গল্পঃ #বাক্সবন্দী_চিঠি
লেখকঃ Ninika Jaman Noor
পর্বঃ ১৬
সেদিন আর তারা গেলো না ইতুর বাড়ি।
আবির অনেক বলেও ইতুকে রাজি করাতে পারেনি।
ইতুর মা ইতুকে কল দিয়েছিলো কিন্তু ইতু কথা বলেনি। আবির কথা বলে বুঝিয়েছে তাদের। ইতুর বাবা কষ্ট পেলেন ইতুর ব্যবহারে।
পরেরদিন থেকে ইতু সবাইকে এড়িয়ে চলতে শুরু করে। আবিরের মা কয়েকবার কথা বলেতে চাইলে ও ইতু এড়িয়ে গেলো তাকে। ইতু এমনভাবে সবাইকে এড়িয়ে চলতে শুরু করেছে মনে হচ্ছে তার আশেপাশে কেউ নেই।
এভাবেই দুই দিন কেটে গেলো, ইতু কারোর সাথে কথা না বলে নিজের মতো করে কাজ করে যায়। আবিরের মা কে ঘরের কাজে নিরবে সাহায্য করে। আবির সবই দেখে গেছে এই দুইদিন কিছু বলেনি। ইতুকে মানিয়ে নেয়ার সময় দিয়েছে। রাতে ঘুমাতে আসলেও আবির কাথা বালিশ নিয়ে নিচে শুয়ে পড়ে।
রাতে সবাই ঘুমিয়ে যাওয়ার পর হঠাৎ আবির কিছুর শব্দ শুনে ঘুম থেকে জেগে ওঠে। বিছানায় তাকিয়ে দেখে ইতু নেই। আবির ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে রাতের ২ঃ৪৫ বাজে। আবির ইতুর নাম ধরে কয়েকবার ডাক দিলো। দরজা খোলা দেখে আবির রুম থেকে বেরিয়ে নিচে গিয়ে দেখে বাড়ির মেইন দরজা খোলা।
আবির এর বুকে মোচড় দিয়ে উঠলো। বুজতে পারছে ইতু অঘটন ঘটিয়ে ফেলেছে। আবির তাড়াতাড়ি অনুর রুমের দরজা নক করলো।
এতো রাতে আবিরকে দরজার সামনে দেখে অনু বেশ অবাক হলো।
“কিরে ভাই তুই এতো রাতে, কোনো সমস্যা? ”
আবির কাঁপা কাঁপা গলায় বললো, “ইতু পালিয়ে গেছে।”
অনু চিৎকার করে বললো, “কি?? কখন? ”
আবির অনুর মুখে হাত দিয়ে বললো, ” আস্তে কথা বল সবাই শুনবে। তুই একটু দরজাটা আটকে দে আমি ইতুকে খুঁজে নিয়ে আসছি। প্লিজ ততক্ষণে কাওকে কিছু বলিস না। আমার যদি আসতে দেরি হয়ে যায় কিছু একটা বলে মেনেজ করে নিস। ”
“তা ঠিক আছে ভাই। কিন্তু তুই ইতুকে কোথায় খুজবি।আর ও এমন একটা কাজ করলো কি করে?”
আবিরের চোখ ছলছল করে উঠলো। ইতু এমন কিছু করবে ভাবতেই পারেনি। আবির ভেজা গলায় বললো, “যানিনা অনু, কিচ্ছু যানি না। কিন্তু যে করেই হোক ওকে খুঁজে বের করবো। তুই দরজাটা লাগিয়ে দে আমি আসছি।”
আবির বেরিয়ে যাওয়ার পর অনু রুমে গিয়ে থম মেরে বসলো। অনু যে এমন কিছু করবে ভাবতে পারেনি। তার ভাইটার জন্য খারাপ লাগছে খুব। মুখের দিকে তাকানো যাচ্ছিলো না। ইতুকে হারানোর ভয় যেনো তাকে ঝেকে ধরেছে।
অনু দীর্ঘ শ্বাস ফেলে কুয়াশাকে কল দিল।
ইতু বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে বসে আছে। এতোরাতে কনো বাসই ছাড়বেনা। ভোর ৫টায় একটা বাস আছে ইতু ওটাতেই চট্টগ্রাম চলে যাবে। এই দুইদিন অনেক চিন্তা ভাবনা করে আজকে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে। ইতু নিজের মনেই বির বির করতে লাগলো, ” থাকবো না আমি এখানে, কেউ বুজেনি আমাকে। নিজের বাবা মা ও না।
এখানে থেকে আবির ভাইয়ের সাথে সংসার করার থেকে আমি চট্টগ্রাম চলে যাব। সেখানে পড়ালেখা করে কোন একটা চাকরি করে নিজের মতো থাকবো। আমার কথা যখন কেউ ভাবেনি আমিও কারোর কথা মনে করবো না। হ্যাঁ বাবা মা, অনু, মামনি সবার কথা মনে পড়লেও নিজেকে সামলে নিতে পারব। কিন্তু তারপরেও আমি আবির ভাইয়ের সাথে সংসার করতে পারবোনা। ভালোবাসি তার মানে এই নয় যে, নিজের আত্মসম্মান বিসর্জন দিয়ে দিব। সে আমি কিছুতেই ভুলতে পারবো না।
রাত তিনটা 15 মিনিট।।
ইতু হঠাৎ খেয়াল করলো কিছু দূরে কিছু ছেলে তার দিকে তাকিয়ে হাসাহাসি করছে। ইতুর ভয় করতে শুরু করল। ছেলেগুলো হেলতে-দুলতে তার দিকে আসতে লাগলো। ছেলেগুলোর হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে নেশাখোর। ইতুর ভয় যেন কয়েকগুণ বেড়ে গেল। মনে মনে আল্লাহকে ডাকতে লাগলো। ছেলেগুলোকে কাছে আসতে দেখেই ইতর ভয়ে বুক কাপাকাপি শুরু হলো। ইতু মনেপ্রাণে চাইছে এখান থেকে পালিয়ে যেতে কিন্তু ভয় যেন পুরো শরীর জমে গেছে।
এত ভয় আশেপাশে তাকাতে লাগলো। হঠাৎ অনুভব করল কেউ তার হাত শক্ত করে ধরেছে। ইতু ছেলেগুলো ভেবে ভয়ে চিৎকার করতে গিয়ে দেখলো তার পাশে আবির বসে। আবির ইতুর দিকে এমন ভাবে তাকিয়ে আছে মনে হচ্ছে তার মহামূল্যবান কিছু হারিয়ে গিয়েছিল সেটা আবার ফিরে পেয়েছে। আবির ইতুকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো।
কাঁপা কাঁপা গলায় বললো, ” আর কখনো এমন কাজ করবিনা ইতু। জানিস তোকে বাসায় না দেখে আমার কি হাল হয়েছিলো। তুই আমাকে মার, ঝগড়া কর, অভিমান কর কিন্তু কখনো আমাকে ছেড়ে যাস না। তোকে ছাড়া আমি এক মুহুর্তও থাকতে পারবো না ইতু। প্লিজ আমাকে ছেড়ে চলে যাস না ইতু। আমি জানি আমার উপর অনেক অভিমান তোর। তোকে অনেক কষ্ট দিয়েছি আমি। প্লিজ আমাকে ক্ষমা করে দে। ”
ইতু থম মেরে বসে আছে। আবিরকে এখানে আশা করেনি সে। আবির এখনো তাকে শক্ত করে ধরে রেখেছে। মনে হচ্ছে আবির তাকে ছেড়ে দিলে হারিয়ে ফেলবে।
ইতু আবিরকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল। আবির এর দিকে তাকিয়ে দেখে আবির করুন মুখ করে তার দিকে তাকিয়ে আছে।
ইতু অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে নিল। শক্ত গলায় বললো,” তুমি কেন এসেছ এখানে। চলে যাও এখান থেকে। আমি তোমার সাথে ফিরবো না। ”
ইতুকে চমকে দিয়ে আবির ইতুর পায়ের কাছে হাটু মুড়ে বসে পড়লো।
ইতু ছিটকে সরে পরলো। আবিরকে এভাবে দেখে ইতু অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে।
আবির ছলছল চোখে ইতুর দিকে তাকালো।
আকুলতার সাথে বললো,” তুই ফিরে চল ইতু। তুই চলে গেলে আমি মরে যাবো।”
ইতু তাচ্ছিল্য ভাবে হাসলো। “একবার তো তোমাকে ছেড়ে সবাইকে ছেড়ে চলে গিয়েছিলাম, কই তখন তো একটা খোঁজ নেয়ার প্রয়োজনবোধ করোনি। আজ চলে যাচ্ছি বলে মরে যাবে তুমি?”
ইতু ওট্টোহাসিতে ফেটে পড়লো।
আবির অবাক হয়ে ইতুকে দেখছে। মেয়েটা শক্ত হয়ে গেছে অনেক।
আবির এর ফোন বেজে উঠলো তাকিয়ে দেখে ইতুর মায়ের নাম্বার। কপালে চিন্তার ভাজ পড়লেন আবিরের। বাসায় যেনে গেলো না তো!
ইতু সুরু চোখে আবিরের ফোনের দিকেই তাকিয়ে আছে।
আবির হ্যলো বলার সাথে সাথেই ইতুর মায়ের কান্নার আওয়াজ শুনতে পেলো।
আবির ঘাবড়ে গিয়ে বললো, “কি হয়েছে মামনি?”
ইতুও সোজা হয়ে দড়ালো।
” আবির ইতুর বাবা হাটর্ এট্যাক করেছে।”
ইতুরা সবাই হাপাতাল এ বসে আছে। অনুকে চেপে ধরে ইতু ডুকরে কাঁধছে। “সব আমার দোষ, আমি যদি বাবার কথা শুনতাম তাহলে এমন কিছুই হতো না। সব আমার কারণে হয়েছে।”
“কিচ্ছু তোর কারণে হয়নি। এমন করিস না, নিজেকে দোষ কেনো দিচ্ছিস।”
অনু বার বার ইতুকে বুঝনোর চেষ্টা করে চলছে।
ইতুর মা একদম ভেঙ্গে পড়েছে।
আবির ওষুধ নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করছে। তার ফাঁকে ফাঁকে ইতুকে দেখে যাচ্ছে। ফজরের আযানের সময় ডাক্তার যানালেন ইতুর বাবা এখন কিছুটা ঠিক আছে। হাস্পাতালে কিছুদিন রাখতে হবে উনাকে।
ডাক্তারের কথা শুনে কিছুটা শান্তি পেলো সবাই।
ইতুর মা এগিয়ে এসে বললো,” আমি কি একটু দেখতে পারবো তাকে?”
ডাক্তার যানালেন সকালের আগে কেউই দেখা করতে পারবে না।
আবির এগিয়ে এসে ইতুর মাকে বললো,” মা শুনলেন তো ডাক্তার কি বলেছে, আপনার ও রেস্টের দরকার। সবার সাথে আপনি বাসায় চলে যান আজ আমি থাকি এখানে।” ইতুর মা কিছুতেই যেতে চাইছিলেন না। আবির জোর করে পাঠিয়ে দিলো।
ইতুর মাকে পাঠাতে পারলেও ইতু ঠায় দাঁড়িয়ে থাকলো। আবিরের কথায় এক চুল ও নড়লো না।
আবির ও হাল ছেড়ে দিলো।
ইতু কেবিনের পাশে গুটিয়ে বসে আছে। আবির কফি নিয়ে ইতুর পাশে বসলো।
ইতুর দিকে কফি এগিয়ে দিতেই ইতু বললো, “আমি খুব খারাপ মেয়ে তাই না?”
আবিরের দিকে শুন্য চোখে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো।
আবির শান্ত গলায় ইতুর হাত ধরে বললো, একদম না। তুই অনেক ভালো একটা মেয়ে। তোর বাবা তোকে নিয়ে প্রাউডফিল করে।”
ইতু ছলছল চোখে তাকালো আবিরের দিকে, “তোমাকে ভালোবেসে কষ্ট পেয়ে দূরে চলে গেলাম। বাবা মার কথা একটি বার চিন্তা করলাম না। তাদের ভালোবাসাকে উপেক্ষা করে চলে গেলাম। আবার যখন ফিরে আসলাম আবার তাদের ছেড়ে চলে যাচ্ছিলাম। কিরে পারলাম এমন সার্থপরের মতো কাজ করতে, কিভাবে?”
ইতু ডুকরে কেঁদে উঠে। আবির ইতুকে নিজের বুকে চেপে ধরে মাথা হাত বুলিয়ে দিতে থাকে।
কাঁদে হালকা হয়ে যাক।
অনেকক্ষন কাঁদার পর ইতু শান্ত হয়ে এলো। তখনও নাক টেনে যাচ্ছে।
আবির পরিবেশ হালকা করতে বললো,” এখনো কাঁদলে তোর নাক দিয়ে সর্দি বের হয় নাকি?”
ইতু কান্না থমিয়ে দিলো সাথে সাথে। আবিরের বুক থেকে উঠে তাড়াতাড়ি নাক মুছে নিল।
আবির ইতুর দিকে তাকিয়ে হাসলো।
পরেরদিন সকালে ইতুর বাবাকে ছেড়ে দিলো। ওইদিনের রাতটাও ইতু আর আবিরই ছিলো হাস্পাতালে। আবির আর ইতুর মধ্যে অনেকটা সহজ হয়ে এসেছে।
ইতু আর এখন আবিরের সাথে জগড়া করে না। মাঝে মাঝে হেসে হেসে কথা বলে।
ইতু তার বাবা মার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিলো। সেদিন ইতু তার বাবাকে ধরে অনেক কাঁদলো।
ইতুর বাবা ইতুর মাথায় হাত দিয়ে বললো,” অনেকতো হলো এইবার মা মন দিয়ে সংসারটা কর।
আমি মরে যাওয়ার আগে যেনো তোর সুখের একটা সংসার দেখে যেতে পারি।”
“এভাবে কেনো বলছো বাবা। প্লিজ এভাবে বলো না।
আমি আগের সব কিছু ভুলে আবার নতুন করে শুরু করে চাই বাবা। তুমি চিন্তা করো না। দোয়া করো শুধু।”
ইতুর বাবা খুশি হয়ে ইতুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। ইতুর মা আঁচলে নিজের চোখের জল মুছলেন।
তাদের কথার মাঝেই আবির এলো।
ইতু আবিরের দিকে তাকিয়ে হাসলো।
আবির কিছুক্ষণের জন্য থমকে গেলো। এই হাসি অনেকদিন দেখেনি আবির। অনেকদিন কেনো অনেক বছর দেখেনি। এই সে হাসি যেটা ইতু আবিরকে দেখলেই হাসতো।
আবিরের মনে আশার আলো জাগলো।
চলবে।