বাক্সবন্দী চিঠি পর্ব -১৭+১৮

গল্পঃ বাক্সবন্দী চিঠি
লেখকঃ Ninika Jaman Noor
পর্বঃ ১৭
ইতুর বাবা এখন অনেকটাই সুস্থ। এই কয়দিন ইতু সবসময় তার বাবার পাশেই থেকেছে। আবিরও যখন যা লেগেছে তার জন্য ছুটে গেছে ওই বাড়িতে। এই কয়দিন ইতু তার সাথে খুব নরমালি ছিল। আবির মনে আশা জাগতে লাগল তাদের মধ্যে এইবার মনে হয় সব ঠিক হতে চলেছে।
এ ঘটনার সপ্তাহ খানেক পর ইতুর বাবা ইতু আর আরাবিকে ডেকে পাঠালো।
ইতু তখন রান্নাঘরে তার মায়ের সাথে কাজ করছিল। আবির তখনো তার বাবার সাথে অফিসে এখনো ফিরেনি। ইতু হন্তদন্ত হয়ে তার বাবার ঘরে গেল। “কি হয়েছে বাবা কিছু লাগবে তোমার?”
ইতুর বাবা মেয়ের দিকে তাকিয়ে এক চিলতে হাসলেন,”নারে আমার কিছু লাগবেনা। আর আমার পাশে বসে কিছুক্ষণ।”
ইতু বাধ্য মেয়ের মত বাবার পাশে বসে পরল।
আব্দুল তার মেয়ের দিকে কিছুক্ষন তাকিয়ে রইল।
“কি হয়েছে বাবা? কিছু বলবে?”
ইতুর বাবা মাথা দুলিয়ে হেসে বলল, “তোর আর আবিরের সাথে কিছু কথা ছিল আমার।”
“আবির তো বাসায় নেই। অফিসে কিছু দরকারি কাজ ছিল তাই সকাল সকালেই চলে গেছে। ”
ইতুর বাবা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ” আবির আসলে তুই আর আবির একসাথে আমার ঘরে আসিস। কিছু দরকারি কথা ছিলো।”
ইতু চিন্তিত হয়ে গেলো। বাবা আবার কি বলবে।
“চিন্তা করিস না মা তোদের দুইজনকে নিয়ে কিছু কথা বলব।”
ইতু হালকা হেসে নিজেকে শান্ত করলো। কিন্তু মন থেকে চিন্তা কমলো না।
“তুমি কিছু খাবে এখন বাবা? ”
“না মা, আমি একটু আমার করবো। ”
“ঠিক আছে বাবা তূমি শুয়ে পড়ো, কিছু লাগলে আমাকে ডেকো।”
ইতুর বাবা হালকা হেসে মাথা নাড়িয়ে সায় দিলেন।
ইতু মায়ের কাছে গিয়ে বলল,” মা তোমার কি আর কোনো হেল্প লাগবে?”
” নারে সব কাজ হয়ে গেছে, তুই গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নে। আর ভাল দেখে একটা শাড়ি পড়ে আসিস।”
ইতু ভ্রু কুঁচকে বলল, “কেন মা হঠাৎ শাড়ি পড়তে বলছো। ”
ইতুর মা মুচকি হেসে বলল, “আবির আসবে, ওকে দুপুরে এখানে খেতে বলেছি।”
আবির আসবে শুনে ইতুর ভালো লাগায় মনে একটা শীতল হাওয়া বয়ে গেলো। আবির এখনে যত বারই এসেছে সবার সামনে বসে কথা বলেছে। একলা সময় কাটাতে পারেনি।
তার যে আবিরের সাথে অনেক কথা বলার আছে।
ইতু আচ্ছা বলে নিজের ঘরে চলে গেলো।
বেডে দেখলো একটা বেবি পিঙ্ক কালারের জামদানী শাড়ি আর সাদা ব্লাউজ রাখা, সাথে কিছু এন্টিকের জুয়েলারি। ইতু সেগুলো দেখেই খুশি হয়ে গেলো।
তাড়াতাড়ি গোসল করে শাড়ি পড়ে রেড়ি হয়ে নিলো।

আবির অফিস থেকে ফিরল দুপুর ২টায়।
কণা আফরোজ আবিরকে দেখে বললো, “কিরে এত দেরি করে এলি যে?” তোর না ইতুদের বাড়িতে যাওয়ার কথা।”
আবির ক্লান্ত শরির সোফায় এলিয়ে বসে পড়লো।
কণা আফরোজ বিরক্ত হয়ে বলল,” ওরা তোর জন্য সেই কখন থেকে ওয়ে করছে তুই আবার এখনে এসে বসে পড়লি কেনো। যা তাড়াতাড়ি রেড়ি হয়ে নে।”
“মা অফিসে এতো কাজ। বাবাতো এখনো আসতেই পারলো না, আমাকে জোর করে পাঠিয়ে দিলো। ”
“তোর বাবার জন্য আমি খাবার পাঠিয়ে দিয়েছি। অফিসেই খেয়ে নিবে। তুই আর বসে থাকিস না।”
আবির ক্লান্ত শরীর নিয়ে নিজের রুমে ডুকে ফ্রেশ হতে গেলো।
আলমারি থেকে একটা সাদা পাঞ্জাবি বের করে পড়ে নিলো।
চুল গুলো ব্রাশ করে হাতে একটা কালো গড়ি পড়ছে আবির।
নিচে নেমে ইতুর বাসায় যাওয়ার সময় কণা আফরোজ হেসে বলল,” মাশাল্লাহ, আমার ছেলেটাকে একদম রাজপুত্রর মতো লাগছে। কারোর নজর না লাগুক।”
আবির মুচকি হেসে বলল, “অলরেডি একজনের নজর লেগে গেছে মা। হাজার চেষ্টা করেও সে নজর সরাতে পারবে না।”
কণা আফরোজ আবিরের মাথা চাটি মেরে বলল,”ওই নজর আমি সরাতেও চাই না।”
আবির তার মাকে জড়িয়ে ধরে হেসে ইতুদের বাড়িতে চলে গেলো।
ইতুরা আগে থেকেই খাবার রেডি করে আবিরের জন্য অপেক্ষা করছিলো।
ইতু সোফায় বসে দরজার দিকে তাকিয়ে ছিলো।
কিছুক্ষণ পরেই আবিরের দেখা মিলল।
ইতু যেন চোখ ফেরাতেই পারছে না। সাদা পাঞ্জাবিতে তাকে এতো মানিয়েছে। আবিরকে দেখেই ইতুর বুকটা চিনচিন করে উঠলো। একটু ছুঁয়ে দেখার প্রবন ইচ্ছা জাগলো মনে। আবির ইতুর সামনে এসে গলা ঝারলো। আবিরকে সামনে দেখে ইতুর হুঁশ ফিরলো।
“এমন করে দেখার কি আছে তোরই তো।” কথাটা বলে আবির ইতুকে চোখ টিপে চলে গেলো।
ইতু লজ্জায় মাথা নুয়ে ফেললো। ইসস! ঠিকই তো কি দরকার ছিলো এইভাবে বেহায়ার মতো তাকিয়ে থাকার। কিভাবে লজ্জায় ফেলে দিলো। আর কখনো এইভাবে তাকাবি না।
ইতু নিজেকে মনে মনে বকে শান্ত হলো।
রান্নাঘরে গিয়ে দেখে আবির ইতুর মার সাথে কি যেন বলে হাসাহাসি করছে। ইতুকে দেখে হাসি থামিয়ে দিলো তারা। ইতুর ভ্রুঁ কুঁচকে এলো।
ইতুর ভ্রুঁ কুঁচকানো দেখে ইতুর মা হেসে দিলেন।
আবির ও মুচকি হেসে বেরিয়ে গেলো।
“তোমারা কি নিয়ে এতো হাসাহাসি করছিলে। আমাকে দেখে থেমে গেলে কেন?”
“তেমন কিছু না এমনি আমি আবির হাসাহাসি করছিলাম। ইসব যেনে তোর কাজ নেই টেবিলে খাবার দিয়েছি চলে আয়।”
ইতুর মা চলে গেলেন ইতুর বাবাকে ডাকতে।
ইতু রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে থাকলো। ভাবছে আবিরএকটা বারও তার প্রশংসা করল না। এই যে এত সুন্দর করে শাড়ি পড়ল,যত্ন করে সাজলো সবই তো আবিরের জন্য। তাহলে আবির কেন তাকে নোটিস করল না। তাকে কি সুন্দর দেখাচ্ছে না?
ইতু একরাশ মন খারাপ নিয়ে খাবার টেবিলে চলে গেল। খাবার টেবিলে ইতু একটি বার ও আবিরের দিকে তাকালো না।
আবির আড় চোখের ইতুর দিকে তাকিয়ে বুঝল মহারানীর মন খারাপ করেছে। তাও আবির কিছু বলল না মুচকি হেসে খাবারে মনোযোগ দিল। ইতুর মার আবিরের প্রতি যত্ন যেন কমতি নেই। আবির এর সব পছন্দের খাবার করেছে আজ।
পোলাও থেকে শুরু করে চিংড়ি মাছের মালাইকারি, রোস্ট, গরুর মাংস,খাসির মাংস সিজলিং, পায়েস, দই।
খাবার দেখে ইতুর মুখ আরো কালো হয়ে গেলো। আবিরকে পেয়ে মা মনে হয় তাকে ভুলেই গেছে। সে কি যানে না ইতু পোলাও খায় না।
ইতুর মা ইতুর মুখ কালো করা দেখে বলল, এমন মুখ কালো করতে হবে না। তোর পাশে রাখা বাটির ঢাকনা খুলে দেখ ওখানে কাচ্চি আছে।”
ইতু খুশি হয়ে কাচ্চি নিয়ে তাড়াতাড়ি খাওয়া শুরু করলো।
ইতুর কান্ড দেখে আবির মুচকি হাসে।
খাওয়া-দাওয়া শেষ করে ইতু আর আবির তার বাবার হয়ে গেল। তাদের দুজনকে দেখে উঠে বসে আবদুল।
” তোমাদের অনেকদিন ধরে একটা কথা বলব ভাবছিলাম। আমি তোমাদের দুইজনের জন্য সাজেক এর টিকেট কেটেছি। আজ রাতেই বেড়াতে যাবে তোমরা।”
বাবার কথা শুয়ে ইতুর মুখ করেক ইঞ্চি হা হয়ে গেলো।
অবাক চোখে আবিরের দিকে তাকিয়ে দেখে আবির একদম নরমাল। যেনো আগে থেকেই যানতো সব।
ইতু আবার তার বাবার দিকে চোখ ঘুরালো।
” বাবা হঠাৎ ঘুরতে যাওয়ার প্লানিং?”
আব্দুল কাদের হেসে মেয়েকে কাছে ডাকলেন।
ইতু কাছে গেলে তিনি মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন,” এতদিন অনেক ঝামেলা হয়েছে তোদের মধ্যে। তারমধ্যে আমার জন্য আবার কিছুদিন অশান্তিতে কাটিয়েছিস। এবার একটু তোরা নিজেদের সময় দে। কিছুদিনের জন্য ওখান থেকে ঘুরে আয় দেখবি ভালো লাগছে অনেকটা।”
ইতু ও হেসে বাবার কথায় সায় দিল। বাবার রুম থেকে বেরিয়ে আবির সোজা ইতুর রুমে চলে গেলো।ইতু সেদিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আবিরের পিছনে তার রুমে ডুকলো।
রুমে ডুকে দেখে আবির বিছানায় হাত পা ছড়িয়ে শুয়ে আছে।
ইতু কোমড়ে হাত দিয়ে বিছানার পাশে দাড়ালো।
রাগ দেখিয়ে বললো, ” তুমি এখন এখনে এসে শুয়ে পড়লে যে? বাবা কি বলেছে শুননি? আমাদের রাতে বেরুতে হবে। এখানে এভাবে শুয়ে থাকলে কাপড় গুছাবে কখন আর রেডি হবে কখন?”
আবির ইতুর কথা কানে না তুলে ইতুকে এক টানে নিজের সাথে মিশিয়ে নিলো।
শক্ত করে জড়িয়ে ধরে গলায় মুখ ডুবিয়ে দিয়ে ওইভাবে শুয়ে থাকে আবির।
ইতু বুজতে পারলো না কয়েক সেকেন্ডে কি হয়ে গেলো তার সাথে।
আবিরের ঠোঁট হালকা ভাবে ইতুর গলায় ঘষে যাচ্ছে। ইতু বার বার এমন ছোঁয়ায় কেঁপে উঠছে।
কয়েক মুহুর্তের জন্য ইতু আবিরের জগতে হারিয়ে গেলো। আবির আলতো করে ইতুর গালে চুমু খেয়ে বলল,” সারাদিন কাজ করে অনেক ক্লান্ত, একটু ঘুমিয়ে নি তারপর যাবো। মাকে বলা আছে কাপড় গুছিয়ে রাখবে।”
ইতু কাঁপা গলায় বলল,”তোমার ঘুমানোর হলে ঘুমাও আমাকে এমন জড়িয়ে ধরে রেখেছো কেনো। আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে ছাড়ো।”
আবির আবার ইতুর গলায় মুখ ডুবিয়ে লম্বা শ্বাস টেনে বলল, তোর গা থেকে বেলি ফুলের ঘ্রাণ আসছে খুব। কি সাবান ইউজ করিস বলতো?মনে হচ্ছে একটা ঘোরের মধ্যে চলে যাচ্ছি।”
“আবোলতাবোল না বকে ছাড়তো আমাকে। আমার কাজ পড়ে আছে।”
“রাখ তোর কাজ এখন নিজের একমাত্র স্বামীর সেবা করতো। এই অকাজের হাতগুলো কাজে লাগা একটু আমার চুলে হাত বুলিয়ে দে।”
ইতু আর কিছু বললো না। তার ও যে এইভাবে থাকতে ভালো লাগছে। বুকটা কাঁপছে আবিরকে এতো কাছে পেয়ে।
ইতু মাথায় হাত বুলিয়ে দিতেই আবির মুচকি হেসে ইতুকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে গেলো।
হঠাৎ করেই ইতুর মনে হচ্ছে সে এই পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষের মধ্যে একজন। সুখ সুখ অনুভব হচ্ছে তার। থেমে যাক এই সময়টা এখনেই থেমে যাক। একজন স্ত্রীর জন্য স্বামীর ভালোবাসা থেকে আর কোন কিছুই দামী নয়।
ইতুর চোখ থেকে কয়েক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে।
হারাতে চায় না এই মুহুর্তটা। ইতু নিজের কাছেই প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলো আর কখনো আবিরকে হারাতে দিবে না। আবিরের চুলে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে ইতুও ঘুমিয়ে পড়লো। গল্পঃ বাক্সবন্দী চিঠি
লেখকঃ Ninika Jaman Noor
পর্বঃ ১৮
ইতুর মনে সুখ সুখ অনুভব হচ্ছে। অবশেষে তারা সব মান আভিমান দূরে সরিয়ে এক হতে যাচ্ছে।
ইতু ব্যাগে সব ঠিক ঠাক ভাবে নিয়ে নিলো। আবার ভালো কিরে চেক করে নিলো কিছু বাদ পড়লো কিনা। শীতে শুরু তখন, সাজেকে ঘুরতে বেরুলে শীতের কাপড়তো লাগবে। ইতু নিজেরটা নিয়ে ভাবলো আবির সব ঠিক করে নিয়েছে কিনা।
ইতু নিজের গুছানো শেষ করে আবিরদের বাড়ির পথে এগিয়ে গেলো। যদি আবিরের কোনো হেল্প লাগে। একটু পরেই তারা বেরিয়ে পড়বে। ইতু আবিরের দরজা সামনে গিয়ে থমকে দাঁড়ালো। কুহুকে আবিরের বুকে দেখে হাত পা কাঁপতে লাগলো। কুহু আর আবিরকে এইভাবে দেখবে ভাবতেই পারছে না। ইতুর পুরো দুনিয়া ঘুরছে।
ইতু মুখ চেপে ফুঁপিয়ে উঠলো।
ইতুকে দেখে আবির কুহুকে এক ধাক্কায় সরিয়ে দিলো। ইতুর কাছে যেতে নিলে ইতু কয়েক পা পিছিয়ে পড়ে। আবির অস্থির হয়ে ইতুকে বলে, “তুই যা ভাবছিস এমন কিছুই না ইতু। প্লিজ ভুল বুঝিস না।” ইতু আবিরের দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে নিলে মাথা ঘুরে পড়ে গেলো। আবির ইতু বলে চিৎকার দিয়ে ইতুকে ধরে বসে পড়ল।
কুহু কিছুই বুঝতে পারছে না কি হচ্ছে। ওকে আর আবিরকে দেখে ইতুই বা কেন এইভাবে রিয়েক্ট করলো। তাহলে কি তার চলে যাওয়ার পর আবির আর ইতুর মধ্যে কিছু হয়েছে? কুহু এইসব চিন্তা করে থমকে গেলো। না, এটা কিছুতেই হতে পারে না। আবির ওকে ভুলে কিছুতেই ইতুকে কাছে টেনে নিতে পারে না। আবিরকে একবার হারিয়ে ভুল করেছে এই ভুল আর করতে পারে না সে। কুহু ঠিক করলো যেভাবে হোক তাকে সব কিছু সামলাতে হবে। আগে পুরো ব্যপারটা তাকে যানতে হবে।
আবির পাগলের মতো ইতুর নাম ধরে ডেকে যাচ্ছে। আবিরের চিৎকারে কনা আফরোজ দৌড়ে এলেন। ইতুকে এভাবে পড়ে থাকতে দেখে হকচকিয়ে গেলেন।
“আবির, ইতুর কি হয়েছে। এভাবে পড়ে আছে কেনো মেয়েটা?”
আবিরের গলা শুকিয়ে আছে চোখ লাল হয়ে গেছে। ইতুকে এভাবে দেখে মাথা কাজ করছে না তার।
কণা আফরোজ ছেলের অবস্থা বুজতে পেরে বললো, “আবির ওকে তুলে গাড়িতে নিয়ে যা। হাস্পাতালে নিতে হবে।
আবির মায়ের কথা শুনেই ইতুকে কোলে নিয়ে গাড়ি তে বসালো। কণা আফরোজ ইতুকে ধরে বসলেন। আবির গাড়ি স্টাট দেওয়ার সময় কুহু দৌড়ে এসে আবিরের পাশের সিটে বসলো। কণা আফরোজ কুহু দেখে কিছুটা অবাক হয়ে গেলেন। এতদিন পর কুহু কোথায় থেকে আসলো। আবিরকে কিছু বলতে গিয়েও চুপ করে গেলেন। এই মুহুর্তে এসব নিয়ে আলোচনা করার সময় নয়।
আবির কুহুকে দেখে কিছু না বলে গাড়ি স্টার্ট দিলো।
কণা আফরোজ ইতুর বাসায় কল দিয়ে জানিয়ে দিলেন ইতুর ব্যাপারটা। আবির পাগলের মতো গাড়ি চালাতে লাগলো। কণা আফরোজ ঘাবড়ে গিয়ে বললো, ” আবির শান্ত হয়ে গাড়ি চালাও, এইভাবে গাড়ি চালাতে গিয়ে কোনো অঘটন ঘটিয়ে ফেলবে।”
“মা তুমি ইতুর দিকে খেয়াল রাখো আমি সাবধানে চালাচ্ছি।”
হাস্পাতালে পৌছে আবির ইতুকে কোলে নিয়ে বের করলো। ইতুকে আবিরের কোলে দেখে ওয়ার্ড বয় গুলো স্টেচার নিয়ে ইতুকে শোয়ালো। একটা সিস্টার ইতুকে কেবিনে নিয়ে যেতে বললো। আবির অস্থির হয়ে বললো, “সিস্টার প্লিজ ডক্টরকে নিয়ে আসুন। ও হঠাৎ করেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে।”
“দেখুন আপনি উত্তেজিত হবেন না আমরা দেখছি।”
ওদের পিছনে আবির, কণা আফরোজ আর কুহু ও গেলো। ইতুকে কেবিনে রেখে সিস্টার গেলো ডাক্তারকে ডাকতে। আবির শক্ত করে ইতুর হাত ধরে পাশে বসলো। ইতুকে এইভাবে দেখে আবিরের মনে হচ্ছে তার সব কিছু থেমে গেছে, বুকের ভিতরটা কামড়ে ধরে আছে মনে হচ্ছে। চোখ দুটো জ্বালা করছে ভিষণ। কণা আফরোজ কুহুর দিকে তাকিয়ে দেখে আবির আর ইতুর দিকে তাকিয়ে আছে এক দৃষ্টিতে। তিনি কুহুকে টেনে কেবিন থেকে বেরিয়ে গেলেন।
ডাক্তার কেবিনে ডুকেই অবাক হয়ে বেডে শুয়ে থাকা মেয়েটার দিকে তাকালো। এক পলক আবিরের দিকে তাকিয়ে বলে উঠলো,”কি হয়েছে ওর?”
আবির ডাক্তার কে দেখে বললো,” হঠাৎ করেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে। ”
“তার আগে কি কিছু হয়েছিল?”
আবির কুহুর ব্যপারটা চেপে গেল।
“না ডক্টর ও খুব খুশি ছিল। আমরা ঘুরতে যাওয়া কথা ও সেটা নিয়েই এক্সাইটেড ছিলো খুব।”
ডাক্তার ইতুকে পর্যবেক্ষণ করে বলল, “ও কোনো ব্যাপারে সাডেন শক খেয়েছে। ঘটনাটা বোধহয় ঠিক ভাবে নিতে পারেনি তাই জ্ঞান হারিয়েছে। চিন্তা করবেন না আমি ওষুধ দিয়ে দিয়েছি আশা করি কয়েক ঘন্টার মধ্যে জ্ঞান ফিরবে।”
আবির একটা সস্তির নিশ্বাস ফেলে বললো,”থ্যাঙ্ক ইউ ডক্টর।”
ডক্টর হেসে বলল, “ইটস মাই জব। আপনাকে এটার জন্য থ্যাংকস দিতে হবে না। যদি কিছু মনে না করেন একটা কোশ্চেন করতে পারি? ”
“জি বলুন।”
“আপনাদের দুজনের সম্পর্ক কি?”
আবির স্মিথ হেসে বলল, “আমরা স্বামী স্ত্রী।”
ডক্টর আর কিছু না বলেই বেরিয়ে গেলো কেবিন থেকে।
ডক্টরের এমন চলে যাওয়া আবির কিছুটা অবাক হলো।
ডক্টর যেতেই ইতুর বাবা মা কেবিনে ডুকলো। ইতুর মা গিয়ে ইতুর পাশে বসে ইতু কপালে হাত বুলিয়ে দিয়ে কাঁদতে লাগলেন।
আবির ইতুর বাবাকে কিছু বলতে নিলে তিনি তাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন,”তোমার মায়ের সাথে আমাদের কথা হয়েছে। তুমি চিন্তা করো না।
ডাক্তার কি বলেছে? ”
“ওষুধ দিয়েছে। ঠিক হয়ে যাবে বললো।”
ইতুর মা ফুপিয়ে কেঁদে উঠে, “একটার পর একটা বিপদ লেগেই আছে। আমার ঘরে কি সুখ স্থায়ী হবে না?”
“আহা শারমিন, মেয়ের কাছে বসে এইভাবে কাদছো কেনো, উঠে এসো।”
“আমার মেয়েটার কি হয়ে গেলো হঠাৎ করে। কত খুশি ছিলো ঘুরতে যাবে বলে আর এখন দেখো এখানে হাস্পাতালের বেডে শুয়ে আছে।”
শারমিন বেগমের কথা শুনে আবির ইতুর দিকে তাকালো, কেমন শান্ত হয়ে ঘুমিয়ে আছে। মেয়েটা তার জন্য কম সহ্য করেনি। তাকে ভালোবেসে প্রত্যেক মুহুর্তে কষ্ট সহ্য করতে হয়েছে। পারেনি সে ইতুকে ভালোবেসে একটু সুখ এনে দিতে। মেয়েটা তাকে ভুল বুজে কষ্ট পাচ্ছে। আবির ইতুর দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে। আবদুল কাদের ইতুর কাছে গিয়ে মেয়ের মাথা হাত বুলিয়ে দিলেন। শারমিন বেগমকে বললেন,”বাইরে গিয়ে বসবে এসো।”
“আমি আমার মেয়ের কাছে থাকবো, তুমি আমাকে কোথাও যেতে বলবে না।”
“আমার কথাটা শুনো।”
“না, আমি কোনো কথাই শুনবো না। আমার মেয়েটা যতক্ষণ না চোখ খুলছে আমি কোথাও যাবো না।”
আবির আবদুল কাদের কে এমন জোরাজোরি করতে দেখে বললো,” বাবা, তোমারা বস এখানে আমি মা কে দেখে আসছি।”
কথাটা বলে আবির বেরিয়ে গেলো। তার ইতুর কাছেই থাকতে ইচ্ছা করছিলো। কিন্তু আবির এখানে থাকলে ইতুর বাবা তাদের একা ছেড়ে দিতে চাইছেন। তাদের ও ইচ্ছা করছে ইতুর পাশে কিছুক্ষণ থাকতে।
আবির বেরিয়ে কণা আফরোজ খুঁজতে লাগলো। করিডরের কাছে এসে দেখলো কণা আফরোজ আর কুহু কিছু নিয়ে তর্ক করছে। কুহু আবিরকে আসতে দেখে চুপ হয়ে গেলো। কণা আফরোজ তখনও কুহুকে বলে যাচ্ছে, “তোমার বাবা মা তোমাকে সঠিক শিক্ষা দেয়নি বলে তুমি এখানে এখনো দাঁড়িয়ে আছো নির্লজ্জ বেহায়া মেয়ে।”
আবির ভ্রু কুঁচকে বললো,” কি হয়েছে মা? তুমি ওকে এভাবে বলছো কেনো?”
কণা আফরোজ ঘুরে দেখেন আবির দাঁড়িয়ে আছে।
তিনি আবিরের দিকে তাকিয়ে শক্ত গলায় বললো, “ইতু উঠার আগে আমি যেনো এই আপদকে এখানে না দেখি। আমি কোনো এক্সপ্লেনেশন শুনতে চাই না আবির। আমার শেষ কথা ইতুর চোখের সামনে যেনো এই মেয়ে না আসে। এখন ব্যাপারটা কিভাবে সামলাবে সেটা তোমার ব্যাপার। ”
কণা আফরোজ চলে যেতে গিয়ে আবার দাঁড়িয়ে বলেন, ” আবির, ইতুকে নিয়ে সুখে থাকতে চাইলে এই মেয়ের এখানে থাকা চলবে না। তোমাদের সংসার ধ্বংস করে দিবে।”
কণা আফরোজ আর দাঁড়ালেন না ইতুকে দেখতে চলে গেলেন।
আবির কুহুর দিকে তাকালো। করুন মুখ করে তার দিকে তাকিয়ে আছে।
“আবির প্লিজ তোমার মায়ের কথা শুনে আমাকে তাড়িয়ে দিয়ো না। আমার যে কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। তুমি তো সবই যানো। তুমিও যদি আমাকে তাড়িয়ে দাও আমার মরা ছাড়া উপায় থাকবে না।”
কথা শেষ করে কুহু ডুকরে কেঁদে উঠলো। আবিরের মাথা কাজ করছে না। এই মুহুর্তে এইসব নিয়ে চিন্তা করার মন মানসিকতা তার নেই।
আবির ফোন বের করে অয়ন কে কল দিলো।
” অয়ন একটু আমার বাসার কাছে হাস্পাতালে আসতে পারবি?”
“কি হয়েছে আবির? কোনো সমস্যা? কারোর কিছু হয়নি তো?”
“তুই আগে আয় তারপর বুঝিয়ে বলছি।”
“আচ্ছা ঠিক আছে আসছি।”
কিছুক্ষণ পরেই অয়ন আর শ্রাবণ এলো। দুইজনই আবিরের সাথে কুহুকে দেখে চমকে উঠলো।
অয়নের মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো কুহুকে দেখে। এই মেয়ের মতো লোভী আর স্বার্থপর মেয়ে আর একটাও দেখেনি। অয়ন কোনো দিনই কুহুকে আবিরের পাশে পছন্দ করেনি।
অয়ন সরু চোখে তাকালো ওদের দিকে। শ্রাবণ কিছুটা চমকালেও তেমন পাত্তা দিলো না।
অয়ন ওদের কাছে এসে বলে,” এই মেয়ে এখানে কি করছে? তুই ওর সাথে এখানে কি করছিস?”
আবির দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, “ইতুকে হাস্পাতালে ভর্তি করিয়েছি। আমাকে আর কুহুকে একসাথে দেখে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে।”
শ্রাবণ চমকে উঠে বলে, “কি? ইতু হাস্পাতালে আর তুই এখন আমাদের বলছিস? কোথায় ইতু?”
আবির শীতল চোখে তাকালো শ্রাবণের দিকে। শান্ত গলায় বললো,”একটু আগে নিয়ে এসেছি। ২০৩ এ আছে।”
শ্রাবণ আর দাঁড়ালো না সেখানে ইতুকে দেখতে চলে গেলো। অয়ন তখন ও সব কিছু বুঝতে চেষ্টা করছে।
“আবির আমাকে সবকিছু খুলে বলতো কি হয়েছে? আর এই মেয়েটা এখানে কেনো?”
কুহু মেজাজ দেখিয়ে বললো, “অয়ন তুমি তখন থেকে আমাকে এই মেয়েটা এই মেয়েটা বলছ কেনো? আমার একটা নাম আছে আর সেটা তুমি ভালো করেই যান।”
“তোমার মত মেয়ের নাম আমার মুখে নিতেও ঘেন্না লাগে। ফারদার আমার সাথে কথা বলতে আসবে না আমি তোমার সাথে কথা বলছি না।”
“অয়ন থাম। এখন এইসব ভালো লাগছেনা। তোকে একটা দরকারে ডেকেছি যদি আমার কথাটা একটু রাখতে পারিস।”
“হ্যাঁ বল আমার সাধ্যের মধ্যে থাকলে অবশ্যই করবো।”
আবির কথাটা কিভাবে বলবে বুঝতে পারছে না। না বলেও উপায় নেই।
“তুই কিছু দিনের জন্য কুহুকে তোর বাসায় রাখতে পারবি? তোর বোনের কিছু একটা বলে ম্যনেজ করে নিস?”
অয়ন চোখ বড় বড় করে আবিরের দিকে তাকালো। কুহুও অবাক হলো আবিরের কথায়।
“ইম্পসিবল! এই মেয়েকে আমি আমার বাসায় কখনো নিবো না। এই মেয়ে যে বাসায় যাবে সেটাকে নরক বানিয়ে দিবে। আমি সুখে থাকতে এই আপদ মাথায় নিতে পারবো না।”
কুহু অয়ন এর কথা শুনে রাগে ফুঁসছে। আবিরের সামনে কিছু বলতেও পারছে না।
আবির অয়নকে নিয়ে সাইডে গেলো, সবকিছু বুঝিয়ে তাকে রাজি করালো।
“ঠিক আছে শুধু তোর আর ইতুর কথা ভেবে কাজটা করছি পরে এর দাম চেয়ে নিবো। তার আগে ইতুর কাছে চল পিচ্চিটাকে দেখে আসি।”
আবির অয়নকে নিয়ে কেবিনে গেলো।সবাই ইতুর কেবিনে বসে আছে। আবিরের বাবা মা, ইতুর বাবা মা, অনু আর কুয়াশাকে ও দেখা গেলো কেবিনে। শ্রাবণ এক পাশে দাঁড়িয়ে এক দৃষ্টিতে ইতুকেই দেখে যাচ্ছে। অয়ন সবার সাথে কথা বলে শ্রাবণকে নিয়ে বেরিয়ে গেলো। একে একে সবাই বেরিয়ে গেলো। অনু কিছু বলতে গেলে কুয়াশা ইশারায় নিষেধ করলো। কুয়াশা আবিরের কাধে হাত রেখে বললো, “এতো তাড়াতাড়ি হাল ছেড়ে দিয়ো না। তোমাকে আরও শক্ত থাকতে হবে।”
“ভাইয়া আপনি সবাইকে নিয়ে বাসায় চলে যান আমি ইতুর সাথে এখানে থাকবো।”
“ঠিক আছে আমি দেখছি।”
আবির ইতুর পাশে গিয়ে চুপচাপ শুয়ে পড়লো। কপালে গভীর ভাবে চুমু দিলো।
“ইতু প্লিজ ভুল বুঝিস না আমাকে। আমার থেকে আর দূরে থাকিস না। আমি সহ্য করতে পারবো না।”
ডাক্তার আদিত্য আহমেদ দরজার সামনে এসে দাঁড়ায়। ওদের দুজনকে এইভাবে দেখে চোয়াল শক্ত করে বললো, আমার সাথে এটা করতে পারো না ইতু। আমি থাকতে তুমি অন্য কারোর কিভাবে হতে পারো!
চলবে।
চলবে।
( পড়ে দেখা হয়নি। ভুল গুলো ক্ষ্মার দৃষ্টিতে দেখবেন।)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here