বিকেল বেলার রোদ পর্ব ২

#গল্পঃবিকেল বেলার রোদ
#পর্বঃ০২
#লেখাঃনুসরাত মাহিন

দুই দুই বার ইন্টার পরিক্ষা দেবার পর পাশ করতে পারিনি। আমি বাবার অযোগ্য সন্তান তাই বাসা থেকে বের করে দিয়েছে। প্রথমে ভেবেছিলাম বাবা হয় তো রাগ করে বলেছে। পরে বুঝালাম রাগ না সত্যি সত্যি বাসা থেকে বের হয়ে যেতে বলেছে।

ওই দিন বাবার ব্যবহারে খুব কষ্ট পেয়েছিলাম। দুপুর বেলা মাত্র খেতে বসেছি ভাত মেখে মুখে দেব বাবা এসেই ভাতের প্লেটটা আমার সামনে থেকে নিয়ে গেল।

— লজ্জা করেনা পরীক্ষায় ফেল করে ভাত গিলতে। ভাই, বন্ধু, আত্নীয়স্বজন কারো কাছে মুখ দেখাতে পারি না। আমাকে দেখলে সবাই বলে ভাই শুনলাম আপনার ছেলেনাকি এবারো ডাব্বা মেরেছে তা কয়টায় আন্ডা পাইছে..? লজ্জায় আমার মাটির নিচে চলে যেতে ইচ্ছা করে।

— ভর দুপুরে এসে তুমি কি শুরু করেছ বলতো। আজ দুই দিন পর ছেলেটা খেতে বসছে। মুখের সামনে থেকে কেউ খাবার কেরে নেয়..??

— আহ্লাদ দিয়ে দিয়ে তুমি মাথায় তুলেছ। তোমার জন্য ছেলের এই অধঃপতন হয়েছে। আমার বাড়ির ভাত আজ থেকে ওই জন্য বন্ধ । ওরে বাসা থেকে বের
হয়ে যেতে বল। যেমন অযোগ্য মা তেমন তার অযোগ্য সন্তান।

— জুনায়েদের আব্বা তোমার মাথা ঠিক আছে। কি সব বাজে কথা বল তুমি..?

— আমার মাথা ঠিক আছে তোমার মাথা পুরাটাই গেছে। আমাকে আর জুনায়েদের আব্বা বলে ডাকবে না। এই রকম গবেড ছেলের বাবা হয়ে থাকার থেকে মরে যাওয়াও ভালো। আজ থাকে তুমি আমাকে জুলহাসের বাবা বলে ডাকবে। জুনায়েদ সিদ্দিকি বলে আমার কোন ছেলে নাই আমার একটাই ছেলে জুলহাস ।

জেবুন্নেসা তোমাকে যেকোন একজন কে বেছে নিতে হবে হয় আমাকে না হয় ওই কুলাঙ্গারটাকে। যদি ছেলের সাথে থাকতে চাও তাহলে এখনি এই বাড়ি থেকে বের হয়ে যাবে। বুড়া বয়সে তোমার সাথে আমার সব সম্পর্ক এখানে শেষ হয়ে যাবে। এখন তুমি বেছে নাও আমাকে, নাকি ছেলেকে চাও।

— আমি নিরব দর্শকের মত দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলাম। মা বাবাকে আর কিছু বলতে পারল না কান্নায় ভেঙে পরছে।

আমার বাবা যা বলে তাই করে উনার কথা কখনো নরচর হয়া না খুবি একরখা মানুষ । আমার রুমে এসে ব্যাগে সার্টিফিকেট, প্রশংসাপত্র, জরুলী কাগজপত্র ঢুকিয়ে নিলাম। ভেবেছিলাম এক কাপড়ে বাসা থেকে বেরিয়ে যাব। ডিসিশন চেইঞ্জ করলাম একটা প্যান্ট, একটা গেঞ্জি, শার্ট নিয়েছি।

মায়ের জন্য বুকটা ফেটে যাচ্ছে। মা আমাকে জড়িয়ে ধরে কেদে দিয়েছে আমিও মাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছি। মা তুমি কেঁদোনা এখন থেকে নামাজ পড়ে আমার জন্য প্রতিদিন দোয়া করবে। তোমার ছেলে যেন মানুষের মত মানুষ হয়। শিক্ষীত হলেই মানুষ হয় না মনুসত্য থাকা লাগে। আজ বাবা আমার সামনে থেকে খাবার কেরে নিল কুলাঙ্গার বলে বাসা থেকে বের করে দিল। একদিন বুঝবে কী ভুল করেছে এই কুলাঙ্গারটাকে বেকে টেনে নেবার জন্য হাহাকার করবে। সমাজের মানুষের কাছে ডেকে ডেকে বলবে জুনেয়েদ সিদ্দিকি আমার ছেলে।

ঘরের থেকে বের হবার সময় মা হাতের মধ্যে একটা খাম গুজে দিল।

বাবা বাসার সামনে ফুলের বাগানে বসে আছে জারা খেলছে আর বাবা চা খাচ্ছে। জারা আমার ভাতিজি।
জীবনে কখনো বাবার মুখের উপরে কোন কথা বলিনি। বাবা যখন যা বলেছে তাই মেনে নিয়েছি। আজকে কিছু কথা বাবাকে বলতে ইচ্ছে করছে।

আমাকে দেখে বাবা মুখ অন্য দিকে ঘুরিয়ে রেখেছে।

আজ আপনাকে কিছু বলতে চাই প্রথম এবং শেষবারের মত।

আমি আপনার অযোগ্য সন্তান আমার জন্য সমাজে আপনি মুখ দেখাতে পারেছেন না। অথচ একটা সময় আমাকে নিয়েই আপনি গর্ভবোধ করতেন। আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বলেতেন আমার ছেলে জুনায়েদ সিদ্দিকি সারা এলাকার গৌরব।

আমার এই অযোগ্য হবার পিছনে আপনি দাই। আপনি কখনও কারো ইচ্ছার, মতামতের মূল্য দেননি নিজে যা বলেছেন তাই করেছেন আর ওটাই সবাইকে মানতে হয়েছে। আপনার এক ঘেয়েমিতার জন্য শুধু আমার জীবনটা নষ্ট হয়নি আমার স্বপ্নগুলোর মৃত্যু হয়েছে।

আমি তো খারাপ স্টুডেন্ট ছিলাম না বিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট ছিলাম। খারাপ স্টুডেন্ট হলে ফাই ফাইবে বৃতি, এইটে টেলেন্টপুলে বৃতি পেতাম না। তখন তো অহংকার করে সবাইকে বলতেন আমার ছেলে সারা গ্রামের অহংকার এর আগে কেউ গ্রাম থেকে বৃতি পাইনি একমাএ আমার ছেলে জুনেয়েদ পেয়েছে।

প্রতিটা মানুষের কোন না কোন স্বপ্ন থাকে। আমার স্বপ্ন ছিলো জাহাজের ক্যাপ্টেন হব। আমার স্বপ্ন স্বপ্নই রয়ে গেল বাস্তবে রুপ নিলো না শুধু তোমার একঘেয়েমির কারনে। আমি চেয়েছি বিজ্ঞান বিভাগ নিয়ে পড়তে আপনি আমাকে জোড় করে ভর্তি করলেন বানিজ্য বিভাগে। আমাকে চার্টারএকাউন্টার বানাবেন। আপনি নিজে বানিজ্য বিভাগ নিয়ে পড়েছ দেখে আপনার সন্তানদের ওই একি সাবজেক্ট নিয়ে পড়তে হবে। এটা কেমন নিয়ম বাবা…??

সারাজীবন শুধু নিজের ইচ্ছার মূল্য দিলেন অন্যের ইচ্ছার কোন দাম ছিলনা আপনার কাছে। এস এস সি তে এ প্লাস আসেনি দেখে কি মাইর টা না মারলে আমাকে। হিসাব বিজ্ঞান বাদে আমার সব সাবজেক্টটে আমার A+ ছিলো। এইচ এস সি তেও হিসাব বিজ্ঞান আর পরিসংখ্যান শুধু ফেল করছি অন্য সব বিষয়ে A+ ছিলো । আমি যদি সাইন্স নিয়ে পড়তাম শুধু A+ না গোল্ডেন এ প্লাস পেতাম।
তোমার ওই জেবেদা, রেওয়ামিল, খতিয়ান, চূরান্ত হিসাব আমার মাথায় যায় না।

আপনি কলেজের অধ্যাপক এই জন্য সবাই আপনাকে সম্মান করে কিন্তু ব্যক্তিগত মানুষ হিসাবে আপনাকে কলেজের একটা মানুষ ও পছন্দ করে কারন কি জানো আপনি বদমেজাজি, রাগি ।

বাবা ভালো পড়ালেই ভালো শিক্ষক হওয়া যায় না সাথে ভালো ব্যবহারটাও থাকতে হয়। আপনাদের মতো বাবার কারনে আমার মত হাজারো সন্তান হয় আত্নহত্যা করে, মাদাক আসক্ত হয় বেপথে চলে যায়।
ছোটবেলা থেকে শুধু শাষন করে বড়ে করেছেন মনে করে দেখেন তো কখনো ভালবেসে বুকে টেনে নিয়েছেন কিনা কক্ষনো নেননি।

ছোটবেলায় আমার খুব ইচ্ছা করতো আপনার হাত ধরে হাটতে, স্কুলে যেতে যেমনটা আমার বন্ধুদের দেখতাম। আমার বন্ধুরা ওদের বাবার হাত স্কুলে আসত আমার ও খুব ইচ্ছা করত বাবা কিন্তু ভয়ে কখনো হাত ধরা তো দূরে থাক মুখ ফুটে বলতেই পারিনি।

আপনার যুক্তি ছিল মুরুব্বীদের পাশাপাশি হেটে গেলে নাকি তাদেরকে অসম্মান করা হয় তাই আপনি আগে হেটে যেতেন আর আমরা আপনার দুই হাত দূরে পিছনে থাকতাম।

আমার সমবয়সি ছেলেরা যখন হাসি আনন্দে ঘুরেবেরিয়ে, খেলাধুলা করে সময় কাটাত আর আমি তখন ঘর বন্দী হয়ে থাকতাম। আমাদেরকে সব সময় ঘরে বন্দী করে রাখতে। আমার ঠিকানা ছিল স্কুল আর বাসা। পান থেকে চুন খসলেই শুধু মাইর আর মাইর।

আপনি যখন বাসায় থাকেন খুশি হবার বদলে ভয়ে রুমের মধ্যে কাঁচুমাচু হয়ে বসে থাকি।

আপনি শুধু শাসন করতে শিখেছেন ভালোবাসতে শিখেননি। শাসন না করে একবার ভালোবেশে যদি বলতে বাবা জুনায়েদ চেষ্ঠা কর তুই পারবি। আমি আরো পরিশ্রম করতাম। বাবা সন্তানদের শুধু শাসন করলে হয় না সাথে ভালোও বাসতে হয়। সন্তানদের মতামতের গুরুত্ব দিতে হয়। আমার সবকিছু শেষ হয়ে যাইনি এখন ও একবার সুজগ আছে আমার হাতে।

যে ভুই করেছে একদিন তুমি নিজেই আক্ষেপ করবে। আজ জুলহাস জুলহাস বলে অহংকার করছো ওই ছেলের জন্য আপনার মান সম্মান ধুলায় মিশে যাবে কথাটা মনে রেখ বাবা।

আমি চলে যাচ্ছি বাবা আমার জন্য আপনাকে আর মানুষের কাছে অপমানিত হতে হবে না। একটা কথা মনে রেখবেন আজ আপনি আমাকে বাড়ি থেকে বের করে দিলেন একদিন আমাকে নিয়ে সবার কাছে অহংকার করবে।

বাসার থেকে বের হয়ে আসার সময় শেষবারের মত বাড়িটা দেখার জন্য পিছনে ফিরে তাকালাম। বেলকুনিতে জুলহাস মানে আমার বড় ভাই ভাবি দাড়িঁয়ে আছে মুখে তাদের বিজয়ের হাসি। সম্পত্তি লোভ মানুষকে কতটা নিচে নামাতে পারে আমার ভাইকে দেখলে বোঝা যায়। আমার আপন ভাই হয়ে সব সময় আমার নামে মিথ্যা কাহিনী বানিয়ে বাবার কানভারি করত। আমি না থাকলেই তো সব সম্পত্তির মালিক ও একা হবে।

খা বেশি করে খা কয় বছর পরে তোরে আমি তোকে বাড়ি ছাড়া করব।

মা রান্নাঘরের জানালা কাছে দাঁড়িয়ে আছে মুখে শাড়ির আচল গুজে কাঁদছে। মায়ের ওই আসহায় মুখটা আমি কোন দিন ভুলতে পারবো না।

মায়ের মুখটা আমার চোখের সামনে এখনো ভেসে উঠেছে। কান্না করে দিলাম।

— ভাইয়া আপনি কাঁদছেন ..??

— ও কিছু না মাথা ব্যথা করছে তো তাই চোখে পানি চলে এসেছে।

— আমার কাছে মাথা ব্যথার মেডিসিন আছে খাবেন..??

— ধন্যবাদ, লাগবে না এমনি কমে যাবে। আপনি কি ঢাকা যাবেন..?

— হ্যা। আপনি কোথায় নামবেন..??

— গাপতলি

— আমিও গাপতলি নামবো। ভাইয়া নামার সময় আমাকে ডেকে দিয়েন।

প্রতিটা মানুষের মধ্যে কোন না কোন কষ্ট লুকানো থাকে। কী সুন্দর মানুষটা মনের মধ্যে কষ্টে পাহার। ঘুমিয়ে পড়েছে এখনো চোখ দিয়ে পানি পড়ছে।
আসোলে প্রকৃত অর্থে আমরা কেউ সুখি না।

চার কি.মি. আসার পর আবার বাস থামিয়ে আছে লোক উঠাচ্ছে।

হঠাৎ করেই চোখ গেল একসিট সামনে দাঁড়ান লোকটার দিকে। ভয়ে আমি কুচুমুচু দিয়ে বসলাম দুলাভাইয়ের বোনের স্বামী। আমার সামনের সিটে বসা লোকাটার সাথে কথা বলছে মনে হয় পরিচিত।

চলবে…

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here