।হিয়ার ইচ্ছানুযায়ী পারভেজের কাছেই প্রতিদিন পড়ছে মৌনতা।ছেলেটা যতটা রুষ্টই হোক।প্রত্যেকটা টপিক খুব ধৈর্য্য সহকারে বুঝিয়ে পড়ায়।যার দরুন এডমিশনের জন্য খুব ভালো প্রিপারেশন হয়েছে মৌনতার।উপরন্তু পারভেজের সাথে তার সখ্যতাও সৃষ্টি হয়েছে।মৌনতার প্রিয় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এডমিশন পরীক্ষার আর মাত্র দুইদিন বাকি।কালই হিয়ার কাছে পাড়ি জমাবে সে।এতোদিন ঢাকায় অবস্থান করায় বাড়ির প্রত্যেকটা সদস্যের প্রতি মায়া জমেছে।পারভেজের সাথে নিয়ম করে ঝগড়া করতো সে।কাল থেকে আর তাও হবে না ভেবে মন ক্ষুন্ন হয়।পড়ার টেবিলে বসে হাজার চেষ্টা করেও মন বসাতে পারে না।একটু প্রশান্তি পেতে ছাদ বাগানের দিকে পা বাড়ায় সে।সময়টা বিকেল।মৃদু বাতাস বইছে।তার মাঝে গিটার হাতে ছাদে বসে আছে পারভেজ।পড়নে থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট।তার উপর দিয়ে ছাই রঙা টি শার্ট পড়েছে সে।এলো চুলগুলো কপালে লেপ্টে রয়েছে।গিটারে টু টাং আওয়াজ তুলছে সে।জড়ানো গলা খাঁকাড়ি দিয়ে পরিষ্কার করে সুর তোলে মৃদু কন্ঠে,

“ফাগুন হাওয়ায় হাওয়ায় করেছি যে দান
তোমার হাওয়ায় হাওয়ায় করেছি যে দান

আমার আপনহারা প্রাণ, আমার বাঁধন-ছেড়া প্রাণ

তোমার হাওয়ায় হাওয়ায় করেছি যে দান
ফাগুন হাওয়ায় হাওয়ায় করেছি যে দান

আমার আপনহারা প্রাণ, আমার বাঁধন-ছেড়া প্রাণ

তোমার হাওয়ায় হাওয়ায় করেছি যে দান
ফাগুন হাওয়ায় হাওয়ায় করেছি যে দান

তোমার অশোকে কিংশুকে
তোমার অশোকে কিংশুকে
অলক্ষ্য রঙ লাগল আমার অকারণের সুখে
তোমার অশোকে কিংশুকে
অলক্ষ্য রঙ লাগল আমার অকারণের সুখে

তোমার ঝাউয়ের দোলে
মর্মরিয়া ওঠে আমার দুঃখরাতের গান

তোমার হাওয়ায় হাওয়ায় করেছি যে দান
ফাগুন হাওয়ায় হাওয়ায় করেছি যে দান

পূর্ণিমাসন্ধ্যায় তোমার রজনীগন্ধায়
রূপসাগরের পারের পানে উদাসী মন ধায়
পূর্ণিমাসন্ধ্যায় তোমার রজনীগন্ধায়
রূপসাগরের পারের পানে উদাসী মন ধায়

তোমার প্রজাপতির পাখা
তোমার প্রজাপতির পাখা
আমার আকাশ-চাওয়া মুগ্ধ চোখের রঙিন স্বপন মাখা
তোমার প্রজাপতির পাখা
আমার আকাশ-চাওয়া মুগ্ধ চোখের রঙিন স্বপন মাখা

তোমার চাঁদের আলোয়
মিলায় আমার দুঃখসুখের সকল অবসান

তোমার হাওয়ায় হাওয়ায় করেছি যে দান
ফাগুন হাওয়ায় হাওয়ায় করেছি যে দান

আমার আপনহারা প্রাণ, আমার বাঁধন-ছেড়া প্রাণ

তোমার হাওয়ায় হাওয়ায় করেছি যে দান
ফাগুন হাওয়ায় হাওয়ায় করেছি যে দান।”

মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকে মৌনতা।কতটা আবেগ নিয়ে পারভেজ গানটি গাইছে তার মুখশ্রীজুড়ে তা স্পষ্ট।হটাৎ পারভেজের তার দিকে চোখ পড়ায় লজ্জা পায় মৌনতা।মুচকি হাসে পারভেজ।গলা ছেড়ে দিকে হাঁকে,

“কি বেয়াইনসাব আড়ালে কেন?লজ্জা পাওয়ার কিছু নেই।এদিকটায় আসেন।”

পারভেজের কথাগুলো মৌনতার লজ্জা আরও কয়েকগুন বাড়িয়ে দেয়।দৌড়ে পালায় সে সেখান থেকে।নিচের ঠোঁট কামড়ে হাসে পারভেজ।বিড়বিড় করে বলে,

“পালিয়ে বেড়াচ্ছো মেয়ে পালাও।পালিয়ে যাবে আর কতদূর।চোখের অদৃশ্য হলেও মনের আড়াল কি হতে পারবে!”

________
দুই বছর পর,
পারভেজের প্রচেষ্টায় মৌনতা সব ভার্সিটিতেই চান্স পেয়েছিল।সারা এলাকায় রই রই পড়ে যায় যখন সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম স্থান অর্জন করে।লজ্জিত হয় মইন আহমেদ।তখন জোর করে বিয়ে দিলে হয়ত আজকের এই দিন দেখতে পেত না ভাবে।মৌনতা তার সম্মান কুড়ায়।পথে ঘাটে সব যায়গায় সম্মানিত ব্যক্তিবর্গেরও সম্মান কুড়ায় সে।মৌনতার প্রতি রাগ পড়ে যায় তার।মনজুরাও কিছুটা সদয় হয়।মৌনতা স্বপ্নের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে অধ্যয়নরত রয়েছে।তার সবচেয়ে অপ্রিয় ব্যক্তিটিই সময়ের ক্রমবর্ধমানে অতি প্রিয় অভ্যেস হয়ে ওঠে।যে অভ্যেসকে ছাড়তে না পেরে নিজের স্বপ্ন ছেড়ে দেয়।এই যেমন ক্যারিয়ারের চেয়েও সেই প্রিয় অভ্যেসটিকে একান্ত আপন করে পেতে চলেছে আজ।পারভেজ পড়াশোনা শেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েই লেকচারার হিসেবে জয়েন করেছে।তার সি জি পি এ খুব ভালো ছিলো বলে জব পেতে বেগ পোহাতে হয় নি।জব পেয়ে যখন মৌনতাকে নিজের করে পেতে চায় লজ্জায় নিরব সম্মতি দেয় মৌনতা।তার পরিবারের লেকজনের কাছেও বিশাল পাওয়া এটা।মৌনতা অতিরিক্ত দুষ্ট স্বভাবের বলে তাকে অপছন্দ করত সবাই।সব সময় দূর্ঘটনা ঘটায় জন্য অপয়া নামে আখ্যায়িত করেছিলো।কিন্তু হাজার হলেও তো মেয়ে।এতো ভালো প্রস্তাব প্রত্যাখান করতে পারে না।উপরন্তু তার দুই মেয়ে জা হলে মিলেমিশে থাকবে ভেবে কিঞ্চিৎ খুশিও হয় মইন।একই বিশ্ববিদ্যালয়ের একই ডিপার্টমেন্ট এর শিক্ষক ছাত্রীর সম্বন্ধ হওয়ায় ঘরোয়া ভাবেই অনুষ্ঠিত হয় বিয়েটা।বাসর ঘরে মাথায় বড় ঘোমটা টেনে বসে না থেকে বেলকনিতে গ্রিল ধরে হাওয়া লাগাচ্ছে মৌনতা।বসন্তকাল চলায় নাতিশীতোষ্ণ হাওয়ায় শরীর মন ফুরফুরে হয়ে আছে।সারাদিনের ক্লান্তিও উবে গিয়েছে নিমিষে।ঘরে ঢুকে মৌনতার উপস্থিতি না পেয়ে বেলকনিতে পা রাখে পারভেজ।সঙ্গে সঙ্গে মিষ্টি একটা ঘ্রান নাক ছুঁয়ে দেয় তার।এক পা দু পা করে এগোয় মৌনতার দিকে।ঘোরলাগা নয়নে তাকায় মৌনতার পানে।গতানুগতিক লাল শাড়ি বা লেহেঙ্গা না পড়ে আগুনরঙা শাড়ি পরেছে সে।বড্ড মিষ্ট লাগছে মেয়েটিকে।আড়চোখে পারভেজকে দেখে মৌনতা।লজ্জা মিশ্রিত কন্ঠে রিনরিনে আওয়াজ তোলে,

“এভাবে কি দেখছেন?”

“তুমিই বা উদাস হয়ে কি দেখছো?

পাল্টা প্রশ্ন করে পারভেজ।প্রতিউত্তরে মৌনতা বলে,

“ভাবছি বসন্তেরও সুর বদলায়।”

“মানে!”

“আপনার সাথে আমার কাটানো প্রতিটা বসন্তে আমারঅপ্রিয় তালিকায় ছিলেন আপনি।অথচ ষষ্ঠ বসন্তেই সুরটা বদলে গেল।আস্তে আস্তে আমার প্রিয় হয়ে গেলেন আপনি।নিজের ক্যারিয়ারের জন্য বিয়ে বিমুখ আমিও আপনাকে একান্ত করে পাওয়ার নেশায় বিয়ের পিঁড়িতে বসলাম পড়াশোনা শেষ হওয়ার আগেই।”

স্মিত হাসে পারভেজ।মৌনতার দিকে ঝুঁকে তার মুখের উপর লেপ্টে থাকা ছেড়ে দেওয়া ক্ষুদ্র এলো চুলে হালকা ফুঁ দেয়।কন্ঠে বদমাইশি ফুটিয়ে বলে,

“সত্যি বসন্তের সুর বদলায়।তোমার চেনা বসন্তের অচেনা সুরে আজ থেকে মাতাল হবে তুমি।অনুমতি পাবো কি মাতাল করার?”

নিরব সম্মতিতে লজ্জায় নুইয়ে যায় মৌনতা।পারভেজের কথার অর্থ স্পষ্ট।আচমকা জড়িয়ে ধরে পারভেজ।দুজনেই ভেসে যায় বসন্তের অচেনা সুরে।
এ সুর ধীরে ধীরে অতি পরিচিত হবে।যুগ যুগ ধরে কেটে যাবে পরিচিত হতে।কিন্তু এই অচেনা সুর চির স্মরণীয় হয়ে থাকবে তাদের মাঝে।

সমাপ্ত

(অনেকদিন পর গল্প দেয়ায় রিচ কমে গিয়েছে।তাই দীর্ঘযাত্রার করতে চাইলেও এখানেই সমাপ্তি টানলাম।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here